ছায়া চন্দ্রা ও সমুদ্রের সংসার-পুরো অংশ
ছায়া চন্দ্রা ও সমুদ্রের সংসার
সকাল হতেই মৃদু বৃষ্টি হচ্ছে।বৃষ্টি ছাড়বে তার নাম গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না।প্রকৃতি এত বেখালে কেন,ভেবে পায় না।এভাবে চলতে থাকলে অনুষ্ঠান কিভাবে সম্পন্ন হবে,তার কুল কিনারা ভেবে পাচ্ছে না সুশীল।মাথাটা ভন ভন করে ঘুরছে।এর মধ্যে হাই ভলিয়মে পুলায়পান গান চালাচ্ছে।মনে হচ্ছে গালের উপর ঠাস করে থাপ্পড় মারতে।পরক্ষণে ভাবল,আজ বিয়ের দিন,সবাই মজা করবে এটাই স্বাভাবিক।মেয়েটার কাছে গেল।মেয়েটা মুখ ভার করে বসে আছে।মেয়েটা এমন করে বসে আছে কেন,তার কি ছেলে পছন্দ না?বোধহয় ভুল হয়ে গেছে,মেয়েটাকে আগে জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল।কেমন করে যে হুটহাট করে বিয়ে ঠিক হয়ে গেল,কিছুই বুঝতে পারল না।ছেলে খুব ভাল,বাপের টাকা পয়সা আছে।তবে একটা সমস্যা,ছেলের বয়স বেশি।তিরিশ হবে।মেয়েটা তো সে অনুযায়ী বাচ্চা,কেবল মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে।এখনও রেজাল্ট বের হয় নি। বয়স আর কত হবে,ষোল-সতেরো।এটাতো আগে ভাবা উচিৎ ছিল।এরকম একটা বুড়ো ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে,এটাতো মেয়ের উপর ঘোর অন্যায় হয়ে যাচ্ছে।মনটায় খারাপ হয়ে গেল।দুই একদিন আগে বিষয়টা মাথায় এলে,কিছু একটা করা যেত।আজ বিয়ের দিন,আজতো কিছু করার নেই।তার বুকফেটে কান্না আসতে চাইল।
-বুড়ি?
-হু বাবা।
-এমন মন মরা হয়ে বসে আসিস কেন মা?
-এমনেই বাবা।
-বিয়েতে তোর মত নেই?
চন্দ্রা কিছু বলল না।বাবার দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকাল।সুশীল মেয়ের দিকে আর তাকাতে পারল না।বাড়ির এক কোণায় গেল,যেখানে লোকজন একদম নেই।চোখ হতে অবিরাম অশ্রু ঝরে পড়ছে।আজ পর্যন্ত এত কান্না করেছে কিনা,তার মনে নেই।
-এই,এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে?
সুশীল কোনমতে অশ্রু মুছে আনন্দির দিকে তাকাল।
-একি তুমি কান্না করছ?
-ও কিছু না।খুব খারাপ লাগছে তো।
-মেয়ে হয়ে জন্মেছে ,আগে পরে বিয়েতো দিতেই হবে।
একটু থেমে আনন্দি বলে-তবে চন্দ্রা আমাদের সুখেই থাকবে।ছেলেটা খুব ভাল।
-সবই ঠিক আছে।তবে বয়সটা একটু বেশি।
-ছেলেদের বয়স একটু বেশিই হয়।
-মেয়ে আমাদের সে তুলনায় একেবারে কম বয়সের।
-ও নিয়ে ভেব না,মা আমার ঠিক মানিয়ে নিবে।
-বোধ হয় অবিচার হয়ে গেল।তুমি বুড়িকে একবার জিজ্ঞেস করবে,বিয়েতে ওর মত আছে কিনা?
এবার আনন্দি কিছুটা রেগে বলল-অনেক কষ্টে ভাই আমার এমন পাত্র যোগাড় করেছে।শেষে এসে ঝামেলা পাকাবে না।এমন ছেলে হাত ছাড়া হলে আর একটা খোঁজে পাওয়া যাবে?
