সীমা
বাবু এবং সীমা একই গ্রামের বাসিন্দা। ওরা দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও। সীমার চাচাতো ভাই রিপন বাবুর বন্ধু। সে হিসেবে সীমাদের বাড়িতে বাবুর যাতায়াত আছে। সীমার বাবা মা বাবুকে খুব পছন্দ করেন।
ওদের মধ্যে দুই একটা সাধারণ কথা, একটু চোখাচোখি এই-ই কেবল হয়। কিন্তু সীমাকে দেখলে, তার সাথে কথা হলে বাবুর খুব ভালো লাগে।
সীমা মাঝে মাঝে বিকেলে তার মা, ছোট বোনদের সাথে বাবুদের বাড়িতে বেড়াতে যায়। তখন তার দৃষ্টি বাবুকে খুঁজে বেড়ায়। যদি দেখা পায় তবে শান্তি অনুভব করে।
মার্কেটে কিম্বা কলেজে যাওয়া আসার পথে রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে পাশ কাটানোর সময় পরস্পরের দিকে অজান্তেই দৃষ্টি চলে যায়। চোখাচোখি হলে দুজনেই হয় লজ্জাবনত।
বাবু যখন রাজশাহী ভার্সিটিতে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়ে সেখানে থাকা শুরু করে তখন দীর্ঘদিন একে অপরের সাথে দেখা হয় না। তাই মনের গভীরে একে অপরের জন্য যে পিপাসা আছে তা অন্তরে স্পষ্ট হয়ে অনুভুত হলো। একে অপরকে না দেখতে পেরে দুজনের অন্তরই খরায় ফেটে চৌচির হওয়া মাটির মতো শুন্যতায় খা খা করে। অনুধাবন করতে পারে যে ওরা পরস্পরকে কি প্রবলভাবে ভালোবাসে।
কিন্তু মনের শুন্যতার দাহ দূর করার জন্য যে ভালোবাসার উষ্ণতার প্রলেপ দরকার তা কেউই ঢালতে পারে না। স্বাভাবিক সংকোচ বোধের কারণে মনের কথা মনেই সুপ্ত রয়ে যায়। বাবু ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা পর্যন্ত বাড়িতে থেকেছে। জীবনে ঘুরে বেড়ানো একটু কমই হয়েছে তার। লাজুক স্বভাব তথা সংকোচ বোধ তার মধ্যে রয়েই গেছে। তাই সীমার চোখের দিকে তাকিয়েও তার মনের ভাষা সে পড়তে পারেনি।
কিন্তু সীমা একজন মেয়ে। বাবুর মনের ভাষা বুঝতে তার কষ্ট হয় তার প্রতি বাবুর যে ভালোলাগা আছে সেটা সে বুঝে ফেলেছে। তাই এক রাতে বাবু রিপনের সাথে আড্ডা মেরে চলে আসার সময় একা পেয়ে সুযোগ বুঝে সীমা বাবুকে বলে, বাবু ভাই, একটু দাঁড়ান।
বাবুর কাছে সীমার ডাকটা যেন অমৃতের মতো লাগে। সে দাঁড়িয়ে যায়।
সীমার দিকে তাকায়। সীমার পরনে সালোয়ার কামিজ, মাথায় ওড়না, ওড়নার ভিতরে চুলের বড় খোঁপাটি বোঝা যাচ্ছে।
সীমা সতর্কতার সাথে এদিক ওদিক তাকিয়ে এগিয়ে এসে বামহাতে বাবুর ডানহাত ধরে। সীমার হাতের স্পর্শ পেয়ে বাবুর সারা শরীর বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো উষ্ণ হয়ে ওঠে। ডানহাত দিয়ে বাবুর ডানহাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়েই সীমা বাড়ির ভিতরে দৌড়ে পালায়।
বাবু চিঠিটা লুকিয়ে তারাতারি বাড়ির বাইরে চলে আসে। ওটা যে প্রেমপত্র তা আন্দাজ করে খুশিতে, উত্তেজনায় একরকম উড়তে উড়তে ওদের বাড়িতে এসেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে চিঠিটা খোলে।
সীমা লিখেছে,
বাবু ভাই,
বেশ কিছুদিন হলো আপনাকে চিঠি লিখবো বলে ভেবে এসেছি কিন্তু লিখতে বসলেই এ আসে ও আসে তাই লেখা হয়ে ওঠেনি। আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি বাবু ভাই। আপনার কাছে একান্ত অনুরোধ, আপনি আগামীকাল সকাল নয়টায় কলেজের ওখানে যাবেন। আপনার সাথে অনেক কথা আছে।
ইতি,
আপনার চেনামুখ সীমা
চিঠিটা পড়ে তৃপ্তিতে বাবুর মনটা উত্তেজনায় ভরে উঠলো। সীমার সাথে দেখা করার জন্য রাতটা যেন আর ফুরাতে চায় না। সকালে সীমার আগেই বাবু কলেজের ওখানে গিয়ে অপেক্ষায় থাকে।
একসময় বাবুর অপেক্ষার পালা শেষ হয়। আর দূর থেকে রিক্সায় বসে বাবুকে দেখেই সীমার ঠোঁটে আপনা আপনিই মুচকি হাসি ফুটে ওঠে।
কাছে আসার পর সীমা উৎফুল্ল কন্ঠে বললো, আপনি এসেছেন?
