Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

অনেক কথা২৩

: | : ২১/১১/২০১৩

আমিরাতে দুই হাজার বছর–

আমিরাতে দুই হাজার বছর কথাটা শুধু চিন্তার বিষয়ই নয়, পৃথিবীর সকল মানুষকে অবাক করে দেওয়ার মতো একটি কথা। এটা কোনো গল্পকারের রূপকথা নয়, না কোনো ইতিহাসের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী, না কোনো অলৌকিককাহিনী। এটি একটি বাস্তবচিত্র এবং যথার্থ সত্যঘটনা। আমিরাতে এসে জানতে পারি, প্রবাসীদের অন্তিমদশা! যারা ছোটখাটো ব্যবসাবাণিজ্য করছে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে! যেখান থেকে তারা এক পাও নড়তে পারছে না! যা রোজগার করছে, বছর শেষে সরকারি ফি–এ-ফি ও-ফি কর-ফি দিতে দিতে রীতিমতো জীবনটা তাদের অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে! না পারে পালাতে, না পারে ফেলে যেতে। বলা বাহুল্য, প্রবাসের চেয়ে নির্বাসন ভাল।

‘আমিরাতে দুই হাজার বছর’ কথাটার রহস্য পরে জানা যাবে। এখানে আমরা অনেকের কথা বাদ দিয়ে একজনমাত্র অসহায়ের কথা প্রচার করতে চাই, যেজন ছত্রিশ বছর বিদেশ খেটে নিঃস্বই রয়ে গেছে! ঊনিশ শ ছিয়াশি সালের কথা, সতের বছর বয়সের অতি গরিবপরিবারের এক নিরুপায় কিশোর সচ্ছল জীবনের আশায় জমিজমা যা ছিল সব বিক্রি করে আমিরাত নামক দেশটিতে আগমন করে। কারণ অভাব মোচন করতে তখন বিদেশকেই অনেকে একমাত্র অবলম্বন বলে মনে করছে। তাই স্বদেশ ও মা-বাবা ভাইবোনের মায়া ত্যাগ করে পরদেশকেই তারা আপন করে নিতে দেখা যাচ্ছে। তবে বিদেশ এসে অনেকেই যে অভাবমোচন করতে পারে নি এ কথাও নয়। সকলের বিবেকবুদ্ধি যেমন এক হয় না তদ্রূপ সকলের ভাগ্যলিখনও একই কলমে লিখা হয় না। বিধাতা ’হও’ বললে সব হয়ে যায় কিন্তু সব ত আর একই ধাঁচে হয় না, তেমন মানুষের ভাগ্যলিপিও বোধহয় ভিন্ন ভিন্ন কলমে লিখা হয়? বিচারক ফাঁসি দেওয়ার পর যেমন কলমের নিপ ভেঙে ফেলে, কুল মখলুকাতের মালিক স্রষ্টাও বোধহয় এক-একজনের জীবনবৃতান্ত লিখার পর কলমটি ভেঙে ফেলে? নাহয় এক-এক মানুষের ভাগ্যকরোটি এক-এক রকম হয় কেন? যাই হোক, যেকথা আজীবন গোপন আছে সেকথা আজীবন গোপনই থাকুক। যার কথা নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু তার কথাই বলে যাই, যেই বয়সে একজন কিশোর বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈহল্লায় ও খেলাধুলায় মেতে দিন কাটার কথা, সেই বয়সে তাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ও বছরের পর বছর হাড়ভাঙা খাটুনি করে যুগের পর যুগ কাটাতে হয় পরদেশে! এটাই অনেক প্রবাসীর নিয়তি।

জিন্দেগি খুব ছোট কিন্তু জিন্দেগির আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেক বড়। একজন মানুষের জিন্দেগি শেষ হয়ে যায় তবু স্বপ্নদেখা বা ইচ্ছের শেষ হয় না। মানুষ শেষমুহূর্ত পর্যন্ত কামনার দাস। তাই এ বালকও এমনই স্বপ্নের সুখপাখির শিকারে বাইর হয়েছিল একদিন। এপাখির খুঁজে ছুটতে ছুটতে জীবনমাঠের শেষসীমায় চলে আসে তবু সেই পাখির দেখা মিলে না! তবু আশায় থাকে : আজ নাহয় কাল অথবা–দিন যায় মাস যায় বছরের পর বছর যায় তবু অপেক্ষায় থাকে সুখ নামক পাখিটির জন্যে–ছত্রিশ বছর কেটে যায় কিন্তু কোথায় তার সেই সুখপাখি!

