আলোকিত এক ভোরের স্বপ্ন ( তৃতীয় পর্ব )
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
৫ .
সেই দুপুরে ইয়ার হোসেন আর ফেরেইনি ।
ওদিকে পেটের ক্ষুধায় সদুর রীতিমতন কাবু অবস্হা । তাই একসময় মনুকে প্রস্তাবটা দিয়ে ফেলল সে ।
– আর কতোক্ষণ বাইয়ের লিগা এমনে বয়া থাকবা ? তুমারও তো নিচ্চই বহুদ খিদা লাগছে !
– লাগলেই আর কি করবাম আফনেই কইন ? অই ইবলিসডা না আইলে বাড়ীতই বা যায়াম ক্যামনে ?
– তুমি চাইলে আমি তুমারে দিয়া আসবার পারি !
– আফনে ?
অনেকটা দ্বিধান্বিত শোনায় মনুর কন্ঠস্বর ।
– ক্যান আমি কানা দেইহা ডরাইতাছ বুজি ? ডরানের কিছু নাই । এদককার সবকিছু আমার এক্কেবারে মুখস্ত করা আছে । তুমি খালি তুমাগো গরডা কই হেইডা কও । তারবাদে দেহো ক্যামনে তুমারে তুমার জাগামথন নিয়া দিয়া আসি ।
– না সদু বাই , আমি জানি আফনে পারবাইন । কিন্তুক আমি নিজেই যে অহনও আমাগো গরডা চিইন্যা সারবার পারি নাই । হুদা জানি রেল লাইনের ধারে !
– ও তাইলে তো বিরাট সমুইস্যা । এই এলাকা তো কম বড় না আর ! ডান বাঁও না চিনলে দিনবর খালি আটবারই থাকবা কিন্তুক জাগামথন আর পৌচবার পারতা না !
বলে একটু থামে সদু ।
– বেলা তো গড়ায়া বিয়াল অইবার চলে ! তুমার বাই মনে অয় কুনুহানে কামের দান্দায় গুরতাছে । তুমি অহন লও আমার লগে !
– আমি কই যায়াম আবার ?
– কই আবার ? খানা খাইতে ? খিদা লাগছে না তুমার ? চলো আবুর মার হেনে যায়া দেহি কিছু মেলে নি ?
– না বাই … আফনে যায়া খায়া আহুইন যে ! আমি অই বজ্জাতডার লেগা বয়া থাহি । নাইলে হারামীডায় আয়া খুঁজবার লাগব নে !
– আরে খুঁজবো না ! আচ্ছা আমররা যাওনের সুময় কাউরে কয়া যাইতাছি ! লও অহন আমার লগে । আমার কিন্তুক মম্যালা খিদা পাইছে । কিন্তুক তুমারে রাইখা আমার যাওন অইতো না !
বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে আলগা হয়ে আসা লুঙ্গির গিঁট টাইট করে বাঁধে সদু ।
– ক্যান গো সদু বাই । আমারে ছাড়া আফনের যাওন অইতো না ক্যান ?
প্রশ্নটা হয়তো স্বাভাবীকভাবেই করে মনু । কিন্তু সেই স্বভাবীক প্রশ্নটাই কেমন যেন একটু নাঁড়িয়ে দেয় সদুকে । উত্তর দিতে পারে না সাথে সাথেই । খানিক সময় নিয়ে নিজেকে সামলে ফের মুখ খোলে সে ।
– ক্যান আবার ? একলগে এক জাগায় কাম করি । চিন পরিচয়ও ভালাই অয়া গ্যাছে ! আইজ তুমি একটু সমুস্যায় পড়ছো তো আমি ইট্টু দেখবার পারি না ?
– ও !
একটু কি হতাশ হয় মনু সদুর উত্তরে ! কে জানে ? তবে সেও আর কথা বাড়ায় না । একটু ভেবে নিয়ে রাজী হয়ে যায় সে ।
– আইচ্ছা চলেন । আমি না গ্যালে যহন আফনে যাইতেনি না তখন আর কি করবাম ! চলুইন যে !
বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় মনুও ।
খানিকবাদে ঐখানকার লোকজন বেশ অবাক হয়ে দেখে , দুটো অন্ধ মানুষ কি অদ্ভুদভাবে এগিয়ে চলেছে তাদের গন্তব্যের দিকে পরম নিশ্চিত ভঙ্গিতে ।
—————————————————- *************** ———————————————
আবুর মায়ের রাস্তার পাশের ভাতের হোটেলটা তেঁজগাও ষ্টেশনের মূল ফটক থেকে খুব বেশি দূরে না । এমনকি ওদের মতন অতি ধীর গতিতে সাবধানে পথচলা অন্ধ মানুষের জন্যও পথটা মিনিট পাঁচেকের বেশি লাগে না । ওরা যখন ঠুকঠুক করে সেই হোটেলে পৌছুল তখন আবুর মা সে দুপুরের মতন বিকিকিনি শেষ করে তার ব্যবসার জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করে দিয়েছে ।
– কি গো সদু মিঞা তুমি আইজ এত্তো দেরী করলা যে ! আমি তো মনে করছি তুমি কুন না জাগায় দাওত খাইতে গেছ গা !
সদুকে দেখে হাড়ি পাতিল গোছাতে গোছাতে বলে আবুর মা ।
– না গো খালা , আইজ ইট্টু পেরেশানীর মইদ্যে পইড়া গেছিলাম ! হের লাইগ্যা ইট্টুহানি দেরী অইল আইতে ।
– অ ! তা আইছ তো এক্কেরে শ্যাষ বেলায় । আমার সব গুছান গাছান শ্যাষ । অহনই যাইতাম গা । আর ইট্টু বাদে আইলে আমারেও পাইতা না সদু মিঞা ।
– হ খালা । তুমারে যে পামু তা আমিও ভাবি নাই ! তারবাদেও আইলাম ইট্টু ঘুরান দিয়া যামু মনে কইরা ! তা খালা তুমার খানা সব শ্যাষ অয়া গ্যাছে , না ?
– হ রে বাপ । এত্তোবেলা পরযন্ত কি থাহে ! আমি তো হারাদিনের বিজনিস করি না বাপ !
– হ । খালা তা তো জানি অই !
বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সদু ।
– আমাগো আইজ কপালই খরাপ গো ! আর কি করমু খাড়ায়া থাইকা ! তাইলে আমরা যাইগা খালা !
হতাশ শোনায় সদুর কথাগুলো ।
– আরে আইছো যহন ইট্টুহানি বয়া যাও । তারবাদে আবার আইজ নতুন মেমান লয়া আইছ ! এমনে এমনে তুমাগোরে বিদাই করতে মন চাইতাছে না ।
– তাইলে কি করমু খালা ?
– কি আর করবা ? কইলাম তো বও মেমান লয়া জুইত কইরা ! দেহি তুমাগো লিগা কিছুমিছু জাইরা পুঁছ কইরা পাই কিনা ? তা জারপুঁজ খাওন খাইতে আবার আপিত্তি নাই তো সদু মিঞার !
– কি যে কও খালা ? তুমার আতের জারা পুঁছা খাওনও আমাগো মথন মাইনষের লাইগা অমিরতি !
বিগলিত কন্ঠে বলে সদু ।
– আইচ্ছা ! আইচ্ছা ! বহ তুমরা ! আমি দেহি কি আছে ! রিজিকের মালিক তো আল্লাহ পাক , কি কও ?
– হ । খালা ঠিকই কইছেন । একদম খাঁটি কতা কইছেন ।
বিগলিত কন্ঠে সায় দেয় সদু ।
– অই ছেমড়া , কই গেলি ? এইমিহি আয় ! অগোরে দইরা বহায়া ল আগে ।
আবুর মায়ের উঁচু গলার ডাক শুনে দোকানের পেছনদিক থেকে ইয়ার হোসেনের বয়সী একটা ছেলে দৌড়ে এল । এর নাম কালাম । আবুর মায়ের হোটেলের একমাত্র কর্মচারী । আবুর মার সহকারী ।
– আল্লা সদু ভাই , তুমি আইলা কুনহান দিয়া ? দেহিই তো নাই । আহ বহ আমার আত ধইরা ।
প্রতিদিনের মত সদুকে হাত ধরে ফুটপাতে বিছানো ইট আর কাঠের টুলে বসাতে এগিয়ে যায় চটপটে স্বভাবের কালাম ।
————————————– ************* ——————————————–
