Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

উটন দাদুর কাহিনী–পর্ব-৭(শিশু ও কিশোর বনজঙ্গলের রোমাঞ্চকর উপন্যাস)

: | : ২৬/১০/২০১৩

(৩)

মানচিত্র

কাসনি গ্রামের মানচিত্র দেখছিল উটন। নেচু তখনও ঘুমাচ্ছে। বেচারা বড় বাঁচা বেঁচে গেছে। ওষুধ নেবার পরেও ঘুমের মধ্যে যন্ত্রণায় উঁ,আঃ করছে। উটনের নিজের হাতে বানানো মানচিত্র। কাসনি গ্রামে যাবার পথের নকশা,দুগ্গল রাম তাকে যেমনটি বর্ণনা দিয়ে ছিল।

দুগ্গল সব কথা জানে–ওরা ক’জনে নাকি কাসনি গ্রামের অভিযানে একবার বেরিয়ে ছিল। সে গ্রাম আর তারা দেখতে পায় নি। পারে মাত্র নৌকো ভিড়িয়ে ছিল। অমনি নাকি কাসনি গ্রামের নরখাদকের দল ওদের দিকে তেড়ে এসেছিল। তাদের হাতে ছিল মাটির বড় বড় ঢেলা,আর পাথরের তৈরি ছুরি, দাও–বিচিত্র আকৃতির আরও সব নতুন ধরনের হাতিয়ার।

সেখানকার সব উলঙ্গ লোকেরা তাদের দেখে উচ্চ স্বরে চীৎকার করে চলেছিল। ওরা দুগ্গুদের নৌকার দিকেই ছুটে আসছিল। কেউ কেউ নাকি নদীর পারের কাছে এসে জোরে জোরে লাফঝাঁপ করে নাচানাচি শুরু করেছিল। দুগ্গুর মনে হয়েছিল,মানুষের মাংস খেতে পারবে বলে নরখাদকরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল! অনেক দিন পর পর্যাপ্ত মাংসের লালসায় ওরা নেচে উঠে ছিল। এই দুগ্গুর কথা থেকেই উটন দাদু সব কিছু জেনে ছিল। ওর কাছ থেকেই জেনে জেনে সে তৈরি করেছে এই হাতে রাখা মানচিত্র।

উড়ালী নদীর রেখা এঁকে বেঁকে চলেছে সমস্ত ম্যাপ জুড়ে–দু ধারে জঙ্গল আর জঙ্গল–ম্যাপে তা লেখা আছে। আর ম্যাপের পাতাতেই ছোট ছোট নোট করে লেখা ছিল অনেক সতর্কতা,যাতায়াতের অনেক নির্দেশাবলী। এক রাত পেরিয়ে নদী পারের জঙ্গলের বদলে দেখা যায় বালি আর বালি–নদীর দু পার ধরে অনেকখানি জাগা নিয়ে বিস্তৃত এই বালুচর।

এই বালিচরেও নাকি দুগ্গল তার নৌকো ভিড়িয়ে ছিল। তীরে এসে দাঁড়িয়ে ছিল কোন লোকালয়ের খোঁজ করতে। চারিদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ দুগ্গলের চোখে পড়েছিল অনেক,অনেক দূরে খুব ছোট ছোট দু একটা ঘরের আকৃতি। দূরের ঝাপসা দৃষ্টিতে খেলার পুতুলের মত মনে হচ্ছি সেগুলিকে। দুগ্গলের  প্রধান অভিযান ছিল কাসনি গ্রামের,তাই ওরা আর সেই দূরের বালুচরি ঘরের দিকে এগোয় নি।

উটন দেখল,হ্যাঁ,নিজের আঁকা মানচিত্রের এক জাগায় দেখানো আছে বটে নদীর বালিচর আর তার পাশে দূরে ছোট ছোট ঘর। তার মানে দুগ্গলের বর্ণনার সেই দূরের বালুচরের ঘরগুলিই হবে এগুলি !

ইতিমধ্যে ছেলেরা সবাই ফিরে এলো নৌকায়। উটন তার নিজের বানানো নকশা দেখাল ছেলেদের। বলল,এ বালুচর নদী পথে চলতে চলতে আরও অনেক সময় ধরে দেখতে পাবো। এটা ছোটখাটো এক মরুভূমি বলা যায়।

কুন্তা উত্সাহ ভরে বলে উঠে ছিল,উটন দাদু ওই যে দূরে ঘর দেখা যাচ্ছে–ওখানে গিয়ে দেখলে হত না?

