আলোকিত এক ভোরের স্বপ্ন – ( দ্বিতীয় পর্ব )
৩ .
ঘটনা যে কতদূর গড়াতো কে জানে ! কারণ ততোক্ষনে ওদের ঝগড়ায় আকৃষ্ট হয় আশেপাশে রীতিমতন ভীড় জমায়েত হয়ে গেছে । আর সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার সদুর জন্য যেটা , উপস্হিত লোকজনের মধ্যে অনেকেই এরই মধ্যে মেয়েটার পক্ষ নিতে শুরু করে দিয়েছে । কন্ঠ শুনে যাদের মধ্যে দু একজনকে বেশ চিনতেও পারছে সে । এই এলাকায় ওর যেমন পক্ষের লোক আছে তেমনি তাকে দেখতে পারে না – এমন মানুষও খুব কম নেই । যাদের নজর মূলত ওর নিজস্ব বসার জায়গাটার প্রতি !
সুযোগের অপেক্ষায় ওৎ পেতে থাকা শত্রুরা কি সেই সুযোগটাই পেয়ে গেল আজ ! এই মেয়েটা তাদেরই পাঠানো কোন ষড়যন্ত্রের গুঁটি নয়তো তার বিরুদ্ধে – ভীষণ অসহায় সদু যখন এসব দুশ্চিন্তায় ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গিয়ে ভয়ে মরে যাচ্ছিল প্রায় – ঠিক তখনই তাকে উদ্ধার করার জন্য যেন খোদ আল্লাহতালার পাঠানো ফেরেশতা হিসাবে আরো একবার আবির্ভূত হলেন তার অতি হিতাকাঙ্খী মতি ভাই !
প্রথমেই প্রবল যুযুধমান দুই প্রতিপক্ষকে টেনে নিয়ে আলাদা করে ফেলা হলো ।
এরপর মতি ভাই দারুন দক্ষতা আর প্রভাবের জোরে ধমকে ভেঙ্গে দিলেন মানুষজনের ভীড় । মুফতে মজা দেখতে আসা লোকজন আর সদুর বিরোধীপক্ষরা মনে মনে হতাশ হলেও সাহস পেল না আর কোন উচ্চবাচ্য করার । আপাতত সব চেষ্টা বাদ দিয়ে একএ একে কেটে পড়লো সবাই ।
সবশেষে মতিভাই সদুকে ধরে নিয়ে গিয়ে বসলেন করিম মিঞার চায়ের ষ্টলে । ষ্টেশন প্ল্যাটফর্মেই এই চায়ের দোকানটি মতি ভাইয়ের অন্যতম প্রিয় বসার একটি স্হান । লম্বা টুলে দুজনে পাশাপাশি বসার পর দু কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে সদুকে নিয়ে পড়লেন মতিভাই ।
-অহন ক , এই বিয়ানবেলায়ই বেডি মাইনষের লগে ইমুন ক্যাল বাঁদাইলি কুন হিসাবে ! আমি হেই ভোর রাইতে দুকানে না আয়া চকে গেছি পাইকারী মাল আনথে । আয়্যা দেহি দুইন্যার খবিসি কারবার !
উষ্মার সঙ্গেই কথাগুলো বলেন মতিভাই ।
– আমি হাইদ্দা কুনু গ্যাঞ্জাম করি নাই মতিবাই । আর ওই বেশরম বেহায়া বেডিয়ে যে দুষ আমার উফরে দিছে , হেইডাও বেবাক বানাইনা কথা ! আপনেরা হগ্গলে আমারে আজকার থিকা চিনেন না বাই ! আমি আল্লার কিরা কাইটা কইতাছি সব মিছা কতা কইতাছে ওই বেডি । তার বাদেও আপনেরা বিচার কইরা যুদি আমার কুনু দুষ পান তাইলে আমারে নিজের আতে আফনে আমারে মাটিত গাইড়া হালায়েন বাই !