এর মধ্যে খবর পেল, বাবা মরে গেল! তখন আকাশ ভেঙে মাথায় পড়লেও মায়ের সান্ত্বনাই ছিল পথচলার প্রেরণা। আরেকদিন চিঠি এল, মা নেই! তখন আশার আলো নিবে চার দিকে দেখে আঁধার আর আঁধার। নিরুপায়–ভিসা নামক শিশা ভেঙে কবেই চুরমার হয়ে গেছে জানা নেই। চুপিসারে কাজকর্ম করে চলছে এখানে-ওখানে। এক দিন করতে পারলে তিন দিন বসে খেতে হয়। বাড়ি যাওয়ার কথা একবার ভাবলে তিনবার মনের বাধা আসে, কারণ চিরনিষিদ্ধের লালকালির মোহরের ভয়। পুনরায় আসতে পারলে নাহয় কোনো একটা সদগতি হত। বাড়ি গিয়ে করবে কী এ কথাও চিন্তার বিষয়। এতটুকু জমিজমা অবশিষ্ট রাখে নি যে, তা বিক্রি করে কিছু একটা করবে। সম্বল বলতে সামান্য ভিটেবাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। সব সময় লেগে থাকে আইনের হাতে ধরা পড়ার ভয়। অবৈধ প্রবাসীদের মন ফাঁসির দণ্ড আসামির মনের চেয়েও ছোট। ধরা পড়ে দেশফেরত হলে কেউ কেউ মৃত্যুকামনা করে। কেউ কেউ লজ্জার চেয়ে মরণ ভাল বলে।

আমরা বলছি না, দুনিয়ার সকল অবৈধ প্রবাসীদের বৈধতা দাও। আমরা এটুকু কামনা করছি, তাদের একটা সদগতি হোক। কারণ অনেকে বিদেশ এসে হাজার কোটি টাকার মালিক না হলেও কোটিপতি ত বনেছে–এটা অবশ্য বাস্তব। তাদের অনেকেই আশেপাশের গরিবিদূরিকরণে যে দানদাক্ষিণ্যের সবল হাত বাড়ায় নি–এটাও অবাস্তব নয়। গরিবিকে যারা খুব কাছ থেকে দেখেছে তারা তার চেহারা কখনো ভুলতে পারবে না। তাই যেখানেই তারা গরিবির ছায়া দেখবে সেখানেই তাদের সবল হাতের ছাপ আশা করা যাবে।

গ্লাফের যে আইনকানুন আমরা দেখছি সাধারণত তা অন্যসব দেশে দেখা যায় না। এখানে ভিনদেশিরা ব্যবসাবাণিজ্য করতে গেলে (স্পন্সর) কফিল। অন্য কোথাও চাকরি করতে গেলে বাধা। আইনের হাতে ধরা পড়লে জেলজরিমানাপর চিরনিষিদ্ধ! এ কেমন বিচার? এমন একটি নগণ্য অপরাধে যদি জেলজরিমানাপরও আজীবন নিষিদ্ধ হতে হয়, তা হলে এসব দেশে শ্রম দেওয়ার যৌক্তিকতা কী? নিজের দেশে খেটে খাওয়া অনেক ভাল। কারণ যে গাছটি ছায়া দিতে অক্ষম তার তলে আশ্রয় নেওয়া বোকামি। নিজেকে যারা সবকিছু মনে করে তাদের কাছে ভাল কিছু আশা করা ভুল। গ্লাফের আলোবাতাস কারও জন্যে নয়, সকল প্রবাসীদের জন্যেও যদি নিষিদ্ধ হয়, আশা করি বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়বে না কোনো প্রবাসীর জীবনে। তা হলে? মানুষ দিন দিন গ্লাফের প্রতি যেহারে বিমুখ হচ্ছে, একদিন গ্লাফ নামের কোনো শব্দ মানুষের অন্তরে থাকবে বলে মনে হয় না! কারণ অমৃত মনে করে বারবার বিষফল খাওয়া যায় না।

