Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

প্রিয়ন্তী-শেষ পর্ব (সংস্কারের প্রাচীর ভাঙ্গা তরুণী )

: | : ৩০/১১/২০১৩

Priontiপরদিন অর্পনের বাবার সঙ্গে কথা বলে প্রিয়ন্তী অর্পনের জন্য আরো সময় বাড়িয়ে দিয়েছে তাতে তার টিউশন ফি বেড়েছে আরো এক হাজার টাকা। এই বাড়তি সময় পড়াতে গিয়ে প্রিয়ন্তীর ইদানীং বাসায় ফিরতে দেরি হয়। প্রিয়ন্তী প্রায় দিনই বাসায় ফিরে দেখে সুশান্ত ঘরে কিংবা বারান্দায় পায়চারি করছে। কোনদিন গম্ভীর মুখে বসে আছে। সুশান্তর মুখ দেখে প্রিয়ন্তীর কথা বলতে ভয় করে।
সেদিন রাতে অর্পনের বাবা প্রিয়ন্তীকে মোবাইল করার পর থেকে সুশান্তর মনের মধ্যে একটা সন্দেহ দানা বেঁধেছে, অর্পনের বাবা প্রিয়ন্তীকে মোবাইল করবে কেন? বেশি করে সময় দিবে কেন? অর্পনের পড়ার জন্য যতটুকু সময় প্রয়োজন ততটুকু সময়ই পড়াবে। প্রিয়ন্তী দেরিতে ফিরলে আমার কষ্ট হয় একথা বললে কি প্রিয়ন্তী বিষয়টা সহজভাবে নিবে? প্রিয়ন্তী যদি মাইন্ড করে? যদি বলে সুশান্ত তুমি আমাকে সন্দেহ করছ?
না সুশান্ত কিছু বলবে না। আরো কিছুদিন দেখবে, প্রিয়ন্তী যদি নিজেই বুঝতে পারে তবে আর তাকে বলার প্রয়োজন কী?
কিন্তু প্রিয়ন্তী নিজে থেকে কিছু বলল না। প্রায় দিনই দেরিতে বাসায় ফিরে, আজ সুশান্ত মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রিয়ন্তীকে সে তার কষ্টের কথা বলবে, প্রিয়ন্তী এভাবে হয় না, সামান্য ক’টা টাকার জন্য আমাদের এমন সুন্দর মুহূর্তগুলো ম্লান হয়ে যাবে? একটা হাসি দিয়ে বলে, তুমি অনেক আগে ফিরেছ, না? আর দেরি হবে না। কি করব বলো? ছোট ছেলে তো, একেবারে একা। আমি যখন চলে আসার জন্য উঠে দাঁড়াই তখন আমার দিকে এমন করে তাকায় যে ওকে ছেড়ে আসতে আমার খুব কষ্ট হয়।
ওকে ছেড়ে আসতে কষ্ট হয় আর আমাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয়, না? আসলে ওকে ছেড়ে আসতে কষ্ট হয় নাকি ওর বাবাকে ছেড়ে আসতে কষ্ট হয়? ছিঃ প্রিয়ন্তী তুমি..
কলিং বেল বেজে উঠল। সুশান্ত চমকে উঠল। বাসায় দিলীপ এবং তিথি বাসায় নেই। সুশান্ত দরজা খুলে দিল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রিয়ন্তীর বুক কেঁপে উঠল, কী ব্যাপার সুশান্ত?
কিছু না।
কিছু না কেন? নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে, আমাকে বলো?
প্রিয়ন্তী কথা বলো না, আমার ভালো লাগছে না।
তুমি একটু বসো, আমি চা তৈরি করছে।
সুশান্ত নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল, সে চেয়ারে বসল।
প্রিয়ন্তী চা তৈরি করল, চা তৈরি করতে করতে সে দু’য়েকবার সুশান্তর মুখের দিকে তাকিয়েছে কিন্তু রাগ কমেনি। সে চায়ের কাপ সুশান্তর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, সুশান্ত কী হয়েছে আমাকে বলো? আমি কোন দোষ করেছি?
