Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

মুক্তি যুদ্ধের গল্প (শেষ পর্ব )

: | : ১৬/০৩/২০১৪

পর দিন আমাদের শহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সযবাদ এল । আমরা পাথর ঘাটা ক্যাম্প পরিত্যাগ করে মহেড়া জমিদার বাড়ি রওয়ানা হলাম ।দিন শেষে জমিদার বাড়ি পৌঁছলাম । তোমরা তো দেখনি, মহেড়া জমিদার বাড়ি প্রাচীন স্থাপত্যের একটি । শুনেছি বৃটিশ আমলে জমিদারদের বর্তমান প্রজন্মের পূবৃ পুরুষেরা পান সুপাড়ির ব্যবসা করতো । বৃটিশ সরকার যখন জমিদারী প্রথা চালু করে তখন এই পান সুপাড়ির দোকানদার কলিকাতা গিয়ে এই এলাকার জমিদারী কিনে নিয়ে আসে । কাজেই তখনকার জনগন তাদেরকে পাইনা জমিদার বলতো । যাই হোক আমরা সেই জমিদার বাড়ি গিয়ে উঠলাম । জমিদার বাড়ি রাত্রি যাপন কালে অতীত কালের স্মৃতি ভেসে বেড়াতে লাগলো মনের গহীনে । আমার পূর্ব পুরুষদের বাড়ি মহেড়া গ্রামের উত্তর পাশে গবড়া গ্রামে ছিল ।এখনও আমার দাদার ভাইদের একটি অংশ উক্ত গ্রামে বসবাস করে । কাজেই পৈত্রিক সূত্রে গবড়া মহেড়া গ্রামে পাকিস্তান আমলেও আমাদের জমি জমা ছিল । সেই জমির খোঁজ খবর নেওয়ার জন্যআমার বাবা গবড়া যেতেন । তখন মহেড়া বাজারেও যেতেন ।গবড়া হতে মহেড়া বাজারে যাওয়ার রাস্তা ছিল মহেড়া জমিদার বাড়ির সন্মুভখ দিয়ে ।শুনা যায় এক সময় ওই জমিদারেরা এমন অত্যাচারী হয়েছিল যে,সাধারন মানুষেরা জমিদার বাড়ির সন্মুখ দিয়ে জুতা পরে যেতে পারতো না । জমিদার বাড়ির কাছে পৌঁছেই জুতা খুলে হাতে নিয়ে জমিদার বাড়ি পার হয়ে পূনরায় জুতা পরে বাজারে যেত । আমি তখন ছোট ছিলাম । এক দিনের কথা আমার মনে পরে । তখন ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিক । তখন আমার বয়স আট কি দশ হবে । তখনও আমার দাদার ভাইয়েরা কেউ কেউ জীবিত ছিলেন ।আমি আমার বাবার সাথে গবড়া বেড়াতে গিয়েছি । মকালে নাস্তা খেয়ে বেড় হলাম মহেড়া বাজারে বেড়াতে যাবো বলে । বাবার পিছে পিছে হেটে যাচ্ছি । জমিদার বাড়ির কাছে গিয়ে দেখি প্রধান ফটকের দুই পাশের পিলারের উপর দুটি সিংহ বিকট আকারের হা করে দাড়িয়ে আছে ।যেন এখনই ঝাপিয়ে পরবে কারও উপর । আমিতো সিংহ দেখে ভয়ে থেমে গেলাম ।আমার বাবা বললেন – কি ব্যাপার থামলে কেন ? আমি সিংহ দেখিয়ে বাবাকে আমার ভয় পাবার কথা জানালাম । তখন বাবা বললেন- ভয়ের কিছু নেই । ওগুলো জীবিত নয় , মৃত, এবং চুন সড়কি দিয়ে তৈরী । বাবা আমাকে আস্বস্থ করলেন বটে । আমার কিন্তু ভয় কাটলো না । আমি বাবার হাত শক্ত করে ধরে সিংহ দুটির দিকে চোখ রেখে রেখে গেইট পার হলাম ।