বলতে বলতে আবেগে প্রায় কেঁদে ফেলার মত দশা হয় সদুর ।
মতি ভাইও মানুষ চেনেন । আরো ভালোমতন চেনেন তিনি এই অন্ধ যুবকটাকে । পেশায় ভিখিরি হলেও এর চারিত্রিক কোন দোষ আজ পর্যন্ত তার চোখে পড়েনি । যে কারনে সদুকে বেশ পছন্দ করেন তিনি ।
তাই মতিভাই আর মেয়েটার করা অভিযোগ সম্পর্কে কোনরকম কথা বাড়ালেন না ।
– কিন্তুক ঝগড়া করলি কুন কামে রে ? তুই তো ঝগড়া কাইজ্জার মানুষ না ?
এবার যেন খানিকটা লজ্জাই পায় সদু ।
– কি করমু বাই কন ? আফনের গরে যুদি চোর হান্দায় তাইলে আফনে কি করতেন , কন ? অই মাগী না জিগায়া না হুইন্না আরেগজনের জাগায় চোরের মথন বয়া পড়ছে । আমি বারবার জিগাইছি তুমি ক্যাডা ! তুমি ক্যাডা ! কিন্তু বেডি কুনু জওব দেয় না দেইহা শ্যাষে মিজাজ গরম অয়া গেছিল বাই !
-হুম !
আন্মনে মাথা ঝাঁকান মতি ভাই ।
– মতি ভাই , এই যে আপনেগো চা লন !
মাঝবয়সী করিম মিঞা চা বানিয়ে নিজে দোকান থেকে চায়ের কাপ হাতে নেমে এসে ওদের সামনে । তার দোকানে ছোট একটা ছেলে কাজ করলেও একমাত্র মতি ভাইয়ের জন্য এই কাজটা সব সময় নিজের হাতেই করতে পছন্দ করে । এবং এজন্য মানুষটার কাছে মাঝে মধ্যে বকাও শোনে । কিন্তু অমায়িক ভালমানুষ মতিভাইয়ের প্রতি ভালবাসা আর শ্রদ্ধা থেকে সে সব কিছুই গায়ে মাখে না করিম মিঞা ।
আজ অবশ্য সে সবের দিকে খেয়ালই করলেন না মতিভাই ।
– ও হয়া গেছে ! দেও করিম মিঞা ।
হাত বাঁড়িয়ে নিজের চায়ের কাপটা নেন মতি ভাই ।
-সদু তুই বইসা আরাম কইরা চা টা খা । আমি দেইখা আসি মাইয়াডার কি অবস্হা । অরে আবার আমার দুকানে বসাইতে কইয়া আইছি । তই থাক । আমি অহনই আইতাছি ।
জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই নিজের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উঠে যান মতি ভাই ।
খানিকক্ষণের কথা বলে গেলেও মতি ভাই সহসাই ফেরেনি । বহুক্ষণ বাদে তিনি যখন ফিরে এলেন ততক্ষনে তিন কাপ চা আর গোটা পাঁচেক বিড়ি শেষ করে ফেলেছে সদু ।
– কি রে সদু তরে মনে অয় দেরী করায়া দিলাম ? আর এক কাপ চা খাবি নি !
– কি যে কন বাই । আফনের কতায় আমি হারা জনম এক জাগায় কাউয়ার মথন ঠাইট বয়া থাকবার পারুম !
মতি ভাইয়ের এই ধরণের সৌজন্যবোধ বিশেষ করে তার মত একজন পথের ভিক্ষুকের সাথেও – এই বিষয়টা বরাবরই মুগ্ধ করে সদুকে । তাই বিনয়ে বিগলিত সদু মনের আবেগ থেকে সত্যি কথাই বলে ফেলে মতিভাইয়ের কথার প্রতিত্তোরে ।
– হ ! বুজছি । বুজছি । তা আর এক কাপ চা চলবো নি ।
– না বাই .. আফনে আইতে আইতে এর মদ্যেই তিন কাপ খায়া হালাইছি । এই বিয়ান থিকা পাঁচ কাপ অইলো । আর বেশি খাইলে টক ঢেউক উটবো । প্যাটেও ব্যাদনা করবো রাইতে গুমানের সুমুয় ।
– হ । তা তো করবোই । যেই হাড়ে সারাদিন বিঁড়ি টানছ !
– হে … হে … বাই , আমি আর কুনু নিশাপানি করি না – জানেন অই । শখ কইরা এইটাই ইকটু যা খাই !
লজ্জা পেয়ে হাসে সদু ।
– এই বিঁড়িও কিন্তুক ভালা জিনিস না । বিশেষ কইরা তুই যেমনে একটার পাছা দিয়া আরেকটা দরায়া হারাদিন ভইরা ফুকফুক টানতেই থাকস !