খাবার সময় দেখা গেল খাবার আছে মাত্র একজনের পেটপুরে খাবার মতন । কিন্তু সেটাই অনেক যত্নে দুটি টিনের প্লেটে সমান ভাগ করে বেড়ে নিয়ে এলেন আবুর মা নিজের হাতে । এমনিতে যে কাজটা করে কালাম । কিন্তু আজ যেহেতু অন্যকোন খদ্দের নেই আর তখনও খদ্দেরদের রেখে যাওয়া প্লেট ধোঁয়া বাকী আছে – তাই কালাম ওদের বসিয়ে দিয়েই ফিরে গেছে নিজের অসমাপ্ত কাজে । যার ফলে আজ ওদের খাওয়ানোর ভার নিজের হাতে তুলে নিলেন আবুর মা ।
– যা আছে তাই তুমাগো দিলাম সদু মিঞা । ইকটু কষ্ট কইরা বাগাবাগি কইরা খায়া লও আইজকার মথন ! ইমুন টাইমে মেমান লয়া আইলা যে ফিরাইতেও শরমিন্দা লাগতাছে ।
– না ! না খালা কিছু অইতো না । আমগো অয়া যাইবো এতেই ।
– হ বাপ , বিসমিল্লাহ কইরা আরমভ কর । দেখবা ঠিক প্যাট ভইরা গেছে গা । বিসমিল্লায় অনেক বরকত রে বাপ ! অনেক বরকত ।
– তা তো ঠিকই খালা । হাজার অউক আল্লার কালাম ।
আবুর মার কথায় সায় দিয়ে খাবারের প্লেটে হাত লাগায় সদু । তার সাথে একসাথে খাবার মুখে তোলে মনুও ।
খেতে খেতে হটাৎ কররেেই সদুর মনে হয় আবুর মার কথায় খেতে না বসলেই হয়তো ভাল হত । আবুর মা নিশ্চয়ই নিজের ব্যবসার কথা ভেবেই ওকে ফেরায়নি । এমনিতে বিশ টাকা বাঁধা রেটে পেট পুরে খাওয়া যায় এখানে একজন মানুষের । বিশটাকা হিসাবে পদও খারাপ দেয় না মহিলা । একটা ছোট গুঁড়া মাছের তরকারী , যে কোন একটা ভর্তার সাথে পাতলা ডাল । তরকারী আর ডাল একবারের বেশি দেয়ার নিয়ম না থাকলেও ভাত নেয়া যায় ইচ্ছামত । যাকে বলে পেটচুক্তি !
সব মিলিয়ে বেশ পুষিয়ে যায় এখানে একজনের বিশ টাকা খরচ করে ।
কিন্তু আজ খাবার সময়ই সদু টের পেল গুড়া মাছের তরকারীতে আসলে মাছ বলতে কিছুই নেই । যা পড়ে আছে সব কাঁটা । আজ আলু ভর্তাটাও যা আছে তা বলা চলে অন্যান্য দিনের তুলনায় চার ভাগের এক ভাগ । শুধু ডালটাই পাওয়া গেল পুরা এক বাটি ভর্তি ।
নাহ , সুযোগ বুঝে আজ খালাও বেশ ব্যবসা করে নিল । একজনের মত নয় এমন পরিমান খাবার দুজনের থালায় তুলে দিল ! এখন বিল কয় প্লেটের ধরে বসে – কে জানে !
তবে সে কিছুতেই একজনের বেশি খাবারের দাম দেবে না খালাকে ! দরকার হলে ঝগড়া করবে ! টাকা তো তার এতো সস্তা না !
মুখে কিছু না বললেও খেতে খেতে সদু নিজের মনেই নিয়ে ফেলে সিদ্ধান্তটা । !
————————————————– ************* ——————————————-
– ও খালা তুমার কত ট্যাহা অইছে ?
ইচ্ছে করেই আজ গলায় খানিকটা বাড়তি জোর এনে জিজ্ঞেস করে সদু খাওয়া দাওয়া শেষ করে চলে আসার আগে । যাতে আবুর মা তার নিয়মিত খদ্দেরকে গলা কাঁটার আগে একটু চিন্তা করে !
– কিয়ের ট্যাকা গো সদু মিঞা ?
সদুর কথায় ভীষণ অবাক হয় যেন আবুর মা ।
– কিয়ের আবার ? তোমার খানার দাম কতো অইছে ?
– আরি সদু মিঞা কি কইতাছো তুমি এইসব ? আমি কি তুমার লগে আইজ বিজিনিস করছিনি ? যা তুমাগো খাওয়াইলাম হেইডার আবার দাম দিবার চাও ? আমারে কি এত্তো চামারনী ভাবলা নি ?
– কি যে কও খালা ? তৌবা ! তৌবা ! তুমারে চামারনী ভাবুম ক্যান ? তুমারে কি আমি চিনি না ?
– চিনো যহন তাইলে আর কতা বাড়াইয়ো না ! নয়া মেমান আনছো অথচ তুমাগো লাইগা কিছুই করতে পারলাম না ! অহন ট্যাকার প্যাঁচাল পাইড়া আর শরমিন্দাডা বাড়ায়ো না তো বাপ !
