প্রভুভক্তি
গল্পটা আমার বাবার কাছে শুনেছি। তাঁর জবানিতেই লিখছিঃ
১৯২৯ সালে আমার জন্ম। আমাদের একটা পাখড়া ঘোড়া ছিল। তখন ভালো রাস্তা-ঘাট ছিল না। কিন্তু আমার বাপজান-কে দূর-দূরান্তরে যেতে হতো। তাই তিনি ঘোড়ায় চলাফেরা করতেন। আমাদের ঘোড়ার সম্বন্ধে একটা সুন্দর গল্প আছে। গল্পটা বাপজানের মুখে শোনা। আমি ছিলাম আমার পিতামাতার বহু আকাংখিত পুত্র সন্তান। আমার জন্মের সপ্তম দিনে আমার আক্কীকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এইরকমের একটা আনন্দানুষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজন যেখানে যে আছে তাদের কাউকেই তো আর বাদ রাখা যায় না।
এসবের বেশীরভাগ আত্মীয়-স্বজনকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য বাপজান একদিন বের হয়েছিলেন আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকের সমস্ত আত্মীয়-স্বজনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। নয়/দশটা গ্রামের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ির দাওয়াত প্রদান তিনি একদিনে সেরে আসবেন এটাই তাঁর পরিকল্পনা।
সকালে ঘোড়ায় চড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে চারটা গ্রাম হয়ে তিনি যখন আমার বড় খালার বাড়িতে গিয়ে উঠলেন তখন বেলা দুপুর। বৈঠকখানা ঘরের খুঁটির সঙ্গে লাগাম আলতোভাবে একটা পেঁচ দিয়ে রেখে বাপজান বাড়ির ভিতরে গেছেন; ইচ্ছা এই যে খালাকে দাওয়াতটা দিয়েই তিনি অন্য একটা গ্রামে চলে যাবেন এবং জোহরের নামাজ সেখানেই পড়বেন। বাপজান বাড়ির মধ্যে যেতেই খালা তাঁকে বসতে দিয়েছেন।
বাপজানের কানে একটা হই-চই এর মত আওয়াজ যেন এলো। হঠাৎ একটা ছেলে দৌড়ে এসে খবর দিল, “আপনার ঘোড়া ছুটে গেছে।” বাপজান দৌড়ে বাইরে এসে দেখেন যে ঘোড়া পূরা কদমে বাড়ির দিকে ছুটে চলেছে। হয়েছে কি, বাপজান যখন ঘোড়া রেখে বাড়ির মধ্যে যান তখন ওইসব ছেলেমেয়েরাও এসে ঘোড়ার চারদিকে জড়ো হয় ঘোড়া দেখার জন্য। একসময়ে তারা উল্লাসে সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে এবং ওতেই হয়তো ভয় পেয়ে ঘোড়া বাড়ির দিকে ছুটতে শুরু করেছে।
বাপজান খুবই চিন্তিত হলেন। প্রথমতঃ ঘোড়া কি ঠিকমত বাড়ি পৌঁছবে না হারিয়ে যাবে? দ্বিতীয়তঃ বাপজানের সামনে তখন ছিল চৈত্র মাসের সমগ্র দিন এবং দিনের সমস্ত কর্ম পরিকল্পনা। আক্কীকার আর মাত্র তিন দিন বাকী। সেদিন যদি তিনি ওইদিকের সব দাওয়াত সারতে না পারেন তাহলে খুব অসুবিধা হবে। তাছাড়া তাঁর বাড়ি ফিরে আসার প্রশ্নও ছিল, তিনি তখন ছিলেন বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ মাইল দূরে! এইরকমের একটা নিরূপায় অবস্থায় পড়ে তিনি আর কি করেন।