-জ্বে আফনে যহন কইছেন অহন থিকা আস্তে ধীরে কমায়া দিমু ।
– কমাইলে তর লিগাই ভালা ! যাউকগা , অহন কামের কতা কই আয় ! অইদিগে জুহুরের নামাজের ওক্তও হয়া আইলো পেরায় !
– জ্বে বাই কন !
কথা বলার আগে খানিকটা গুছিয়ে নেয়ার জন্যই বুঝি সময় নেন মতি ভাই । সদুর চোখ থাকলে দেখতে পেত মতি ভাই খানিকটা বিচলিত বোধ করছেন কথা বলতে যেয়ে । যা তার মেয়েটার সাথে কথা বলার পর থেকেই শুরু আসলে । মেয়েটার সাথে কথা বলে যেন মায়ায় আটকে গেছেন তিনি । মেয়েটা যে মোটেই খারাপ স্বভাবের নয় , বরং অভাবের কারণেই স্বভাবটা খিটখিটে হয়ে গেছে – সেটাও তার মত অভিজ্ঞ মানুষের বুঝতে কোন অসুবিধা হয়নি । বিশেষ করে সব কথা শেষ করে মেয়েটা যখন হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে তাকে একেবারে বাপের মতন বলে বসে – এরপর আর তার মত দয়ালু মানুষের পক্ষে মেয়েটাকে উপেক্ষা করা কিছুতেই সম্ভব হয়ে উঠেনি ।
– সদু তগো আইজকার এই ক্যাঁচালের লেগা কিন্তু তরা দুইজনের কেউই না , দায়ী হইলাম গিয়া আমি !
সব কথা গুছিয়ে নিয়ে মনস্হির করার পর মুখ খোলেন মতি ভাই ।
– এইডা কিমুন কতা কইতাছেন বাই ! কাইজ্জা করলাম আমরা , তো আফনে এরমইদ্যে দুষী অন কেমতে ?
ভীষণ অবাক হয় সদু মতি ভাইয়ের কথা শুনে ।
– আহ ! আমারে কইতে আগে । কথার মাজে কথা কইস না তো !
– জ্বে বাই ! আর কমু না !
– হুম । হুন অই যে মাইয়াডা জগড়া করলি যার লগে তার আসলে কুনু দোষ নাই ! ও আগ বাড়ায়া ওই জায়গায় বইতে যায় নাই । আমিই তারে ওইখানে বইবার কইছিলাম রে ।
সচরাচর মিথ্যা না বললেও মতি ভাই এই মুহুর্তে একটা অসহায় মেয়ের জন্য মিথ্যাটুকু বলতে বাধ্য হন । যদিও মিথ্যাটুকু বলার আগে তাকে নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে । ভীষণ রকমের পাপ পূন্যে বিশ্বাসী মতি ভাই শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই সহায় সম্বলহীন মেয়েটার জন্য মিথ্যা বলায় আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চেয়ে নেবেন । আর তারপরও যদি উপরওয়ালার ক্ষমা না পান তাহলেও একজন দুঃস্ব মেয়ের জন্য গুনাহটুকু না হয় তার হবে !
– কি কন বাই ? আফনে অই মাথারীরে আমার জাগায় বইবার কইছেন !
নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস হয় না সদুর ! মতি ভাই তার এত আপন আর কাছের মানুষ হয়েও তার এতবড় ক্ষতি করতে পারলো ! এতো সরাসরি তার রোজগারে ভাগ বসানোর ব্যবস্হা করে তার পেটে লাথি মারার অবস্হা !
মতি ভাইও যদি তার সাথে এমন করেন তাহলে এই দুনিয়ায় আর কাকে বিশ্বাস করবে সে – ভাবতে গিয়ে রীতিমত কান্না এসে যায় সদুর ।
– তুই ভুল বুজতাছোস আমারে সদু । আমি অরে তর জাগায় বইতে কই নাই । কইছি তর পাশে বইতে !
– কিন্তু ক্যান বাই ? অয় কি লাগে আফনের ?
