কুকুর কুণ্ডলী
কুকুর পোষার শখ মিলির কোন দিনই ছিল না। তবু পুষতে হল কুকুর–কালো কুচকুচে সে কুকুর—জার্মান সেফরড ডগ।
মিলির স্বামী পুলকেশ পুলিশে চাকরি করে। পুলিশের চাকরি বদলির চাকরি–আজ কাঁকুড় গাছি আছে তো কাল ঠাকুর পুকুর।
কিন্তু সে বার বদলি হল গিয়ে একেবারে নর্থ বেঙ্গল–জলপাই গুড়ি–আর ডিউটিও ছিল বড় টাইট–ইদানীং তাই মাসে দু মাসে একবার বাড়ি আসতে পারে পুলকেশ।
দিনকাল ভাল না–তারপর আবার পুলিশের চাকরি। শত্রুর তো অভাব নেই। মিলিদের ফ্ল্যাট বাড়ি হলেও কেউ কারো বিশেষ একটা খোঁজ খবর রাখে না।
প্রায়ই মনু মাসির ফোন আসছিল,বক্তব্য একই ছিল–মিলি তুমি বলছিলে ফ্লাটে একা থাকতে নাকি ভয় করে। বিশ্বাসী কাজের লোকও পাওয়া যায় না। তা হলে আমি তোমাকে বারবারই যা বলছি তাই কর–আমাদের মত একটা কুকুর রাখ। জান তো কুকুর মানুষের চে অনেক বেশী বিশ্বস্ত হয়। আর প্রভুর প্রতি তার আত্মসমর্পণ থাকে।
এই তো সে দিনের কথা–রাত বারটা বেজে গিয়েছিল হবে। তখন তাদের বিল্ডিং লাগোয়া বড় রাস্তা দিয়ে,বল হরি,হরি বল,ধ্বনি দিয়ে মরা নিয়ে যাচ্ছিল। কি ভয়টাই না করছিল মিলির। বড় বিছানার দুরে সরিয়ে রাখা পুলকেশের পাশ বালিশটা টেনে এনে জড়িয়ে ধরে ছিল। ভয় তবু তাকে ছাড়তে পারে নি—তার মনে হচ্ছিল এই জীবন মৃত্যুর আড়ালটা বড় ছোট–ঘরের জানলার এ পাশ যদি জীবন হয়,তবে কি ও পাশটা মৃত্যু !
একা একা থাকতে কত আর ভাল লাগে–মাঝে মাঝে মনে হয় তার কোলে যদি একটা বাচ্চা থাকত ! অন্তত তাকে নিয়ে মনে হত–আছে–কেউ তো আছে !
পর দিনই বিনা দ্বিধায় সে মানু মাসিকে নিয়ে এক কুকুর কিনে নিয়ে এলো—জার্মান সেফরড ডগ। কালো কুচকুচে তার চেহারা।
কুকুর বড় পোষমানা হয়। মিলির মনে হয় তুলনা করলে মানুষের চেও ওরা বেশী পোষ মানে। মানুষের মধ্যে পছন্দ অপছন্দ,নাক সিটকানো বড় বেশী। আর পোষমানা ? কৈ এই তিন চার বছরেও পুলকেশ কি পোষ মেনেছে তার কাছে ? পান থেকে চুন খসলে চেঁচিয়ে সে বাড়ি মাত করে ! বড় কাঠ খোট্টা ঐ মানুষটা।
কুকুরের নাম নাইট—ক’দিনেই মিলির বড় নেওটা হয়ে উঠলো। পুলকেশেরও পছন্দ হয়েছে। তার মতে মানু মাসি ঠিক কাজই করেছে। দুটো দিনের জন্যে পুলকেশ বাড়ি আসে। দুটো রাতই যেন মিলির পাশে থাকা। সারা দিন তো পুলিশ হেড কুয়াটারে, আর এদিক ওদিক তাকে ঘুরে বেড়াতে হয়।
কুকুর,নাইট আবার রাতে যেখানে সেখানে শুতে পারে না,তার জন্যে গদ্দা পাতা বিছানা আছে। বিদেশী জাতের কুকুর,শীত সহ্য করতে পারে না–গদ্দায় শুয়েও ঘেউ ঘেউ,কুই কাই করতে থাকে।
সে দিন মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেল মিলির। চমকে উঠলো সে–সে কি ! ওর লেপের নিচে নাইট শুয়ে আছে ! মিলির গায়ের ওপর ওর সামনের এক পা উঠিয়ে দেওয়া। আর পেছনের একটা পা ছুঁয়ে আছে মিলির জঙ্ঘা !
না,এটা সহ্য করা যায় না–নাইটকে জবরদস্তি খাট থেকে নামাল মিলি। নাইট তার মালকিনের দিকে তাকিয়ে এমন ভাব করল যে সে সব কিছু বুঝতে পেরেছে। নাইট তারপর নিজের বিছানায় গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ল।
ইদানীং প্রায় রাতেই জোর করে ধমকে নাইটকে তার বিছানা থেকে নামাতে হয় মিলির।
শুরুতে পুরুষ কুকুর,নাইটের হাবভাব তার ভাল লাগে না। মিলির পাশে শুয়ে থাকার কি আলাদা কোন মজা আছে ওটার ! নাকি প্রভুকে ভালবাসে বলে ! অথবা কনকনে শীত থেকে বাঁচতে এমনি করে!
