দুই টুকরো কাশ্মিরী শাল – ১৭
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
সেই ছিল এক ১৬ ডিসেম্বর ।
যা সালেহার জন্য কেটেছিল রীতিমতন স্বপ্নের মধ্য দিয়ে । সেদিন অনেক রাত অবধি বলতে গেলে প্রায় পুরো ঢাকা শহরটাকেই রিক্সায় করে দেখিয়ে দিয়েছিল ওদের মাষ্টার । তবে সেদিন কোন জায়গায় নেমে তেমন বেড়ানো হয়নি । রিক্সায় চলার উপরেই ছিল ।
কিন্তু পরদিন সকাল থেকে ওরা সত্যিকার অর্থেই ঘুরে বেড়িয়েছিল । আহাদ মাষ্টার ওদের নিয়ে গিয়েছিল লালবাগের কেল্লা , যাদুঘর , বলদা গার্ডেন । তবে আতিক সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চিত আর আনন্দিত হয়েছিল দুপুরের পর চিড়িয়াখানা ঘুরে ।
ওহ , এতোদিন বইয়ে ছবিতে দেখা সব জন্তু জানোয়ারগুলো চোখের সামনে জ্যান্ত দেখে সে কি উত্তেজনা তার । নড়ানোই যায় না তাকে একেকটি খাঁচার সামনে থেকে । বলতে গেলে প্রতিটা খাচার সামনে থেকে রীতিমতন জোর খাটিয়ে সরিয়ে আনতে হয়েছে তাকে ।
সালেহারও কিন্তু ঠিক একই অঅবস্হা হয়েছিল ।
না , তবে চিড়িয়াখানার জন্তুজানোয়ার দেখে নয় ! জীবনের প্রথম সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে গিয়ে !
হ্যাঁ , সবশেষে সেই রাতে গুলিস্হান সিনেমা হলে অপ্রত্যাশিতভাবে সিনেমা দেখতেও বউ বাচ্চাকে নিয়ে গিয়েছিল আহাদ মাষ্টার ।
আহ ! সে এক অভিজ্ঞতা বটে !
সিনেমা হলের অন্ধকার পরিবেশে সিনেমা দেখতে দেখতে সালেহা সত্যি সত্যিই যেন হারিয়ে যাচ্ছিল কোন রুপালী স্বপ্নের জগতে । সিনেমার পর্দায় অভিনয় করতে থাকা মানুষগুলোকে আসলেই মননে হচ্ছিল ভিন্ন জগতের বাসিন্দা সব । আর পর্দায় ভেসে ওঠা নায়ক নায়িকার প্রমের দৃশ্যগুলো তো রীতিমতন লজ্জায় রাঙিয়ে দিচ্ছিলো প্রতিমুহুর্তে । ঐ অন্ধকার পরিবেশের মধ্যেও মনে হচ্ছিল আশেপাশের মানুষগুলো সব চেয়ে আছে তার দিকে ! অথচ আতিক পর্যন্ত সারাদিনের ঘোরাফেরায় ক্লান্ত হয়ে ততোক্ষণে তার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে ছবি শুরু হতে না হতেই ।
শেষ পর্যন্ত তার যতো মৌন অভিযোগ গিয়ে পড়েছিল সিনেমার নায়িকার উপর !
ছি ঃ ! মাগো , মেয়েরা এতো লজ্জাহীন হয় কি করে ! ওদের কি লাজ হায়া বলতে কিছু নেই ! গানের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে , তাদের আশেপাশে মানুষজন ঘোরাফেরা করছে ! অথচ তার মধ্যেই কেমন হাত ধরাধরি করে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে গান গাইছে !
ইস ! এ যে মরে গেলেও পারবে না সালেহা ! হোক না মানুষটা যতোই তার স্বামী !
তবে বলতে নেই , এসবকিছুর পরেও কিন্তু নায়ক নায়িকার প্রেমের দৃশ্যগুলো অসম্ভব ভাল লাগা আর আবেশের সৃষ্টি করে চলেছিল সালেহার দেহমনে । লজ্জায় রাঙ্্গা হতে হতে তাই কোন একটি দৃশ্য সেদিন উপভোগ করতে ভুল করেনি সে ।
যাই হোক । ঢাকা শহরে ওটাই ছিল তাদের শেষ রাত । পরদিন সকাল বেলা তারা ফের ফিরে এসেছিল নিজেদের আপণ ঠিকানায় ।সাথে করে সালেহা নিয়ে এসেছিল আজীবনের জন্য কিছু স্মৃতি ।
পরবর্তী জীবনে যেগুলো সালেহার জন্য হয়ে দাঁড়িয়ে কঠিন প্রতিজ্ঞা আর জীবনের অমোঘ দিক নির্দেশিকা !
