ঢাকাকে সত্যিকারের রাজধানী হিসাবেই আমরা দেখতে চাই ।
একটি শহরের ঐতিহ্য আছে, আছে ঐতিহাসিক তাৎপর্য ।শুধু তাই নয় প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন কারনে এই শহরটির গুরুত্বপূর্নতা দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে দেশের বাইরে সমান তালে মাধূর্যতা ছড়িয়ে গেছে ।এই ঢাকা এমন একটি শহর যার সব দিক থেকে অন্নপূর্না কিন্তু শুধু পরিকল্পনার অভাবে এই শহরের ইতিহাস ঐতিহ্যও আজ ধ্বংশের মুখে ।শুধু তাই নয় প্রাচীন কালের যে যে ঐতিহ্য নিয়ে এই শহর গর্বিত তার অনেকগুলিই নিস্চিহ্নের পথে । সত্যিই কি এই বিখ্যাত শহরটির এমন চেহারা মানায় ! অনেক বড় বড় শহরের উদাহরন টেনে বলতে পারি আমাদের ঢাকাকে এমন করে গড়ে তুলতে চাই । কিন্তু তাতেই কি আমাদের তুষ্টি এসে যাবে ? আমাদের ঢাকা আমাদের কাছে প্রাণের মত । যদি শুনি ঢাকার ধানমন্ডি লেকের রবীন্দ্র সরবরের একটি ইট খসে পড়ে গেছে,-মনটানা কেমন যেন খারাপ হয়ে যায় । এটা বোঝানো যাবে না ।আমরা ঢাকাকে অনেক ভালোবাসি ।কিন্তু আমাদের এ ভালোবাসার মূল্যায়ন হবে তখনই যখন আমরা এর সঠিক যত্ন নিতে পারবো । একটু চিন্তা করলেই দেখবেন ঢাকা শহরের থাকার জন্য সিটি করপোরেশন আমাদের কি দিচ্ছে বা নাগরিক সেবার জন্য আমরা সরকার বা এর সংশ্লিষ্ট মহল থেকে আমরা কি পাচ্ছি । আমাদের নগর জীবনটা একেবারেই লাগাম ছাড়া, নিয়ম বর্জিত, অনিয়ন্ত্রিত দিকহীন গতিশীল ।
একটি ব্যাগ হাতে নিয়ে যাচ্ছেন, তাও আবার ময়লার ব্যাগ । ঢিল দিয়ে ফেলে দিলেন রাস্তার এক পাশে । ভাবটা এমন যেন আমিও দেখি নাই, কেউ দেখে নাই । ময়লা হল রাস্তা । গন্ধে হাটা যাচ্ছেনা । কিন্তু ঢিল দেওয়ার সময় নিজের বিবেক যেমন বাঁধ সাধলো না তেমনি কোন প্রহরী বা আইনানুগ সংস্থাও কিছু বললো না । তা নয় নাই বলল, রাস্তার মানুষও কেউ প্রতিবাদ করলো না ।
কিন্তু এত অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা বা অপরিকল্পনার শহরকে নিয়েই আমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে । কারন এটাই আমাদের অতিপ্রিয় রাজধানী শহর ঢাকা । তবে স্বপ্ন আর তার বাস্তবায়নের পথে মূল অন্তরায়ক হচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দূরদর্শীতার অভাব ।যদি ঢাকাকে উন্নত শহরে রুপদান করতেই হয় তবে কোথায় কোথায় সমস্যা রয়েছে তা আগে চিহ্নিত করতে হবে ।
অপরিকল্পিত গৃহায়ন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, রাস্তার অভাব, নাগরিক সেবার অপর্যাপ্ততা, পানির অভাব, নদীর কাঠামো সঠিকভাবে বিন্যস্ত না করা, জনসাধারনের অসচেতনতা ইত্যাদি সবকিছুই ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্যের কারন হিসাবে চিহ্নিত করা যায় । অবাককর হলেও সত্য যে এখনও প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়িঘর ঢাকা শহরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে । আর একটি অপরিকল্পিত বাড়িঘর গড়ে ওঠা মানে ঐ এলাকার অনেকগুলো মানুষের ভোগান্তির সৃষ্টি হওয়া । একেতো সংকুচিত রাস্তা তার উপর গড়ে তোলা বাড়ি ঘরের সরজ্ঞাম সব মিলিয়ে একটি আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস বা এম্বুলেন্স ভিতরে ঢোকার মতও জায়গা থাকে না ।