ভিনদেশিদের প্রতি যে আচরণ তারা করছে! এ আচরণ কিন্তু মনুষ্যত্বের আচরণ নয়। এ আচরণ বর্বরতার পরিচয়। আল্লাহ্‌র কাছেও ফেরেস্তার চেয়ে মানুষের মর্যাদা বড়। আর তাদের কাছে দরিদ্রদেশের শ্রমিকেরা মানুষই নয়! শত্রু শত্রুর প্রতি বিমুখ হয় তবে এমন আচরণ করে না। মানুষ মানুষকে ভালবাসা মনুষ্যত্বের পরিচয়। যারা মনুষ্যত্বের পরিচয় দিতে অক্ষম তারা ঘৃণিত। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে ভিনদেশি নেই। যারা পরকে আশ্রয় দেয়, পরের স্বার্থের কথা ভাবে তারা সবচেয়ে মহান এবং হৃদয়বান। তবে আজকাল বেশির ভাগ দেশেই দেখা যাচ্ছে, ভিখারিকে ভিক্ষা দেখিয়ে তার ভাণ্ড কেড়ে নেওয়ার কাজ।

 

আজ গ্লাফজুড়ে দেখা যাচ্ছে, ভিসাব্যবসা একটা অন্যতম ব্যবসায় পরিণত হয়েছে! সরকার যেখানে সামান্য একটা কাগজের বিনিময়ে হাজার হাজার টাকা কেড়ে নিতে একবিন্দু সংঙ্কোচ করছে না, সেখানে সাধারণ মানুষ লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিতে দ্বিধা করবে কেন! সামান্য একটা কাগজের মূল্য যদি এত হয়, তা হলে হিরামুক্তা ও সোনাচাঁদির মূল্য তত বেশি অস্বাভাবিক নয়। মজলুমের প্রতি জুলম করা যদি অন্যায় হয়, তবে এটা কেমন ন্যায়? এটা কি মজলুমদের প্রতি অত্যাচার নয়? শক্তি যার আছে সে দুর্বলকে লাথি দিতে একটুও চিন্তা করবে না, এটাই দুনিয়ার দস্তুর এবং এটাই মানুষের নীতি। এই নীতির কাছে একজন দুর্বল কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। তাই তাকে বাধ্য হয়ে অন্যপথ অবলম্বন করতে হয়।

 

মনে রাখা দরকার, নতুন মানুষের চেয়ে একজন পুরাতন মানুষ সব সময় কার্যকর এবং অগ্রসর ও অভিজ্ঞ। যে কথাটা একজন অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞই বলতে পারে। মানুষ মনুষের প্রতি বিমুখ হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু এমন নির্দয় হতে পারে না। এখানে ভিনদেশিরা অপরাধ করে, তবে সকলে এমন অপরাধ করে না যে, যার জন্যে তার ফাঁসির আদেশ জারি করা হোক! অর্থাৎ অন্যকোথাও শ্রম দিলে চিরনিষিদ্ধের দণ্ড। এটা একজন শ্রমিকের জন্যে ফাঁসির দণ্ডই বটে। কারণ আমরা এমন কতজনকে দেখেছি, এ আদেশের কারণে তার লক্ষ টাকার (রিয়াল বা দিরহাম) ব্যবসাবাণিজ্য রেখে শূন্য হাতে বিদায় নিতে হয়েছে! আজকাল খুনি আসামীর প্রতিও সহানুভূতি দেখানো হচ্ছে, হয়তো কোনেক পরিস্থিতির শিকার সে। মানুষ কখনো স্বেচ্ছায় অপরাধ করে না–হয়ে যায়। তাই অপরাধীর অপরাধানুসারে দণ্ডিত করা প্রত্যেক বিচারকের কর্তব্য। বিচারকগণ মনে রাখতে হবে, তাদের এ আদালত শেষ আদালত নয়, তার উপর আরেকটি মহা আদালত আছে এবং আরেকজন মহাবিচারক আছে আর সে বিচারকের আদালতের কার্যক্রম এতই নিখুঁত যে, চুলচেরা বিশ্লেষণ করেও খুঁত পাওয়া যাবে না। একথা যেন দুনিয়ার বিচারকগণ মনে রাখে, ওই আদালতের কাঠগড়া সকলের জন্যে অপেক্ষা করছে।