-তুই কি লাগোস আমার ! তরে এতো মায়া মহব্বত করি আমি কুন স্বার্থে – এই ধরণের কছু সদুর কথার উত্তরে বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেন মতি ভাই । সদু এই কথার অন্য রকম মানে করতে পারে ! অন্ধ ছেলেটা অযথা কষ্ট পাক – তা তিনি মোটেই চান না । তাই শেষমেষ আরেকটু মিথ্যা কৌশলের আশ্রয় নেন তিনি ।
– না রে , আমার কিছু না লাগলেও আমার খুব পরিচিত একজনের দ্যাশ সম্পর্কে আত্বীয় অরা ! মৈমনসিং বাড়ী অগো । অবস্হা নিকি খুব খারাপ আছিল না দ্যাশে ! কিন্তু কয় বচ্ছর আগে বাপটা মইরা যাওনের পর থিক্যা অগো কপাল পুড়া শুরু । অরা মোটে দুই বাই বুইন । মাইয়াডাই বড় । বাই অনেক ছোট ছিল বাপ মরার কালে । অহনও ভাইটা কইতে গেলে ছুটই । চৌইদ্দ পনরো বচ্ছর অইব । যাউকগা … সংসারে কামাইয়ের লোক না থাকায় আস্তে আস্তে গরের জিনিসপত্র ব্যাঁচা দিয়া শুরু ।
– ক্যান ? অগো মায় কই ?
নিজের মায়ের কথা মনে করেই বুঝি কন্ঠস্বর খানিকটা শক্ত আর কঠিন শোনায় সদুর ।
সদুর কন্ঠস্বরের পরিবর্তনটা ঠিকই লক্ষ্য করেন মতি ভাই । ওর মায়ের ঘটনা তিনি জানেন । তাই ছেলেটার মনের চাঁপা কষ্ট আর ক্রোধটাও বেশ বুঝতে পারেন তিনি ।
– না । অর মা আছে । তয় সে অইলো জনম রুগী । বিছনাতেই পইড়া থাকে বেশি । যাউকগা ! অভাবে পইড়া শেষম্যাষ যা ইকটু ভিটামাটি আছিল অইটিও বন্ধক দিতে অইছিল মাতবরের কাছে । যেইটা কয়মাস আগে মাতবর গোরে গর থিকা খেদায়া দখল লইছে । এই কয় মাস তারপরেও দ্যাশেই অভাবের মদ্যেই খায়া না খায়া কাটাইছে । কিন্তুক আর চলতাছে না দেইখা কয়দিন আগেই মাত্র তারা তিনজনে মিল্যা এই শহরে আইছে ।
বলে বুঝি দম নেওয়ার জন্যই থামেন মতি ভাই ।
– অরা ভিক্ষা করার মানুষ না রে ! করবোও না বেশিদিন ভইটায় একটা কাম জুটাইতে পারলেই ! কিন্তুক যতদিন ছেমরায় কাম না পায় আমিই কইছি আমার চোখের সামনে তর লগে বইতে । তয় আমি অগোরে কিন্তু আইজই বইতে কই নাই । আমি চাইছিলাম তর লগে কতা কইয়া তারপরে যা করণের করতে । কিন্তু গত দুইদিন কি জামেলার মদ্যে আছিলাম তুইও জানস । আমার মনেই আছিল না কতাটা তর লগে পাড়তে । আর অরাও যে গরে একদানা খাওন নাই – হেই চিন্তা কইরা আইজই বয়া পড়ব আর ইমুন ক্যাচাল বাঁদাইব কে জানতো ! আমি খুব শরমিন্দা রে তর কাছে সদু !
– বাই এমনে কয়া আমারে শরম না দিয়া পাওয়ের জুতা দুইডা খুইলা আমারে বাড়ি দ্যান তার বদলি ! আমি যুদি আফনের কতা জানতাম তাইলে কি ইমুন করি , কন ?
– তা জানি বইলাই তো আগ বাড়ায়া অরে কয়া দিছি রে সদু !
– হেরও কিন্তুক পরথমেই আমারে কওয়া উচিৎ আছিল আফনের কথা !
– মাইয়াডা ভয় পায়া গেছিল আসলে ! এই পয়লা গেরাম থিকা শহরে আইছে ! তার উপরে আবার কানা !
– কানা ? কি কন বাই ?
– হ রে ! পুরাই কানা ! তার উপরে অইলো যুয়ান বয়স । ঐই দুইন্যায় তো বদ মাইনষের কুনু অভাব নাই ! কিন্তু তুই ভালা মানুষ ! তাই তর লগে বহাইতে সাহস করছি ! তুই অন্তত অর কুনু ক্ষেতি করবি না – এই ভরসা আমার আছে রে !
মেয়েটার কাহিনী শুনতে শুনতে নির্বাক বসে থাকে সদু । তার নীরবতাকে সম্ভবত অসমমতি বলে ধরে নেন মতি ভাই !
– তয় তুই নারাজি থাকলে দরকার নাই রে সদু ! আমি ছেমড়ির অন্য কুনুখানেই ব্যবস্তা করমু নাইলে !
– আরে কি কন বাই ! একডা মার মথনই কানা মাইয়া ! অরে আমি না করমু কেমনে । তার উপরে আপনের চীনা পরিচিত ! বউক ! হেয় যদ্দিন খুশী বউক আমার লগে !
সদু মানা করবে কি মেয়েটা তারই মত অন্ধ শোনার পর থেকে তার মনে মেয়েটার জন্য একটু মমত্ববোধই যে সৃষ্টি হতে শুরু করেছে !
– আলহামদুলিল্লাহ । তুই আমার ইজ্জত রাখলি রে সদু । আর মনে রাখিস , আয় রোজগারে বরকত দেওনের মালিক একমাত্র আল্লাহপাক । কে জানে এই বড় মনের পরিচয় দেওনের জন্য আল্লাহপাক খুশী অয়া তগো দুইজনের উপরেই অন্যরহম রহমত ঢাইল্যা দিতে পারে !
তারপর থেকে মেয়েটার আর অন্য কোথাও যাওয়া হয়নি ! সদুর পাশাপাশি বসেই বেশ চলতে শুরু করেছে তার নতুন ভিক্ষুক জীবন !!!!
——————————————— ***** ————————————————-
৪ .
মেয়েটার নাম মনোয়ারা । সংক্ষেপে পরিচিতরা তাকে ডাকে মনু বলে । আজকাল সদুও তাকে এই নামেই ডাকছে ।
যদিও প্রথম কয়েকটা দিন পয়লা সাক্ষাতের তিক্ততার কারণে ওরা দুজনেই একটু গুটিয়ে রেখেছিল নিজেদের । বিশেষ করে সদু প্রথমদিকে ইচ্ছা করেই একটু গম্ভীর রাশভারী ব্যবহার করেছে মনুর সাথে । যথা সম্ভব কম কথার মাঝেও যতটুকু বলার দরকার বলেছে গলায় চেষ্টাকৃতভাবে আনা কতৃত্বের সুরে ! আসলে সে মেয়েটাকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে , মতি ভাইয়ের সুপারিশের জন্যই নিতান্ত দয়াপরবশ হয়ে মনুকে এখানে বসার অনুমতি দিয়েছে !
মনে হয় তাতে বেশ কাজও হয়েছে । কারণ ঐ দিনের ঘটনার পর আর উচ্চস্বরে ঝগড়াঝাঁটি তো দূরের কথা বরং তার সঙ্গে বেশ সমীহের সঙ্গেই কথা বলছে মনু । ঐ দিনের দুর্ব্যহারের জন্য দুদিন পরেই মাফও চেয়ে নিয়েছে । এমনকি প্রতিবার আসা যযাওয়ার সময় সদুর অনুমতি না নিয়ে উঠছে না !
