আলোকিত এক ভোরের স্বপ্ন ( পাঁচ পর্বে সমাপ্য বড় গল্প / প্রথমাংশ )
১ .
কানা সদু ।
তেঁজগাও রেল ষ্টেশন এলাকায় পেশায় ভিক্ষুক মানুষটাকে সবাই এই নামেই সবাই চেনে ।
নাম শুনেই ধারণা করা যায় মানুষটা চোখে দেখে না । চোখে দেখবে কি – চোখ বলতে আসলে কোন জিনিসই যে নেই জন্মান্ধ মানুষটার ! শরীরের অন্যসব অঙ্গ প্রতঙ্গ আর দশজন সুস্হ মানুষের মত স্বাভাবীক থাকলেও , অস্বাভীক ছিল সদুর কপালের নীচে দু চোখের জায়গাটা । চোখবিহীন বিভৎস দুটি শূন্য অক্ষি – কোটর নিয়ে ভুমিষ্ট হয়েছিল সে ! ফলে প্রথম দিন থেকেই সদুর কাছে তার চারপাশের পৃথিবীর একটাই মাত্র রঙ ।
আর সেটা হলো নিকষ আঁধারের ভারী চাদর মোড়ানো গাঢ় কালো রঙ ।
ছেলেবেলায় বাবাকে হারানোর ফলে বাবা সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাই নেই সদুর । জন্মের পর থেকে মায়ের কাছেই বড় হয়েছে । তারপর একসময় অনেকটা বুঝের হয়ে উঠার পর হারাতে হয়েছে মাকেও । যদিও মায়ের কথা আর মোটেই মনে করতে চায় না সে । মাকে হারানোর সেই স্মৃতিটা আজও দগদগে ঘাঁ হয়ে বিঁধে আছে তার বুকের মাঝখানে !
সেই থেকে জগৎ সংসারে একা হয়ে পড়া কানা সদু আজ তেইশ চব্বিশ বছর বয়সী যুবক । জীবনের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সময় একাকী কাটিয়ে দেয়া সদু ঠিকভাবে আর কবে থেকে ভিক্ষাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে – তা বোধ হয় আজ তার নিজেরও আর খেয়াল নেই । এমনকি এই পেশাটিকে কেউ তার জন্য নির্ধারণও কিন্তু করে দেয়নি । বরং গ্রামের দূরন্ত শিশুরা যেমন হটাৎ পানিতে পড়ে যাওয়ার পর বাঁচার তাগিদে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে এক সময় আপনা আপনি আয়ত্ব করে ফেলে সাঁতার কাঁটা ! ঠিক তেমনিভাবেই অন্ধ সদুও আচমকা জীবন সাগরে একলা হাবুডুবু খেতে খেতে কখন যে ভিক্ষুক হয়ে গেল আর শিখে নিল বেঁচে থাকা – তা বুঝি একমাত্র বিধাতারই বেঁধে দেয়া বিধিলিপিরই নির্ধারণ করা ছিল ।
ভাসমান হিসেবে ভিক্ষুক জীবন শুরু করা কানা সদু এই তেঁজগাও রেলষ্টেশন এলাকায় এসে শেষ পর্যন্ত থিতু হতে পেরেছে – তাও আজ কোনভাবেই আট দশ বছরের কম নয় । এইখানে স্হিতি পেতে অবশ্য তাকে অনেক ধৈর্য আর কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে প্রথম বেশ অনেকদিন ।
যাই হোক , সময়ের দীর্ঘ্য ব্যবধানে কানু সদু নিজেই এখন এই এলাকার নেতৃস্হানীয় ভিক্ষুকদের একজন !
সারাদিন ভিক্ষা করে সদু এখন বেশ ভালোই রোজগার করে প্রতিদিন । তেঁজগাও রেল ষ্টেশনটি দিন রাত চব্বিশ ঘন্টাই জমজমাট থাকে মানুষের ভীড়ে । শুধু কি যাত্রী ? সে আর কতোজনই বা উঠানামা করে এই ষ্টেশন থেকে ! আসলে এটা হচ্ছে যাকে বলে একেবারে ব্যবসার জায়গা ! ষ্টেশনের পাশেই রয়েছে বিরাট কয়েকটি আড়ৎ । যার ফলে এইখানে পাইকারী ব্যবসায়ী আর ফঁড়িয়াদের ভিড়ের মচ্ছব লেগেই থাকে ্রতিটা মুহুর্ত । আর অন্যসব বানিজ্যিক স্হানের মতন এখানেও এসব ব্যাবসাপাতিকে পুঁজি করে দুই নম্বরী নানান ধান্দা চালাবার মতন ধান্দাবাজ লোকজনের আনাগোনাও তাই এতটুকু কম নেই !