আনন্দি বুড়ির বাপের উপর বেশ মন ক্ষুণ্ণ হল।মেয়েকে নিয়ে বেশি চিন্তায় মাথায় গন্ডগোল পাকিয়েছে।চিন্তা হচ্ছে বিয়ে নিয়ে।ভালই ভালই বিয়েটা হলে ভাল হয়।তাহলে মাথা হতে মস্ত বড় বুঝা নামে।গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি থেমেছে।ঝকঝকে চকচকে আকাশ।কড়া রোদ উঠেছে।রোদের খুব দরকার ছিল।উঠানটা যত তাড়াতাড়ি শুকায়,তত ভাল।কাজের লোকটা যে কই,উঠানটা ভাল করে ঝাড়ু দেওয়া দরকার।এত লোকজন বাড়ির ভিতর,তবু কাজের লোকজন কমই আছে বলে মনে হয়।রান্নার দিকে গেল।এলাকার নামকরা বাবুর্চী ভাড়া করা হয়ছে।বরপক্ষ যেন খাবার মুখে দিয়েই বলে-এই প্রথম,জীবনে এমন খাবার খেলাম।
-আপনার সবকিছু রেডিতো?
-জ্বি মা।
-রান্না যেন কোনভাবেই খারাপ না হয়।
-ও নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না মা।দীর্ঘ দশ বছরের অভিজ্ঞতা বলে রান্না কোনভাবেই খারাপ হবে না।
আনন্দি নিজের ঘরে ঢুকল।চেয়ারের উপর বসল।তার কিছুক্ষণ একা একা থাকতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু বিয়ে বাড়ি।এমন পরিবেশতো পাওয়া যাবে না।বিছানায় শুয়ে পড়ে।বেশ ঘুম ঘুম ধরে।কিন্তু তার তো আজ ঘুমালে চলবে না।তার আজ মেয়ের বিয়ে।কত কাজ এখনও বাকি?অন্যরা কাজ কাম ঠিকমত করছে কিনা, সেগুলোও দেখতে হবে।সব আত্নীয় স্বজনের সাথে ভদ্রতা করতে হবে।আনন্দি দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে।এত চাপে বুঝি পাগল-ই হয়ে যাবে।
-দিদি দিদি?
এই বলে আনন্দির বড় ভাই অনিমেষ ঘরে ঢুকল।আনন্দির পাশে বসল।
-দিদি,তোমার মেয়ের বিয়ে আর তুমি শুয়ে আছ?
-মাথাটা ঝিম ঝিম করছে রে ভাই।তোরা আছিস বলেই ভরসা পাচ্ছি।না হলে যে কি হত?
-আচ্ছা তুমি ঘুমাও।আমি দেখছি।
এই বলে অনিমেষ ঘর হতে বের হল।কুঞ্জের কাজ এখনো শুরু করেনি।কেবল বাঁশ কাটা শুরু করেছে।বেলা একটা বেজে গেছে।সাতটার লগ্নে বিয়ে।ছেলেগুলো কুঞ্জ বানানো শেষ করবে কিভাবে?
-তোমরাতো বিয়ের লগ্ন ক্রস করে ফেলবে?
-না মামা,শেষ করে ফেলব।
-কাজের যে অগ্রগতি তাতেতো মনে হচ্ছে না।ঠিক সময়ে বিয়ে না হলে বর কনের সাংসারিক জীবনে অশান্তি আসে সেটা জানোতো?
-তা জানব না কেন মামা?
-তাহলে হাত গুটিয়ে না থেকে জলদি কাজটা কর।
এই বলে অনিমেষ ব্যান্ড পার্টির কাছে গেল।এদের ভাড়া করা আনা হয়েছে বাড়িঘর মাতিয়ে রাখার জন্য।অথচ চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে আছে।লোকজনের মধ্যে এত ফাঁকি দেওয়ার টেন্ডিসি কেন,মাথায় ধরে না।
-কি আপনারা এভাবে হাত গুটিয়ে বসে আছেন কেন?আপনাদের কি শুধু শুধু ভাড়া করে আনা হয়েছে?
