ছায়া চন্দ্রা ও সমুদ্রের সংসার-৭
-মহামতি চন্দ্রমুখী দেবী,এতক্ষণ যা শুনলেন বাস্তবতার সাথে তার কোন মিল নেই।যদি কারও জীবনের সাথে মিলে যায়,তাহলে লেখক দায়ী নয়।
চন্দ্রার বেশ রাগ উঠছে।ছেলেটার মাথায় কি সমস্যা আছে নাকি?-ফাযলামি করবেন,করেন,তাই এসব বিষয় নিয়েও?এটা আপনি ঠিক করেন নি।
-ফাযলামিতো ফাযলামিই,এত সিরিয়াসলি নিচ্ছ কেন?
-সবকিছুর একটা লিমিট আছে।আপনি লিমিট ক্রস করেছেন।
-আচ্ছা সরি।
-আপনি কি সবসময় মিথ্যা কথা বলেন?
-কি করব বল,ছোটবেলার অভ্যাস।আর মিথ্যা কথা বলা আমার একটি প্রিয় কাজগুলোর একটা।
-আজব।এমন পাবলিক আর একটি দেখিনি,মিথ্যা কথা বলা নাকি প্রিয় কাজ?
-বুঝ তাহলে,কত বড় ভাগ্য তোমার,এমন আজব পাবলিকের সাথে তোমার পরিচয় হয়েছে।
-ভাগ্য না ছাই।আমি বললে কি মিথ্যা কথা বলা ছাড়বেন?
-তুমি বললেই মিথ্যা কথা বলা ছাড়ব কেন?
-তাও ঠিক,আমি বললে ছাড়বেন কেন?আমি তো আর আপনার কেউ হই না।
সমুদ্র ম্যাসেজ পাঠাবে,দেখে চন্দ্রা আর অনলাইনে নেই।মনে হয়,মেয়েটা বেশ কষ্ট পেয়েছে।এতটা বুঝি ফাযলামি করা ঠিক হয় নাই।
রাত্রি বারটা বাজে।মোহিত বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।আকাশে আধা চাঁদ দেখা যাচ্ছে।হালকা বাতাস।অলক এসে কাধে হাত রাখে।অলক বলে-বন্ধু মেয়েতো একটা পছন্দ হয়েছে,কি করা যায় বলতো?
-সেইজন্যইতো উড়ু উড়ু ভাব দেখতে পাচ্ছি।কি, মেয়েটা কে?
-আমাদের ক্লাসেরি।
-কে বলতো?
-দেখি ধারণা করতো।
মোহিত কয়েকটা মেয়ের নাম বলে।অলক হেসে বলে-না রে হল না?
-কে বলতো?
অলক মুচকি হেসে বলে-চন্দ্রা।
মোহিত কিছুটা চমকে উঠল।কিন্তু বুঝতে দিল না।অলক যে ফাযলামি করছে বুঝতেই পারছে না।দম ফাটা হাসি পাচ্ছে।হাসি চেপে রেখে বলল-তোর কি হয়েছে বলতো?
-কই,কিছু হয় নিতো?
-না,বেশ চেঞ্জ দেখছি।বেশ ফিটফাট হয়ে বিভাগে যাচ্ছ।কোনদিন সেন্ট ইউস করতে দেখিনি,কয়েকদিন ধরে সেন্ট মেরে যাচ্ছ।চুলগুলো স্পাইক করছ।দিনে কমকরে হলেও ছয় সাতবার ফেসিয়াল দিয়ে মুখ ধুচ্ছ।এসবের মানে কি?
-মানে কি আবার,শরীরের যত্ন নিতে হবে না?
-এই,এইসব কথা ছাড়তো।এই তুইতো আবার চন্দ্রার প্রেমে পড়িস নি?মানে মানে বলে দিচ্ছি,ওই দিকে কিন্তু ভুলেও তাকাবি না।
মোহিত কোন কথা বলল না।চোখে মুখে চিন্তার পূর্ণ ছাপ।
-কি কথা বলছিস না কেন?
মোহিত অলকের হাত ধরে বলল-ভাই,চন্দ্রার পিছু ছেড়ে দে না?
