মন চলে যায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে (পর্ব-১)
যারা ভ্রমণ কাহিনী লেখেন তাদের ভ্রমণে যাওয়ার প্রস্তুতিই থাকে ভিন্ন রকম। সাথে রাখেন ডায়েরি অথবা নোটবুক ও কলম। যা দেখেন তা ঐ ডায়েরিতে সাংকেতিক ভাষায় লিখে রাখেন। আর যারা প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী তারা অনায়াসেই হৃদয়ের হার্ডডিস্কে জমা করে রাখতে পারেন। আমি অবশ্য ভ্রমণ কাহিনী লিখতে পারি না, তবুও লেখার চেষ্টা করছি।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোন এক কবিতায় বলেছিলেন, ‘বিপুল এই পৃথিবীরে কতটুকু জানি’ সত্যিই আল্লাহর দেয়া এই সুন্দর পৃথিবীকে আমরা কতটুকুইবা জানি। পাহাড়, পর্বত, গাছ-পালা, নদী-নালা, গ্রহ-তারা, বন-বনানী, আর আদিগন্ত শ্যামলের এই পৃথিবীকে তিনি যেমন অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি বানিয়েছেন, তেমনি করেছেন রহস্যের এক মায়াবী লোক।
আমাদের প্রিয় দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের অপরূপ সৌন্দর্যের সাথে অন্য কোন দেশের তুলনা হয় না। বাংলাদেশের তুলনা বাংলাদেশ নিজেই। এ যেন সবুজ চাদরে আবৃত একটি দেশ। সুজলা সফলা শস্য শ্যামলা সোনার বাংলাদেশের অতুল সৌন্দর্যে লাবন্যমন্ডিত একটি জেলার নাম কক্সবাজার পর্যটন জেলা। দেশী-বিদেশী সকল পর্যটকদের জন্য এটি একটি আকর্ষণীয় স্থান। প্রতি বছর সমুদ্র সৈকত দেখতে শীত মৌসুমে আসেন লাখ লাখ পর্যটক। সুদুর আমেরিকা, ইউরোপ থেকেও পর্যটকরা এখানে আসেন। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত। এর দৈর্ঘ্য ১৫৫ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম শহর থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ১৫৩ কিলোমিটার। পর্যটকদের নিকট আকর্ষনীয় জায়গাটি মাইলের পর মাইল বালুকাময় সৈকত, ঝিনুক, বৈচিত্র্যময় প্যাগোডা রাখাইন উপজাতিদের অভিনব জীবন যাত্রায় পূর্ণ। ঘন সবুজ পাহাড় ঘেরা এই শহর একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রও বটে। কক্সবাজারের আয়তন ২,৪৯২ কিঃ মিঃ এই কক্সবাজার জেলায় চাষ করা হয় লবণ, তরমুজসহ আরো অনেক কিছু। দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদনের কেন্দ্র হচ্ছে কক্সবাজার। এর মধ্যে চকোরিয়াও পেকুয়া উপজেলায় লবণের চাষ বেশি করা হয়। সনাতন ও পলিথিন দুই পদ্ধতিতেই লবণ চাষ করা হয়। বর্তমানে কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় ৪২ হাজার একর জমিতে পলিথিন পদ্ধতিতে লবণ চাষ করা হচ্ছে। কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, চকোরিয়া, কুতুবদিয়া, রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও পেকুয়া এই ৮টি উপজেলা নিয়ে গঠিত কক্সবাজার জেলা। এটি নাফ নদী ও মাতামুহূরী নদীর তীরে অবস্থিত। এর পূর্ব নাম ফালকিং। এর ইতিহাস বড়ই চমৎকার। ১৭৯৭ সাল। তখন এই দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকাল। তখন বার্মার আরাকান অঞ্চলে গন্ডগোল দেখা দিলে বাঙালিদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। এই বিতাড়িত ছিন্নমূল বাঙালিরা তখন বর্তমান কক্সবাজার, উখিয়া এলাকায় এসে আশ্রয় নেয়। তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কক্স নামে একজন দূত বার্মার রাজদরবারে কাজ করতেন। তিনি কোম্পানির নির্দেশে এখানকার শরণার্থীদের তদারকের জন্য কক্সবাজার ছুটে আসেন। তখন এ অঞ্চলে দেখা দেয় মহামারী। মশা, মাছির কামড় ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। এমন দুর্যোগের দিনে ক্যাপ্টেন কক্স শরণার্থীদের ফেলে চলে যাননি বরং তাদের সঙ্গে কাজ করে গেলেন। ১৮০২ সালে ক্যাপ্টেন কক্স মারা যান। তখন তার নামানুসারে ফালকিং এর পরিবর্তে ‘কক্সবাজার’ নামকরণ করা হয়।
১৯৯৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নরসিংদী সরকারি কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শিক্ষাসফরে যাওয়ার জন্য একটি বাস উপহার দেন। সেই বাসে চড়ে ১৭ নভেম্বর ২০০৫ সাল রাত ১০:৩৫ মিনিটে বিরল সৌন্দর্যের এই জনপদ কক্সবাজারের উদ্দেশ্য নরসিংদী ত্যাগ করছি। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে কক্সবাজার, সাফারী পার্ক, টেকনাফ ও বাংলাদেশের শেষ সীমানা এবং একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন যাব। ৫দিনের এই শিক্ষা সফরের আয়োজন করে নরসিংদী সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ। আমরা সকল শিক্ষাবর্ষের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও স্টাফসহ মোট ৫২ জনের সফর কাফেলা। এর মধ্যে ২৬ জন ছাত্র, ১৬ ছাত্রী, ২ জন স্টাফ, ৪ জন শিক্ষক। শিক্ষকদের মধ্যে অত্র কলেজের উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী স্যার ও তাঁর স্ত্রী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আবদুল মান্নান খাঁন ও তাঁর স্ত্রী, প্রভাষক আবু ইব্রাহিম মোঃ নুরুল হুদা স্যার ও তাঁর ছেলে অন্তু এবং স্ত্রী ও গেষ্ট টিচার মোশারফ হোসেন স্যার।
[নরসিংদী সরকারী কলেজ ভ্রমণ বাস। যা ১৯৯৪ সালে তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া উপহার দেয়।]
আমাদের বাসটি কাঁচপুর হয়ে ৯৩০ মিঃ লম্বা মেঘনা গোমতী সেতু পার হয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে কুমিল্লার দিকে। আর এদিকে বাসের ভেতর শুরু হয়েছে পাঁচমিশালী গানের আসর। যে যেই গান পারে সে সেই গান গাইছে। আজ যেন ছাত্র-শিক্ষক কোন ভেদাভেদ নেই। সবাই যেন আজ বন্ধু। বাসের ঝাকুনির তালে তালে আমরা নাচে গানে মেতে উঠলাম। শ্যামল ভাই, খাইরুন নাহার, জুয়েল, মিথুন, সোহেল ভাই ও আকরাম ভাইয়ের গানের সুরের মুর্ছনায় কখন যে বাস কুমিল্লায় এসে গেল টের পেলাম না।