-জনাব বাজানো নিষেধ আছে।বিয়ে শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত নিষেধ।
-এমন আউল ফাউল কথা কে বলেছে আপনাকে?
-সুশীল সাহেব।
নাম শুনে কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।জামাই বাবুর এই বয়সেও আক্কেল জ্ঞান কিছু হবে না?আজ মেয়েটার বিয়ে,বাঁশি বাজবে,সানাই বাজবে।এসব ছাড়া বিয়ের অর্ধেক মজাতো এমনেতেই নষ্ট।
-আপনারা বাদ্য বাজান।বাকিটা আমি দেখতেছি।
সবগুলো বাদ্য একসাথে বাজা শুরু করল।অনিমেষের মনটা নেচে উঠল।তার কাছে এখন বাড়িটা মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়ি।
চন্দ্রা বারান্দায় বসে আছে।যে ছেলেটার সাথে বিয়ে,সে ছেলেটাকে লজ্জায় ঠিকমত দেখতেও পারে নি।চোখে একটি হাই ভোল্টেজের বলদ মার্কা চশমা ছিল।মুখের গঠন যে ঠিক কেমন,কিছুতেই মনে করতে পারছে না।তবে চেহারাটার মধ্যে হেবলা হেবলা ভাব আছে।দেখতে একেবারে হেংলা,ধাক্কা দিলেই পরে যাবে-এমন।এমন ছেলের সাথে বিয়ে,ভাবতেই যেন তার কেমন লাগে।এমন একটা ছেলের সাথে সারাজীবন থাকতে হবে;মনে হচ্ছে পুকুরে ঝাপ দিয়ে মরলে এর থেকে ভাল হত।বিয়েটা আটকাতে পারলে ভাল হয়।মাকে বললে কোন কাজ হবে না।বাবাকে বললে যদি কিছু একটা হয়।
-মা,কি এত ভাবছিস?
পেছনে তাকিয়ে দেখে অনিমেষ মামা।এই লোকটার প্রতি ওর সবচেয়ে বেশি রাগ।এই লোকটার জন্যই আজ তার এই ঝামেলায় পড়তে হয়েছে।বিয়ের সম্বন্ধটা না আনলেই কোন ঝামেলা ছিল না।পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারত।কত শখ ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার।সব আশা নিভে গেল।তার উপর ছেলে সম্পর্কে এত ভাল ভাল কথা বলেছে,বিশেষ করে ছেলের বাবার অগাধ টাকা আছে-শুনে ওর মার চোখতো চকচক করছিল।যেন হাতের কাছে সোনার হরিণ পেয়েছেন।
অনিমেষ চন্দ্রাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল-কিরে,কি হল?কথা বলছিস না কেন?
চন্দ্রা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-ও মামা,বল।
-মন খারাপ নাকি?
-না মামা,মস্তবড় খুশি।
এই বলে চন্দ্রা হাসল।
-তুইতো রাজরাণী হবি মা,রাজরাণী।
-ছেলে যখন রাজা,তখন রাজরাণীতো হবই।
-দেখতে হবে না,কে এমন ছেলে খোঁজে বের করেছে?হাজারে এমন পরিবার আজ খোঁজে পাওয়া যায় না।
মামার সাথে চন্দ্রার আর কথা বলতে ইচ্ছে করল না।অনিমেষ কথা বলতেই লাগল।কিন্তু চন্দ্রা কিছু বলল না।ডান হাত দিয়ে মাথাটা এমনভাবে টিপতে লাগল যেন মামা মনে করে প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে।
-কিরে তোর মাথা ব্যথা করছে?