ওজু করে জোহরের নামাজ পড়ে তিনি সামান্য কিছু খেলেন এবং তারপর খালার দক্ষিণ দূয়ারী ঘরের বারান্দায় মৃদুমন্দ বাতাসে গা এলিয়ে দিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে যেই একটু তন্দ্রার মতো এসেছেন অমনি কে যেন তাঁর কানে মধূ ঢেলে দিল, “আপনার ঘোড়া ফিরে এসেছে।” তিনি তড়াক করে উঠে পড়লেন এবং এক দৌড়ে বাইরের দূয়ারে এসে যা দেখলেন তাতে আনন্দে তাঁর চোখে পানি এসে গেল। তিনি দেখলেন যে গলদঘর্ম অবস্থায় তাঁর প্রিয় ঘোড়া তিনি যেখানে যে অবস্থায় তাকে দাঁড় করিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকেছিলেন সেখানে ঠিক সেই অবস্থাতেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে-যেন কিছুই হয়নি। বাপজানকে দেখে ঘোড়া খুব খুশী হলো বলে বোঝা গেল এবং বাপজানও খুব খুশী হলেন। তিনি তাড়াতারি গিয়ে ঘোড়ার লাগাম ধরলেন, ঘোড়ার গলায়, মাথায়, গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করলেন, ঘোড়া সে আদর গ্রহণ করলো। বাপজান লক্ষ্য করলেন যে, আর সবকিছুই ঠিক আছে শুধু গদীর উপর যে “চারজামা” বা আলগা একটা চাদরের মত থাকে সেইটা নেই, সম্ভবতঃ বাতাসে উড়ে কোথাও পড়ে গেছে।
বড় খালার ওখান থেকে বাপজান আরও পশ্চিমের একটা গ্রামে যান এবং সেখান থেকে ফিরতি পথে আমার নানার বাড়ি সোনাতলায় যান।
বিকাল পাঁচটার দিকে বাপজান আমার নানার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি ফিরে আসছেন। চৈত্রের বিকালবেলা বসন্তের ঝিরঝিরে বাতাস-কে পিছনে রেখে বাপজান পূর্বদিকে আসছিলেন মোটামুটি ধীরগতিতেই। আমাদের গ্রাম থেকে এক মাইল দূরের একটা গ্রাম থেকে দৃষ্টি চলে যায় এতখানি থাকতেই বাপজান দেখলেন যে একজন লোক গ্রাম থেকে বের হয়ে আসতে গিয়েই আবার গ্রামের মধ্যে ঢুকে গেল, হয়তো বা বাপজানের দিকে চোখ পড়তেই। রাস্তাটা যেখানে গ্রামকে ফোঁড় দিয়ে চলে গেছে পথিকদের বিশ্রাম এবং পানি খাওয়ার জন্য সেখানে একটা ছায়াদার আম গাছ ও একটা কুয়া ছিল বাপজান সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতেই একজন লোক সম্ভবতঃ সেই ফিরে যাওয়া লোকটিই হাঁসতে হাঁসতে এসে বাপজানের সামনে এসে দাঁড়ালেন, তাঁর হাতে বাপজানের ঘোড়ার গদির উপরকার সেই “চারজামা” খানা।
বাপজান ঘোড়া থেকে নামলেন এবং সালাম বিনিময়ের পর লোকটির কাছ থেকে যা শুনলেন তার বর্ণনা নিম্নরূপ।
লোকটি বলছিলেন যে তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। তিনি মাঠ থেকে বাড়ি ফেরার পথে আম গাছ তলায় কুয়ার ধারে বসে একটু জিরোচ্ছেন-একটু পরেই যাবেন, তাঁর বাড়ি ওখান থেকে মাত্র “এক ঢিল দূরে।” এমন সময়ে পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখলেন যে চৈত্রের ধু ধু দুপুরে ধূলা উড়িয়ে পশ্চিম থেকে একটা ঘোড়া তীড় বেগে ছুটে আসছে অথচ ঘোড়ার পিঠে কোনও সোয়ারী নেই। দেখতে দেখতে ঘোড়া পরিচিতির মত দূরত্বে যখন এলো তিনি তখন দেখেই বুঝলেন যে এতো জোড়দহ গ্রামের “প্রামাণিক সাহেবেরই” ঘোড়া কিন্তু সোয়ার কোথায়? আমার বাপজান বাইশ গ্রামের প্রধান ছিলেন, সেসব গ্রামের বিচার-সালিশ তিনিই করতেন এবং এলাকায় তাঁর পরিচিতি “প্রামাণিক সাহেব” হিসাবে। সোয়ার বিহীন ঘোড়ার এভাবে ছুটে আসতে দেখে তিনি আতংকিত হলেন। তবে কি খুন বা অন্য কোন দুর্ঘটনায় – – – ! ঘোড়া ততক্ষণে প্রায় বিশ হাতের মধ্যে চলে এসেছে, এমন সময় হঠাৎ গদির উপর থেকে চারজামাটা উড়ে মাটিতে পড়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াও হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ালো, বোধহয় এক মুহূর্ত কী যেন ভাবলো এবং তারপরেই লোকটি দৌড়ে গিয়ে ঘোড়ার লাগামটা ধরার জন্য উঠতে উঠতেই ঘোড়া আবার যে পথে এসেছিল সেই পথেই তীরবেগে ছুটে চললো এবং ক্ষণিকের মধ্যে পশ্চিম দিকে একটা গ্রামের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। সোয়ারবিহীন অবস্থায় ঘোড়ার ওইভাবে ছুটে আসা এবং ফিরে যাওয়া দেখে লোকটি কোনও নিশ্চিত দুর্ঘটনার আশংকা নিয়ে চারজামাটা তুলে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন এবং সাড়া দুপুর সেই কথাই ভাবছিলেন। তারপর এই একটু আগে মাঠে বের হতে গিয়ে বাপজানকে আসতে দেখেই তিনি দৌড়ে বাড়ি গিয়ে চারজামাটা হাতে নিয়ে এই এখানে এসে দাঁড়িয়েছেন।
বাপজান তাঁর হাত থেকে চারজামাটা নিলেন এবং পূর্বাপর সব ঘটনা লোকটাকে বললেন। তখন সমস্ত ঘটনাই তাঁদের দু-জনের এবং উপস্থিত আরও সকলের কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেল যে বড় খালার বাড়িতে ওই অপরিচিত জায়গায় ক্লান্ত দেহে একাকী শিশুদের কাছ থেকে যে অপূর্ব সম্বর্ধনা সে পেয়েছিল তার জন্যেই সে হয়তো ভীত হয়ে বাড়ির দিকে ছুটে চলেছিল, সোয়ারের কথা ভাবার মত অবস্থাও হয়তো তার ছিল না কিংবা সে খেয়ালও ছিল না কিংবা হয়তো বা মনে করেছিল যে সোয়ার পিঠেই আছে। কিন্তু অনেকদূর এসে যেইমাত্র পিঠের উপর থেকে চারজামাটা উড়ে গেছে তখনি তার খেয়াল হয়েছে যে সর্বনাশ! সোয়ার তো পিঠে নাই! তখনি হয়তো তার সব কথা মনে পড়েছে এবং তাই ছুটে গিয়ে শিশুদের সেই অদ্ভূত সম্বর্ধনার ভয়কে উপেক্ষা করে ঠিক যেখানে এবং যেভাবে বাপজান প্রথমে নিয়ে তাকে দাঁড় করিয়েছিলেন সেইখানে এবং সেইভাবেই গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সকলে খুব অবাক হলো এই ভেবে যে, অজানা অচেনা রাস্তায় ঘোড়া ঠিক ঠিক রাস্তা চিনে এলো এবং গেলো কীভাবে?
লোকটাকেও দাওয়াত করে বাপজান যথাসময়ে বাড়ি ফিরে এলেন এবং পরে যথাসময়ে আমার আক্কীকাও সম্পন্ন হয়ে গেল।
আরবী ঘোড়ার প্রভুভক্তির আশ্চর্যজনক বহু গল্প বই-পুস্তকে পড়েছি। কিন্তু আমাদের এই ঘোড়াটির যে প্রভুভক্তি উক্ত ঘটনাটির মধ্যে প্রকাশ পায় তা কি সে সব গল্পের চাইতে কোনও অংশে কম আশ্চর্যজনক ও কম চিত্তাকর্ষক?