সব মিলিয়ে ভিক্ষা করেই সদুর আয় খুব কম নয় । বরং বেশ ভালো । তার উপর সে ঘর সংসারহীন একলা মানুষ । তারউপর বেশিরভাগ ভাসমান মানুষদের মতন তার তেমন কোন চারিত্রিক দোষও নেই ! নেশা ভাঙও করে না একমাত্র শখের বিড়ি খাওয়া ছাড়া । যা কিনা এই আকালের বাজারেও চার টাকায় পাওয়া যায় বিশটার এক বান্ডেল । আর সদুর মোটামুটি এক বান্ডিলেই চলে যায় পুরো দিন ।
সবমিলিয়ে তিনবেলা খাওয়া দাওয়ার খরচ আর শখের বিড়ি কেনার পরও তাই সদুর প্রতিদিনই বেশ একটা ভাল পরিমান টাকা ( অন্তত তার হিসাবে ) রয়ে যায় তা হাতে । আর প্রতিদিনের বাড়তি এই টাকাটা সদু প্রতিদিন রাত্রিবেলা নিয়ম করে জমা রাখে এই ষ্টেশনেরই মনোহারী দোকানদার মতি ভাইয়ের কাছে । ষ্টেশন তো হলো দুনিয়ার ঠগ বাটপারের জায়গা । সুযোগ পেলে একজন অন্ধ ভিখিরির সর্বস্ব চুরি করে নিতেও দ্বিধা করে ঐ নেশাখোর চোরের দল , যারা কিনা সারা দিনরাত আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করে একটুখানি সুযোগের অপেক্ষায় । এদের কাছে সদুর নিজেরও সর্বস্ব গেছে বেশ কয়েকবার । ফলে সাবধানতা হিসেবে সদু কয়েকবছর ধরেই টাকা জমা রাখছে মতি ভাইয়ের কাছে ।
মতি ভাইয়ের কাছে ঠিক কতোদিন ধরে টাকা রাখছে আর কতো টাকা তার এ কয় বছরে জমেছে – তার কোন হিসাব সদু রাখে না । রাখার চেষ্টাও করে না । মতি ভাই এই ষ্টেশনের সবচেয়ে পুরনো লোকেদের অন্যতম । সবাই তাকে একনামে সৎ ভাল মানুষ হিসাবেই চেনে । হজ্ব করে আসা পাঁজ্ঞেগানা নামায ইবাদত আদায় করা মতিভাইয়ের কাছে তাই সদুও টাকা জমা রাখতে এতটুকু ভয় পায় না । সে জানে , মতি ভাইয়ের হটাৎ আল্লাহ না করুক কিছু ভাল মন্দ হয়ে গেলেও তার মত ভিখিরির টাকা কোনভাবেই মার যাবে না । কারণ মতিভাই সাবধানতার জন্য তার সমস্ত হিসেবনিকেশ জানান দিয়ে রাখে নিজের দুই ছেলের কাছে । বাপের ব্যসায় সহযোগী ঐ দুই ছেলেও সততা আর ভালমানুষির হিসাবে বাবার চাইতে কোন অংশেই কম যায় না !
আর তাছাড়া এই ষ্টেশন এলাকায় সদুর থিতু হয়ে বসতে পারার পেছনে মতি ভাইয়ের অবদানই তো সবচেয়ে বেশি । মতি ভাই দয়ালু মানুষ হিসেবে এমন দয়া অনেককে দেখালেও কি জানি কোন এক অজানা কারনে সদুকে সেই প্রথম থেকেই একটু যেন বেশি ভালবাসেন । আর এই মতিভাইয়ের কারনেই তো এই প্ল্যাটফর্মে রাত্রি কাটানোর সুযোগ পাচ্ছে নিয়মিত কাউকে কোনরকম বখরা দেয়া ছাড়াই । ষ্টেশন পুলিশ থেকে চাঁদাবাজ সবাইকেই সদুর সম্পর্কে বলে দিয়েছেন মতিভাই । সেইকারনে তার থাকার খরচটাও বেঁচে যাচ্ছে অনেকবছর ধরেই ।
সব মিলিয়ে মতিভাই মানুষটার কাছে কৃতজ্ঞতার কোন শেষ নেই কানা সদুর ।
————————————- ****************** ——————————————-
২ .