শুধু যাতায়াত নয় নগর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঢাকার মানুষ হাতিস পিতেস করে । প্রচুর কলকারখানা, গাড়ির ধোয়া, পয় নিস্কাশন এবং অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চরম অব্যবস্থাপনা ঢাকার পরিবেশও করে ফেলছে বসবাসের অনুপযোগী ।এখন যে ড্যাপ নিয়ে বার বার কথা বলা হচ্ছে তা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমেই ঢাকার জনসংখ্যার বিকেন্দ্রিকরন করা সময়ের দাবি । এগুলো বাস্তবায়নের জন্য অবশ্যই কতগুলো লক্ষ নিয়ে সামনে আগানো প্রয়োজন ।
লক্ষগুলো হতে পারে এরকম :
রাজধানীর মতই আশেপাশের শহরগুলোর উন্নয়ন : এখন ঢাকাকে যদি একটি সুন্দর শহর হিসাবে বিনির্মান করতেই হয় তবে অন্যভাবে ভাবতে হবে । ঢাকার উন্নয়নের পাশাপাশি সমপরিমান গুরুত্ব দিতে হবে ঢাকার আশেপাশের শহর গুলোকে । যদি ঐ শহর গুলোকে বসবাসের জন্য উপযোগী করা যায় তবে ঢাকা থেকে জনগনের চাপ কিছুটা কমানো যাবে । বিশেষ করে এখন যেটা দেখা যাচ্ছে তা হলো ঢাকার পাশের শহরগুলোও ঢাকার মতই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে । আমাদের এখানেই সমস্যা যখন গড়ে উঠে শেষ হয়ে যায় তখন আমরা ভাবতে শুরু করি কিভাবে সুন্দর করা যায় । ঢাকার মতই গাজীপুর, সাভার, নারায়ন গঞ্জ, মানিক গঞ্জ সহ সব শহরগুলোই অব্যবস্থাপনার মডেল । নামে পৌরসভা বা সিটি করপোরেশন ঘোষনা করে কোন নাগরিক সুবিধা না দিয়ে যে কোন জায়গায় শিল্প কারখানা, আবাস স্থল গড়ে তোলা হচ্ছে । এর ফলে থাকছেনা পরিকল্পিত রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ, পয় নিস্কাশন ব্যবস্থা সহ অণ্যান্য সকল নাগরিক সুবিধা ।অবশ্যই এই শহরগুলিকে এখন উন্নত হিসাবে গড়ে তুলতে হবে । বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি কেন্দ্রীয় অফিসগুলো আশেপাশের উপজেলাগুলোতে স্থানান্তর করতে হবে ।
নদ-নদীর সীমানা নির্ধারন এবং সৌন্দর্য বর্ধন: এক বুড়িগঙ্গাই ঢাকার রুপকে বদলে দিতে পারে ।এখনও বুড়িগঙ্গার যে যৌবন রয়েছে তা ঢাকাকে সুরক্ষার জন্য, সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য যথেষ্ঠ বলে মনে করি । কিন্তু অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে এখনই, এখন থেকেই । এর পাশাপাশি ঢাকার আশেপাশের প্রতিটি নদীর পারগুলো সংস্কার করে এগুলোর পাড়ে স্থায়ী বাধ নির্মান করতে হবে । যাতে এগুলোর পার দখল নিয়ে নৈরাজ্য না হয় । শুধু পার দখল বন্ধ করলেই হবে না নদীগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধিতে খনন কাজ করতে হবে ।নদী দুষন রোধে কেন্দ্রীয়ভাবে ইটিপি ব্যবস্থাচালু করতেই হবে ।ময়লা নদীতে ফেলতেই হলে তা প্রক্রিয়াজাত করে ফেলতে হবে । পলিথিন নদীতে ফেলা সম্পূর্ন বন্ধ করতে হবে । পার সংরক্ষনের জন্য কিছু এলাকা বিস্তৃত করে নদীর পারগুলোতে গাছ লাগানো যেতে পারে ।