ব্যাপারটা মনে মনে বেশ ভালোই উপভোগ করছিল সদু ।
কিন্তু একসাথে দিনের বেশিরভাগ সময় পাশাপাশি থাকলে যা হয় , ওদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না । আস্তে আস্তে নিজেদের অজান্তেই কেমন করে যে ওদের মধ্যকার সম্পর্কটা সহজ হয়ে এল – তার কোন খবর বোধহয় তাদের কাছেও নেই ।
মনুর ভাইটার সাথেও তার বেশ আলাপ জমে গেছে গেছে । ওর নাম ইয়ার হোসেন । ওকে সব সময় তার পুরো নাম ধরেই ডাকে সদু । ছোট করে ইয়ার বলে যেমন যেমন ডাকে না এত ছোট ছেলেকে বন্ধু হিসাবে ভাবা যায় না বলে ! তেমনি শুধু হোসেন নামেও কাউকে ডাকতে তার বাঁধে প্রিয় নবীজীর প্রাণধিক প্রিয় নাতির নামের সাথে মিলের কারণে ! তাই একটু বড় হলেও মনুর ভাইকে পুরো নাম ধরে ডাকতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সদু ।
প্রতিদিন অন্তত চারবারের জন্য ইয়ার হোসেনের সাথে দেখা হয় সদুর । সকাল সন্ধ্যায় বোনকে দিয়ে যাওয়া নিয়ে যাওয়ার সাথে প্রতিদিন দুপুরের খাবারের জন্যও মনুকে আনা নেয়া করতে হয় তার । এরমধ্যেই রেল লাইনের ধারে ওরা একটা ঝুপড়ি ভাড়া নিয়েছে । যেহেতু অসুস্হ হলেও মা সারাদিন বাসায় থাকে তাই কষ্ট করে হলেও নিজেদের রান্নাটা তিনি করেন । আর মনুও প্রতিদিন দুপুরবেলা বাসায় গিয়েই খেয়ে আবার ফিরে এসে বসে নিজের জায়গায় ।
মনুর এই ব্যাপারটা মনে মনে বেশ হিংসা করে বদু । যত কষ্টেই থাকুক , নিজের ঘরে বসে তিনবেলা খাবার মত সৌভাগ্য তো ওদের আছে । যা কিনা বলতে গেলে সদুর ভাগ্যেই নেই সেই বুঝার বয়স থেকেই । ইচ্ছা করলেই সদু অবশ্য নিজের জন্য ঝুপড়ি একটা ঘর ভাড়া নিতে পারে । কিন্তু তাতেই বা কি হবে ! ওর জন্য সেই ঘরে কেউ প্রতিবেলা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করবে না ! তেমন কেউ এই দুনিয়ায় থাকলে তো অপেক্ষা করবে তার জন্য রান্না করা খাবার নিয়ে !
যাই হোক , ওদের মধ্যে ভাবটা হটাৎ করেই বেশ গাঢ় হয়ে গেল এক দুপুরবেলায় । যোহরের আযানের পর বহু সময় পেরিয়ে যাববার পরেও ইয়ার হোসেনের কোন পাত্তা নেই সেদিন । প্রথম কয়দিন বোনের আশেপাশে মোটামুটি সারাদিন ঘোরাফেরা করলেও আজকাল বোনকে বসিয়ে দিয়েই লা পাত্তা হয়ে যায় ইয়ার হোসেন । বেশ চঞ্চল আর চালু ছেলে সে । বয়সও নেহায়েতই কম না । তাই আজকাল নিজের মত করে টই টই করে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় – সেই জানে । তবে যেখানেই থাকুক না কেন , সময়মত এসে বোনকে খেতে নিয়ে যেতে ভোলে না সে । অবশ্য এক্ষেত্রে নিজের পেটের তাড়াটাও বোধহয় কম গুরুত্তপূর্ণ নয় !
যাই হোক , সেদিন একেবারেই কোন পাত্তা নেই ইয়ার হোসেনের । এরমধ্যেই মনু বেশ অস্হির হয়ে উঠেছে ভাইয়ের জন্য । এদিকে সদুও কেন জানি হতে পারে চক্ষু লজ্জার খাতিরেই নিজেও উঠে যেতে পারছে না মনুকে ফেলে । কেমন জানি বাঁধছে তার একটা মেয়েকে অভুক্ত ফেলে রেখে নিজে খেতে যেতে ।
– সদু বাই , আফনে খাইবার যাইবেন না ?
– যামু তোমার বাইয়ে আহুক । একলগেই উঠুম নে ।
আর কোন কথা না বলে চুপচাপ ফের ভাইয়ের পথ চেয়ে বসে থাকে মনু । মনুর জন্য তাই সদুরও ওঠা হয় না । অনেকক্ষণ পার হবার পর আববারও সদুকে শুধায় মনু ।
– ও সদু বাই । ম্যালা টাইম অয়া গেল গা যে বড় ! আফনে খাইতে যাইতাইন না ?
