বড় সাধ করে সেদিন সেজেছিল ছোট্ট পরীটি !
এ বাড়ীতে যে জিনিসটি পরীর কাছে সব চাইতে বেশী প্রিয় তা হল এই বিশালাকার বাহারী ড্রেসিং টেবিলটা ! এর ঝকঝকে আয়নাটার ভিতর দিয়ে নিজেকে দেখতে কি যে ভাল লাগে পরীর !
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ড্রেসিং টেবিলটা খালাম্মার শোবার ঘরে রাখা । যেখানে বিনা কারনে যখন তখন ঢুকাটা কঠোরভাবে নিষেধ । এই বাড়ীতে অবশ্য এমন অনেক বিধি – নিষেধ জারী করা আছে খালাম্মার ! প্রথম প্রথম এসব ক্ষেত্রে তার প্রায়ই ভুল হয়ে যেত ! আর সঙ্গে সঙ্গে কপালে জুটেছে বদমেজাজী খালাম্মার নানান ধরণের অভিনব আর কঠিন সব শাস্তি ! ফলে এখন এসব ব্যাপারে ভারী সতর্ক হয়ে গেছে পরী ।
অভিজ্ঞ পরী এখন চেষ্টা করে খালাম্মার মনমতো চলতে । আচমকা ক্ষেপে ওঠাখালাম্মার প্রচন্ড মারকে দারুন ভয় তার । শুধু পারেনা ঐ হতচ্ছাড়া আয়নাটার প্রতি তার গোপন লোভটাকে নিজের মন থেকে পুরোপুরি ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে । আর তাইতো সারাদিনে বিভিন্ন কাজের ছুতোয় যখনই এই ঘরটাতে ঢোকার সুযোগ পায় , তার মধ্যেই নানারকম কান্ড কারখানা করে বসে । কখনো আয়নার মধ্যে নিজেকে নিজে জিভ বের করে ভেংচি কেটে দেয় ! মন চাইলে কখনো বা ফিক করে হেসে ফেলা হাসি উপহার দেয় নিজেকেই ! তবে এসবই পরী করে অতি সতর্কতার সাথে ! যাতে কোনমতেই তা খালাম্মার চোখে না পড়ে ।
আজ অবশ্য কোনরকম সতর্কতার প্রয়োজন নেই । তাকে বাসায় একা তালা মেরে রেখে সবাই কোথায় দাওয়াত খেতে গেছে । সুতরাং কয়েকঘন্টার জন্য পরী বাসায় সম্পূর্ণ একা । তবে যাবার আগে খালাম্মা কিছু কাজও দিয়ে গেছে অবশ্য । সেগুলি একটা একটা করে সেরে তারপর এসে ঢুকলো খালাম্মাদের ঘরে । বিছানার উপর ছড়ানো খালাম্মা খালুজানের কাপড়গুলো গুছিয়ে জায়গামতন রাখলো । বিছানাটাও গোছালো পরিপাটি করে । সবশেষ করে এসে দাঁড়ালো তার ভীষণ প্রিয় ড্রেসিং টেবিলটার সামনে । এটাও গোছগাছ করে রাখতে হবে খালাম্মারা ফিরে আসার আগেই ।
কিন্তু ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখা মাত্রই যেন সব ভুলে গেল পরী । মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিজের প্রতিবিম্বটার দিকে । হটাৎ করেই যেন তার নিজেকে মনে হল মহারানী ভিক্টোরীয়া । বড়দের কাছে শোনা অনেক রাণীর নামের মধ্যে এই ভিক্টোরিয়া নামটা তার ভারী পছন্দ । এমন নাম ছাড়া যেন রাণীদের মানায়ই না – অন্তত এমনটাই মনে হয় তার ।
– হা হা হা ..আমিই মহারাণী ভিক্টোরিয়া !
বলতে বলতে যেন একজন সত্যিকার রাণীর মতই গর্বিত ভঙ্গিতে হেসে ওঠে পরী । তারপরই যেন তার মনে পড়ে , রাণীরা এতোটা সাধারণভাবে নিশ্চয়ই থাকে না । রাণীদের সব সময়ই অন্তত খানিকটা সেজে গুজে থাকা উচিৎ । আর তার তো সাজার মতন জিনিসেরও অভাব নেই । এই তো সমনেই পড়ে আছে লিপষ্টিক , নেইল পলিশ , মেকাপের বাক্স – আরো কত্তো কিছু ! এখন রাণী হিসেবে একটু সাজগোজ করাই যেতে পারে !