——————————————— ********* ——————————————–
পরের ১৬ ডিসেম্বরটা সালেহার জন্য এলো সম্পূর্ণ অন্যরকম একরুপ নিয়ে । আগের সেই বিশেষ দিনটি যদি হয়ে থাকে স্বপ্নীল রঙধনু যার প্রতিটা পরতে পরতে মিশে ছিল সাতরঙের বর্ণিল আলোকচ্ছটা । সে হিসেবে পরবর্তী ঐ বিশেষ দিনটিই এসেছিল একটিমাত্র রঙ নিয়ে । সে নিকষ কালো আধারের রঙ । এক লহমায় জীবনের সমস্ত লালিমা আর আলো কেড়ে নেয়া ভয়াবহ অন্ধকার ঘেরা এক ভবিষ্যতকে সম্মুখে এনে দাঁড় করানো অনিশ্চয়তার মেঘে ঢাকা সে রঙ ।
বছরটা অবশ্য শুরু থেকেই ভালো যায়নি সালেহা দম্পত্তির । বছরের শুরুতেই প্রচন্ড ঠান্ডায় কাঁবু হয়ে আতিককে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ঘুরে আসতে হয়েছে হাসপাতাল অবধি । ফলে ইচ্ছা মোতাবেক তাকে আর সেবার স্কুলে ভর্তি করানো যায়নি । কারন সপ্তাহ দুয়েক পর হাসপাতাল থেকে ফিরে এলেও তার দুর্বল শরীর পুরোপুরি সারাতে লেগে গিয়েছিল কয়েকমাস ।
এরমধ্যে আবার দেশে রাষ্ট্রপতি হত্যাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্হিরতার কারণে স্কুলের বেতন ভাতা হঠাৎ করেই অনিয়মিত হয়ে পড়ায় খানিকটা আর্থিক কষ্টেও ভুগতে হয়েছে ওদের কিছুদিন । যা বিয়ের পর এই প্রথম সালেহা অনুভব করেছিল স্বামীর সংসারে এসে ।
যাই হোক , যেভাবেই হউক দেখতে দেখতে সব বিপদ আর ঝক্কি ঝামেলা পেরিয়ে অবশেষে সমাপ্তি ক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছিল সালেহার বিবাহিত জীবনের ঘটনাবহুল বছরটি । ততোদিনে আতিককে আগামী মাসেই স্কুলে ভর্তি করাবার জন্য সব প্রস্তুতিও প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গেছে ।
আতিকও এখন প্রতিটা মুহুর্ত মহা উৎসাহে বাবার কাছে সেই ভর্তি পরীক্ষার চূড়ান্ত তালিম নিতে মহাব্যাস্ত ।
ঠিক এমনই অবস্হায় এসে গেল আরেকটি মহান বিজয় দিবস !
১৬ ডিসেম্বর ।
প্রতিবারের মতন আহাদ মাষ্টার সেই ভোরবেলাই বেরিয়ে গেছেন । সালেহা স্বামীকে খাইয়ে বিদায় করে নিজের ফযরের নামায আদায় শেষে ফের এসে শুয়ে পড়েছিল ঘুমন্ত আতিককে বুকে জড়িয়ে ।
সেদিন কতোক্ষণ ঘুমিয়েছিল সালেহা – কে জানে ! তবে তার ঘুম ভেঙ্গেছিল বাড়ীর উঠানে অনেক মানুষের মিলিত হাঁকডাকে । সেই সাথে কেউ কেউ যে চিৎকার করে কাঁদছিল – তা শুয়ে থেকে বুঝতে পারছিল সালেহা ।
কি ব্যাপার ? কে কাঁদছে এভাবে ? কার আবার কি হলো এই সাত সকালবেলা !
ভয় পেয়ে শোয়া থেকে জেগে ওঠা সালেহা পড়নের শাড়ীটা কোনমতে টেনেটুনে ঠিকঠাক করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো ঘর থেকে আতিককে ঘুমন্ত রেখেই । তবে ঘর থেকে তার বেরুনো হলো না পুরোপুরি । উঠানে ভীড় করা মানুষজন দেখে ভীত বিস্ময়ে সালেহাকে থেমে পড়তে হলো দরজার উপরেই ।
-ও সালেহা বু গো ! এ কি অইলো গো !