ভাবটা এই রকম যে,বাবা যা-ই বলুক না কেন সিংহ দিয়ে বিশ্বাস কি ? সিংহকে আমার উপর লাফিয়ে পরতে দেখলেই আমি এক ঝটকায় সড়ে যাব । সেদিনের কতা মনে হলে আজও হাসি পায় । জমিদার বাড়িতে সারা রাত এ সব কথা ভাবতে ভাবতেরাত কোথা দিয়ে শেষ হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না । সকালে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লাম এলাকা দেখতে । জমিদার বাড়ি থেকে পূর্ব দিকে এক কি, মি, এর কাছা কাছি দূরত্বে গিয়েই বাজার দেখতে পেলাম । বাজারটি অনেক পুরোনো । জমিদারদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠা । সারা বাজার ঘুরে একটি কালি মন্দির পেলাম । তার মাঝে একটি কালি মূর্তি দাঁড় করানো । সেটার আকার এতই বড় যে সেই চেহারার কতা মনে হলে আজও গা শিউরে উঠে । আজও মনে পরে বাবার সাথে ছোট সময় এই কালির এক হাত লম্বা লাল জিহ্বা দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম । কালির লাল চোখ আর জিহ্বা জল জল করছিল । আজও যেন সে শান্ত হয়নি । দেশের স্বাধীনতা পেয়েও সে শান্ত হতে চাচ্ছে না । একবার মনে মনে ভাবলাম, মা কালি তুই জমিদারদের অত্যাচার দেখেতো ক্ষেপে যাসনি । ৯ মাস ব্যাপী পাক সেনারা এ দেশের মানুষের এত রক্ত ঝড়ালো তাতেও তুই শান্ত হসনি? তুই কি এখনও ক্ষেপে আছিস সমাজের প্রতি ? সেদিন কালি কিছু বলেনি । সেদিনের এই আমি কি জানতাম যে , ৭১ সালের ৯ মাস ব্যাপী যারা বাঙ্গালীর রক্তে দেশ ভাসিয়ে দিল শোসকদের রক্তের নেশা তবু শেষ হবে না । আজ বুঝতে পারি কালির ক্ষোভ কেন মিটেনি । ৭১ সালের রক্ত চোষাদের বংশধররা আজও স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায় বাংলার মাটিতে । তারা নিশ্চহ্ন তো হয়ইনি বরং আরো বেশী শক্তি অর্জন করে আবার আঘাৎ হান্তে চাচ্ছে বাঙ্গালী জাতির উপর । আমরা মহেড়া জমিদার বাড়ি কয়েক দিন অপেক্ষা করলাম । এই অবস্থান কালে মহেড়া জমিদার বাড়ির আশ পাশের এলাকা ঘুরে দেখলাম ।এই জমিদার বাড়ি ঢাকা টাংগাইল মহা সড়কের পূর্ব পাশে । মহা সড়ক থেকে প্রায় তিন কি, মি, দূরে । জমিদার বাড়ির ঐ সকল স্থাপনা গুলিতে বর্তমান সরকার পুলিশ ট্রেনিং স্কুল ঘোসনা করে স্কুল পরিচালনা করছেন । এখন প্রতিদিন অনেক লোক সেখানে পিকনিক করতে যায় । অনেকেই যান প্রাচীন স্থাপনা দেখতে । আমি মহেড়া অবস্থান কালে ঐ সময় যা কিছু দেখেছি তার মধ্যে দুটো জিনিসের কথা আজও মনে পরে ।আমি স্থাপনার সব রুম ঘুরে একটি রুমে অনেক গুলো হিসাবের খাতা পেলাম । সেই হিসাবের খাতা গুলি সম্ভবত সেই যুগের দোয়াতে কলম ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে লিখিত । কিন্তু দেখার বিষয় হলো এই যে, আমার এই সারা জীবনে আমি আর কোন দিন এমন সুন্দর লেখা দেখিনি । জমিদার বাড়ির দক্ষিণ পশ্চিম পাশে অবশ্য দক্ষিণ পাশেই বলা যায় , একটি পুকুর আছে । সেই পুকুরের উত্তর পশ্চিম কোণে একটি দোচালা চোট টিনের ঘরে একটি মিষ্টির দোকান ছিল । একদিন হাটতে হাটতে সেই দোকানে গিয়ে দুটি মিষ্টি খেলাম । সন্দেসকে কোন কোন এলাকায় মন্ডা বলে । সেই সন্দেসের সাধ আমি আজও ভুলতে পারিনি ।শুধু আমি নই , সকালে নাস্তা শেষে দেখা যেত প্রায়সকলেই সেই ঘরে সন্দেস খেতে যেতেন । আজকের মিষ্টি আর সেদিনের মিষ্টির মধ্যে যে কতটা পার্থ্যক্য তা যারা দুই যুগের মিষ্টি না খেযয়ছে তারা বুঝতে পারবেন না । তোমরা যদি চাও তাহলে তোমাদের একদিন মহেড়া জমিদার বাড়ি দেখাতে নিয়ে যাবো ।

