কেমন কাটছে ব্রিটেনে প্রবাসী জীবন? (পর্ব-৩)
ব্রিটেনে বর্তমানে প্রবাসী বাঙালিদের সংখ্যা ধরে নেয়া হয় পাঁচ লক্ষাধিক।২০০১ সালের আদমসুমারী ও পরিসংখ্যানে তা ছিল তিন লক্ষের উপর।এই পাঁচ লক্ষাধিক প্রবাসীর বেশির ভাগই বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি বিশেষ জেলার অধিবাসী। প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে শতকরা প্রায় আশি ভাগেরও বেশি লোক ওই অঞ্চলটি থেকে আগত।ওই বিশেষ অঞ্চলটি–বৃহত্তর সিলেট জেলা।আর সে জন্যই ব্রিটিশ বাঙালি বললে অনেকেই ‘সিলেটি’ বলে ধরে নেয়।এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসীরা বাস করছে পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হেমলেটে যা ওই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৩ ভাগ।
এই পরিসংখ্যানটা দেয়ার ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য নেই। উদ্দেশ্য একটাই। আর তা হলো ওই বিশাল বাঙালি জনগোষ্ঠীকে পাশ কাটিয়ে ব্রিটেনের প্রবাসী জীবন আলোকপাত নিরর্থকই বটে।তাই আজকের এই পর্বে থাকবে ওই আশি শতাংশ জনগোষ্ঠির যাপিত জীবন,তাদের সংগ্রাম-সাফল্য-আনন্দ-বেদনার চিত্র। একটু ঘুরিয়ে বল্লে, কেমন কাটছে ব্রিটেন প্রবাসী ‘সিলেটিদের’ জীবন?
এইটি ঐতিহাসিক ভাবেই সত্য যে ব্রিটেনে বাঙালি প্রবাসী আগমনের ইতিহাসের সাথে ‘সিলেট’ শব্দটি জড়িয়ে আছে প্রবাসীদের গোড়াপত্তন থেকেই।ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় ১৯৩০-এর দশকের দিকে জাহাজের খালাসিরা মাঝে মধ্যে জাহাজ থেকে পালিয়ে গিয়ে ব্রিটেনে থাকতে শুরু করে।আর ওই পালিয়ে যাওয়া খালাসিদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন সিলেট অঞ্চলের।সেই থেকেই তাদের যাত্রা শুরু।আর থেমে নেই।
পুরনো ইতিহাসের দিকে ফিরে না তাকালেও এখনো ব্রিটেনে প্রবাসী মানে ‘সিলেটি’ জনগণকেই বুঝায়।ব্রিটেনের যেখানেই বাঙালি প্রবাসী রয়েছে সেখানেই বৃহত্তর সিলেটের জনগোষ্ঠী নেই তা কল্পনাও করা যাবেনা।শুধু তরুণ নয়, সব বয়সের জনগোষ্ঠী সব এলাকাতেই খুঁজে পাওয়া যায়।
ব্রিটেনে প্রবাসী বাঙালিদের কৃতিত্বের প্রায় পুরোটাই দখল করে আছে সিলেটের জনগণ।বাল্যকালে যে শিশুটি বাবা-মায়ের হাত ধরে পাড়ি জমিয়েছিল ব্রিটেনে, সেই ক্ষুদে শিশুটি এখন ব্রিটেনের একজন রাজনৈতিক সেলিব্রেটি। এদের কেউ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য, কেউ নির্বাচিত সিটি মেয়র,কাউন্সিলর কেউবা সরকারী অন্য কোনো প্রশাসনিক যন্ত্রের বড় কর্তা।
সিলেটিদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত, সেলিব্রেটি এবং ব্রিটেনের মূলধারার রাজনীতিসহ স্থানীয় সরকারের উচ্চপদে আসীন অনেক মেধাবীদের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় ও মোহনীয় যে পেশার জন্যে সিলেটিরা ব্রিটেনে সর্বাধিক সুনাম অর্জন করেছে তা হলো রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। ব্রিটিশ বাঙালিদের ‘চিকেন টিক্কা মসল্লা’ এখন ব্রিটেনের ক্বারী ইন্ডাষ্ট্রীর শ্রেষ্ট আকর্ষন।ব্রিটেনে ভারতীয়দের মাধ্যমে ওই ক্বারী শিল্পের প্রতিষ্ঠা পেলেও এর প্রসার ও জনপ্রিয়তা এসেছে এই সিলেটি জনগনের একনিষ্ট পরিশ্রমের কারণেই।
যুক্তরাজ্যে বার্ষিক ৩.৬ বিলিয়ন পাউন্ডের ক্বারী শিল্পের আশি ভাগেরও বেশি মালিকানা ব্রিটিশ বাঙালি তথা সিলেটিদের হাতে। দেশটির রাজ পরিবার থেকে শুরু করে অতি সাধারণেরও রসনা বিলাসে ব্যাপক জনপ্রিয় ওই বাঙালি রেস্টুরেন্টের রকমারি খাবার।