-সেতো ছাড়া যাবে না।এমন মেয়ে হাতছাড়া হলে তো আর পাব না।এছাড়া এই প্রথম কোন মেয়েকে খুব বেশি পছন্দ হয়েছে।
-ভাই,আমি ওকে ভালবেসে ফেলেছি।তুই প্লীজ সরে যা।
-আচ্ছা দেখা যাবে,চন্দ্রা যাকে সিলেক্ট করে।তুইতো এখানো এগিয়ে।ওর সাথে বেশ যোগাযোগ আছে তোর।
এভাবে তাদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চলতে থাকে।দ্বন্দ্ব আরও বাড়তে থাকে।অলক কিছুতেই চন্দ্রার পিছু ছাড়তে রাজি নয়।
ভরদুপুর বেলা।প্রচন্ড রোদ উঠেছে।এর মাঝে শিলা,মিলা আর চন্দ্রা টিএসসি যাচ্ছে।সময় বেশি লাগবে না,মিনিট পাঁচেক।একটা ছাতা থাকলে বেশ হত।শরীর মনে হয় ঝলসে যাচ্ছে,এমন অবস্থা।টিএসসির চায়ের দোকানে বসে।চন্দ্রা বলে-মামা তিনটি চা।
একঝাক ছেলে রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে।অপরাজয় বাংলার সামনে যাবে।হালকা পাতলা শ্লোগান হচ্ছে।
-শেখ হাসিনা ভয় নাই,রাজপথ ছাড়ি নাই।এক মুজিব লোকান্তরে,লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে।ছাত্রলীগের মূলনীতি,শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি।
ইত্যাদি এসব এসব।নিরীহ ছাত্রগুলো নিতান্তই সিটের জন্য রাজনীতি করে।রাজনীতি করলেই হলে সিট পাওয়া যাবে,হলে যা খুশি করা যাবে,তাই বাধ্য হয়েই করা।বাইরে থাকলে যে খরচ,তার ব্যয়ভার বহন করা কষ্টসাধ্য। বেশিরভাগ ছাত্রই লোয়ার মিডিল ক্লাস অথবা মিডিল ক্লাস।যাদের বেশিরভাগই চলতে হয় টিউশনি করে।এতক্ষণে ওরা চা পান করা শুরু করেছে।মিলা একটি ছেলে দেখিয়ে বলে-দেখ,ছেলেটা কেমন করে তাকিয়ে আছে?চোখের দিকে তাকালেই বুঝা যাচ্ছে,মেয়ে দেখলেই প্রেমে পড়ে যায়।
শিলা মৃদুস্বরে বলে-সেতো শুধু ঐ ছেলের সমস্যা নয়।পৃথিবীর সমস্ত ছেলেদের একই প্রভলেম।কেউ কেউ নিজেদের লুকিয়ে রাখে,কেউ কেউ আবার এর মত হা হয়ে তাকিয়ে থাকে।
মিলা মুচকি হেসে বলে-দোস্ত দেখ,তোর দিকেই তাকিয়ে আছে।
-আমার দিকে না জনাব,আপনার দিকেই।
-আমাদের কারও দিকে নয়,চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে আছে।দেখ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।
শিলা চন্দ্রার কাধে হাত রেখে বলে-সখি,তাকাও না একটু।মজনু তোমার কত আশা করে দাড়িয়ে আছে।
চন্দ্রা তেমন কিছু বলে না।শুধু বলে-তোদের ইচ্ছা হয়,তোরা দেখ।
চন্দ্রার মাথায় অর্ণবের কথা বারবার ঘুরেফিরে আসছে।ছেলেটার হল কী?যেই থেকে তার বন্ধুর সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছে,সেই থেকে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে।এইরকম করছে কেন,তার বন্ধুর সাথে এমন কিছু হয়নি যে যোগাযোগ কমিয়ে দিতে হবে।
মিলা ধাক্কা দিয়ে বলল-এই কি হল তোর?এত কি ভাবছিস?
শিলা চন্দ্রাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলে উঠে-নতুন প্রেম তো,প্রেমিকের ভাবনায় মজে আছে।
-প্রেম,কার সাথে?
বলেই হেসে দেয় চন্দ্রা।
-কেন,সেই যে তোকে ম্যাসেজ দিল।ওরে কি রোমান্টিক ম্যাসেজ রে বাবা?
-শিলা ঠিক হচ্ছে না কিন্তু।
মিলা বেশ উৎসাহ নিয়ে বলে-কি লিখেছিল রে শু?
-তোমাকে ছাড়া যে একটা দিন কাটানো কত কঠিন,তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।যাই করতে যাচ্ছি,মনে হচ্ছে আমার পাশেই বুঝি দাড়িয়ে আছ।দিন দিন এ কোন গহ্বরের দিকে যাচ্ছি,যার আদি,অন্ত,মধ্য কিছু নেই মনে হচ্ছে।এ কোন ঘোরের গভীরে ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছি,তা জানি নে।
শিলা চন্দ্রাকে গালে হালকা থাপ্পড় দিয়ে বলে-ছেলেটার নাট বল্টুতো সব আউট করে দিয়েছেস চাঁদ।
মিলা এবার হেসে বলে-আমাদের চাঁদরও যে নাট বল্টু গেছে।সে কি লিখেছে শোন?