রাজধানীর ভিতরে লেকগুলো সংস্কার করতে হবে :
নদীগুলোর উন্নয়নের পাশাপাশি শহরের ভিতরে যে লেকগুলো রয়েছে তার সংস্কার করতে হবেই । আবর্জনামুক্ত করে এগুলোতে ভালো পরিবেশ সৃষ্টি করে শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে হবে ।শুধু সৌন্দর্যের জন্যই নয় লেকগুলো/খালগুলো অতিবৃষ্টির সময় পানি নিস্কাশনের জন্যও বড় ভূমিকা রাখতে পারে ।
বস্তিগুলোর বিকেন্দ্রিকরন: রাজধানীর বস্তিগুলো অপসারন করলে অনেক নিম্নবিত্ত মানুষ দিশেহারা হয়ে যাবে । বস্তিগুলোকে উপশহরে সরকারের নিজস্ব উদ্যোগে কিস্তিভিত্তিক ঋন প্রকল্পের মাধ্যমে বাড়ি তৈরী করে বরাদ্দ করতে হবে ।যাতে এই নিম্নবিত্ত মানুষগুলো একটি স্থায়ী ভাবে কোন নিবাস খুজেঁ পায় এবং ঢাকার জনসংখ্যার ভার কমে আসে ।
হ্উজিং প্রপাটিগুলোর জন্য একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরী করে দেওয়া : রাজউকের কিছু ধরা বাধা নিয়ম থাকলেও হাউজিং প্রপাটি গুলো ইচ্ছামত বাড়ি তৈরী করছে, মানের দিক থেকেও এরা সঠিক মান নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না । যেকোন জায়গায় যে কয়তলা ইচ্ছা বাড়ি তৈরী করেফেলছে । ভূমিকম্প প্রতিরোধীয় ব্যবস্থা, আগুন নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা, রাস্তার জায়গা ঠিকমত রেখে পরিকল্পিতভাবে বাড়ির কাঠামো তৈরী করার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে ।
রাস্তা প্রশস্তকরন: ঢাকাকে বাসযোগ্য, সুন্দর এবং পরিকল্পিত শহর হিসাবে গড়ে তোলার জন্য যে কয়টি শর্ত তার মধ্যে রাস্তার বৃদ্ধি, পুরানো রাস্তার প্রশস্তকরন এবং উন্নয়ন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ । যানজট নিরশনের পাশাপাশি পায়ে হাঁটার পথ এবং ছোট যান চলাচলের পথ নির্দিষ্ট করেদিতে হবে ।
ঢাকা একটি ব্যস্ত নগরী । আমার এই ব্যস্ততা ঢাকার একটি সম্পদ মনে হয় । তবুও ব্যস্ততাও হওয়া উচিৎ সাবলিল এবং ছন্দময় । তাই ড্যাব বাস্তবায়ন এবং এর কিছু সংশোধনও প্রয়োজন । যা আল মাসুদ এবং গালিব ভাই আমাদের সামনে সুন্দর ফিচার হিসাবে তুলে ধরেছেন ।এখন এগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন হলেই ঢাকা আসল রাজধানীর ঐতিয্যগত দিক সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারবে । আমরা চাই ঢাকা সুন্দর শহর হিসাবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হোক । রাজধানীও যে বসবাসের এবং পর্যটনের জন্য আদর্শ শহর হতে পারে তা আমাদের ঢাকাই একদিন প্রমাণ করবে এই স্বপ্ন দেখি সবসময় ।