কিছুক্ষণ পর পাদুয়া বাজার নুরজাহান হোটেলের সামনে আমাদের বাসটি থামল। তখন রাত ১টা বাজে। নুরুল হুদা স্যার আমাদেরকে বলে দিলেন ফ্রেশ হয়ে এখানে কিছু খেয়ে নেয়ার জন্য। আমরা সবাই বাস থেকে নেমে হোটেলে প্রবেশ করলাম। খুবই উন্নতমানের থ্রীস্টার হোটেল। হাত মুখ ধুয়ে আমি ও আমার বন্ধু নিশিথ এক সাথে বসলাম। এখানে প্রতিটা টেবিলে খাবারের দামসহ মেনু দেয়া আছে। এই হোটেলের সবচেয়ে সস্তা খাবার হচ্ছে নানরুটি। দু’জনে দুটি স্পেশাল নান রুটি নিলাম। সাথে ভাজিও নিলাম। বিল হয়েছে ৬০ টাকা। এখানে এক ঘন্টা ১৫ মিনিট যাত্রা বিরতির পর ২:১৫ মিনিটে আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করলাম। বাসের ভেরত আবার শুরু হলো গান, কৌতুক, হৈ হুল্লোর। গান গাইতে গাইতে এক সময় আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। সবার চোখেই ঘুম আসছে। কেউ ঘুমাচ্ছে আবার কেউ মৃদু স্বরে গান গাইছে। কিছুক্ষণ পর পর নুরুল হুদা স্যার আমাদেরকে হ্যান্ড মাইক দিয়ে ডেকে সজাগ করে দিচ্ছে আর মজার মজার কথা বলে হাসাচ্ছেন। রাত ৩টায় আমাদের বাসটি ফেনীতে পৌঁছে। ভোর ৪টায় সীতাকুন্ডে পৌঁছে। এখানে ৫ মিনিট যাত্রা বিরতীর পর আবার যাত্রা শুরু করলাম। ৫টায় চট্টগ্রাম আসি। ৫:২০ মিনিটে স্টেশন রোডে হোটেল মিসকাহতে আমরা উঠি। সকালের নাস্তা ও রেস্ট নেয়ার জন্য এই হোটেল ভাড়া নেয়া হয়। কিন্তু আমরা এসে দেখি এখানে কোন খাবার তৈরি হয়নি। স্যারদের রাগারাগিতে এক পর্যায়ে তারা রান্নার কাজ শুরু করে। তাড়াহুড়ো করে হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে ৬:৩০ মিনিটে আধা কাচা সেদ্ধ তরকারি ও পাউরুটি এনে দিল। এক দিকে খাবার দিলে অন্য দিকে দিচ্ছে না। নাস্তার পর চা দিল, চা নয় এ যেন পুকুরের গোলা পানি গরম করে দিল। এভাবে কষ্ট করে কোন মতে নাস্তা করে এখান থেকে বিদায় নিলাম।
ইতোমধ্যে বাসে আমাদের ১দিন চলে গেল। ১৮ তারিখ ৭:১০ মিনিটে বাসটি কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। বাসটি চট্টগ্রাম শহরের উপর দিয়ে যাচ্ছে। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হয়ে কর্ণফুলী নদীর উপর দিয়ে কর্ণফুলী রেল সেতু পার হয়ে যাচ্ছে। এদিকে বাসের ভেতর শুরু হয়েছে প্যারোডি গানের আসর। প্রথমে উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী স্যার চারটি প্যারোডি গান গাইলেন।
প্রথমটি হলো- ‘মরি হায়রে হায় দুখে পরান যায়, দিবা নিশি জ্বইলা মরি বউয়ের যন্ত্রণায়, মরি হায়রে হায়…।’
দ্বিতীয়টি হলো- ‘এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না…।’
তৃতীয়টি হলো- ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছাইয়া দেরে তুই আল্লাহ…।’
সর্বশেষ গানটি হলো- ‘সোসিওলজি ক্লাসে দেখ…।’