-বল।
-তাই বুঝি?এত তাড়াতাড়ি কাউকে না জেনেশুনে সবসময় সাথে সাথে রাখবেন না।অর্ণব বলেছিল,আপনি লেখালেখি করেন।আজ তার প্রমাণ পেলাম।বেশ ভাল লাগল।
-ও তলে তলে এতদূর চলে গেছ।লায়লি মজনুও তো ফেল মেরে যাবে।
ওরা উঠে পড়ে।ধীরে ধীরে হাটতে হাটতে হলে চলে যায়।চন্দ্রা রুমে ঢুকেই স্নান করার জন্য বের হয়।ঝর্ণা হতে অবিরল ধারায় পানি পড়তে থাকে শরীরে।চন্দ্রা নিঃশব্দে কাদতে শুরু করে।তার হূ হূ করে কাদতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু লজ্জায় হূ হূ করে কাদতে পারছে না।
বিকেলবেলা।চন্দ্রা ঘুমাতে চেষ্টা করে।কিন্তু ঘুম আসে না।ফেসবুকে ঢুকে।ঢুকতেই সমুদ্র লিখে পাঠায়-হাই।
-বলুন।
-একটি গবেষণা করছি।একজন মানুষ সপ্তাহে কয়বার কান্না করে।
-আপনার কি খেয়েদেয়ে কোন কাজ নেই?
-কোনও কাজই ছোট নয় মহামতি।এবার বলুনতো,এই সপ্তাহে কখনও কেঁদেছেন কিনা?
-আমার মনে নেই।একটা কথা বলি।
-বল।
-আপনাকে আমি দাদা বলি।
-দাদাই তো বলবে,নো প্রভলেম।
চন্দ্রা আরও ভ্যাবাচেকার মধ্যে পড়ে গেল।কেন সে দাদা শুনতে রাজি হবে?এখনতো সবাই কত সুন্দর করে নাম ধরে ডাকে,তুমি তুমি করে বলে।
-না অর্ণবকে দাদা বলতে চেয়েছিলাম,রাজি হয় নি।
-রাজি হবে না কেন?
-আপনার বন্ধু,আপনি ভাল জানেন।
-তোমার বড় ভাইয়ের জন্য একটি মেয়ে দেখ।কয়েকদিন পর তো চাকরি করা শুরু করবে।
-কোন বড় ভাই?আপনি না অর্ণব?
-আমার জন্যতো দেখতে হবে না,অর্ণবের জন্যই দেখ।
কথাটা তেমন কিছু না।তবু বেশ লাগল।
-আচ্ছা দেখব।অর্ণবতো এখন আর খোঁজখবর নেয় না।আগে দিনে অন্তত দুই তিনটা ম্যাসেজ দিত।
-আচ্ছা বন্ধুকে বলে দিব।
-বাসায় গেছেতো,মাসিমার আদরে বোনটার কথা একেবারে ভুলে গেছে।আমার ভাইটা একেবারে ভাল না।
-এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না,বন্ধুর সামনে বন্ধুর বদনাম।
-ওকে ঠিক আছে।আর করব না।ও অর্ণবকে একটা রিকোয়েস্ট পাঠালাম।
-খুব ভাল কাজ করেছ।ওর মত ছেলে ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা ভাগ্যের ব্যাপার।
চন্দ্রা কিছুটা রেগে লিখে পাঠাল-এর মানে কি?
-ভাল ছেলেকে তো ভাল বলতেই হবে।আমার দেখা খুব ভাল ছেলেদের ও একজন।
-ভালতো, ভাল না?আপনি আপনার বন্ধুর প্রশংসা করবেন,আপনার বন্ধু আপনার প্রশংসা করবে,খুব ভাল।
এই লিখে চন্দ্রা ফেসবুক হতে লগ আউট করে।ঘটনা কেমন কেমন প্যাচ প্যাচ লাগছে।সমুদ্রকে দাদা বলতে চাইলে সহজেই রাজি হয়ে গেল,অথচ অর্ণব দাদা শুনতে কিছুতেই রাজি নয়।এর মানে কি?অর্ণব কি তাকে পছন্দ করে?না,কিছুতেই কিছু মাথায় ঢুকছে না।বিছানায় শুয়ে পড়ে।মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে।মনে মনে যে কল দিয়েছে,প্রথমে তাকে বকা দেয়।এরপর মোবাইলটা হাতে নেয়।মোহিত কল দিয়েছে।এসময়ে গাধাটা কেন আবার কল দিয়েছে?গাধাটা দেখি বেশ জ্বালাতন শুরু করেছে।কল ধরল না।গাধাটা আবার কল দিয়েছে।
-মোহিত বল?