দুই টুকরো কাশ্মিরী শাল – ১৪
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
সন্তান হবার পর অন্তত সালেহা আশা করেছিল মানুষটা বুঝি এবার সংসারের কথা ভাববে ! ভাববে নিজেদের ভবিষ্যতের কথা !
কিন্তু আদতে তা হয়নি । অন্তত সালেহা যেভাবে জীবনটাকে দেখে অভ্যস্ত – সেই হিসাবে আহাদ মাষ্টার কখনোই সংসারী মানুষ ছিলেন না । অন্তত সংসারী হিসেবে সালেহার চিরচেনা মানুষগুলোর সাথে তার ছিল বিস্তর ফারাক । তিনি বরং সংসারী মানুষের চাইতে সালেহার চোখে একজন সমাজসেবীই ছিলেন । অন্তত মানুষটার নিজের সামর্থের তুলনায় । এক্ষেত্রে দুজনের জীবনবোধটাই আসলে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে অবস্হান করা কখনো না মেলা দুটি বিপরীতমূখী সরলরেখা । কারণ যার যার কাছে তাদের নিজস্ব জীবনবোধটা কিন্তু ছিল একেবারেই স্বচ্ছ আর সরল !
তাহলে কি আহাদ মাষ্টার মানুষটা সংসারী ছিলেন না ? ছিলেন না ভবিষ্যতের প্রতি চিন্তাশীল ? অবশ্যই তা নয় । কারন তিনি জীবন বলতে কখনো নিজেকে আলাদা করে ভাবতে শেখেননি । তার কাছে জীবন ছিল আশেপাশের মানুষগুলোকে বাদ নিয়ে নয় কোনভাবেই । আলাদা করে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবার মতন স্বার্থপর তিনি কখনোই হতেই পারেননি । তার মানসিক গঠনই আসলে তেমন ছিল না ।
আর তাইতো আপাদমস্তক সৎ মানুষটা যে কখনো ছোটেনি অর্থ প্রতিপত্তির পেছনে – বিয়ের পরেও নিজেরটা বুঝে নেবার মতন বোধোদয় তার আর হয়ে ওঠেনি । আর তাইতো নিজের সামান্য উপার্জিত আয় থেকেও সামর্থের শেষটুকু দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করার প্রচেষ্টা তার বন্ধ হয়নি কখনোই । এমনকি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কয়েকবিঘা ফসলী জমিও তিনি নিঃশেষ করে দিয়েছিলেন গ্রামের অসহায় মানুষদের জন্য ।
যা কিনা অব্যাহত ছিল সন্তান জন্মের পরেও । আর এটা দেখে সন্তানের ভবষ্যত চিন্তায় একসময় খানিকটা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিলেন সালেহা । তাও সেটা কোন তীব্র প্রতিবাদ নয় , বরং তাকে অনুযোগ বলাটাই ঢের শ্রেয় হবে । কিন্তু সালেহার সেই অনুযোগ হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন আহাদ মাষ্টার ।
-এই সব জায়গা জমি বিষয় বস্তু নিয়া তুমি অযথাই ভাইবো না । আমার তো শয়ে শয়ে বিঘা জমিজিরাত কখনোই আছিল না । যা দুই চাইর বিঘা আছিল তাতে বচ্ছরের খাওনটাও কুনুদিন আসে নাই ওইখান থিকা । ওইগুলান রাইখা গেলেও তুমার ব্যাটায় রাজা মহারাজা জাতীয় কিছু হইয়া যাইতো না ! পারতো না পাওয়ের উপর পাও তুইলা সারা জীবন বইসা খাইতে ।
উল্টো তাকে বলেছিলেন সেদিন বলেছিলেন আহাদ মাষ্টার !
– আমি কি অমুন কুনু কতা কইছি নি আপনেরে !