বাবু বললো, চিঠিটা দেওয়ার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
দুজনই মনে মনে অনেক কথা সাজিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এখন কোন কথাই মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। কেউ যেন কোন কথাই খুঁজে পাচ্ছে না। অবশেষে সীমা বললো, আপনি কবে রাজশাহী যাবেন?
বাবু বললো, পরশুদিন।
সীমা বললো, আপনার ঠিকানাটা দিবেন না?
বাবু তার ঠিকানাটা লিখে দিলো।
সীমা বললো, রাজশাহী গিয়েই কিন্তু চিঠি লিখবেন।
বাবু বললো, ঠিক আছে।
সীমা বিদায় নিয়ে কলেজের ভিতরে চলে গেল। বাবু ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো।
সন্ধ্যার পর সীমাদের বাড়ি গেল বাবু। বাবুকে দেখে সীমা খুব খুশী হলো। সীমাকে বাবু জিজ্ঞেস করলো, রিপন কি বাড়ি আছে?
সীমা বললো, না নেই।
বাবু মুখে একটু হতাশ ভাব ফুটিয়ে তুললো। তাই দেখে সীমার ভিতর থেকে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো। রাতের নির্জনতায় কয়েক মুহূর্ত পর তার মুখে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো। রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। বাবু ভয় পেল। যদি কেউ এভাবে ওদেরকে দেখে ফেলে! ওর এই দুশ্চিন্তা টের পেয়ে সীমা বললো, আপনি এত ভীতু কেন? আমাদের মধ্যে তো আত্মীয়তার সম্পর্কও আছে। সে হিসেবে আমরা তো কথাবার্তা বলতেই পারি।
বাবু ভাবলো, সীমা তো ঠিকই বলেছে! ওর ভয় দূর হয়ে গেল। কিন্তু তখনই রিপনের কন্ঠ শোনা গেল। তাই ওদের মধ্যে আর কথা হলো না।
পরদিন বিকেলে বাবুর মনটা খারাপ হয়ে গেল রাজশাহী যাওয়ার কথা ভেবে। এতদিন এক ধরণের যন্ত্রণা ছিল, আর এখন যেন তা ছটফটানিতে রূপ নিল। সীমাকে ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। সন্ধ্যার পর সীমাদের বাড়ি গেল।
সীমার সাথে দেখা হয়ে যাওয়ায় সীমা জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছেন?
বাবু বললো, ভালো না।
সীমা বললো, কেন?
