দুই টুকরো কাশ্মিরী শাল – ১৬
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
যাই হোক , ফেরীঘাটে এসে বাস থেমে দাঁড়ানোর অল্প কিছু সময় পর থেকেই শুরু হল আতিকের যন্ত্রণা । সে আর বসে থাকতে রাজী নয় । তার চুপচাপ অতটুকুন ছোট্ট পরিসরে আবদ্ধ থাকা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না । হয় বাস চলুক । নতুবা তাকে বাস থেকে নামতে দিয়ে তার স্বাচ্ছন্দ চলাফেরা নিশ্চিত কররা হোক !
একসময় তার ছটফটানী পৌঁছে গেল রীতিমতন জেদ আর জোরাজুরিতে । আর এক মুহুর্ত তাকে আটকে রাখার চেষ্টা করা হলে হয়তোবা জোর করেই নেমে যাবে সে । অন্তত তার ভাবভঙ্গি দেখে তাই মনে হলো সালেহার । আর ছেলের গোয়ার্তুমীতে ক্রমশই মেজাজ খারাপ হতে শুরু হল তারও । হয়তো আর একটু বাড়াবাড়ি হলে ভরা বাসের মধ্যেই ছেলের পিঠে বসিয়ে দিতেন দুই এক ঘা যে কোন মুহুর্তে ।
কিন্তু ব্যাপরটা টের পেয়ে আবারও ছেলের সম্ভাব্য বিপদ সামাল দিলেন আহাদ মাষ্টার ।
– আমি দেইখা আসি বিষয়টা কি ? কত সময় লাগবো জানা দরকার । এইখানে বইসা বইসাই তো আর দিন পার করন যাইো না ।
বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন আহাদ মাষ্টার । তারপর তাকালেন মায়ের কোলে বসে যুঝতে থাকা ছেলের দিকে ।
– কি রে ব্যটা ? যাবা নাকি ? চলো সামনে আগায়া গিয়া দেইখা আসি ঘটনা কি ?
বলে দুহাত বাড়িয়ে দেন ছেলের দিকে আহাদ মাষ্টার । সেই বাড়ানো হাতের বন্ধনে নিজেকে এগিয়ে দিতে একমুহুর্ত দেরী করে না আতিক । প্রায় লাফ মেরে মায়ের কোল থেকে ছিটকে চলে আসে বাবার কাছে ।
সালেহাকে গাড়ীতে বসিয়ে রেখে ছেলেকে কোলে নিয়ে নেমে যান আহাদ মাষ্টার ।
————————— ***** ————————
এরপর আর ঐ গাড়ীতে করে আসা হয়নি সালেহাদের । কারণ বেশ অনেকক্ষণ বাদে ফিরে এসে আহাদ মাষ্টার হতাশ সুরে জানিয়েছিলেন , যানবাহনের তীব্র জট পেরিয়ে তাদের বাসের ফেরীতে ওঠার সুযোগ আসতে আসতে কম করে হলেও আড়াই তিন ঘন্টা সময় লেগে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে । অথচ এখনই প্রায় সাড়ে নটা বাজে সকাল । সুতরাং ঐ পারে পৌঁছেও তাদের স্মৃতিসৌধে যেতে যেতে বিকাল হয়ে যাবে নিশ্চিত । তা উপর এখন শীতকালে দিন এমনিতেই খুব ছোট ।
আসলে এসব কথা সালেহাকে ব্যাক্ষা করার কোন প্রয়োজন ছিল না কোনই । সালেহা জেনে করবেই বা কি ! এই জীবনের প্রথম এতদূরের পথ পাড়ি দেয়ার যে রোমাঞ্চ তার মধ্যে কাল থেকে ছিল – তার অনেকটাই এখন ম্লান হতে বসেছে । না, কোনরকম দুশ্চিন্তা তার হচ্ছে না মোটেই । দুশ্চিন্তা করবেই বা কেন ? জীবনের সবচেয়ে বড় ভরসার মানুষটার সাথেই সে যাচ্ছে । দুশ্চিন্তার কোন প্রশ্নই আসে না তার !
আসলে ব্যাপার হল , এভাবে ঠায় বসে থাকতে তারও ভাল লাগছে না মোটেই আর । ছেলের মতন তারও যেন বিরক্তি ধরে গেছে । তার উপর রয়েছে দীর্ঘ যাত্রায় অনভ্যাস । কিন্তু তার তো নিজের কিছুই করার নেই । এমনকি জানা নেই , কি করতে হবে । তাই সে আহাদ মাষ্টারের দিকে চেয়ে রইল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ।
– এখন রাস্তা একটাই । বইসা না থাইকা চলো নাইমা পড়ি । তারপর ঐ পারে গিয়া আবার নতুন কইরা গাড়ীতে উঠুম নে ! চলো বইসা থাইকো না । উঠো ।
আহাদ মাষ্টারের কথাগুলো শুনে পরম স্বস্তি অনুভব করলো সালেহা । একমুহুর্ত দেরী না করে তাড়াতাড়ি স্বামীর পেছন পেছন নেমে এল বাস থেকে । আবদ্ধ পরিবেশ থেকে খোলা আকাশের নীচে নেমে প্রথমেই বুক ভরে নিল স্বস্তির নিঃশ্বাস ।
সেই সাথে বাঁচলো হাঁফ ছেড়ে !