খানিকটা অনুযোগই প্রকাশ পায় সালেহার কথায় স্বামীর প্রতি ।
– আমি জানি তুমি তা কওনি বউ ! তুমি যে তা কইবা না তাও আমি জানি । এত্তদিনে তুমারে এইটুক অন্তত আমার চেনা অইছে । আর তুমার কথায় কোন দোষের কিছুও নাই । মা হিসাবে সন্তানের জন্য এইটুক চিন্তা তুমি তো করবাই ! তয় তুমি জাইনা রাখো , আমাগো ব্যাটারে সবচাইতে বড় সম্পদ যেইটা আমি দিয়া যাইবার চাই তা হইলো বিদ্যার সম্পদ । আমি আমাগো ব্যাটারে ইনশাল্লহ দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষায় শিক্ষিত করুম । অ নিবো এই দেশের সবচেয়ে উঁচা ডিগ্রীটা যেইটা সুযোগের অভাবে আমার ভাইগ্যে জুটে নাই !
বলতে কেমন স্বপ্নালু হয়ে উঠতো যেন মানুষটার সারা মুখ যা দেখে আর কোন কথা বলার মতন ভাষা সালেহার মুখে জোগাতো না । চুপ করে মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায়ও দেখতো না সালেহা ।
যদিও পরবর্তী জীবনে সালেহার বহুবার মনে হয়েছে , সেদিন মানুষটার সব কথা ার উচিৎ হয়নি বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়া । বরং কিছুটা হলেও প্রয়োজন ছিল তার বাঁধা দেওয়া । তাতে অন্তত পরবর্তী জীবনে মুখোমুখি হওয়া দৈন্যতার বিরুদ্ধে তার একক লড়াইটা খানিকটা হলেও সহজতর হতো !
কিন্তু কে ভেবেছিল তাকে এমন দিনও দেখতে হবে ! তাও এতো তাড়াতাড়ি !
_______________________ ****** _______________________
১৬ই ডিসেম্বর তারিখটা সালেহার জীবনে এক চির অবিস্মরণীয় দিন হয়ে আছে !
সেটা শুধু বাংলাদেশের বিজয় দিবস বলেই নয় । বরং ঐদিনটিতে তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীই তাকে বাধ্য করেছে মনে রাখতে । এবং ঘটনা দুটির মূল সূত্র অতি অবশ্যই মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্য করেই । একই সূত্রে গাঁথা সেই অবিস্মরণীয় ঘটনা দুটিও আবার একসাথে ঘটেনি । ঘটেছিল আলাদা আলাদাভাবে । সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি রুপ নিয়ে তার জীবনে আসা একই তারিখের ঘটনাদুটি এসেছিল পর পর ।
তারিখ অভিন্ন হলেও তাদের মধ্যে সময়ের ব্যবধানটা ছিল দীর্ঘ্য এক বছরের । অর্থাৎ পরপর দুটি বিজয় দিবসে সালেহা মুখোমুখি হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি অভিজ্ঞতার । যার প্রথমটা ছিল ভীষণ সুখের । আনন্দের আর উচ্ছাসের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হওয়া সালেহার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় একটি দিন ।
এই মহান দিবসের দিনই জীবনে প্রথমবারের মত ঢাকা শহর দেখেছিল সালেহা স্বামীর সাথে । কোলে ছিল চার পূর্ণ করে মাত্রই পাঁচ বছরে পা রাখা তাদের আদরের একমাত্র সন্তান আতিক । যদিও ঢাকা যাওয়ার কোন কথা তাদের ছিল না ।অন্তত আহাদ মাষ্টার ঢাকায় তাদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়া সম্পর্কে আগে থেকে কিছুই জানাননি । আসলে তিনিও বোধহয় এই ব্যাপারে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন হটাৎ করেই ।
প্রতি বছর নিয়ম করে বিজয় দিবসের দিন স্মৃতিসৌধে যাওয়া ছিল আহাদ মাষ্টারের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ । একুশে ফেব্রুয়ারী আর স্বাধীনতা দিবস নিজের স্কুল আর গ্রামে নানান আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে কাটালেও বিজয় দিবসের দিন কাকভোরে তিনি বেরিয়ে যেতেন স্মৃতিসৌধের উদ্দেশ্যে । কেউ সঙ্গী না হলে রওয়ানা হতেন একাই । এরপর বেলাবেলি ফিরতে পারলে কখনো সখনো হয়তো যেতেন স্কুলে বা আশেপাশের কোন অনুষ্ঠানে ।
অন্তত বিয়ের পর থেকেই সালেহা এমনটাই দেখে এসেছে সবসময় । কিন্তু সেবার হটাৎ করেই আগের রাতে মানুষটা পুরো পরিবার নিয়ে স্মৃতিসৌধে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল । সালেহা এত ছোট ছেলেকে সাথে নিয়ে এতদূরে যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল প্রথমটায় ।
– আরে আমার ব্যাটারে তুমি এখনো ছোট কইতাছো কুন হিসাবে ? ব্যাটা আমার এরমধ্যেই বর্ণমালা আর ABCD লিখতে পড়তে শিখা গেছে । সামনের মাস থিকা ব্যাটা আমার স্কুলে যাইবো ! কি যাইবা না , ব্যাটা ?
বলতে বলতে নিজের কোলে বসে থাকা ছোট্ট আতিককে প্রশ্ন করেছিলো স্নেহময় পিতা ।
– যামু বাবা ।
কচিকন্ঠের অধিকারী আতিক মাথা হেলিয়ে সায় দেয় বাপের কথায় ।
বেশ অনেকদিন ধরেই বাপের কাছে নিয়মিত পড়তে বসে আতিক । এরমধ্যেই বাংলা ও ইংরেজী বর্ণমালা পড়তে ও লিখতে শিখে গেছে সে । পারে বলতে অনেক ছড়া মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে । জানে বাংলা ও ইংরেজী ১২ মাসের নাম মুখস্ত বলতে । অনেক ফল ফুলের বাংলা নামের সাথে ইংরেজী শব্দার্থও বলে যেতে পারে নির্ভূল ।
আহাদ মাষ্টারের খুব ইচ্ছা সামনের নতুন বছরেই নিজের স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে সন্তানকে ভর্তি করিয়ে দেবে ।
– শাবাস ব্যাটা ! এইতো চাই ।
বলে ছেলেকে খুশীতে বুকে জাপটে ধরে আহাদ মাষ্টার । তারপর হাসিমুখে তাকায় সালেহার দিকে ।
– এখন তুমিই বলো আমার ব্যাটায় কি আর ছোট আছে ? ছোট থাকলে তো আর আমার ব্যাটা স্কুলে যাইবার চাইতো না ! ছোটরা কি স্কুলে যায় নিকি ?
– হ মা । আমি স্কুলে যামু । আমার বাবার স্কুলে । আমি এত্তো বড় ।
বাবার বুকে জাপটে থেকেই যথাসম্ভব দুইহাত প্রসারিত করে মাকে নিজের বড় হয়ে যাবার প্রমানটা যথাসম্ভব বাড়িয়েই দেখাতে চেষ্টা করে ছোট্ট আতিক ।
– হ । আমার ব্যাটায় এত্তো বড়ো ! বুজলা তুমি আতিকের মা !
বাপ ছেলের কান্ড দেখে না হেসে পারে না সালেহা । তার ভীষণ ভাল লাগে বাপ ছেলের মধ্যকার এই আন্তরিকতা । আর খুনসুটি । ভীষণ অবাকও হয় এই সময়গুলোতে মানষটার মধ্যকার পরিবর্তণ দেখে । শিশু পুত্রের সাথে সাথে এত্তোবড়ো মানুষটাও যেন কেমন শিশুর মতন হয়ে যায় নিজেও ।
– হ বুজছি । বুজছি । যার এত্তো বড় বড় দুইটা সন্তান আছে তিনি তো বুড়্যা থুরথুইরা অইবেনই !
হাসতে হাসতে সালেহাও নিজের পরাজয় মেনে নেয় স্বানন্দে ।
সেরাতে তাড়াতাড়ি রান্নাবান্না আর খাওয়াদাওয়া দেয়ে আগেভাগেই বিছানায় চলে যায় ওরা । কারণ পরদিন খুব ভোরবেলায় বেরুতে হবে তাদের । ( চলবে )