সুশান্ত কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর গম্ভীর মুখ তুলে বলল, প্রিয়ন্তী তোমার টিউশনিটা ছেড়ে দিলে হয় না?
কেন?
প্রিয়ন্তী তোমার আজকাল আসতে অনেক দেরি হচ্ছে, একা বাসায় থাকতে আমার খুব খারাপ লাগে।
কিন্তু তাই বলে এত সুন্দর একটা টিউশনি, মাসে মাসে অনেকগুলো টাকা। টিউশনিটা ছেড়ে দিব।
হ্যাঁ, ছেড়ে দাও।
তারপর দিন চলবে কী করে?
চলবে কোনভাবে?
সুশান্ত আমাকে বোঝাও দিন চলবে কী করে? আমি ছেড়ে দিব।
সুশান্ত আর কিছু বলল না। তার মনে তখন অনেক কথা বিড় বিড় করছে, দিন চালানোর অজুহাতে তুমি টিউশনিটা ছাড়বে না। একদিন এমন ছিল তুমি আমার জন্য পৃথিবীর সব ছাড়তে পারতে, ছেড়েছেও কিন্তু আজ আমার জন্য সামান্য একটা টিউশনিও ছাড়তে পারছ না। আমার চেয়ে তোমার কাছে টিউশনিটা বেশি হলো?
তখন রাত দশটা বাজে, সুশান্তর ঘাড় ব্যথা শুরু হলো, চোখ দু’টো লাল যেন ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। ব্যথায় সে অস্থির হয়ে পড়ল। প্রিয়ন্তী জিজ্ঞেস করল, ঘাড়ে তেল মালিশ করে দিব?
সুশান্ত কিছু বলল না।
প্রিয়ন্তী ঘাড়ে তেল মালিশ করে দিল অনেকক্ষণ কিন্তু কোন উন্নতি হলো না।
দিলীপ এবং তিথির পরামর্শে রাতেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। না তেমন কিছু হয়নি, প্রেসারটা বেড়েছে ডাক্তার প্রেসারের ঔষধ দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে ডাক্তার বলে দিয়েছে প্রেসারের ঔষধটা যেন কোনদিন বাদ না যায়? প্রেসারের ঔষধ খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে সুশান্ত সুস্থ হয়ে উঠল।
সেদিনের পর প্রিয়ন্তী কয়েকদিন তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছে। তারপর থেকে আবার দেরি করে বাসায় ফিরতে শুরু করেছে। প্রিয়ন্তী পড়েছে উভয় সংকটে, একদিকে বেশি বেতনের একটা টিউশনি, অর্পনের মতো নিষ্পাপ শিশুর আকুতি আরেকদিকে সুশান্তর অভিমান। সে আসলে কী করবে বুঝতেই পারছে না। সব সময় তার মনের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা কাজ করছে। সে কোন দোষ করছে না অথচ সুশান্ত তাকে দোষী ভাবছে, সে কোনভাবেই সুশান্তকে বোঝাতেই পারছে না।
আজকাল সুশান্তও দেরিতে বাসায় ফিরে। কোচিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে কোন কোনদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় বেড়াতে যায়, কোনদিন পদ্মার পাড়ে বেড়াতে যায়। প্রিয়ন্তী কিছু জিজ্ঞেস করলেই রেগে যায়, তুমি বাসায় থাকো না তো আমি একাই বাসায় তাড়াতাড়ি এসে কী করব?
প্রিয়ন্তী সুশান্তর একথার কোন জবাব দিতে পারে না। সুশান্ত শুকিয়ে গেছে, তার চোখের গোড়া কালো হয়ে গেছে, ক’দিন থেকে দাড়ি সেভ করেনি মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়েছে। প্রিয়ন্তী সুশান্তর এ অবস্থা সইতে পারে না আবার কিছু বলতেও পারে না।
সেদিন সুশান্ত আসতে দেরি হলো। প্রিয়ন্তী মোবাইল করল কিন্তু সুশান্ত মোবাইল রিসিভ করল না। একটি অপরিচিত কণ্ঠের মানুষ মোবাইল রিসিভ করেছে।
প্রিয়ন্তী চমকে উঠল, আপনি কে? সুশান্তর মোবাইল আপনার হাতে কেন?