আরো দু একবার সাধার পরও যখন আবুর মা কোনমতেই টাকা নিতে রাজী হলো না – তখন সদু সত্যিই ভীষন লজ্জিতবোধ করলো নিজের কিছুক্ষণ আগের ভাবনার জন্য ! শুধু শুধু মানুষটাকে অযথা সন্দেহ করছিল সে । আসলেই ভিক্ষাবৃত্তি করতে করতে তার মনটাও একেবারে ছোট হয়ে গেছে !
– আইচ্ছা খালা , অহন তাইলে যাই গা । রাইতে তো আবার আইতেই আছি ।
– হ বাপ । যাও ।
বলতে বলতে ওদের সাথেই দুই কদম হেঁটে এগিয়ে আসে আবুর মা ।
– ও মাইয়া , তুমি কিন্তু আবার আইবা আমার এইহানে । খালার আতের খাওন খায়া যাইবা প্যাট ভইরা ! বুঝলা ?
শেষ কথাগুলো মনুর হাত ধরে বলে আবুর মা ।
– হ খালা । আইবাম । নিচ্চই আইবাম । আজ যাই গা খালা । আসসালামোলাইকুম ।
– ওলাইকুম সালাম । হ । মা যাও ।আল্লাহ ভরসা ।
বিদায় জানাবার পরও বেশ কয়েক মুহুর্ত অন্ধ মানুষ দুটির ঠুকঠুক করে এগিয়ে চলা পেছন থেকে তাকিয়ে দেখতে থাকে আবুর মা ।
———————————————– ************** ——————————————-
৬ .
সেদিনের ওই ঘটনার পর থেকে সদু আর মনুর সম্পর্কটা একেবারেই সহজ হয়ে গেল । বলা যায় , দুজনের মধ্যে গড়ে উঠলো দারুন এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক । কিংবা কে জানে , তাদের সম্পর্কটা পেরিয়ে গেছে বন্ধুত্বের শেষ সীমানাটুকু । যেখান থেকে শুরু হতে চলেছে অন্যরকম আবেগীয় কোন সম্পর্কের কোন গল্পগাঁথা !
যাক গে , ভবিষ্যত সম্পর্কের অবয়বটা যতক্ষণ না পরিষ্কার হচ্ছে ততোক্ষণ তা আগামীর হাতে ছেড়ে দিয়ে আমরা না হয় বর্তমানকেই বিশ্লেষণ করতে থাকি ! সেটাই আসলে আমাদের গল্পের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য যুৎসই হবে !
আজকাল আর নিজেদের জায়গায় বসে চুপচাপ ভিক্ষা করে না ওরা । ফাঁকে ফাঁকে গল্প গুজবেও বেশ মেতে ওঠে । এর মধ্যেই মনু সম্পর্কে আরো অনেক কিছুই জানা হয়ে গেছে সদুর । নিজেই আস্তে আস্তে প্রশ্ন করে সব জেনেছে সে । যেমন একদিন কথার ফাঁকে প্রশ্ন করেছিল সে মনুর বাবার সম্পর্কে ।
– তুমার বাজান কেমতে মরছে ? কত্তোদিন আগে ?
– আমার বাজানে মরছে আমাগো ইয়ার হোসেনরে ছুডু থুইয়া ! মনে অয় তহন অর চাইর পাঁচ বচ্ছর অইবো ।
– কি অইছিল তুমার বাজানের ? অসুক আছিলো নি ?
– না রে বাই ! পুরা ভালা মানুষডা রাইতে খানাপিনা কইরা পরতেক দিনের মথন গুমাইতে গ্যালো ! ওই যে গুমাইলো আর আমার বাজানের গুম শ্যাষ অইলো । আমাগো গুম ছুটল মার চিক্কুইর হুইনা ! কুন সুমে যে মানুষটার দম বাইর অয়া গেল – আমরা কেউই ঠাওর পাই নাইক্যা । বিয়ান কালে মায় উইঠা বাজানরে ডাকতে যায়া দ্যাহে মইরা ভ্যাটকি লাইগা আকড়ায়া রইছে !
বলতে বলতে শেষদিকে কান্নার দমকে কন্ঠ বুঁজে আসে মনুর ।
মনুর কন্ঠস্বরে কান্নার আভাস বুঝে তাড়াতাড়ি সেদিন কথা অন্যদিকে ঘুরিয়েছিল সদু । যদিও মনোয়ার সবকিছু জানার বিষয়ে তার ঔৎসুক্য মোটেই কমেনি । এরমধ্যেই আর একদিন সে প্রশ্ন করে বসলো মনোয়ার অন্ধত্ব সম্পর্কে ।
– তুমারে একখান কতা জিগাই যুদি কিছু মনে না লও !