—————————————– ***——————————–
এরপর আর কোন ঝামেলা হয়নি বলতে গেলে । বেশ ভালভাবেই ফেরী করে এপারে এসে আবার বাসে উঠে ওরা যখন সাভার স্মৃতিসৌধের সামনে এসে নামলো তখন প্রায় দুপুর হয়ে গেছে । স্মৃতিসৌধের সামনে থেকে তিনটি ফুলের তোঁড়া কিনে ওরা অনেক মানুষের সাথে লাইন ধরে তা রেখেছিল স্মৃতিসৌধের বেদীতে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে । তাারপর কিছুক্ষক্ষণ মৌন শ্রদ্ধা প্রদর্শণের পর বেরিয়ে এসেছিল স্মৃতিসৌধ থেকে । ওখানেই দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে ফের বাসে উঠেছিল ওরা । তবে ফিরতি বাসে না ।
ঢাকার বাসে ।
হ্যাঁ , সালেহাকে অবাক করে দিয়ে আহাদ মাষ্টার ওদের নিয়ে এসেছিল ঢাকা শহর দেখাতে ।
—————————————- ************** ———————————————–
ঢাকা শহরে কোন নিকটাত্বীয় না থাকায় ওরা উঠেছিল গুলিস্হানের একটা হোটেলে । সেটাও ছিল সালেহার জীবনের প্রথম ও শেষ হোটেলে রাত্রিবাস । হোটেলে পৌঁছে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যার পর ওরা বেরিয়েছিল ঢাকা শহর দেখতে ।
সারা জীবন গ্রামে কাটানো সালেহা প্রথমবারের মতন মুগ্ধ হয়ে দেখলো ঢাকা শহর । রিক্সায় ঘুরে ঘুরে দেখলো রাতের ঢাকার আলোক ঝঝলমলে রুপ । আহাদ মাষ্টার তাকে চেনালো হাইকোর্ট , পূর্বানী হোটেল , হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল , বীমা ভবন আরো কত কি ! আর সবগুলোই ছিল কি সুন্দর লাল নীল হলুদ নানান রঙের বাহারী সব বাতিতে সাজানো !
উফ ! ঢাকা শহর যে এতো সুন্দর কে জানতো !
তবে আহাদ মাষ্টার তাকে জানালো , এই সব নাকি আজকের মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে বিশেষ ভাবে সাজানো হয়েছে । এরপর ওরা এল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় । রিক্সা দিয়ে যেতে যেতে কাছ থেকে দেখলো ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান ! যা নাকি ততদিনে নাম পাল্টে রাখা হয়েছে শহীদ সোরওয়ার্দী উদ্যান ।
সালেহা তার স্বামীর কাছেই জেনেছিল এই জায়গটির ঐতিহাসিক মাহাত্ব্য । এই খান থেকেই নাকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন । আহাদ মাষ্টারও সেইদিন ঐ জনসভায় যোগ দিতে এসেছিলেন ।
যেতে যেতে সেদিনের সেই ঘটনাবলী ফের বর্ণনা করে চলেন আহাদ মাষ্টার । শুনতে শুনতে প্রতিবারের মতন আবারও শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে সালেহার ।
এরপর ওরা প্রবেশ করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল এলাকায় ।
– বুঝলা সালেহা , আমার খুব ইচ্ছা আছিল এই বিশ্ববিদ্যালয় থিকা পাশ দেওনের । কিন্তুক সামর্থ্য আর সহযোগিতার অভাবে আমার সেই সাধ পূরণ অয় নাই । কিন্তুক আমার জীবনের স্বপ্ন অহন একটাই , আমার আতিক এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থিকা সর্বোচ্চ পাশ দিয়া বাইর অইব । আমার সব স্বপ্ন আমার ব্যাটায় পূরণ করবো ।
বলতে বলতে কেমন স্বপ্নালু হয়ে ওঠে আহাদ মাষ্টারের কন্ঠস্বর । সেই কন্ঠস্বরে ভীষণ অবাক হয়ে সালেহা স্বামীর দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে । রাত্রির আলো আঁধারী আর বোরকার ফাঁক দিয়ে যতটুকু মনে হয় মানুষটা যেন সত্যিই তখন বিরাজ করছে তার কল্পণার ভীষণ প্রিয় কোন জগতে ।
এরপর শহীদ মিনার দেখতে দেখতে ঢাকা মেডিকেলের সামনে দিয়ে অনেক রাস্তা পেরিয়ে চলে এসেছিল আহাদ মাষ্টারের কল্পনার ভুবনের আরেকটি অংশে ।
– এইটা কি জানো তোমরা ?