বাবু বললো, রাজশাহী যেতে ইচ্ছা করছে না।
সীমা বললো, কিন্তু যেতে তো হবেই। আর খারাপ তো আমারও লাগছে। জীবনের প্রয়োজনে এটা মেনে নিতেই হবে। ভালোভাবে পড়াশোনা করবেন।
সে হেসে আবার বললো, মাঝে মাঝে চিঠি লিখবেন। আর আমার কথা বেশি বেশি করে স্মরণ করবেন।
বাবু বললো, তুমি ভালো থেকো।
বাবুর চোখ ছল ছল করে উঠলো।
সীমার চোখ থেকে পানি বের হয়ে গালের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়লো। সে কাঁপা গলায় বললো, আপনিও ভালো থাকবেন।
এভাবে শিহরণে, ভালোলাগায় আর কষ্টে এগিয়ে যায় মুহূর্ত, গড়িয়ে যায় দিন। ভবিষ্যতে ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর হয়ে দুটি প্রাণ পার করে কত নির্ঘুম রাত।
ধীরে ধীরে দুই পরিবারের সবাই ওদের সম্পর্কের কথা জানতে পারে।
বাবু পড়াশোনা শেষ করে একটা কলেজে লেকচারার হিসাবে জয়েন করে। বাড়িতে তার বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা ওঠে। বাবু সীমার কথা অভিভাবকদের জানায়। কিন্তু তার বাবা মা এবং বাড়ির অন্যান্যরা রাজী হয় না। তারা বলে যে বাবুর বউ হওয়ার যোগ্যতা সীমার নাই।
বাবু কখনও চিন্তাও করেনি যে ব্যাপারটা নিয়ে এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। সীমাকে তার খুব পছন্দ। সীমার প্রতি সে যে প্রবল আকর্ষণ অনুভব করে ক্লিওপেট্রার মত সুন্দরী মেয়েকে সামনে দাঁড় করালেও সে তা অনুভব করবে না। জীবনের সকল কর্ম ও সাধনা সফলতার সাথে সম্পাদন করার জন্য এ রকম একজন বউই তো একজন পুরুষের জন্য প্রয়োজন। এতে সব অনাকাংখিত বিষয় থেকে জীবনে নিজেকে দূরে রাখা যায়।
আর পছন্দনীয় মেয়েকে বিয়ে করার নিয়মই তো ধর্মে বহাল আছে। কিন্তু আমরা ধর্ম মানি অথচ অহংকার করে তার বাস্তবায়ন করা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখি। বাবুর ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হলো, কিন্তু কারো অমতে কিছু করার সাহস সে অর্জন করতে পারলো না। বাড়ির সবাই বাবুকে বললো যেন সীমাকে বলে দেয় সে সীমাকে বিয়ে করতে পারবে না। কিন্তু বাবুর লজ্জা হতে লাগল যে এতে সীমা তাকে কাপুরুষ ভাববে। তাই সে বাড়ির সবাইকে অনুরোধ করে যে তারা যেন সীমাকে বুঝিয়ে আশ্বস্ত করে, কিন্তু সে নিজে সীমাকে এ ধরণের কথা বলতে পারবে না।
সীমার প্রতি এই অবহেলায় সীমা খুব কষ্ট পায়। বাবুর পরিবারের লোকদেরকে পাথরের মতো পাষাণ মনে হয়। কিন্তু তার অন্তরের ব্যথা দুচোখ দিয়ে পানি হয়ে শুধু গড়িয়েই পরে, কাউকে তা বলতে পারে না।
বাবুর বাবা অন্য মেয়ের সাথে বাবুর বিয়ে ঠিক করলো।
বিয়ের দিন ধুম ধাম করে বরযাত্রী রওনা হলো। নতুন বৌকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর বাবুর একমাত্র বোন এবং একমাত্র ভাগ্নে বাবুদের বাড়িতে থেকে যায়। আর আইন পেশায় নিয়োজিত দুলাভাই ত্রিশ মাইল দূরে তার বাড়িতে চলে যান এই বলে যে রাতটা সেখানে কাটিয়েই পরদিন ভোরে সেখান থেকে আবার রওনা হবেন।
শেষ রাত থেকেই বাবুদের বাড়িতে বৌ ভাত অনুষ্ঠানের হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। সকালে ছোট ছেলে মেয়েরা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। পাশের বাড়ির মহিলারা নতুন বউয়ের মুখ দেখতে ভীড় জমায়। রান্নাবান্নার সুগন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক সেই সময় খবর আসে যে বাবুর দুলাভাই রাতে ঘুমের মধ্যে হার্ট এটাক করে মারা গেছেন। তার ডানহাত বুকের উপর চাপ দেওয়া অবস্থায় ছিল আর মুখ দিয়ে কিছুটা রক্ত বের হয়েছিল।
বৌ ভাতের সব আনন্দ আয়োজন মাটি হয়ে যায়। সবাই যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায়ই তড়িঘড়ি করে বাবুর দুলাভাইয়ের বাড়িতে রওনা হয়। বাবুর শ্বশুর বাড়ি থেকে লোকজনের এ বাড়িতে আসা আর হয় না।
বাবুর একমাত্র বোনের চোখের পানিতে ভেসে আর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করা একমাত্র ভাগ্নের আকাশ বাতাস কাঁপানো কান্নার ধ্বনির মাঝ দিয়ে এক গোরস্তানে দাফন কাজ সম্পন্ন করার পর বাবুর বাবা সহ বাড়ির সকলে এই ঘটনায় একদম নীরব হয়ে যান।
সকলের বিবেকই সকলের মনকে এই প্রশ্নটা করে যে ইহা কি সীমার মনে দুঃখ দেওয়ারই ফল? কিন্তু এই কথাটি একজন আরেকজনের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারে না, কারণ সীমাকে দুঃখ দেওয়ার কাজে সকলেই যে জড়িত ছিল।