– এইডা কি কইতাছুন সদু বাই ? আফনে একডা কতা জিগাইবাইন হ্যাতে আমি কি মনে করাম , কইনচে ?
– না .. জিগাইতাছিলাম আর কি …. এই যে তুমিও যে আমারই মথন চৌক্ষে দেহ না – হেইডা কি জনমের পর থিকাই ?
একটই ইতস্তত করে শেষমেষ জিজ্ঞেস করেই ফেলে সদু ।
– ও এই কতা !
বলে বুঝিবা একটা দীর্ঘশ্বাসই ছাড়ে মনু ।
– না গো বাই , আমি জনম কানা না গো ! আমি তো পাঁচ ছয় বচ্ছর তরি বেবাকই চক্ষে দেখতাম !
– কও কি ? তাইলে ?
– তাইলে আর কি ? উই যে পুড়া কপাল । হের লাইগাই তো আৎখা একদিন কাঁপাইয়া জ্বর আইলো । জ্বর খালি জ্বর ! বেদুম হেই জ্বরের সুময় শইলে চাইল ভরা পাতিল রাখলে ফুইট্টা ভাত অয়া যাইবো – ইমুন দশা ! পরথমে গেরামের মাওলানা সাবে কইল বদ বাতাস লাগছে ! ঝাঁড় ফুঁক তাবিজ কতো কিছু কইরা শইল বন্দ করল ! কিন্তু ওম্মা জ্বর তো বালা অয় না । এরবাদে আমারে নিয়া বাজান আর মায় গেল কবিরাজের কাছে ! হেই কবিরাজেও ফেল মারলো ! উইদিকে মাস কাবার অয়া আমি বলে মরতে বইছিলাম ! হুগায়া চিমসা কাটি অয়া গেছিলাম । তার উপরে আবার শুরু অইছে কয়দিন ধইরা চক্ষের ব্যাদনা । চাইলেই চোখ মরিচের মথন জ্বলে আর একদারছে পানি বায়া পড়ে !
– শ্যাষে দিশামিশা না পাইয়া বাজানে আমারে নিয়া গেল মমিসিং বড় মেডিকেলে । কিন্তুক ততদিনে সব্বোনাশ যা অওনের অয়া গ্যাছে গো সদু বাই ! চক্ষের সামনে মিসমিসা আন্দার নাইমা আসতে লাগছে তহন ! ডাকতর সাবেরা ম্যালা গাইল পাড়লো মা আর বাজানরে ! মেডিকেলে নিতে দেরী করছে দেইখা ! আমার নিকি টাইফুড অইছিল ! পয়লা দিকে নিয়া গেলে বলে কুনু ক্ষেতিই অইতো না ! শ্যাষম্যাষ যমের লগে কুসতাকুস্তি কইরা ডাকতর সাবেরা আমার জান বাচাইল ঠিকই , কিন্তু চক্ষের রোশনী আর ফিরায়া আনতে পারলো না । পেরায় তিনমাস মেডিকেলে হুইয়া থাকতে থাকতেই একদিন টের পাইলাম – আমার চক্ষের রোশনী পুরাপুরি বুঁইজ্যা গ্যাছে গা !
– মেডিকেল থিক্যা বাঁইচ্যা ফিরা আইলাম আমি আন্দা কানা অয়া গো সদু বাই ! আন্দা কানা অয়া !
নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বলতে বলতে সত্যি সত্যিই সেদিন কান্নায় ভেঙে পড়ে মনু ।
সদুও বসে থাকে নির্বাক হয়ে । মনুকে কোনরকম স্বান্তনা দেয়ার কথা মাথায়ও আসে না তার । শুধু অনুভব করে অভাগী মেয়েটার জন্য বুকের মাঝখানটায় কোন এক আশ্চর্য কারণে চিনচিন করে ব্যাথার অনুভূতি !
কেন যেন মনুর কান্মনার শব্দ মোটেও ভাল লাগে না সদুর ! কেমন যেন বিচলিত বোধ করে ! কি এক ভীষণ মায়ায় মনে হয় মেয়েটাকে নিজের বুকের মাঝখানটায় চেঁপে ধরে ওর কান্না থামিয়ে দেয় এক্ষুনি !
কিন্তু এমনটা মনে হওয়ার কারণ কি আসলে ?
এ কি শুধুই একজন অন্ধ মানুষের অন্য আরেকজন অন্ধের প্রতি কেবলই সমবেদনা ?
নাকি অন্য কোন কিছু ??? ( চলবে )