নিজের খেয়ালে ডুবে থাকা মহারাণী আন্মণে হাত বাড়ায় তার সাজসজ্জার সামগ্রীগুলোর দিকে !
২ .
– কেডা খায় কেডা খায় দেহি তো ! আমার ময়না আম্মায় খায়নি ? আয় হায় হারামী কাউয়াডায় দেহি খাইতে আইতাসে ! তাড়তাড়ি আঁ করো আম্মা ! আঁআআআআআ ….
ভাত খেতে বসে প্রতিদিনের মত মজার খেলা চলছে মা মেয়ের মধ্যে । সে আর খাবে না । আর মাও তাকে জোর করে সবটুকু ভাত খাওয়াবেই । এই নিয়ে মায়ের কতো চেষ্টা ! কতো অভিনয় ! মায়ের নিঁখুত অভিনয় দেখে সত্যিই কাক আসছে মনে করে ভয় পেয়ে যায় পরী । তাড়াতাড়ি মায়ের বাড়িয়ে ধরা লোকমা নেয়ার হাঁ করতে যায় বড় করে !
উহ মাগো !
হাঁ করার সাথে সাথে সমস্ত মুখ তার বিকৃত হয়ে যায় তীব্র ব্যাথায় ! ভাতের বদলে মুখ গহ্বরে টের পায় নোনতা তরলের অস্তিত্ব । দম আটকে আসায় থুক করে মুখ থেকে ফেলে দেয় টকটকে গাঢ় লাল তরলটুকু ! সঙ্গে সঙ্গে লোনা স্বাদ লাগায় আরেকবার দুই ঠোঁটের তীব্র যণ্ত্রণায় কেঁপে ওঠে পরী । তাড়াতাড়ি হাত তুলে সামাল দিতে চায় ঠোঁটের যণ্ত্রণা ! কিন্তু হাত দুটো যেন হয়ে আছে সীসার চেয়েও ভারী ! কেউ বুঝি তার হাত দুটো গুড়িয়ে দিয়েছে হাতুড়ী পেটা করে ! তারপরও দাঁতে দাঁত চেপে বহু কষ্টে ডান হাতটা তুলে আনে নিজের দুই ঠোঁটের উপর !
একি ! একজোড়া বাড়তি ঠোঁট তার এলো কোথা থেকে !
মারের চোটে কেটে ভাগ হয়ে যাওয়া ঠোঁটের উপর হাতের স্পর্শ পড়তেই যেন আগুন ধরে যয় ওখানটায় !
মা ! মাগগো !
যণ্ত্রণা সইতে না পেরে ফের নিশ্চিন্তে জ্ঞান হারায় পরী !
৩.
– এ তুমি কি করেছো মিলি ? এভাবে কেউ কোন মানুষকে কখনো মারতে পারে ?
– আমার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিলো গো ! তবে এখন বুঝতে পারছি আমার একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে আজ ! আই এ্যাম রিয়েলি সরি !
– ইউ সুড বি ! আমি সব সময়ই তোমাকে বলে আসছি তোমার ওই চন্ডালের মতন রাগ কন্ট্রোল কর ! নইলে বিপদে পড়ে যাবে যে কোন সময় !
– হ্যা , তুমি তো খালি আমারই দোষ দেখ সব কিছুর মধ্যে ! তুমি জানো এই হারামজাদীটা কি করেছে ? তুমি তো আমায় নামিয়ে দিয়ে ফের চলে গেলে নিজের কাজে ! আর আমি ঘরে ঢুকেই দেখি এই ফকিরনীর বাচ্চা আমার সব সাজার জিনিস ব্যবহার করে পটের বিবি সেজে ডাঁটে ঘুমিয়ে আছে ড্রসিং টেবিলের উপরেই ! কত্তো বড় সাহস আমার পারফিউমটা পর্যন্ত বাদ রাখেনি মাগীটায় । এখন কি ওর ব্যবহার করা এই জিনিসপত্র ফেলে দেয়া ছাড়া আমার কোন উপায় আছে , তুমিই বল ? আমার এত্তো দামী সব জিনিসপত্র এভাবে নষ্ট হয়ে যেতে দেখেও আমার মাথা ঠান্ডা রাখবো – এটা তুমি নিশ্চই আশা করতে পারো না !