আমরা কয়েক দিন থাকলাম মহেড়ায় ।১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো । এর মধ্যে আমরা টাংগাইল জেলা সদরে চলে গেলাম । জেলার কার্যক্রম চালানোর জন্য সকল স্থাপনা তখনও তৈরী হয়নি । আমরা নতুন তৈরী জেলা পুলিশ লাইনের বিল্ডিং এ থাকতে শুরু করলাম । তিন বেলা খাওয়া আর ঘুরে বেড়ানো ।সারা টাংগাইল শহরে কোথায় কি আছে ঘুরে ঘুরে দেখা । একদিন কি যে এক বিপদে পড়লাম । তোমরা শুনলে অবাকও হবে আবার হাসবেও ।একদিন আমি ও আমার সাথে আর এক মুক্তি যোদ্ধা হাটতে হাটতে নতুন জেলা শহরের উত্তর পার্শে নতুন নির্মিত পানির ট্যাংকীর নিকট গেলাম । মাথায় ভুত চাপলো । ইচ্ছে হলো ট্যাংকীর উপরে কি আছে দেখতে । দুজনে উপরে উঠতে থাকলাম । আমি আগে অপর জন পিছে । ঘুড়ানো সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে একদম উপরে ট্যাংকীর নিচ পর্যন্ত উঠে গেলাম । তার পর ট্যাংকীর পেট বেয়ে অনুমান ২০ ফুট লোহার মই । ট্যাংকীর উপরে কেমন সেটা দেখতেই আমি উঠেছি । কাজেই ওখান থেকে ফির কি করে । উঠতে শুরু করলাম । আমি আগে আগে উঠি আর আমার পিছনের ছেলেটি পিছন পিছন উঠতে উঠতে একদম ট্যাংকীর উপরে উঠে গেলাম ।ট্যাংকীর ভিতর কেমন তাকিয়ে দেখলাম । এখন নামার পালা । এতক্ষণ বেশ ফুর্তিতেই সব কিছু দেখছিলাম । কিন্তু যখনই নিচের দিকে তাকালাম তখনই বুকটা যেন কেঁপে উঠলো । আম আমার সাথের লোকটিকে বললাম নাও তুমি আগে আগে নামতে শুরু কর । তখন সে মইয়ের মধ্যে এক পা দিয়েই আবার উঠে এলো এবং বলতে লাগলো সে নামতে পারবে না । আম তাকে যতই তাড়া দেই সে তাড়া খেয়ে শেষে কাঁদতে লাগলো । নচের দিকে তাকানোর পরে আমারও কিছুটা চন্তিা হচ্ছিলো ।আসলে মইটির মাঝে ছিল জোড়া লাগানো । উঠার সময় উপরের দিকে চেয়ে চেয়ে উঠেছি খেয়াল করিনি । মইটির মধ্যে ১/২ হাত নামার পরই মইটি বাহিরের দিকে হেলে যাচ্ছিল ,যেন ছিটকে পরে যাবো । আমার সাথীর কাঁন্না দেখে চিন্তা কিছুটা বেড়েই গেল ।এদিকে সূর্য আস্তে আস্তে পশ্চিম আকাশ ছেড়ে পালাতে শুরু করলো । ভবাবলাম নামতেতো হবেই । নইলে যে বাতাস আর রাতে যে রকম শীত পড়বে তাতে মৃত্যু অনিবার্য ।তাছাড়া আমরা এখানে এসেছি তাতো কেউ জানেই না । কেহ আমাদের সাহায্য করতেউ এগিয়ে আসবে না । কাজেই যে করেই হোক নামতেতো হবেই । আমি নামতে শুরু করলাম । আমি মইয়ের তিন পায়া নেমে দাঁড়ালাম । আমি দুই হাত দিয়ে মইয়ের দুই পাশের লোহার বার ধরে হাত লম্বা করে দাঁড়ালামএবং আমার সাথের ছেলেটিকে আমার বুকের কাছে যে খোলা জায়গা হলো সেখানে নামতে বললাম । আসলে সে পরে গেলে আমি হয়তো ধরে রাখতে পারবো না, কিন্তু আমি ভাবছিলাম যে করেই হোক তার মনের মধ্যে সাহস তৈরী করতে হবে । আমি তাকে সাহস দিলাম , “তুমি তো আমার বুকের মধ্যেআছ । পরে গেলেআমি তোমাকে ধরবো । কাজেই পড়ার কোন উপায় নেই ।“এই যুক্তিতে তার মনের মধ্যে একটু সাহস এল বলে মনে হলো । সে আমার দিকে পিছন ফিরে দুই হাত দিয়ে মইয়ের বাট ধরে দুই পা আস্তে আস্তে নামীয়ে দিল । আমি তাকে বললাম- নিচের দিকে তাকিয়োনা । উপরের দিকে তাকিয়ে নামতে থাকো । আমি এক পায়া নামী সেও আমার দুই হাতের বিতরে মইয়ের সাথে লেপটে এক পায়া নামে । এভাবে মইয়ের অর্ধেক নেমে এলাম । তখন মই বাইরের দিকে হেলে যেতে থাকলো । মনে হচ্ছিল ছিটকে পরে যাবো । তখন ঝড়ো হাওয়া বইছিল । মইটি একবার বাইরের দিকে যায় একবার ট্যাংকীতে বারি খায় ।

অবস্থা এমন যে মনে হতে লাগলো ৯ মাস যুদ্ধে মারা গেলাম না এবার বুঝি বোকামীর জন্য মারা যাবো ।তবু আমার সাথের ছেলেটিকে উচ্চ স্বরে সাহস দিতে থাকলাম । কারণ সে যদি হাত পা ছেড়ে দিয়ে পরে যায় তাহলে আমিও পরে যাবো । এবং মারা যাবো । এক পা এক পা করে নামতে থাকলাম ।এক সময় দেখলাম আমাদের পা সিড়ির মধ্যে ঠেকে গেছে । তখন মনে হলো এবারের মতো আমরা বেঁচে গেলাম । খোদাকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা হাটতে হাটতে পুলিশ লাইন ব্যারাকে পৌঁছে গেলাম । দিন তারিখ মনে নেই , কয়েকদিন পরে আদেশ হলো অস্র জমা দিতে হবে । আমরা কাদেরীয়া বাহিনীতে যত যোদ্ধা ছিলাম নিজ নিজ হাতিয়ার গুলি নিয়ে বিন্দু বাসিনী মাঠে জমায়েত হলাম এবং নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের নিকট অস্র গুলি জমা দিয়ে খুশীর দোলায় দোলতে দোলতে স্বাধীন জন্ম ভূমির স্বচ্ছ বাতাস খেতে খেতে বাড়ি চলে এলাম । এভাবেই আমার মুক্তিযোদ্ধা জীবনের সমাপ্তি ঘটলো ।

—-০——-

 

 

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top