 

আমরা এমন কথা কখনো বলব না যে, সকলে নিরাপরাধী এবং নিতান্ত ভাল মানুষ। সকলেরই কিছু-না-কিছু অপরাধ থাকে। তবে চুরিডাকাতি খুনখারাবি রাহাজানি প্রবঞ্চনা ধর্ষণ ইত্যাদি জঘন্য অপরাধ মানি। কিন্তু একস্থানের ভিসায় অন্যস্থানে শ্রম দেওয়া কোন্‌‌ ধরনের জঘন্য অপরাধ আমাদের বুদ্ধির অতীত! যদি তা জঘন্য অপরাধই হয়, তা হলে হত্যা কী ধরনের অপরাধ? যার জন্যে একজন মানুষকে আজীবন নিষেধাজ্ঞার গ্লানি বহন করতে হয়! এজন্যে মনে করি, সকল দেশের দূতাবাসকে সোচ্চার হতে হবে, আলোচনা করতে হবে এসব দেশপ্রধানদের সঙ্গে। মনে রাখতে হবে, স্বীয় জনস্বার্থ যেখানে প্রতিষ্ঠিত নয় সেখানে কোনো অধিষ্ঠান কল্যাণকর নয়। ঠিক আছে, ভিক্ষুকের জন্যে এক দ্বার বন্ধ হলে অন্যদ্বারের আশা আছে। তবে একি ন্যায়! এখানে যে তার জন্যে সকল দুয়ার বাঁধা! তা হলে ভিখারির ভিক্ষা কোথায়? এ কেমন কানুন? এক দেশের অপরাধে বহু দেশ নিষিদ্ধ! এক অপরাধে যেমন দশবার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না, তদ্রূপ এক অপরাধে দশ দেশ সাজা দিতে পারে কি? “আমরা মানুষকে ভালবাসি…আমরা মানবতার ঊর্ধ্বে…আমরা মুসলিম…আমরা আরব…” কিন্তু পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, মধ্যমরা মানবতার কত নিচে! পশ্চিমেরা এক দেশের অপরাধীকে কিন্তু আরেক দেশ আশ্রয় দেয়, সাজা দেয় না। তাই সেই আবহমানকাল হতে শোনা যাচ্ছে মানুষ পশ্চিমের গুণগ্রাহী। আজও দেখা যাচ্ছে সেই ধারাবাহিকতা জারি রয়েছে। টাকার পাহাড়ের বিনিময়ে মানুষ ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি দিতে প্রস্তুত। কিন্তু, ইদানীং দেখা যাচ্ছে বিনামূল্যেও মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে আসতে নারাজ! সেই একটা সময় ছিল দুবাইয়ের নাম শুনলে অনেকে আশ্চর্য অনুভব করত। আজকাল দেখা যাচ্ছে তার নামোচ্চারণেও যেকেউ অবজ্ঞা প্রকাশ করছে! এটা বৃহত্তর নামি অথবা ধনী একটি রাষ্ট্রের জন্যে কম লজ্জার বিষয় নয়। দুর্ভাগ্য এমন দেশের, যারা মানুষের আশ্রয়স্থল তৈরির মাধ্যমে সুনাম অর্জন করতে পারে না। দুর্ভাগ্য এমন ধনীদের, যারা অসহায়ত্বের জন্যে একদণ্ড সহায়তার হাতছানি দিতে পারে না।

 

প্রথমপর্ব

চলবে…

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top