সুশান্ত, সুশান্ত আপনার কে হয়?
আমার হ্যাজবেণ্ড।
আপনার হ্যাজবেণ্ড এখন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, আপনি এখুনি হাসপাতালে চলে আসুন।
প্রিয়ন্তী জোরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল, ও মা গো।
তিথি এবং দিলীপ দুজনে একসঙ্গে তাদের ঘর থেকে বের হলো, প্রিয়ন্তী কী হয়েছে?
তিথি সুশান্ত হাসপাতালে, দাদা চলুন তো একটু আমার সঙ্গে, প্রিয়ন্তী কাকুতি করে বলল।
ঠিক আছে চলো, বলে সবাই এক কাপড়ে বের হলো।
মেডিক্যাল কলেজের গেট দিয়ে একে একে জিজ্ঞেস করতে করতে সবাই হৃদরোগ বিভাগে এলো। সুশান্তর নাকে মুখে একটা যন্ত্র লাগানো আছে। একজন সাদা ইউনিফর্ম পরা লোক তার পালস পরীক্ষা করে বলল, এখানে পেশেণ্টের কেউ আছেন?
প্রিয়ন্তী কান্নজড়িত কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ আমি।
সরি, তিনি হার্ট এ্যাটাক করেছিলেন, আমরা চেষ্টা করেছি কিন্তু সম্ভব হলো না।
প্রিয়ন্তী সুশান্তর বুকের ওপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে, তুমি তো জানো কোচিং থেকে একটু দেরিতে ফিরলেই আমি কেমন চঞ্চল হয়ে পড়ি। তুমি কেমন করে আমাকে ছেড়ে চলে গেলে।
হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী একটা স্ট্রেচার নিয়ে এসে তারা সুশান্তর মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে বের করল। দিলীপ প্রিয়ন্তীর কাছ থেকে মোবাইলটা নিয়ে তার শ্বশুরবাড়ি মোবাইল করল। তার শ্বশুর তো মোবাইলে পাগলের মতো কেঁদে উঠল। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমরা আমাকে আগে খবর দিলে না কেন? আমি আগে খবর পেলে যেমন করেই হোক, যত টাকাই হোক সুশান্তকে বাঁচিয়ে তুলতাম।
দিলীপ বলল, আমরাও জানতাম না, খবর পেয়ে যখন হাসপাতালে এসেছি তখন সে আর নেই।
প্রিয়ন্তী, তিথি আর দিলীপ তিনজনে উভয় পক্ষের গার্জিয়ানদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত হলো, সুশান্তর মৃতদেহ এ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে তাদের গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাবে।
সুশান্তর মৃতদেহ নিয়ে হাসপাতালের একটা এ্যাম্বুলেন্স তাদের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। এ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার ছাড়া আরো তিনটি মানুষ যেন বোবা কারো মুখে কোন কথা নেই, শুধু প্রিয়ন্তী মাঝে মাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে আবার কখনো ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে আর তিথি তার চোখে মুখে পানি দিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলছে।
এ্যাম্বুলেন্স যখন সুশান্তদের বাড়ির সামনে খোলা আঙিনায় পৌঁছালো তখন সুশান্তর মা অজ্ঞান হয়ে উঠানে পড়ে আছে, তাকে কয়েকজন পাখার বাতাস করছে কেউ বা মাথায় পানি ঢালছে। তার বাবা বোবা হয়ে একটা ইজি চেয়ারে বসে আছে যেন বাড়িতে কিছুই হয়নি। তার বোধ শক্তি আছে বলে মনে হলো না।