শুধু মাথা নাড়ল।
-মাথা টিপে দিব।
-মামা আমি একটু একা থাকতে চাই।
অনিমেষ বেশ চিন্তায় পড়ে গেল।হঠাৎ করে মাথা ব্যথা হবে কেন?বিয়ের দিনটা অন্তত মেয়েটার শরীরটা ভাল থাকা উচিৎ।ভগবানের এ কেমন লীলা,বুঝতে পারে না।
আনন্দি সব দিক সামলে পেরে উঠছে না।একবার এদিক যাচ্ছেতো,ওদিক থেকে ডাক আসছে।ওদিক থাকলে এদিক থেকে ডাক আসছে।মেয়েটার কাছেই এখন পর্যন্ত যাওয়া হচ্ছে না।পাশের বাড়ির কাকীমাদের বাড়িতে যাওয়া দরকার।পাশাপাশি বাড়িতে বিয়ে অথচ তাদের দেখা যাচ্ছে না।কি এক ঝগড়া হয়েছিল অনেকদিন আগে,সেটা ধরে আজকে বসে থাকলে হয়?চন্দ্রার বাবাকে সকালেতো একবার ডাকার জন্য যেতে বলা হয়েছিল,যে বেখেয়ালি মানুষ,হয়তো ভুলেই গেছে।এত বেখেয়ালি মানুষ দিয়ে সংসার চালানো যে কি কষ্ট তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
-কাকীমা,কাকীমা?
একজন বয়স্ক মহিলা বের হয়ে এল।মাথার সব চুল গেছে পেকে।তবে শরীরে বয়সের ছাপ অতটা পড়েনি।আনন্দি হাত ধরে নরম হয়ে বলল-কাকীমা,আজ আর রাগ করে থাকবেন না।ওই একটা মাত্র মেয়ে আমার,ছেলেটা কেবল এতটুকু।আমাদের উপর রাগ করে না গেলে বিয়ের আনন্দই যে মাটি হবে।
কাকীমা হাত সরিয়ে নিল।মুখটা অন্যদিকে করল।আনন্দি আবার হাত ধরল-কাকীমা,আমায় না করবেন না।
-যাও আসছি।
-তবে এখনি চলুন।
কাকীমা হেসে বলল-বিয়ে বাড়ি।আমি এই অবস্থায় গেলে হবে না বউমা।নাতনীর বিয়ে বলেতো কথা।
-তবে তাই আসুন।আমি যাই।
চন্দ্রা ভাবছে।বিয়ে সম্পর্কে ভাবনা।বলা যায় একসময় এ নিয়ে রোজ স্বপ্ন দেখত।অতি সাধারণ একটি স্বপ্ন।কমবেশি সবমেয়েই বোধ হয় দেখে।একটি ছেলে আকাশ হতে জাদুর গলিতে চড়ে আসছে।চুলগুলো স্পাইক করা,চোখে রঙ্গিন চশমা।পরনে জিন্সের প্যান্ট আর চাঁদলী সবুজ বর্ণের টি শার্ট ।এত সুন্দর লাগছে ছেলেটাকে,বোধহয় এমন সুন্দর ছেলে আর পৃথিবীতে আর একটা নেই।একসময় জাদুর গলি হতে সামনে এসে দাঁড়ায়।
-হাই চন্দ্রা।
-কে আপনি?
-আমি কে সেতো বলা যাবে না।
-বলুন না?
-আসলে আমরা কি কেউ জানি আমরা কে?
-এসব দার্শনিকমার্কা কথা বাদ দিবেন?এবার আপনার নামটা বলুন।
-কোন নামতো আমার নেই।
-তোমার বাবা মা কোন নাম দেয়নি তোমার।
-তুমি দিবে বলে তারা কোন নামই রাখেনি।
চন্দ্রা এবার হাসল।বলল-তাই বুঝি?
-ইয়েস ম্যাডাম।তুমি নাম দিবে বলে কতদিন ধরে অপেক্ষা করছি।
-সে আমি কিছুতেই পারব না।তোমার নাম তুমিই ঠিক করে নাও।
-তুমি যখন দিবে না,তখন আর কি করার?তাহলে আগের মতই নামহীন থাকি,তাতে কার কি আসে যায়?
