মুক্তি যুদ্ধের গল্প (এয়োদশ পর্ব )
রাশরার যুদ্ধ যেন আমাদের জন্য দুঃখই ডেকে আনলো । কারণ তিন জন পাক-সেনা ধরা পরায় তাদের উদ্ধার করার জন্য পাক-সেনারা প্রায় প্রতি দিন ঐ গ্রামে রেড দিতে শুরু করলো ।ফলে গ্রামের সব মানুষ ঘর বাড়ি ফেলে পালিয়ে যেতে লাগলো ।পাক-সেনারা গ্রামে অতর্কিতে হানা দিয়ে যাদের পেল তাদের ধরে নিয়ে গেল । খবর আসতে লাগলো ধৃতদের মধ্যে কাউকে কাউকে হত্যা করে ফেলছে এবং কাউকে কাউকে আটকে রেখে অত্যাচার করছে । তখন আমাদের ক্যাম্পেও খুব সন্ত্রস্ত ভাব চলছিল । আমরা তটস্থ ছিলাম এই জন্য যে, যেহেতু তিন জন পাক-সেনা আমরা গ্রফতার করেছি এবং তারা আমাদের ক্যাম্পেই আছে, সেহেতু পাক-সেনারা যেকোন সময় আমাদের ক্যাম্প আক্রমন করতে পারে ।আমাদের ক্যাম্পের নিরাপত্তা জোরদার করা হলো । কিন্তু রাশরা গ্রামে পাক-সেনাদের অত্যাচার কমছিল না । যার কারনে বাশাইল থানা ক্যাম্প আক্রমন ও দখল করা আমাদের জন্য জরুরী হয়ে দেখা দিল । কিন্তু একটি থানা সদরের সেনা ক্যাম্প আক্রমন করে দখল করার মতো শক্তি ও অস্রের সামর্থ আমাদের ছিল না । কাজেই আমাদের কমান্ডার কাদেরীয়া বাহিনীর হেড কোয়াটার সখিপুর যোগাযোগ করলেন । অবস্থার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাশাইল থানা আক্রমন করা জরুরী হিসেবে বিবেচিত হলো । অপারেশনের দিনক্ষণ নির্ধারিত হলো । সখিপুরের পশ্চিম এলাকায় তখন মুক্তি যুদ্ধাদের একটি কোম্পানী ছিল । সিদ্ধান্ত হলো ঐ কোম্পানীর যোদ্ধারা উত্তর পূর্ব দিক থেকে আক্রমন করবে । আমরা দক্ষিণ পূর্ব দিক থেকে আক্রমন করবো । পশ্চিম দিক খোলা থাকবে । যাতে আক্রান্ত হয়ে পাক সেনারা ইচ্ছে করলে পশ্চিম দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে পারে ।
এর দুটো কারণ ছিল । প্রথমত আমরা চাচ্ছিলাম পাক-সেনারা পালিয়ে চলে যাক , আমাদের বাশাইল থানা সদর মুক্ত হোক । দ্বিতীয়ত পাক-সেনারা পশ্চিম দিক দিয়ে পালিয়ে গেলে মাঠের মধ্যে ফেলে তাদের মারতে সুবিধা হবে । নির্ধারিত তারিখ রাতে আমরা চলে গেলাম বাশাইলের পূর্ব দক্ষিণ এলাকায় । পাথর ঘাটা থেকে আমরা ৩৩ নং কোম্পানী বাশাইল থানার দক্ষিণ পূর্ব দিকের থানার নিকট বর্তী বাড়ি গুলিতে পজিশন নিলাম । আশে পাশের এক কি, মি, এলাকার সকল বাড়ির লোকদেরকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলা হলো ।সবাই বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও আত্নীয় সজনদের বাড়ি চলে গেল । তোমরা শুনে অবাক হবে যে, তখন বাড়ি ঘর ছেড়ে সকলেই চলে গেলেও কোন মালামাল চুরি হতো না । চোরেরা নাহলেও অধিকাংশডাকাতই মুক্তি যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিল । উত্তর দিকের কোম্পানীর লোকেরাও পজিশন নিয়েছে বলে তাদের সাথে যোগাযোগে জানা গেল ।ভোরে যখন চতুর্দিক ফর্সা হয়ে গেল তখন গুলি বর্ষণ শুরু হলো । বিরতি দিয়ে দিয়ে গুলি বর্ষণ চলতে থাকলো । আসলে তখনতো আমাদের হাতে তেমন কোন বড় ধরনের অস্র ছিল না । আমাদের কোম্পানীর বড় অস্র বলতে একটি এল এম জি ছিল । আর তিন জন পাক-সেনা ধরে তাদের নিকট থেকে তিনটি জি থ্রি উদ্ধার করা হয়েছিল । আর অটোমেটিক হাতিয়ারের মধ্যে ছিল কয়েকটি এস এম জি, ও কয়েকটি স্টেন গান । বাকী সব রাইফেল । আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বল ছিল অদম্য সাহস এবং পরিচিত যুদ্ধ ক্ষেত্র ও জন সমর্থন ।