-আমারে নিয়া তুমি ভাইবো না তো ! আমার খিদা লাগে নাই অহনও ! আসলে বিয়ান রাইত থিকাই প্যাটটা আমার জানি কিমুন ফাঁইপা রইছে ! খাইতেই মুন চাইতে আছে না !
কথাগুলা ডাঁহা মিথ্যাই বলে সদু । তার খিধায় রীতিমতন পেট চোঁ চোঁ করছে ! আসলে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়মতন খেতে খেতে এখন আর খাবারের দেরী তার সহ্য হয় না !
মনুরও কোন অসুবিধা হলো না , সদুর মিথ্যা কথাগুলো ধরতে । সে ষ্পষ্ট অনুভব করতে পারছে , মানুষটা আসলে তার কথা ভেবেই মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে নিজে খেতে যাচ্ছে না । অযথা খুধায় কষ্ট করছে !
ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন একটা অদ্ভুত অজানা ভাল লাগা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগলো মনুর সমস্ত দেহ মন জুড়ে ।
– কিন্তুক আফনে দেরীতে গেলে কি আর খাওন পাইবাইন ?
উদ্বিগ্ন স্বরে সদুর কাছে জানে চায় মনু ।
ব্যাপারটা নিয়ে একটু শঙ্কিত বোধ করছে সদু নিজেও । ও যেখানে নিয়মিত খায় সেই সামনের রাস্তার ধারেই ফুটপাতের উপর হোটেলটা চালায় আবুর মা নামের এক মহিলা । ওটা সারাদিন খোলা থাকা কোন হোটেল না । শুধু দুপুর আর রাতে একটা নির্দিষ্ট সময় খাবার নিয়ে বসে মহিলা । যা নাকি তার বাড়ী থেকে রান্না করে আনা ! সস্তা আর ভালো মানের খাবারের কারণে এদিককার ভাসমান মানুষগুলোর কালে আবুর মায়ের রান্না করা খাবারের বিপূল চাহিদা । মানুষজন রীতিমত আগে থেকে অপেক্ষা করে থাকে তার আসার জন্য । ফলে দোকান খুলে বসার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তার খাবার নিঃশেষ হয়ে যাওয়া একটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ।
এতোক্ষনের মধ্যে তার খাবার শেষ হয়ে গেছে কিনা কে জানে – মনে মনে একথাই তখন আসলে ভাবছিল সদু যখন মনু তাকে প্রশ্নটা করলো ।
– আরে অইলে অইলো । হেইডা নিয়া তুমি ভাইবো না তো ! একদিন নাইলে অন্য কুনুহানে খায়া নিমু ! কিছু অইবো না ! কিন্তুক তুমার বাইটায় গেল কই আইজ ? ইমুন তো কুনুদিন করে না অই !
– হ বাই । আমি হেইডাই ভাতে আছি ! ছ্যামড়াডার অইলোডা কি ?
– অইবো আর কি ? অন্য কিছু না ! অর কান্দের নীচে নয়া দুইডা পপাংখা গজাইছে আর কি ! মনে অয় শহরের বাতাসে উড়ন হিগ্যা গেছে !
কেন যেন নিজের ভাই সম্পর্কে এই তির্যক মন্তব্য খুব একটা ভাল লাগে না মনুর কাছে । সাথে সাথে প্রতিবাদ করে সে ভাইয়ের হয়ে সদুর কথায় ।
-ইমুন কতা কইবাইন না যে সদু বাই ! আমার বাই উমুন না ! ওই মনে অয় কুনু ভ্যাজালে পড়ছে !
মনুর কন্ঠের উষ্ণতা সদুর কান এড়ায় না ।
– তুমি চেইতো না মনু । আমি কুনু খারাব কিছু ভাইবা কতাটা কিন্তুক কই নাই !
– না সদু বাই আফনে বুদয় ঠিকই কইছুইন ! সত্যই কয়দিন দইরা বদমাইশটার ভাব গতিক ভালা ঠেকতে আছে না বাই ! ছুডু কাল থিকাই উই একডা হারামির আড্ডি !
– আরে ইমুন কইরা কইয়ো না ! পোলাপইন মানু ! একডু শয়তানি তো করবোই !
– পোলাপাইন না ! আস্তা একটা বান্দর অইছে অইডা !
সত্যিই তখন ভাইয়ের উপর মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে মনোয়ারার । ( ক্রমশঃ )