আহাদ মাষ্টার প্রশ্ন করেন আরেকটি সাদা দেয়াল ঘেরা বিশালাকার প্রবেশ দ্বারের সামনে এসে । স্বাভাবিকভাবেই দুই অনভিজ্ঞ দর্শকের কাছ থেকে উত্তর মেলে । যদিও প্রতিত্তোরে পাল্টা প্রশ্ন করতে মুহুর্ত দেরী করে নাা অতি উৎসাহী ছোট্ট আতিক ।
– কি বাবা ?
আসলে আতিকের উৎসাহ পরখ করতে বা উসকে দিতেই এমন প্রশ্ন করা আহাদ মাষ্টারের । ছেলের কাছ থেকে আশানুরুপ সাড়া পেয়ে আরো বেশি উৎসাহ বোধ করেন যেন শিক্ষানুরাগী পিতা ।
– এইটা অইল ঢাকা কলেজ । এইটা কইতে পারো সারা বাংলাদেশের সেরা কলেজ । দেশের সব সেরা মেধাবীরা এইখানে পড়াশুনা করে মেট্রিক পাশ করার পর । আমার ব্যাটাও একদিন ম্যাট্রিক পাশ কইরা এই কলেজে পড়তে আসবো ইনশাল্লাহ । কি রে ব্যাটা , ভর্তি অইবা না এই কলেজে ?
– হ বাবা । হমু ।
– কিন্তুক ব্যাটা , এইখানে কিন্তুক ইচ্ছা করলেই সবাই ভর্তি অইতে পারে না !
মা ছেলে দুজনই আহাদ মাষ্টারের মুখের দিকে তাকায় কথার হেঁয়ালী বুঝতে না পেরে ।
– হ ব্যাটা । এই কলেজে সব্বাই পড়ালেখা করতে চায় । কিন্তুক এইখানে পড়ার সুযোগ পায় খালি সেরা ফল যারা করে তারাই । তাইলে ব্যাটা , এখন কও তো এই কলেজে পড়তে অইলে তোমার কি করতে হইব ?
– কি করতে অইব বাবা ?
– করার তোমার থাকবো একটাই কাম । খালি ভালা কইরা মন দিয়া পড়ালেখা করা । আর সব পরীক্ষায় সেরা ফল করা । ব্যাস ! তোমার আর কিছু করা লাগবো না ! এরপর দেখবা এই সেরা শিক্ষার মন্দিরগুলার দরজাগুলা আপনাআপনিই কেমনে তোমার জন্য খুইলা যাইতেছে ! কি বাজান পড়বা তো মন দিয়া ?
– হ । বাবা । আমি কখনও ফাঁকি দিমু না পড়ায় । সব সময় মন দিয়া পড়ুম !
বাবার কথার সাথে সাথে যেন প্রতিজ্ঞাই করে ছোট্ট আতিক ।
– এইতো আমার সোনা মানিক লক্ষী ব্যাটার মতন কথা । তাইলে কও ব্যাটা তোমার কলেজের নাম কি ?
– ঢাকা ভারসিটি !
একটু ভেবে জবাব দেয় আতিক ।
– ধূর ব্যাটা ! অইখনে তো সবশেষে পড়তে হয় । স্কুল পাশ কইরা কোন কলেজে জানি ভর্তি হবা তুমি ?
– অহন যেইটা দেখছি ?
– হ । অহন যেইটা দেখলাম মাত্র আমরা ।
এবার একটু সময় নিয়ে ভাবে আতিক ।
– হ ! হ ! ঢাকা কলেজ বাবা !
বলতে পেরে খুশীতে আআআত্বহারা হয়ে ওঠে ছোট্ট আতিক !
– এইতো শাবাস । আমার ব্যাটার ব্রেইন খুব ভাল । সহজে কিছু ভোলে না । তুমি দেইখো সালেহা , ও একটু চেষ্টা করলেই আমাগো সব স্বপ্ন পূরণ করতে পারব ! খুব বেশি কষ্ট আমাগো করতে অইব না ।
-আল্লাহপাক তাই যেন করে !
স্বামীর স্বপ্ন পূরণের জন্য কায়মনোবাক্যে পাশে বসে থেকে মনে মনে দোয়া করে সালেহা ।
সেদিন এভাবেই ঘুরে বেড়ানোর ছলে দুই প্রজন্মের দুই মানুষের মাঝে নিজের সব স্বপ্নের বীজ স্বারথকভাবেই বপন করতে পেরেছিলেন আহাদ মাষ্টার ! (চলবে )