দুই টুকরো কাশ্মিরী শাল – ১৫
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
ফযরের নামায পড়া শেষে হালকা কিছু নাস্তা সেরে ওরা যখন ঘর থেকে বাইরে বেরুলো তখনও গোটা চরাচর ঢেকে আছে কুয়াশার ভারী চাদরে । ফলে এত ভোরে রওনা দিয়েও আসলে তেমন কোন লাভ হলো না । বাসে ওঠার পর যাত্রী পেতে পেতে সময় লেগে গেল অনেকটা । তার ওপর বাস যাত্রা শুরু করার পরও বাড়াতে পারলো না চলার গতি । কুয়াশার কারনে খানিকদূরের দৃশ্যও পরিষ্কার দেখা যায় না বলে হেডলাইট জ্বালিয়ে বাসটি চলতে লাগলো অতি সাবধানতার সাথে । বেশ ধীর গতিতে ।
সবচেয়ে বেশি ঝামেলাটা হলো ফেরিঘাটে এসে । যদিও ততক্ষণে ঠিক পুরোপুরি রোদ না উঠলেও কেটে গেছে কুয়াশার দাপট ।কিন্তু ফেরীঘাটে দেখা গেল বিভিন্ন যানবহনের বিশাল লাইন । যেগুলো গতকাল সারারাত ধরে কুয়াশার কারনে ফেরী চলাচল বন্ধ থাকায় আর পার হতে পারে নি । ঠায় দাঁড়িয়ে আছে পারাপারের অপেক্ষায় ।
সামনে বিশাল যানবাহনের সারি দেখে বেশ একটু বিচলিতই হয়ে পড়লেন আহাদ মাষ্টার । কারণ ততক্ষনে আতিক খানিকটা বিরক্তই হয়ে পড়েছে বুঝি বসে থাকতে থাকতে । যদিও বাস চলতে থাকার সময় সারা পথে তেমন কোন বিরক্তই করেনি সে । বাসের ভেতর উঠে খানিক বাদেই বেশ একটা ঘুম দিয়ে তরতাজা উৎফুল্ল হয়েই ছিল এতক্ষণ । বরং নানারকম দুষ্টুমিতে আর অবিরত প্রশ্নে মাতিয়ে রেখেছিল মা বাবাকে । যা একটু অভিযোগ ছিল তা শুধু জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য প্রায় দেখাই যাচ্ছিল না বলে । আসলে জানালার কাঁচে শিশির আর কুয়াশা মিলে যে রকম আস্তরণের সৃষ্টি করেছিল – তা ভেদ করে বাইরের কোন কিছু ঠাওর করা একেবারেই সম্ভব ছিল না ।
শেষমেষ তার মনোযোগ গিয়ে পড়েছিল একেবারে সামনের কাঁচের দিকে । যেটা কিছুক্ষণ পরপরই ওয়াইপার দিয়ে ঘষে পরিষ্কার রাখা হচ্ছিল গাড়ীর এগিয়ে যাবার প্রয়োজনেই । সামনের কাঁচে দুটো কালো লাঠির মতন জিনিস অনবরত নড়ছে কেন , ওগুলো আসলে কি , অন্যসব কাঁচ ঘোলা কিন্তু সামনের ওই কাঁচটা শুধু পরিষ্কার লাগছে কেন আর কিভাবেই বা পরিষ্কার হচ্ছে – এসব নিয়ে তার শিশু মনের দারুন উৎসাহভরা হাজারটা ্প্রশ্ন সে করে গেছে বাবার কাছে । এবং আহাদ মাষ্টারও তার শিশুসন্তানের প্রতিটা প্রশ্নের জবাব এক এক করে দিয়ে গেছেন যতটা সম্ভব সহজভাবে ।
যে কোন কিছু নিয়ে রাজ্যের উৎসাহ যেন আতিকের । মুখের বোল পুরো না ফোটার আগে থেকেই শুরু হয়েছে তার বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন । এইটুকুন শিশুর হাজারটা প্রশ্নে মাঝেমধ্যে রীতিমতন বিরক্তই হয়ে পড়তো সালেহা । সেইসাথে অনেকসময় প্রশ্নের দাপটে দিশেহারাও বোধ করতেন । কারন এইটুকুন বিচ্ছু ছেলে এমন সব বিদঘুটে প্রশ্ন করে বসতো তাকে যে থই খুঁজে পেত না সালেহা । আসলে ঐসব প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকায় প্রশ্নগুলোকে যেমন তার মনে হতো বিদঘুটে । তেমনি প্রশ্নকর্তাকেও প্রায়ই মনে ইঁচড়েপাকা বা বাচাল জাতীয় কোন কিছু ।
আর এই নিয়ে মঝেমধ্যেই নিজের অজ্ঞানতা ছেলের কাছ থেকে লুকাতেই কিনা কে জানে সালেহা রীতিমতন ধমকে দিতেন নাছোড়বন্দা ছেলেকে । কিন্তু সেটা বেশ কবার আবার মাষ্টার মশাইয়ের চোখে পড়ে যাওয়ায় উল্টো তাকেই জেরার সম্মুখীন হতে হয়েছে প্রতিবার ।
– আরে আরে , পোলাডারে তুমি বকতাছো ক্যান হুদহুদি ?