নাইটকে কত আর তাড়ানো যায়–তা ছাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নাইট তার পাশে থাকলে আজকাল এক রোমশ আনন্দ কি মিলি খুঁজে পায় ! রাতের আবেশে এক সময় মিলি নাইটের পাশে আরও ঘন হয়ে শোয়। এমনি ভাবে নাইটের মিলির পাশে শোবার অভ্যাস হয়ে যায়। মিলি কখনো কখনো এটাও লক্ষ্য করেছে যে কোন কোন দিন নাইট মিলির শরীরে মুখ ঘষে,কেমন উসখুস উসখুস করতে থাকে। এ সময় পুলকেশের কথা মিলির মনে পড়ে যায় !
দু মাস পরে পুলকেশ বাড়িতে এলো। দু দিনের জন্যে–প্রতিবার যেমনটা আসে। সন্ধ্যের আগে সে পুলিশ হেড কোয়াটারে গেল–সেখান থেকে এদিক ওদিকের কিছু কাজ সেরে রাত প্রায় এগারটার পরে ঘরে ফিরল। মিলি ঘুমের ঘোর নিয়ে দরজা খুলে দিল। ডাইনিং টেবিলে পুলকেশের খাবার ঢেকে রাখা ছিল। পুলকেশ খাবার খেয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল।
মিলি অঘোরে ঘুমোচ্ছে। লেপ দিয়ে গা ঢাকা তার–মুখটা কেবল বাইরে বেরিয়ে আছে। পুলকেশ তাকিয়ে থাকলো ঘুমন্ত মিলির মুখের দিকে–কয়েক পা এগিয়ে লাইট নিবিয়ে এলো। ঘরের জানলা আজ খোলা—ম্লান চাঁদের আলো শার্সি গলিয়ে ঘরের ভিতর এসে পড়েছে। ঘরে নিশ্চয় মিলি রুম ফ্রেশনার স্প্রে করেছে। মৃদু মন্দ গন্ধ মনে আমেজ ভরিয়ে দিয়েছে। সুন্দর গোলাপের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। পুলকেশের উপোষী শরীর ক্রমশ জেগে উঠছিল। আপছা আলোয় মিলির মুখ বড় মিষ্টি,বড় স্বচ্ছ সুন্দর গোলাপের মত ফুটে আছে !
আর অপেক্ষা নয়। পুলকেশ মিলির গায়ের লেপ সরিয়ে সমস্ত শরীর ঢেলে দিতে গেল নরম বিছানায়। আর লেপের নিচে থেকে হঠাৎ দু বার বিকট ঘেউ ঘেউ শব্দ করে নাইট কামড়ে ধরল পুলকেশকে। মিলি ধড়ফড় করে উঠে বসল। তুলকালাম কিছু একটা ঘটে গেছে জেনে ও তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে লাইট জ্বালল। তখনও কুকুর,নাইট কামড়ে ধরে আছে পুলকেশের হাত। ওর দাঁত বসে যাওয়া ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে।
ঘটনাটা আচমকা ঘটে যাওয়ায় পুলকেশ কিংকর্তব্য-বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে সে রাগে ফেটে পড়ল। মিলির পাশে এই দামরা কুকুরটা শুয়ে ছিল ! শুধু কি তাই ! ওটা তাকে হিংস্রের মত কামড়ে দিয়েছে !
রাগে পুলকেশের পুলিশী শরীর কেঁপে উঠলো। গলা ফেড়ে মিলিকে ধমকে উঠলো। তারপর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে ছুটে গেল তার রাতের ঝুলিয়ে রাখা পুলিশী ড্রেসের পাশে। প্যান্টের কোমরের ব্যালটের পিস্তলের খাপ থেকে বের করে নিলো পিস্তল আর মুহূর্ত দেরী না করে কুকুরকে গুলি করল—গুড়ুম,গুড়ুম,গুড়ুম–তিন তিনটে গুলি খেয়ে ছিটকে পড়ল নাইট। দু একবার ঘেউ,আওয়াজ করে শরীর ছাঁটিয়ে নাইটের দেহ স্থির হয়ে গেল।
সব কিছু আচমকা ঘটে গেল।
পুলকেশ স্তব্ধ হয়ে খাটের কিনারে বসে আছে। মিলি নাইটের মৃত দেহের পাশে মেঝেতে লেপটে বসে ছিল। ও কাঁদছিল,অঝর কান্নায় সে ভেঙ্গে পড়ল। জানলার বাইরের চাঁদ তখন আর নেই–সে অকালের চাঁদ এখন হয়তো দিগন্তে ডুব দিয়েছে। বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরের আলোকে যেন গ্রাস করতে চাইছে।
ওদের ফ্ল্যাটের বাইরে অনেক লোকের জটলা–সোরগোল চলছে –দরজায় ধাক্কা পড়ছে অনবরত। পুলকেশ ছুটে গেল লাইটের সুইচের কাছে। ঝট করে আলোটা নিভিয়ে দিল সে। নিমজ্জমান অন্ধকার সমস্ত ঘর ঘিরে নিলো।
সমাপ্ত