-তুমি রাগ করলে?
-আমার রাগে কার কি আসে যায়?আমিতো আর কার কেউ নই।
-আচ্ছা যাও।তোমার নাম,তোমার নাম,ধারাও ভাবছি।
চন্দ্রা ভাবতে থাকে।কি নাম দেয়া যেতে পারে,ভাবতে থাকে।
-কি হল?
-এত তাড়াতাড়ি কোনকিছু হয়?
-আমার যে দেরি সহ্য হচ্ছে না।একটু জলদি কর।
-এসব কাজ এভাবে হয় ?আচ্ছা পরে ঠিক করে রাখব।
-যা ভাল মনে করেন ম্যাডাম।
-দেখ,এরকম ম্যাডাম ম্যাডাম করবে না।ম্যাডাম ম্যাডাম করলেই মনে হয়,কাউকে পড়াচ্ছি।
-আচ্ছা চাঁদ দি।
-আমার নাম আবার চাঁদ হলো কবে?আমি তোমার দিদি হই কিভাবে?
-না এমনেই বললাম।
-না এরকম ফাযলামি তুমি করবে না।এরকম ফাযলামি আমার পছন্দ না।
-আমি তোমার হাতটা একটু ধরি।
চন্দ্রা হাতটা বাড়িয়ে দেয়।ছেলেটাও হাত বাড়িয়ে দেয়।দুজনের হাত খুব কাছাকাছি আসে।কিন্তু ছোয়া লাগে না।ঠিক এই সময়েই স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়।প্রতিবার ঠিক এমন সময়েই স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায় কেন,বুঝতে পারে না।ছোয়া লাগলে দোষ কি ছিল?মনে মনে আফসোস থেকে যায়।মনে করে আবার যখন আসবে,তখন প্রথমেই ছোয়ে দিবে।কোনভাবেই লজ্জাশরম করে দেরি করবে না।কিন্তু কোনবারই তা হয়ে উঠেনা।এমন সময় পাশের বাড়ির কর্তা ধাক্কা দিয়ে বলে-কি দিদিভাই,চোখ বন্ধ করে, মনে মনে কি মন কলা খাওয়া হচ্ছে?
চন্দ্রা কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলে-না কর্তা,কিছু না।
-বুঝি সবই বুঝি,বসে বসে বরের স্বপ্ন দেখছিলে বুঝি?
-কি যে বল কর্তা?
-বুঝি সবই বুঝি,বয়সতো আমারও ছিল একদিন।
-বুঝ,কচু বুঝ।
কর্তা হাসে।বলে-নাতজামাই আমার নাকি বেশ,রাজরাণী হয়ে থাকবি শুনলাম।
-রাজরাণী না ছাই।ওরকম বুড়োর সাথে বিয়ের হওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।
-ওরকম কথা বলে না দিদিভাই,বর হচ্ছে দেবতার মত।
-দেবতা না ছাই।তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে দিব,ওমন দেবতা আমার দরকার নেই।
-আমিতো বিয়ে করতেই চাই।কত দিন আগে বিয়ে করেছিলাম,আজ আবার,ও কি যে মজা লাগছে দিদি ভাই।
কর্তা একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে।মাঝে মাঝে অশোভন কথাও।বাসর রাতে বর বধূর সাথে কি করে,কিভাবে কথা বলে এসব।
-তুই কিন্তু একদম পাত্তা দিবি না।বিড়াল মারতে হয় প্রথম রাতেই।নইলে সারাজীবন ম্যাও ম্যাও করতেই থাকবে।বুঝলি?মনে থাকবেতো?