বেশ কদিন ধরেই আয় খানিকটা কমে গেছে সদুর । আর এর জন্য দায়ী হলো আচানক তার পাশেই থান গেঁড়ে বসা আরেকটা নতুন মেয়ে ভিখারী ।
প্রথম যখন এসেছিল মেয়েটা তা াথে সাথেই টের পেয়ে গিয়েছিল সদু । সকালবেলা নাস্তা শেষে কাজে এসে মাত্র নিজের জায়গায় বসে দিনের প্রথম বিঁড়িটা আয়েশ করে ধরিয়েছিল তখন । বলতে গেলে সাথে সাথেই তার অতি সতর্ক ইন্দ্রিয় তাকে সাবধান করে দিয়েছিল তার নিজস্ব এলাকায় কোন অনুপ্রবেশকারীর অস্তিত্ব !
– ক্যাডায় রে বইছে এইহানে ? কুন হালা পুঙ্গির পুতরে তুই লাটসাবের মথন জাগা দখল কইরা লইছস ?
সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড মেজাজ দেখিয়ে অনুপ্রবেশকারীর প্রতি খেঁকিয়ে উঠেছিল সদু !
মেজাজ আসলেই খিঁচড়ে গিয়েছিল তার !
মেজাজ খারাপ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক । সকাল থেকে এখন অবধি বনি করাই তো হল না তার ! এরমধ্যে এ কি জ্বালাতন । আর এ যে নতুন কেউ – তা চোখে না দেখলেও সদুকে বলে দেয়া লাগলো না বোঝার জন্য । নতুন না হলে বে আক্কেলের মতন এমন বে – আইনী কাজ কেউ করবে না কিছুতেই । কারন এই এলাকায় অন্য যে কোন জায়গার মতন প্রত্যেক ভিখিরির রয়েছে বসার জন্য আলাদা আলাদা নির্দিষ্ট জায়গা । যে জায়গার উপর রয়েছে যার যার অলিখিত কিন্তু অলঙঘনীয় মালিকানার অধিকার ! যেখানে অনধিকার প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ !
এই যেমন সদুর জায়গা হলো ষ্টেশনের একেবারে প্রধান ফটক ঘেঁষে সবার পয়লা । যেটা বলতে গেলে এখানকার ভিখিরিদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষনীয় আর প্রার্থিত জায়গা ! এই জায়গাটা কিন্তু এখানে সে একদিনেই অর্জন করেনি । এরজন্য তাকে বহুবছর অপেক্ষা করতে হয়েছে । এমনকি পয়লা দিকে তো এই এলাকার কোনখানে বেশিক্ষণ একসাথে দাঁড়িয়ে ভিক্ষাটাও করতে পারেনি শান্তিতে ! ওকে এখানে বেশিক্ষন ঘোরাঘুরি করতে দেখলেই তেড়ে এসেছে পুরনোরা ! এমনকি বেশ কবার তো গলাধাক্কা এমনকি গায়ে হাতও তুলেছে ওর ।
তারপরে না আস্তে আস্তে ও থিতু হয়ে বসতে পেরেছে এই এলাকায় ! আর এই বর্তমান জায়গাটার জন্যেও তাকে এখানকার মোড়লদের পেছনে বেশ ভাল খরচই করতে হয়েছে ! তাও কি আর এত সহজে পেত সদু এই জায়গার মালিকানা ! যদি না মতি ভাই মাঝখানে পড়ে যেঁচে তার জন্য সুপারিশ করতেন !
তাহলে ?
– কি রে হালার পো কতার জবাব দেস না ক্যান ? বোবা নি ?
ওপাশ থেকে কোন জবাব না আসায় মেজাজ ক্রমশ আরো খারাপ হতে থাকে সদুর । সে বুঝতে পারে সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না । পাশের জবরদখলকারী যে কেউই হোক , নিশ্চিতভাবেই ব্যাটা একটা ঢিঁট !
-খাড়া চুত… পো , তরে আমি দেহাইতাছি !
বলেই নিজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী তেল চকচকে লম্বা আর চিকন বাঁশের লাঠিটা পাশ থেকে হাতে তুলে নেয় সদু ।
– ক হালা মাঙ্গের পুত , বোবা না অইলে জলদি কতা ক ! নাইলে কিন্তুক বাইড়ায়া তর পু… র চামড়া আমি তুইলা হালামু কয়া দিলাম !
বলতে বলতে অভ্যস্ত আন্দাজে পাশের মানুষটাকে লাঠি দিয়ে খোঁচায় সদু । অব্যর্থ তার নিশানা লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে ঠিকঠিক আঘাতও হানে ।
-ওরে আল্লাহরে … মাইরালছে রে ডাকাইতের বাচ্চা ডাকাইতে আমারে মাইরালছে !
সঙ্গে সঙ্গে গগনবিদাড়ী আহাজারীতে ফেঁটে পড়ে আঘাতপ্রাপ্ত মানুষটা ।
ঘটনার আকস্মিকতায় রীতিমতন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়ার মতন দশা হয় সদুর । কারণ সে জানে , সে যত জোরে লাঠি দিয়ে খোঁচা দিয়েছে তাতে আর যাই হোক এইভাবে চিৎকার করে কান্নাকাটির কোনই প্রশ্নই ওঠে না ! আর তার চেয়েও বেশি অবাক হওয়ার কথা হলো চিৎকারটা করছে একজন কম বয়সী নারী । অন্তত কন্ঠ শুনে সদুর তাই মনে হলো ।
এমনকিছুর জন্য আসলেই প্রস্তুত ছিল না সদু । বিশেষ করে মেয়েদেরকে শয়তানের দূত মনে করে সে বরাবরই এড়িয়ে চলে এসেছে । সুতরাং খানিকটা বিহ্বল সদু বেশ একটু থমকেই যায় যেন ।
-আরি আরি আপনে এমতে চিক্কুর পারতাছেন ক্যান ? আমি তো ইমুন কুনু জোরেও মারি নাই !
বিব্রত সদু পরিস্হিতি সামাল দিতে চেষ্টা করে । কারণ মেয়েমানুষটার চিৎকার শুনেই যে দুই একজন করে আশেপাশে উৎসুক মানুষের ভীড় জমা হতে শুরু করে দিয়েছে – তা অনুভবেই বুঝতে পারে সে । যতই এখানে পরিচিত মুখ হোক সে , কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ ধরণের যে কোন ঘটনার দায় যে পুরুষদের উপরই মানুষজন চাঁপিয়ে দেয় – এটা সে খুব ভাল করেই জানে ।
– না ! জুরে মারছুইন না ! এক্কেবারে মুলাম কইরা মারছুইন !
খেঁকিয়ে ওঠে একেবারে মেয়েটা !
এবার ফের মেজাজ গরম হয় সদুরও । সেও সিদ্ধান্ত পাল্টা আক্রমনের । নইলে লোকজন তাকে নির্ঘাৎ ভুল বুঝবে !
– মারছি তো ভালা করছি ! মারুম না ক্যান ! তুই কুন আক্কেলে কারে জিগায়া এইহানে বইছস ? এইডা আমার জাগা তুই জানস না মাগী ! তাইলে তরে মারুম না কি চুম্মা দিমু !
এর প্রতিক্রয়া হয় আরো ভয়াবহ ।
– অই ফকিন্নির পুত । খাচ্চড়ের বাচ্চা খাচ্চড় ! আমি নাইলে বুল কইরা বয়াইআলছি ! তার লিগা তুই কুত্তার বাচ্চা আমার ইজ্জত মারবি ? আমার বুনিতে আত দিবি ? তুই কি আমার ভাতার লাগোস নি রে হারামির বাচ্চা হারামী !
মেয়েটির বিরামহীন চিৎকার আর অসম্ভব অবাস্তব অভিযোগে স্তম্ভিত হয়ে যায় সদু !
এবার রীতিমতন অসহায় আর আতঙ্কিত বোধ করে বেচারা কানা সদু !!!! ( চলবে )