– ওকে ওকে ! আমি বুঝতে পারছি তোমার অবস্হাটা ! কিন্তু এখন যে করেই হোক ব্যাপারটা সামাল দিতে হবে ! হাসপাতালে নেয়া যাবে না কিছুতেই ! নির্ঘাৎ থানা পুলিশ হবে ! তারউপর আছে হাজারটা মিডিয়ার শকুনী চোখ ! একবার যদি ওরা টের পায় এই ঘটনা তাহলে স্রেফ ছিড়েখুড়ে ফেলবে আমাদের ! সমাজে আর কোনদিন মুখ দেখাতে হবে না ! উফ , কি ঝামেলার মধ্যে যে ফেললে না তুমি !
– ওগো আমি বলছি তো আমার ভুল হয়ে গেছে ! এমন ভুল আর কখনো হবে না ! আমাকে তুমি বাঁচাও প্লিজ !
-হ্যা , বাঁচাতে তো হবেই ! নিজের জন্যই বাঁচাতে হবে তোমাকে ! সবার আগে ওর একটা ব্যবস্হা করতে হবে ! তারপর থানায় ওর নামে একটা নিখোজ আর চুরির মামলা বোধ হয় করতে হবে ! আচ্ছা আমি আমার আইনজীবি বন্ধুর সঙ্গে একটু কথা বলে দেখি আগে ! ও বোধহয় আরো ভাল কোন বুদ্ধি দিতে পারবে ! তুমি এই ফাঁকে গাড়ীটা বের করো ! খবরদার হেড লাইট বা গ্যারেজের বাতি কোনটাই জ্বালবে না ! প্রতিবেশিরা কেউ টের পেলে কিন্তু সব শেষ হয়ে যাবে !
– আচ্ছা আচ্ছা তোমার কথামতই সব করছি সোনা ! ডোন্ট ওরি !
– উফ এখন এই ঝামেলা থেকে ভালয় ভালয় বেরুতে পারলেই হয় ! কত্তো টাকা গচ্চা যে কপালে আছে – কে জানে ?দেখি আগে আমার এই বন্ধুই কতো দাবী করে বসে !
বলতে বলতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায় আবিদ ! পেছন থেকে স্বামীর গমন পথের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হাসি হাসে মিলি ! সে জানতো যে কোন পরিস্হতি আর বিপদ সামাল দেবার ক্ষমতা আবিদের আছে ! এমনি এমনিই তো আর এত অল্প বয়সে এতটা সাফল্য আর টাকা পয়সার মালিক হয়নি সে !
স্বামীর জন্য সত্যি সত্যিই গর্ববোধ করে মিলি ! কি মনে করে একবার ফিরে তাকায় পরীর নিথর জ্ঞানহীন দেহটার দিকে !
– খানকির বাচ্চাটায় অনর্থক তাকে কি বিচ্ছিরি একটা ঝামেলায় ফেলে দিল এতো রাত্রে !
তীব্র ঘৃণায় চোখমুখ কুচকে ফেলে মিলি !
পরিশিষ্ট:
পরদিন ভোরবেলা অনেক দুরের কোন এলাকার একটি ডাষ্টবিনে খুঁজে পাওয়া যায় , – পাশবিক নির্যাতনের বিভৎস চিহ্ন সারা শরীরে ধারণ করে নিথর পড়ে থাকা আট – দশ বছর বয়সী একটি বাচ্চা মেয়েকে !
একমাত্র আশার কথা হলো , মেয়েটি তখনো মরেনি ! কোন আশ্চর্য শক্তি বলে সে তখনও প্রণপন লড়াই করে চলেছে মহাপরাক্রমশালী আজরাঈলের সঙ্গে !!!!!
( শেষ )