ব্রিটিশ কারী এওয়ার্ডকে বলা হয় বাঙালির বর্ষ সেরা আয়োজন। লন্ডনে অস্কার খ্যাত ব্রিটিশ ক্বারী এওয়ার্ড এখন সিলেটি বাঙালিদের অহংকার।যা শুধু লন্ডনেই নয়, পুরো ব্রিটেন জুড়ে তাদের এই অর্জন।দশ হাজারেরও বেশি রেস্তোরাঁর মালিক বাঙালি প্রবাসীরা।আর এই মালিকদের মধ্যে সিংহভাগই সিলেটের জনগণ যেখানে প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট কর্মী কাজ করছে। তবে, ব্রিটেনে বেড়ে ওঠা নব প্রজন্মের সন্তানরা অনেকেই এই পেশা থেকে দুরে সরে যাচ্ছে। এই নিয়ে বয়োজৈষ্ঠ সিলেটিদের মধ্যে আক্ষেপও কম নয়।
কিভাবে বেড়ে উঠছে নব প্রজন্মের সিলেটি সন্তানেরা? ব্রিটেনে বেড়ে উঠা তৃতীয় প্রজন্মের সিলেটী সন্তানদের কৃতিত্ব অসাধারণ।শিক্ষাক্ষেত্রে সিলেটি ছেলে মেয়েদের অসাধারন রেজাল্ট নজর কাড়ছে ব্রিটিশ সমাজে।ব্যবসা-বাণিজ্য এবং রাজনীতিতে এ প্রজন্মের অংশগ্রহণ ক্রমশ বেড়েই চলছে।
প্রথম অথবা দ্বিতীয় প্রজন্মের সিলেটিরা পোশাক-পরিচ্ছদ, জীবনযাত্রা এবং পরিবার-কাঠামোয় রীতিমতো রক্ষণশীল।লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকায় প্রায় সব মহিলাই বোরখা পরেন।বয়স্ক পুরুষদের মাথায় টুপিও দেখা যায়।আর এই দিয়ে তাদের সহজে চেনাও যায়।
ব্রিটেনে তৃতীয় প্রজন্মের সিলেটিদের সম্পর্কে এ কথা অবশ্য প্রযোজ্য নয়। তাঁরা উচ্চশিক্ষিত- ডাক্তার, শিক্ষক, সলিসিটর, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ব্যাঙ্কার ইত্যাদি পেশায় অনেক দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। তবে এই প্রজন্মের তরুণীদের মধ্যে হিজাব ও স্কার্ফ পরিধান বিশেষভাবে লক্ষনীয়।
অতিমাত্রায় স্বাধীনতা ভোগকারী দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের সন্তানদের মধ্যে মাদকাসক্তির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।আর সেই সঙ্গে তারা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্ম কান্ডেও।তরুণরা রাস্তার মোড়ে আড্ডা দেয়। সেখান থেকেও তারা মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ছে।এই নিয়ে বাংলা পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হলেও অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয়না।
তবে সিলেট থেকে আগত সকল প্রবাসীরাই শিক্ষিত তা কিন্তু নয়।যে সকল প্রবাসীরা তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে পারিবারিক অভিবাসন আইনের আওতায় প্রতিনিয়ত তাদের সাথে যুক্ত করছে তাদের অনেকেই কম শিক্ষিত।যারা কম শিক্ষিত তাদের অনেকেই কলকারখানা, রেস্তোরাঁ বা কোনও সার্ভিস ইণ্ডাষ্ট্রিতে কাজ করেন। এছাড়াও ফাস্টফুডের দোকান, মুদির দোকান, ট্যাক্সি চালানো, পেট্রল পাম্প পরিচালনায় সিলেটি প্রবাসীদের আধিপত্য রয়েছে।
সিলেটের প্রবাসীরা উচ্চশিক্ষিত হলেও কিনবা উচ্চপদে আসীন থাকলেও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট লক্ষনীয় যে, তারা ঘরের বাইরেও নিজেদের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলতে পছন্দ করেন।তাই কখনো কখনো বাংলা ভাষা বলতে ‘সিলেটি’ ভাষাকেই বোঝানো হয়ে থাকে।এমনও দেখা গেছে ব্রিটেনের এমপি এবং মন্ত্রীরা পর্যন্ত ‘সিলেটি’ ভাষা শিখে বাঙালিদের ভোট আকর্ষণ করেন থাকেন।ব্রিটেনে অন্যান্য ভাষার সাথে ‘সিলেটি’ও আজ একটি স্বীকৃত ভাষা।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী