মানুষ হত্যার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়েছে যে গান!
সময়কাল ১৯৩২ এর ডিসেম্বর। ফ্রান্সের প্যারিসে রেসজো সেরেস নামে এক হাঙ্গেরিয়ান ছেলে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলো সুরকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্টিত করতে। কিন্তু তার প্রতিটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছিল নিদারুণভাবে। তার সুরারোপিত প্রতিটি গান ফ্রান্সের সংগীত প্রকাশকদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছিলো। কিন্তু সেরেস তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ছিলেন দৃঢ প্রতিজ্ঞ। সে যেন প্রতিজ্ঞা করেছিল, তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গীতিকার হতেই হবে। সেরেসের প্রেমিকা সেরেসের এই অতিউচ্চাকাঙ্খী কিন্তু অনিশ্চিত জীবন নিয়ে চিন্তিত ছিল। সে চাচ্ছিলো সেরেস যেন কোন একটা চাকরি জুটিয়ে নেয়। কিন্তু সেরেসকে তার লক্ষ্য থেকে টলানো গেল না। সে গীতিকারই হবে, অন্য কিছু নয়। কিন্তু ভাগ্য সেরেসের সহায় ছিল না। একদিন দুইজনের মাঝে তুমুল ঝগড়া হলো ও একে-অন্যর কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেল। দিনটি ছিল শনিবার।
রবিবার সেরেস তার এপার্টমেন্টের জানালার কাছে বিষণ্ণ সুরে পিয়ানো বাজিয়ে যাচ্ছিলো। বেদনাচ্ছন্ন সে সুর যেন প্যারিসের আকাশে প্রতিধ্বনি তুলে হারিয়ে যাচ্ছিলো দিগন্তে। একটু পরেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেল আর ঝুম বৃষ্টি নামলো। আপনমনেই সে বলে উঠলো, “কি বিষণ্ণ এই রবিবার দিনটি!” সে প্রেমিকার চলে যাবার বেদনা আর প্রকৃতির বিষণ্ণ রূপ নিয়ে যে সুরটি বাজাচ্ছিল, হঠাৎ নিজ মনেই বলে উঠলো, ” হ্যাঁ, আমার এই নতুন গানের শিরোনাম হবে- ‘The Gloomy Sunday’!” সে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলো। দ্রুত একটি কাগজে পেন্সিল দিয়ে তার নতুন সৃষ্ট গানের নোট তুলে রাখলো। ত্রিশ মিনিট পর তার গানটি লেখা সম্পূর্ণ হলো।
এবার সেরেস তার সুরারোপিত গানটি একজন সংগীত এলবাম প্রকাশকের কাছে পাঠালো ও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলো। কয়েকদিন পরে তার কাছে একটি চিঠি আসলো। এতে ছিল তার লেখা সেই গানের কপি, আর একটি নোট। নোটে প্রকাশক লিখেছেন, ” আপনার গানটি বেশ ভিন্ন ধরণের। কিন্তু এর সুর ও ছন্দ খুবই বিষণ্ণ। আমরা দুঃখিত আমরা এটি ব্যবহার করতে পারছি না।”এরপর সেরেস গানের কপিটি আরেকজন প্রকাশকের কাছে পাঠালো। এবার এটি গৃহীত হলো। শুধু তাই নয়, সেই প্রকাশক বললেন, খুব শীঘ্রই গানের কপি পৃথিবীর সব বড় শহরে বিক্রির ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেরেস ছিলেন খুব উচ্ছ্বসিত।
কিন্তু Gloomy Sunday প্রকাশিত হবার কয়েক সপ্তাহ পরেই বিভিন্ন স্থান থেকে বেশ কিছু অদ্ভুত ঘটনার কথা শোনা যেতে লাগলো। যেগুলো ঘটার জন্য দায়ী করা হচ্ছিলো এই গানটিকেই। জার্মানির বার্লিনে এক তরুণ গায়ককে এক অনুষ্ঠানে এই গানটি গাইবার অনুরোধ করা হয়। গায়ক গান গেয়ে অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরে যান এবং একটি রিভলভার মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তার আত্মীয়রা অভিযোগ করে, গায়কটি Gloomy Sunday গানের সুরের কারণে বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলেন এবং এটি থেকে আর বের হয়ে আসতে পারেন নি। যার ফলাফল তার আত্মহত্যা। এর এক সপ্তাহ পর বার্লিনেই এক দোকানে কর্মরত এক মেয়েকে তার ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। যে পুলিশ সদস্য তদন্ত করেছিলেন, তিনি মেয়েটির ঘরে সেই Gloomy Sunday গানের একটি কপি খুঁজে পান। এঘটনার মাত্র দু’দিন পর নিউ ইয়র্কের একজন ব্যক্তিগত সচিব কাম টাইপিস্ট আত্মহত্যা করেন। মেয়েটি তার সুইসাইড নোটে লিখেছিল যে, তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যেন Gloomy Sunday গানটি বাজানো হয়। এক সপ্তাহ পরে ৮২ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তি তার পিয়ানোতে একই গান বাজানোর পর ৭০ তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। একই সময়ে, ইতালির রোমে এক কিশোর এই বিষণ্ণ গানটি শুনে একটি ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
এবার সারাবিশ্বের সংবাদপত্রগুলোতে একের পর এক মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে, যেগুলোর প্রতিটির সাথে জড়িয়ে ছিল সেরেসের Gloomy Sunday র নাম। একটি সংবাদে উত্তর লন্ডনের এক ভদ্রমহিলার কথা বলা হয়, যার বাড়ি থেকে উচ্চস্বরে টানা ৭৮ বার এই গানটি বাজানো হয়। প্রতিবেশীরা ক্ষুব্ধ ও ভীত হয়ে যখন বাড়ির দরজা ভেঙ্গে প্রবেশ করলেন, তখন তারা দেখলেন মহিলাটি অতিরিক্ত বারবিচুরেট সেবনের ফলে নিজের চেয়ার মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন, আর পাশেই বেজে চলেছে সেই বিষণ্ণ গানটি। অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে দেখে বিবিসি’র কর্তাব্যক্তিরা গানটির প্রচার নিষিদ্ধ করে দেয়। এছাড়া ফ্রান্স ও আমেরিকাতেও গানটি নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়।
ফ্রান্সে ফিরে যাওয়া যাক। গানটির স্রষ্টা সেরেস তার প্রাক্তন-প্রেমিকাকে চিঠি লিখলেন যাতে তাদের সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু এবার সেরেসের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ সংবাদটি অপেক্ষা করছিল। পুলিশ জানায় তার প্রিয়তমা বিষপানে আত্মহত্যা করেছে। আর মেয়েটির পাশেই পড়েছিল Gloomy Sunday র একটি কপি! ১৯৬৮ সাল, এবার সেরেস নিজেই আত্মহত্যা করেন।
গানটির মূল কপি এখনো ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। গানটি কি অভিশপ্ত? প্রশ্নটি গানটির শ্রোতাদের জন্যই তোলা থাকলো।