সুশান্তর মৃতদেহ খোলা আঙিনায় একটা খাটিয়ার ওপর রাখা হয়েছে সেখানে একজন কাজের লোক পাহারা দিচ্ছে যেমন করে মানুষ কোন উচ্ছিষ্ট কোন কিছু পাহারা দেয়।
আরো ঘণ্টা খানেক পর প্রিয়ন্তীদের বাড়ি থেকে তার মা আর দাদা অরুণ এলো। তার মা অজ্ঞান প্রায়, তাকে সবাই ধরাধরি করে উঠানে নিয়ে গেল। তার দাদা অরুণের চোখে পানি। প্রিয়ন্তী অরুণের বুক চাপড়ে বলল, আজ কেন এলি? নিচু জাতের বাড়িতে? আজ কেন এলি? তোদের জন্য, তোদের জন্য আজ আমার হাত থেকে শাঁখা খুলে ফেলতে হচ্ছে, কপাল থেকে সিঁদুর মুছে ফেলতে হচ্ছে। তোরা সবাই চলে যা।
তিথি সান্ত্বনা দিল, প্রিয়ন্তী চুপ কর বোন, তোর কপালে যা ছিল তাই হয়েছে, এখানে কারো কোন দোষ নেই।
প্রিয়ন্তীর কান্না থামলো না, সে পাগলের মতো কান্না করতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর তাকে সুশান্ত মৃতদেহর কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। সে বুঝতে পারল না, কারণ এর আগে সে কোন মৃতদেহ এবং তার বিধবা স্ত্রী দেখেনি। এসব সংস্কারের কাছে সে পরিচিত না। প্রিয়ন্তী মোটা করে সিঁদুর পরতো এটা দেখে একদিন তিথি বলেছিল, এত মোটা করে সিঁদুর পরতে হয় না।
প্রিয়ন্তী জিজ্ঞেস করেছিল, কেন রে?
মাথায় সিঁদুর থাকলে আর কেউ তাকায় না, তখন নিজেকে খুব ছোট এবং অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।
প্রিয়ন্তী বলেছিল, আমার তো সিঁদুরটাই সব রে, মাথার সিঁদুরটা ছাড়া তো আমার আর কিছু নেই।
একদিন সুশান্ত তার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছিল সেদিন তার মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবকিছু সে জয় করেছে, স্রষ্টার কাছ থেকে তার সব পাওয়া হয়ে গেছে। কয়েকজন বিধবা মহিলা এলো, তারা প্রিয়ন্তীকে সুশান্তর মৃতদেহের কাছে নিয়ে গিয়ে সুশান্তর পা দিয়ে তার মাথার সিঁদুর মুছে দিল। তখন প্রিয়ন্তী কান্নায় গড়াগড়ি যাচ্ছে কিন্তু সেদিকে কারো কোন দয়ামায়া বলতে কিছু নেই। সুশান্ত এখন লাশ যত তাড়াতাড়ি তার সৎকার করা যায় ততই পুণ্য।
একটা খাটিয়ার চার পাশে চারজন কাঁধে নিয়ে বল হরি, হরি বল বলে সুশান্তর মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সুশান্তর লাশ ভস্ম হলো।
কৃষাণ দত্তের বাড়ির অদূরে একটা বড় পুকুর আছে পরদিন তাকে পুকুরে নামিয়ে তার পরনের কাপড় বদলিয়ে সাদা শাড়ি পরানো হলো, শাঁখা খুলে দেয়া হলো। তারপর অনেকক্ষণ ধরে প্রিয়ন্তীকে বিধবার চাল-চলন সম্পর্কে জ্ঞান বিতরণ করা হলো।
প্রিয়ন্তী বুঝতে পারল যে, যে সমাজ, সামাজিক, আর্থিক বা জন্মগত বৈষম্যর কারণে তাদের দুজনের বৈবাহিক সম্পর্ককে মেনে নেয়নি, সুশান্তর মৃত্যুর পর তার শাঁখা, সিঁদুর খুলে, সাদা শাড়ি পরে বিধবা সাজিয়ে স্বামী-স্ত্রীর স্বীকৃতি দিয়ে স্বীকার করে নিল, বর্ণ-গোত্র যা-ই হোক না কেন সুশান্ত তার স্বামী। এখন সে সমাজে স্বীকৃত স্বর্গবাসী সুশান্তর বিধবা স্ত্রী।

সমাপ্ত

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top