তারপর পর্যায়ক্রমে খাইরুন নাহার, মিথুন, নিপা, শ্যামল ও আকরাম ভাই গান গাইলেন। পরে আবার মোহাম্মদ আলী স্যার গান গাইলেন- ‘আকাশের হাতে আছে এক রাশ নীল, বাতাসের আছে কিছু গন্ধ…।’ ‘নানীগো নানী আমারে নী লইয়া যাইবা ভাইসাবের বাড়ি…।’ ‘কাউয়া ধান খাইলরে খেদাবার মানুষ নাই, খাইবার বেলা আছে মানুষ কামের বেলা নাই…।’ এ গানটি যখন স্যার গাইলেন আমার তখন শিশুকালের কথা মনে পড়ে গেল। একদিন আম্মা ধান রোদে শুকাতে দেয়। আমাকে কাক তাড়ানোর জন্য বসিয়েছিলেন। তখন আমি এই গানটি গাইছিলাম।
এভাবে স্যার পর পর তিনটি গান গাইলেন। মুহূমুহূ করতালির মাধ্যমে স্যারকে আরো গান গাওয়ার জন্য উৎসাহ দেয়া হল। ইতোমধ্যে আমাদের বাসটি চট্টগ্রামের পটিয়া থানায় পৌঁছল। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছি। রাস্তার দু’পাশে সবুজ গ্রাম, সারি সারি তাল গাছ। নাম না জানা অসংখ্য গাছ, সবুজ ধান ক্ষেত। মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে বাসটি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। আর মন ব্যাকুল হয়ে উঠছে কখন কক্সবাজার এসে পৌঁছব। লোহাগড়া থানায় এসে বাসটি যাত্রা বিরতী নিল।
সকাল ৯:৪০ মিনিটে আমরা কক্সবাজার জেলায় প্রবেশ করি। চকোরিয়া হয়ে বাসটি এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দু’পাশে ছোট ছোট সবুজ পাহাড়, আকাশি, শিশু, মেহগনি, ঝাউগাছসহ নানা প্রকার গাছে পাহাড় ভরপুর। পাহাড়ের উপর ছোট ছোট কুড়েঘর। এসব দৃশ্য আমি মুগ্ধ নয়নে দাঁড়িয়ে দেখছি। আঁকাবাকা, উচ-নিচু রাস্তা পার হয়ে বাসটি শো শো আওয়াজ করে সমুদ্র সৈকতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ১০:৫৫ মিনিটে বাসটি হঠাৎ হোটেল ‘অবকাশ’ এর সামনে থেমে গেল। তখন বুঝতে পারলাম আমরা কক্সবাজার এসে গেছি। বামদিকে তাকিয়ে আমরা বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত দেখতে পেলাম। তখন আমরা সবাই বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে সাগরকে স্বাগতম জানালাম। এখান থেকেই আমরা সাগরের গর্জন শুনতে পেলাম।
নুরুল হুদা স্যার আমাদেরকে বললেন এখন রূমে গিয়ে রেস্ট নেয়ার জন্য। বিকেল ৪:৩০ মিনিটে সী-বীচে যাবে। বাস থেকে নেমে আমি, হাফিজ, জুবায়ের ও নিশিথ এই চারজন এক রুম নিলাম। আমাদের রূম নম্বর ১৮। রুমে এসে গোসল করে নিলাম। গত রাতে বাসে একটুও ঘুমাতে পারিনি। এখনও চেষ্টা করছি ঘুমাতে কিন্তু ঘুমাতে পারি নাই। ঘুম যেন ভূতের মতো পালিয়েছে। কখন সমুদ্র সৈকতে যাব সে অপেক্ষায় রইলাম। দুপুরে হোটেল অবকাশ আমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করল। দুপুর ১টায় আমরা খেতে যাই। আমাদের খাবার দেয়া হল কিন্তু খাবার এতই নিম্নমানের যে যা খাবার অযোগ্য। আমাদেরকে এমন একটি লবণ দেয়া হল যা আমাদের এলাকায় গরুও খায় না। অথচ এখানে লবণ চাষ করা হয়! আমাদের স্যাররা এ খবর পেয়ে সাথে সাথে ডিসির নিকট ফোন করেন। কিছুক্ষণ পর মোবাইল কোর্ট এসে তাদেরকে ধরে নিয়ে যায়। স্যাররা সিদ্ধান্ত নিল এখানে থাকবে না। সকালে অন্য হোটেলে চলে যাবে।
চলবে…