চন্দ্রা মাথা নাড়ল।হা হু তেমন কিছু করল না।কর্তা অন্যদিকে গেল।চন্দ্রা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।যেন বেশ বাঁচা বাঁচল।
বিকেলবেলা।সুশীল বাড়ি হতে কিছু দূরে মাঠে গিয়ে একবার এদিক যাচ্চেতো আরেকবার ওদিক যাচ্চে।মেয়ের যে বিয়ে একথা ভাবলেই তার যেন কেমন লাগছে।বুকের ভিতরটা ধক করে উঠছে।যেন কি যে ধন তার হারিয়ে যাচ্ছে,এ ধন যে সে আর ফিরে পাবে না।খুব অস্থির অস্থির লাগছে।বাড়িতে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই হচ্ছে না।মাঠের এক পাশে বসে।সামনে পুকুর।পুকুরে খুব বেশি পানি নেই।বড়জোর হাটুপানি হবে।কয়েকটা হাঁস বেশ আলস্য ভঙ্গিতে সাতার কাটছে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে,বেশ আরামে আছে।সুশীল একটা ঢিল ছুড়ে।এদিকে কত কি কান্ড হয়ে যাচ্ছে,এদের যেন আনন্দ ধরে না।বাবা মেয়ে কতদিন যে এই মাঠ দিয়ে হেটেছে,দৌড়িয়েছে,পুকুরের পাশে বসেছে,তার ইয়ত্তা নেই।দুইজনে পুকুরে ঝাপাঝাপি করেছে,হাঁসের পিছনে ছুটেছে।একবারতো হাঁস ধরতে না পারায় যে কান্না,পরে বাজার থেকে হাঁস কিনে এনে শান্ত করতে এসেছে।বশি দিয়ে বাবা মেয়ে মিলে মাছ ধরেছে।মাছ ধরতে পারলে মেয়ে যে কি খুশি হত,মনে হত পৃথিবীতে স্বর্গ নেমে এসেছে।
-বাবা পুকুরে নামি চল।
-চল।
-বাবা আমাকে একটা হাঁস ধরে দাও না?আমার হাঁস ছুতে বেশ ইচ্ছে করছে।
সুশীল পুকুরে নেমে চুপিচুপি হাঁসের পেছনে ছুটল।হাঁসগুলো বেশ চালাক।ধরার আগে নাগালের বাইরে চলে গেছে।কিন্তু তাকে যে হাঁস ধরতেই হবে।আজ মেয়ের বিয়ে,মেয়ে হাঁস ছুতে চেয়েছে,হাঁস না ধরে কিছুতেই পুকুর হতে উঠা যাবে না।সুশীল বেশ দৌড় ঝাপ পেড়ে প্রায় পনের বিশ মিনিট পর একটা হাঁস ধরে।ধরেই ডাক দেয়-বুড়ী,বুড়ী,সবচেয়ে ভাল হাঁসটা ধরে ফেলেছি।দেখ।
আশে পাশে কাউকে দেখতে পায় না।আবার ডাকে-বুড়ী,বুড়ী?
কোন সাড়া মিলে না।বুঝতে পারে এ তার মনের ভুল।হাঁসটা ছেড়ে দেয়।হূ হূ করে কেঁদে উঠে।
বাড়িতে লোকজন ভরা।চাঁদ কাপড় সম্পন্ন করার জন্য বরপক্ষের কিছু লোক এসে গেছে। চন্দ্রাকে উঠোনে বসানো হয়েছে।পড়েছে টকটকে লাল বর্ণের শাড়ি।তাকে ঘিরে আছে লোকজন।তার সামনে আছে বেশ বড় ধরণের রুই মাছ।মাছটার চোখের পাশে বড় করে দেওয়া হয়েছে সিন্দুরের ফুটা।চন্দ্রার কাকী বলল-বিয়াই এবার শুরু করেন।
বরের কাকা মঙ্গলদীপ হাতে নিয়ে কনের মাথার সামনে দিয়ে ঘুরাচ্ছে।মেয়েরা ওলুধ্বনি দিয়ে মাতিয়ে তুলে চারদিক।এরপর কিছু দূর্বা আর ধান কনের মাথায় দেয়।কনে প্রণাম করে।পাশ হতে এক প্রতিবেশী বলল-বিয়াইয়ের হাত কি খাটো নাকি যে মেয়ের মাথা স্পর্শ করল না।
-না না,কি যে বলেন?হঠাৎ করে আপনার এত সুন্দর মুখখানা দেখতে পেলাম আর সাথে সাথে ভুলে গেলাম হাত যে কনের মাথায় ছোয়াতে হবে।দোষ কার বলুন?