বুনাইও উত্সাহ ভরে বলে উঠলো,হ্যাঁ,হ্যাঁ,আমরাও ওখানে গিয়ে দেখতে চাই! ওখানে নিশ্চয় কোন গ্রাম হবে–ওরাও আমাদের মতই আদমি হবে।

উটন বলল,কে জানে সে আদমিরা কেমন হবে ! শেষে যদি দেখা যায় ওরাও নরখাদক !

উটন দাদুর কথা শুনে সবাই আঁতকে উঠলো। সামান্য জলযোগের পর আবার নৌকো নদীতে ভাসল। সঙ্গের সবাই অল্পবিস্তর নৌকো চালিয়েছে। যে যখন পারছে নৌকোর বৈঠা বা হাল ধরে নিচ্ছে। আর সব চে সুবিধার ব্যাপার হল,স্রোতের অনুকূলে যাচ্ছে তারা। উটন দাদু  আবার চোখের সমনে খুলে ধরল তার বানানো সেই নকশা। সবাইকে মোটামুটি যাত্রা পথের আইডিয়া দিয়ে দিল। ছেলেরা অনেকেই আগ্রহভরে মানচিত্র দেখতে থাকলো। শমী আঙুল  দিয়ে একটা জাগা  দেখিয়ে বলে,উঠলো,ওই দিকটাই কি বালিচর–যার খানিকটা দূরেই তা হলে কি রয়েছে কোন গ্রাম ?

মানচিত্র লক্ষ্য করল উটন,তারপর হেসে বলল,হ্যাঁ,ঠিক ধরেছিস, এখানে নদীর দু ধারেই অনেকটা জাগা ধরে বালুচর। আর ওই বালিচর ধরে কিছুটা পার হলে ওপরে উঠলে দূরে,বহু দূরে দেখা যাবে একটা গ্রাম।

–তুমি কি সে গ্রাম দেখেছ ? নেচু বলে উঠলো। কুমিরের কামড়ের ব্যথায় ও দু তিন দিন একদমই চলা ফেরা করতে পারবে না। তবু সে আগ্রহ ভরে উটন দাদুকে প্রশ্ন করল।

নেচু এমনি ঘায়েল অবস্থায়ও এত আগ্রহ নিয়ে কথা বলায় উটন খুব খুশি হল,বলল,না রে,আমি দেখি নি–দুগ্গু রাম আমায় বলেছে। সে দেখেছে,তবে ওই দূর থেকেই দেখেছে। সেও ওই গ্রামের কাছে যেতে পারে নি। তার মনে হয়েছিল–হতে পারে সে গ্রামের লোকেরাও নরখাদক !

–ওরা কি নরখাদকই হবে ? আবার নেচু প্রশ্ন করেছিল।

–আমি জানি না রে ! তবে হতে পারে যে ওরাও মানুষ খায় ! অজানা জাগায় আমাদের সব সময়ে সতর্ক হয়ে তো চলতেই হবে রে ! উটন দাদু মুচকি হেসে নেচুকে বলেছিল।

বেলা বাড়তে লাগলো–সবাই নৌকোয় বসে জটলা করছিল। কুন্তার হাতে ধরা নৌকোর হাল। কেবল নেচু আধ শোয়া হয়ে আছে। বেচারা ভালভাবে বসতেও পারছে না–এদিক ওদিক নড়াচড়া করলেই ব্যথায় আঃ,উঁ করে উঠছে।

দুপুরের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেল। শুকনো রুটি,পোড়া বেগুন মণ্ড আর শুকনো মাছের ভর্তা।বড় টেস্টি খাবার বলতে হবে। খিদের পেটে এ খাবারে যেন কেউ আরও বেশী টেস্ট ভরে দিয়েছে ! কিন্তু বেশী খাওয়া চলবে না,উটন দাদুর নির্দেশ,বেশী খেলে খাবারে কম পরে যেতে পারে–শেষে আমাদের ভুখা থাকতে হতে পারে।

আর বেশী দূর নেই কাসনি গ্রাম। সন্ধ্যের আগেই নদী কিনারের বালুচর পার করে যাবে ওরা। উটন দাদুর খুব ইচ্ছে হল এখান থেকে দূরের বালুচরি গ্রামের লোকদের এক বার দেখে যাওয়া। কিন্তু ভয় একটাই যদি লোকেরা মানুষের মাংস খায় তবে নিজেদের বাঁচাবার হুজ্জত যেমন থাকবে আর প্রধান উদ্দেশ্য কাসনি গ্রামে যাওয়াও হয়ত তাদের ব্যর্থ হয়ে যাবে।

