Today 12 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

অনুভব

: | : ১০/১১/২০১৩

দুপুর একটায় অফিস থেকে বের হয়ে তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড মসজিদে জুমআর নামাজ পড়ে গাবতলীর উদ্দেশ্যে রওনা হলো রিপন।

ওর বাড়ি সিরাজগঞ্জ। বাড়িতে বাবা, মা আর ছোট দুইটা বোন আছে। ইমীডিয়েট ছোট বোন সুমনার বিয়ের খরচের জন্য ত্রিশ হাজার টাকা নিতে ওর বাবা ওর কাছে আজ আসছেন।

একটা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ-এ চাকরি করে রিপন। গাবতলী পৌঁছার পর জার্নিতে শুকনো হওয়া বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে তার খুব মায়া হলো। বেবী নিয়ে মিরপুর বারো নাম্বারে মেসের উদ্দেশ্যে রওনা হলো ওরা।

পরদিন সকালে অফিসে গিয়েই শিফার সাথে রিপনের দেখা হয়। শিফার বাড়ি টাঙ্গাইল। ওরা বন্ধুর মতো।

অফিসের সেভিংস স্কীমে রিপন হাজার ত্রিশেক টাকা জমিয়েছে। সেই টাকাই তুলে ওর বাবাকে দিবে।

সন্ধ্যার পর একটু তারাতারিই অফিস থেকে বের হলো সে। রিক্সা না পাওয়ায় রাস্তার বাম পাশের ফুটপাত দিয়ে সে হাঁটছে। বিজ্ঞান কলেজ পর্যন্ত পৌঁছার আগেই বিদ্যুৎ চলে গেল।

রিপন বিপরীত দিক থেকে আসা ওর চেয়েও কম বয়সী এক ছেলেকে একদিকে সরে গিয়ে পাশ কাটাতে যাবে এমন সময় সেই ছেলেটাই তার এক পা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে ওর পায়ের সাথে লাগিয়ে দিল।

রিপনকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটা বলে উঠলো, দেখেশুনে পথ চলতে পারেন না?
রিপন বিস্মিত কন্ঠে বললো, আপনিই তো পা লাগিয়ে দিলেন।
ছেলেটা বললো, একশোটা টাকা দেন, কিছু খাবো।
এই বলে সে রিপনের শার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তিনশো টাকার মতো ছিল তা বের করলো। তারপর বললো, টাকাটা নেব?
রিপন তখন পাশে তাকিয়ে দেখলো আরো দু’ তিনজন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
রিপন বললো, ঠিক আছে নেন।
সে বললো, খুশি মনে দিচ্ছেন তো?
রিপন বললো, হ্যাঁ দিচ্ছি।
তারপর ছেলেটা বললো, কাছে কি আর টাকা আছে?
এই বলে সে রিপনের প্যান্টের চারপাশে হাতড়াতে লাগলো। এক জায়গায় তার হাত থেমে গেল। সে বললো, এখানে বোধহয় কিছু টাকা আছে, বের করেন।

রিপনের বাবা ঢাকা এসেছেন টাকা নিতে। বাড়িতে মা বোনরা বাবার পথ চেয়ে আছে। রিপনের দু চোখে পানি এসে গেল।

সে অনুরোধের সুরে বললো, দেখুন, আমার বাবা অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেন। ছোট বোনের বিয়ে পনের দিন পর। ছোট-খাট একটা চাকরি করে কিছু টাকা জমিয়েছি। সেই টাকা নেওয়ার জন্য আমার বাবা ঢাকা এসেছেন। এই টাকাটা আপনি নিলে আমাদের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। প্লিজ ভাই, আমাদের সমস্যাটা একটু বোঝার চেষ্টা করুন।
কিন্তু ওর অনুনয় তার অন্তরে ঢুকলো না। বললো, বের করেন, বের করেন। টাকা পয়সা কিছু না, জানটাই আসল।
রিপন টাকাটা বের করে তাকে দিল। ছেলেটা বললো, আর কি টাকা আছে? খরচের জন্য বোধহয় কিছু টাকা আছে তাই না?
তারপর ছেলেটা ফার্মগেটের দিকে হাত তুলে বললো, কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা চলে যান।

রিপন কিছুদুর হেঁটে যাওয়ার পর ভাবলো, খালি হাতে বাবার সামনে যাবে কিভাবে সে? এই টাকাটা না হলে তো ছোট বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানই হবে না।