– ওরে সালেহারে একি সব্বোনাশ করলোরে আল্লাতালায় !
একসাথে কয়েকজন প্রতিবেশী মহিলা যেন উড়ে এসে ঝাপটে ধরে সালেহাকে দেখামাত্র ।
কি হলো ? কিসের জন্য কাঁদছে এরা ? কিসের সর্বনাশের কথা বলছে এরা সবাই মিলে ?
সালেহা কিছুই বুঝতে পারে না ঘটনা । বোবা বিস্ময়ে সে শক্ত পাথরের মতন দাঁড়িয়ে ঘিরে থাকা মহিলাদের মাঝখানে ।
– অই তুমরা বারিন্দায় জাগা দেও !
– কেউ একটা পাটি বিছায়া দাও জলদি ! মাষ্টরসাবরে শোয়ানের ব্যবস্হা করো !
কিসের জন্য পাটি বিছাতে বলছে ছেলেগুলো ? কাকে শোয়াবে বলছে পাটিতে ?
মাষ্টার সাহেবকে ?
ধূর ! মাষ্টার সাহেবকে পাবে কোথায় পাবে ওরা ? উনি কি এই তল্লাটে আছেন নাকি এখনও ? ঠিকঠাক সময়মতন গাাড়ী ছাড়লে তার এখন কোথায় পৌঁছে যাবার কথা !
কিন্তু ওকি ! আরো কয়েকজন যোয়ান ছেলে মিলে পাঁজাকোলা অবস্হায় ধরাধরি করে এ কাকে তাহলে নিয়ে আসছে ! তাও আবার তাদেরই ঘর বারান্দার উপর ।
– ওরে সালেহারে আমাগো মাষ্টর সাবে আর নাই রে !
-ওরে আল্লাহগো ! এ তুমার কিমুন অবিচার গো খোদা । ইমুন ভালা মানুষরে তুমি ক্যামনে এতো তাড়াতাড়ি তুইল্যা নিলা গো !
ততোক্ষণে লম্বা চওড়া মানুষটাকে ধরাধরি করে এনে শোয়ানো হয়েছে বারান্দায় সদ্য বিছানো পাটিতে । মানুষটার পরনের সাদা পাজামা পাঞ্জাবী এখন জায়গায় জায়গায় নানা আকারের লাল রঙা চিত্রে চিত্রায়িত হয়ে আছে । যার মধ্যে কতগুলো আবার এরমধ্যেই শুকিয়ে গিয়ে ধারণ করেছে কালচে বর্ণ ।
মানুষটি কিন্তু এতোকিছুর মধ্যেও শুয়ে আছে একেবারে নিথর ।
বয়ে আনা লোকজনের মধ্যে থেকে একজন একটা প্যাঁচানো মোটা চাদর ভাঁজ খুলে তা দিয়ে ঢেকে দিল স্হির শুয়ে থাকা মানুষটার সমস্ত শরীর ।
এই মোটা চাদরটাই আজ সকালবেলা বেরুবার সময় গায়ে জড়িয়ে বেড়িয়েছিল মানুষটা !
মহিলাদের ভীড়ের মধ্যে হতবিহ্বল অবস্হা থেকে ক্রমশ বিধ্বস্ত সালেহা কোন ফাঁক গলে একনজর দেখতে পেয়েছিল অতি পরিচিত চাদরটা । চিনতে পেরেছিল সাথে সাথেই !
এরপর আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা হয়নি সালেহা । আচমকাই তার চোখের সামনে যেন দুলে উঠেছিল সমস্ত পৃথিবীটা । দু চোখের পাতা জুড়ে নেমে এসেছিল গাঢ় অন্ধকার । হারিয়ে ফেলেছিল তার পা দুটো বাদবাকী শরীরের ভার বইবার সামান্য শক্তিটুকু ।
– আল্লাহগো !
– আমার আতিইইইককক !!!
অষ্ফুটে শুধু এই শব্দদুটোই উচ্চারণ করতে পেরেছিল সালেহা । তারপরে হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে গিয়ে নিশ্চিন্তে জ্ঞাণ হারিয়েছিল সে !!!! ( চলবে )