সূর্যের শেষ রশ্মির আলোতে বালুচর কি সুন্দর চকমকিয়ে উঠেছে। দূরের আকাশ বেয়ে অসংখ্য পাখীর ঝাঁক ফিরে যাচ্ছে তাদের নিজের কুলায়। পুবের লাল আগুন আলো আর মাথার ওপরের ছাইরঙা আকাশটা যেন কোন রহস্য সৃষ্টি করে চলেছিল।

ওদের অভিযানের এটাই বোধ হয় প্রথম সোপান। এবার শুরু হবে আসল রোমাঞ্চ। ঠিক এমনি সময় শন শন করে একটা শব্দ হল কাছেই কোথাও। তার সঙ্গে সঙ্গে নৌকো থেকে কিছুটা দুরে ঝপ করে কিছু একটা পতনের আওয়াজ এলো। উটন তৎক্ষণাৎ মাথা উঁচু করল–দেখল একটা তীর–একটা তীর এসে তাদের নৌকোর কিনারায় নদীর জলে এসে পড়ল। দাদু চাপা চীৎকার করে বলে উঠলো,সাবধান ! সাবধান সবাই,কেউ মাথা উঁচু করবি না–সবাই নৌকোর পাটাতনে মাথা নিচুকরে শুয়ে পড়—শিগগির,বলে সে নিজেও সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে সমস্ত শরীর ছেড়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ার মত শুয়ে পড়ল।

সা সা শব্দ করতে করতে আর একটা তীর এসে পড়ল ঠিক নৌকোর এক কোণে। তীর নৌকোর কোণে দাঁড় হয়ে গিথে আছে। উটন সামান্য মাথা তুলে দেখল,এ নিশ্চয় বালুচরি বুনোদের কাজ ওদের ভয় দেখাবার জন্যে অথবা শত্রুর নিপাত করার জন্যেই হবে এই আক্রমণ।

আরে,ওটা কি ? উটনের চোখে পড়ল,তীরের মাথায় ভাঁজ করা একটা গাছের পাতা না ? কি ব্যাপার–পাতায় লিখে কোন সাবধান বাণী নয় তো ?—যেমনটা প্রায়ই এডভেঞ্চারের বইতে থাকে ! হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল উটন–তীরের মাঝে গিথে রাখা ভাঁজ করা পাতা নিয়ে খুলল। চমকে উঠল সে–পাতার ওপরে কিছু দিয়ে দাগ কেটে ভূতের মত এক চেহারা আঁকা। তার পেট ফুঁড়ে ঢুকে আছে একটা তীরের ফলা ! উটনের বুঝতে ভুল হল না যে বুনোরা তাদের ধমকি দিয়েছে–চলে যেতে বলছে –ওদের জাগা ছেড়ে দিতে বলছে। নৌকোর সবাই শুয়ে আছে,একটা দুটো তীর এসে এখন আশপাশে পড়ছে। হঠাৎ ওরা শুয়ে শুয়েই দেখতে পেল,নদীর এক পারে চার পাঁচজন আদিবাসী লোক–উলঙ্গ না হলেও তাদের প্রায় উলঙ্গ বলাই চলে। কালো কুটকুটে তাদের চেহারা। হাতে তাদের ধরা আছে তীর- ধনুক–বেঁকানো কোঁকানো অদ্ভুত আকৃতির সে সব ধনুক!  গাছের বাকলের তৈরি রসি তাতে লাগানো আছে ঠিকই।

–কি হবে এখন ? বনুই ভীত কণ্ঠে বলে উঠলো।

নেচু মুখ নিচু করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ওর সবচে বেশী ভয় হচ্ছিল। কারণ কোন পরিস্থিতিতেই ও দূরে কোথাও পালাতে পারবে না।

আদিবাসীরা চীৎকার করতে থাকলো,ওরা হাত দিয়ে কিছু ইশারা করতে লাগলো–সাধারণ ভাবে তা বোঝা যাচ্ছিল,তারা–ভাগ ভাগ এটাই বলতে চাইবে। উটন আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল,বুনোদের মাঝ থেকে কেউ তাদের আসতে বলছিল–আবার কেউ তাদের চলে যেতে ইশারা করছিল !

ক্রমশ…

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top