পাক-সেনাদের জন্য অসুবিধা ছিল গন বিরুধীতা, অসহযোগীতা এবং অপরিচিত যুদ্ধ ক্ষেত্র । কাজেই সর্ব সময়ই ছিল তারা বিপদের সন্মুখীন । কোন স্থানেই তারা নিজেদের নিরাপদ মনে করতো না । দেশের অভ্যন্তরিন যুদ্ধে যদি কোন পক্ষ জন সমর্থন না পায় তাহলে তাদের পক্ষে ঐ যুদ্ধ জয়ী হওয়া এক রকম অসম্ভবই বলা যেতে পারে । কাজেই আমাদের মুক্তি যুদ্ধের সময় পাক সেনাদের পক্ষে তেমন কোন জন সমর্থন ছিল না । কোন জন সমর্থন ছিল না ই বলা যায় , কিন্তু জামায়াতে ইসলামের লোকেরা তাদের পক্ষ ছিল । ফলে কেহই তাদের পক্ষ ছিল না বলা যাচ্ছে না । কোন লোক তাদের সমর্থন ও করতো না সাহায্যও করতো না । ভোর থেকে গুলি চলতে থাকলো একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত ।পাক-সেনাদের ঝাকে ঝাকে গুলি সাই সাই করে এ পাশ ওপাশ দিয়ে চলে যায় ।
একবারও মনে হয়নি যে কোন সময় একটি গুলি লেগে যে কেহ মরে যেতে পারে ।পাক সেনারা থানার চতুর্পামের ব্যাংকার বসে বিরতি দিয়ে দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকলো । বেলা ডুবে গেল কিন্তু যুদ্ধের কোন উন্নতি হলোনা । পাক সেনারা ক্যাম্প ছেড়ে ভাগলোও না । আমাদের জন্য বিপদের রাত নেমে এল ।কারণ পাক সেনাদের জন্য ভয়ের তেমন কোন কারণ ছিল না । তারা অবস্থান করছিল ব্যাংকারে এবং তাদের অবস্থানের চতুর্পাশে সার্চ লাইট জালানো ছিল । কোন লোক থানার দিকে রওয়ানা হলে দূর থেকেই তারা দেখতে পেত । কাজেই কেহই সহজে তাদের ক্ষতি করতে পারবে এমন কোন সম্ভাবনা ছিল না । কিন্তু আমাদের জন্য ভয়ের কারণ ছিল ।যদি পাক সেনারা থানার পশ্চিম দিক দিয়ে বেড়িয়ে অন্ধকারে মিশে গিয়ে মাঠের মাঝ দিয়ে আমাদের পিছনে চলে আসে তাহলে আমাদের গুরুতর বিপদ হতে পারতো ।কাজেই আমাদের সতর্ক পাহাড়ায় থাকতে হচ্ছিল । এমনতর গুলি বিনীময়ের মধ্যেই রাত কেটে গেল ।যুদ্ধে কোন উন্নতি হচ্ছে না দেখে সখিপুর হেড-কোয়াটারে সংবাদ পাঠানো হলো । আমাদের বড় অস্রের মধ্যে সখিপুর হেড কোয়াটারে একটি থ্রি ইঞ্চ মর্টার ছিল বলে শুনেছি । কোন যুদ্ধে মুক্তি যোদ্ধারা হেড়ে যেতে থাকলে হেড কোয়াটার থেকে আমাদের অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী নিজের কোম্পানী নিয়ে বড় ধরনের অস্র সহ এগিয়ে আসতেন । বাশাইল যুদ্ধেও দ্বিতীয় দিন বিকেলে আব্দুল কাদের সিদ্দিকী এসে উপস্থিত হলেন । ঐ সময় পাক সেনারা কাদের সিদ্দিকীকে বাঘা সিদ্দিকী বলে ডাকতেন । আর বাঘা সিদ্দিকী কোন যুদ্ধে হাজির হলে সেখান থেকে পাক সেনারা পালানোর রাস্তা খুঁজতে শুরু করতেন । পরে শুনেছি পাক সেনাদের মধ্যে একটি প্রবাদ প্রচলিত হয়েছিল যে বাঘা সিদ্দিকীর গায়ে গুলি লাগে না । যাই হোক কোন না কোন মাধ্যমে রটে গেল যে বাশাইল যুদ্ধে বাঘা সিদ্দিকী এসেছে ।এই সংবাদ প্রচার হওয়ার পরে যে সকল পাক সেনা বাশাইল থানা ক্যাম্পে ছিল তারা পায়ে হেটে পালিয়ে যেতে শুরু করলো ।কাদের সিদ্দিকী সংবাদ পেয়ে তাদের পিছু ধাওয়া করলো ।কাসিল বিয়ালা পর্যন্ত পৌঁছে গুলি ছুড়ার সময় পাক সেনাদের একটি ফিরতি গুলি কাদের সিদ্দিকীর হাতে লেগে তিনি আহত হলেন । আমরা বাশাইল থানা দখল করলাম । উত্তর দিক থেকে আসা কোম্পানী বাশাইল অবস্থান করলো আমাদের কোম্পানী সকল মুক্তি যুদ্ধাদের নিয়ে পাথর ঘাটা ফিরে এলাম ।