– হুদাহুদি কই দেখলেন আপনে ? হারাক্ষণ প্যাঁচাল পাইড়া মুখের ফেনা উঠায়া ফালানের দশা করে একেক সময় । এত প্যাঁচাল পাড়া কি ভালা নি , তাও এই বয়সে ?
– ও তো প্যাচাল পাড়ে না আতিকের মা ! ও জানতে চায় !
– অহনই সব জিনিস জানার এত্তো দরকারডা কি পড়ছে ? পোলাপইনের মুখে এইসব কথা আছাইড়া প্যাঁচাল ছাড়া আর কি ?
হার মানতে রাজী নন সালেহা মোটেই ।
-এইটা তুমি এক্কেবারেই ঠিক কথা কইলা না , বুঝছো ? আরে এই সময় ওর কাছে চাইরপাশের দুনিয়াদারীর সবকিছুই এক্কেবারে তরতাজা । নতুন । ও অহন অইসমস্ত অজান্তিক বিষয় সম্পর্কে জানতে চায় । চিনতে চায় । বুঝতে চায় সবকিছু ।
– তা অহন এই বয়সেই সবকিছু জানার এত্তো কি দরকারডা পড়ছে তার । সারাজীবনই তো সামনে পইড়া রইছে । আস্তে ধীরে সব শিখব !
সহজ সরল যুক্তি সালেহার ।
– হ শিখবো । জীবনভরাই শিখবো । আর সেইটা শুরু অইব অহন থিকাই । তারপরেও একটা মানুষের পক্ষে খুব কম জিনিসই জানা সম্ভব । জানার বিষয় এত্তো বেশি আর একজন মানুষের জানার জন্য সময় আর সুযুগ এত্তোকম যে আসলে কইতে গেলে জীবনভরই শিখ্যাও শিখা অয় না তেমন কিছুই ।
– অইছে ! আপনের এই সব মারফতি মার্কা কতা আমার মাথায় ঢুকে না !
বলেই মনে মনে জিভ কাটে সালেহা মারফতি শব্দটা মুখ ফস্কে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে যাওয়ায় । স্বামীর সাথে এ ধরণের শব্দ মোটেও ব্যবহার করে না সে সচেতনভাবেই । কিন্তু তারপরেও হঠাৎ হঠাৎ কেমন করে যেন অযাথিত শব্দ মাঝে মধ্যেই বেড়িয়ে যাচ্ছে আজকাল !
সালেহার সেই আচমকা বেরিয়ে যাওয়া বেঁফাস কথা যেটা তাকে নিজেই লজ্জায় ফেলেছিল , কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল সেটা আসলে খেয়ালই করেনি মানুষটা । তিনি বরং রয়ে গেছেন তার আগের কথার রেশের মধ্যেই ।
– শুন সালেহা । এইভাবে অযথা বকাবকি কইরা পোলাটার মনের ভিতরকার জানবার ইচ্ছাটারে মাইরা ফালাইও না , বুঝলা ! এই জানতে চাওয়াটা একটা মস্ত বড় গুন মনে রাখবা ! যা সক্কলের মধ্যে থাকে না । কাজেই অর সব প্রশ্নের উত্তর ধৈর্য্য সহকারে দিবার চেষ্টা করবা সবসময় !
তবু সহজে হার মানতে রাজী নয় সালেহা । স্বামীর সঙ্গে মাঝেমাঝেই ইচ্ছাকৃত তর্ক জুড়ে দেয় সে আজকাল । অবশ্য এমনটা শুধু ছেলেকে নিয়ে কোন ব্যাপারেই একমাত্র করে থাকে সে ।
– কিন্তুক আপনের পোলায় মাঝে মইদ্যে ইমুন সব প্রশ্ন কইরা বসে যে হাসুম না কান্দুম বুঝবার পারি না । রীতিমথন বেইজ্জতি অবস্হার মইদ্যে ফালায়া দেয় । মনে অয় লজ্জায় মইরা যাই । নাইলে এইডারে পিডায়া আড্ডি গুড়া ফালাই !
যেন অনুযোগই করে সালেহা একেক সময় ছেলের বিরুদ্ধে ।
– হ । এইডা ঠিক । মাঝে মইধ্যে বাচ্চাগো মুখে অনেক বড়গো সম্পক্কিত কথা শুনলে চমকায়াই উঠতে অয় ।
– তাইলে অহন আপনেই কন তহন কি করতে ইচ্ছা করে বদমাইশটারে ! কিলাইতে ইচ্ছা করে না ?
স্বামীর কথাকে সায় মনে করে বাড়তি উচ্ছাসই বুঝি একটু দেখিয়ে ফেলে সালেহা । কিন্তু পরমুহুর্তেই ফের দমে যেতে হয় স্বামীর প্রতোত্তর শুনে ।
– না । ওইটাও ঠিক কাজ না মোটেই । এই বিষয়গুলান কায়দা কইরা কাটাইবার চেষ্টা করবা সব সময় । ভালা অয় মনটা তার ভুলায়া অন্য কুনু দিকে নেওয়ার চেষ্টা করা । আর একটা কথা মনে রাইখো , পোলাপানে কিন্তু তাগো না দেহা জিনিস সম্পক্কে কখনোই জানবার চায় না । তারা সেইটা নিয়াই আগ্রহ দেহায় যে জিনিসটা কুনু না কুনু ভাবে তাগো নজরে পড়ছে । কাজে কাজেই দায় কিন্তুক সালেহা আমাগোই । মানে আমাগো বড়গোই আসলে পোলাপাইনের সামনে এমুন কুনু আচরণ বা কাম করা ঠিক না – যা তাগো পক্ষে অহনই জাইনা ফালানোটা অনুচিৎ বা ক্ষতিকর ! বুঝলা ?
– হ । বুঝলি !
বুঝুক আর না বুঝুক – স্বামীর বয়ানের কবল থেকে বাঁচতে তাড়াতাড়ি সায় দেয় সালেহা ।
এবং এরপর থেকে সত্যি সত্যি ছেলের নানারকম কৌতুহলী প্রশ্নে মাথাগরম করে যখন তখন ধমকে দেয় না । বরং ঠিক ভুল যা কিছু হোক কোন একটা ভুজুংভাজুং দিয়ে ছেলেকে বেশ চালিয়ে নিতে থাকে ।
কিন্তু একদিন তাতেও বাঁধে বিপত্তি ! ছেলেকে কি একটা ব্যাপারে যেন বেশ উল্টাপাল্টাই বোঝাচ্ছিল সেদিন সালেহা । আর তা কেমন করে চোখে পড়ে যায় মাষ্টার মশাইয়ের । আয় যায় কোথায় ! সালেহাকে আরো একবার শুনতে হয় জ্ঞাণগর্ভ ভাষণ ।
– এইটা তুমি কি করতাছো সালেহা ?
– ওম্মা ! আমি আবার কি করলাম ?
– এই পোলাটারে ভুলভাল যাতা সব বুঝাইতাছো !
– আমি জানি না নিজেই ! তো কি করুম ?