গাড়িতে উঠতে হবে খেয়াল হতেই বুঝলো একটা ঘোরের মধ্যে সে ফার্মগেটের ওভারব্রিজ পার হয়ে এসেছে। সে রাস্তা পার হয়ে পার্কের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

মানুষ গাড়ি থেকে নামছে, উঠছে, ফিরে যাচ্ছে ঘরে। কিন্তু ওর ফেরার রাস্তা যেন বন্ধ হয়ে গেছে।

আস্তে আস্তে রাত বাড়ছে। পা দুটো অসার হয়ে যাওয়ায় পার্কের ভিতর ঢুকে একটা বেঞ্চির উপর বসলো।

একটু দূরে আগুন জ্বালিয়ে কারা যেন কি করছে। কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে গেল রিপন। একজন মহিলা, তার কোলে এক বাচ্চা, পাশে আরো দুই ছেলে মেয়ে। সবার মুখেই যেন কালি মাখানো হয়েছে। ইটের উপরে পাতিল বসিয়ে মহিলাটা রান্না করছে। আর ছেলেমেয়েগুলো পাতিলের দিকে ঝুঁকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

উঁচু অট্টালিকায় যারা বসবাস করে তারা আর এরা একই প্রকৃতির জীব। কিন্তু জীবন যাপনে কি আকাশ পাতাল পার্থক্য! তাদের দুরবস্থা দেখে রিপনের কষ্ট চলে গেল। কিন্তু বাবাকে বলার মতো কোন কথা খুঁজে পেল না বলে সে ওখানেই আবার বসলো।

একসময় বসে থাকতে না পেরে শুয়ে পড়লো। রাস্তায় গাড়ি চলা কমে গেল। চোখে তন্দ্রা নেমে এল। মশার কামড়ে জেগে উঠে দেখলো ভোরের আলো ফোটা শুরু হয়েছে।

একসময় রিপন অফিসের দিকে রওনা হয়।

ভিতরে ঢুকতেই শিফা বললো, আপনার চেহারা এত উসকো খুশকো লাগছে কেন?
রিপন কিছু বললো না।
শিফা আবার বললো, প্লিজ আমাকে খুলে বলুন তো কি হয়েছে!
সে সব কিছু খুলে বললো। শিফা কিছুই না বলে চলে গেল।

দশ মিনিট পর এসে বললো, আমার কিছু টাকা জমানো ছিল। সেটা প্লিজ আপনি নিন এবং এখনই বাসায় যান।
রিপন বললো, না না তা হয় না।
শিফা বললো, খুব হয়। আমার তো এখন টাকাটা লাগছে না। যখন লাগবে তখন না হয় ফেরত দিবেন। না নিলে আপনার সাথে কিন্তু আমি আর কথা বলবো না।
শিফার প্রতি কৃতজ্ঞতায় রিপনের চোখে পানি এসে গেল।

বাসায় গিয়ে রিপন বাবাকে বললো, রাতে গাড়ি পাইনি, তাই ঐ দিকেই এক বন্ধুর বাসায় ছিলাম।
ওর বাবা বললেন, তোর চোখ মুখের ভাষা আমার মুখস্ত। কার কাছে মিথ্যা বলছিস? কি হয়েছিল আমাকে বল বাবা।
রিপন সব খুলে বললো।
ওর বাবা বললেন, আমাকে অফিসে নিয়ে চল। মেয়েটার সাথে দেখা না করলে ভাববে তুই একজন অকৃতজ্ঞ লোকের সন্তান।

ওরা তেজগাঁও গেল। রিপনের বাবা শিফাকে বললেন, আমাদের অনেক বড় ধরণের উপকার করলে মা।
শিফা বললো, আপনি কষ্ট করে এখানে না এলেও পারতেন।
তিনি বললেন, না এলে মনের মধ্যে খচ খচ করতো। আমার মেয়ের বিয়েতে তুমি অবশ্যই কিন্তু যাবে মা।

শিফা হেসে বললো, ঠিক আছে রিপন ভাই যদি নিয়ে যায় তবে যাবো।

গাবতলী গিয়ে বাবাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ফিরে আসার সময় রিপন ভাবলো, বিজ্ঞান কলেজের সামনের রাস্তায় ছেলেটা তার সমস্যাটা অনুভব করতে না পারলেও শিফা অনুভব করেছিল। যাদের অলস টাকা আছে তাদের অনুভুতি যদি শিফার মতো কার্যকর থাকতো তবে রাতে দেখা মানুষগুলিকে কুকুর বিড়ালের মতো ওভাবে পার্কে জীবন কাটাতে হতো না।

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top