– না জানলে জাইনা নেওয়ার চেষ্টা করবা ? তাও যদি না পারো সোজা স্বীকার যাইবা তুমি জানো না । এতে লজ্জার তো কিছু নাই । দুনিয়ার সবাই বেবাক কিছু জানে না । কিন্তু তা বইলা , পোলাপাইনগো কহনো কুনু কিছু পারতপক্ষে ভুল শিখাইবা না । না জানা এক জিনিস । ওইটা কুনু সময় ক্ষতি করে না । বরং ভবিষ্যতে তা জাইনা নেওনের সুযুগ থাকে । কিন্তু ভুল জানার মতন মারাত্বক ক্ষতির জিনিস আর এই দুইন্যায় দ্বিতীয়টা নাই সালেহা !
সেদিনে আর স্বামীর কথার প্রতিত্তোরে কোন কথা বলেনি সালেহা । আসলে কথা যোগায়ইনি তার মুখে জবাব দেবে কি !শুধু ভেবেছিল –
বাপ রে বাপ ! পন্ডিত মানুষদের ঘরণী হয়ে ঘর সংসার করা কি চাট্টিখানি কথা ! উনাদের সাথে এইদিকে গেলেও বিপদ । ওইদিকে গেলেও !
বাবা , দরকার নাই তার মতন মুখ্যুসুখ্যু মানুষের পক্ষে পন্ডিতমশাইয়ের সন্তানের কোন কিছু শেখতে যাওয়া ! তারচেয়ে যার সন্তান সেই নিক সব শেখানো পড়ানোর দায়িত্ব ! তার নিজের দায়িত্ব দেখভাল করা সন্তানের , সেটাই সে করবে না হয় ঠিকমতন !
বাড়তি ঝামেলায় গিয়ে কি দরকার তার !
এরপর থেকে সত্যি সত্যিই সালেহা ছেলের যে কোন কৌতুহলী প্রশ্নের জবাব সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হলে দেয়ারও চেষ্টা করে না । বলে দেয় সোজা , ছেলে যেন বাপকে এলে জিজ্ঞেস করে নেয় !
এর ফল হল অতি অল্প দিনের মধ্যেই ঐটুকুন বয়সী আতিকেরও একই জবাব বারবার শুনতে শুনতে বোঝা হয়ে গেল তার আসল কৌতুহল নিবারণের উৎসটা ! ফলে সে ধীরে ধীরে মাকে সব বিষয় নিয়ে জ্বালাতন করাটা কমিয়ে দিয়ে বরং অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে বাপের বাড়ী ফেরার । আর বাবা ফেরার পর শুরু হয় তার সারাদিনের সব প্রশ্নের ঝাঁপি মেলে বসা । আর মানুষটাও হয়েছে তেমনি । সারাদিন পর দিনে কি রাতে যত ক্লান্ত বিধ্বস্ত থাকুক না কেন – কোনদিন তাকে এতটুকু বিরক্ত প্রকাশ করতে দেখেনি সালেহা ।
সবমিলিয়ে ক্রমশই মায়ের চেয়ে বাপের সাথেই বেশি সখ্যতা গড়ে ওঠে আতিকের ।
ছেলেরা নাকি মায়ের ন্যাওটা হয় – একথা উল্টা প্রমান করতেই যেন বাপ কাছাকছি থাকাবস্হায় মায়ের দিকে নজর দেবারও ফুরসৎ পায় না সালেহার ছেলেটা !
এইতো এই মুহুর্তে যেমন বাপের কোলে বসেই রাজ্যের যত আলাপ জুড়ে দিয়েছে । বাস ছাড়ার পর প্রথম কিছুক্ষণ বাপের সাথে মায়ের সঙ্গেও খানিকটা খুনসুটি চালিয়েছিল বটে ! কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে বাপ ব্যাটা এখন মশগুল নিজেদের নিয়ে !
– ভালা অইছে । পন্ডিত সাবেরা পন্ডিত সাবেগো সামলাক । আমি এই ফাঁকে মজায় মজায় ঘুমায়া নেই !
বোরকার পর্দার সীমানা পার হয়ে স্বামী সন্তানকে দেখে মনে মনে হাসে সালেহা । তারপর সীটের পেছনদিককার গদিতে মাথা হেঁলিয়ে আরামে চোখ বোঁজে ! ( চলবে )
Comments are closed.