সাথে সাথে প্রচন্ড হাসাহাসি শুরু হল।
-তাই বুঝি,বুড়ো বয়সে আবার ভীমরতি।
আবার হাসাহাসি শুরু হল।
-ভীমরতি কি বলছেন,সৌন্দর্যের প্রতি সবারি দুর্বলতা আছে।
বরপক্ষের পর কনেপক্ষ আর্শিবাদ করল।এরপর কয়েকজন মিলে চন্দ্রাকে রুমে নিয়ে গেল।বরপক্ষের লোকজন এদিক ওদিক হাটাহাটি করছে।কেউবা বসে আছে।দুই একজন আফসোস করছে।কি দেখে ছেলেটা এ বাড়িতে বিয়ে করছে?একেবারে গেয়ো।এতক্ষণ ধরে যে এসেছে আদর যত্ন কিচ্ছু করছে না।চা পানি পর্যন্ত দেয়নি।একেবারে যে ছোটলোক তা হাড়ে হাড়ে বুঝা যাচ্ছে।
সন্ধ্যার আযান পড়ল।কনেপক্ষের লোকজন চন্দ্রাকে সাজাচ্ছে।চন্দ্রার বুক ফেটে কান্না আসছে।ওই বুড়োটাকে তার সত্যি সত্যি বিয়ে করতেই হচ্ছে।ওর পাশের বাড়ির বান্ধবী বলল-ও তোকে যে আজ লাগছে না?মনে হচ্ছে আমিই প্রেমে পড়ে যাচ্ছি।তোর উলু চান দেখলেতো আজ চোখই ফিরাতে পারবে না।
বাকি সবাই এ কথা শুনে হেসে দিল।চন্দ্রা মনে মনে বলল-ঐ রূপই তো যত গন্ডগোল পাকালো।দূর ছাই তোর রূপ।
কিন্তু মুখে বলল-তোরা সব থামবি।মাথা ধরে যাচ্ছে।
আরেকজন বলল-ধরুক না মাথা।ব্যথানাশক তো এসেই গেছে।
চন্দ্রার কাকাতো ভাই এসে বলল-দিদি একটু হাসতো,একটা ছবি তুলি।
চন্দ্রা হাসার চেষ্টা করল।কিন্তু হাসি আসল না।
-দিদি কি হল?এরকম গুমরা মুখে ছবি তুললে ছবি একেবারে পেঁচার মত দেখা যাবে।
-এখান হতে যাবি?এমনেতেই যন্ত্রণায় আছি।
সন্ধ্যা বেলা।বিয়ের লগ্ন হতে আর আধা ঘন্টা বাকি।অনিমেষের মাথা বার বার গরম হয়ে যাচ্ছে।ছেলেগুলোকে এত বারবার করে বলা হল,বিয়ে সাতটার লগ্নে।তাড়াতাড়ি কর।কার কথা কে শুনে?
-তোমাদের কাজ কখন শেষ হবে?
-এইতো মামা,আর কিছুক্ষণ।
-এখন কয়টা বাজে দেখেছ?তোমরা দেখি সত্যি সত্যি বিয়ের বারটা বাজিয়ে ছাড়বে।জলদি কর।
এরপর অনিমেষ কনে সাজানোর রুমে ফুচকি মারল।কনেকে সাজানো কতদূর,দেখার জন্য।রুমে ঢুকল।
-কনে সাজানোর কি অবস্থা?
চন্দ্রার পাশ হতে একজন বলল-এইতো মামা।মিনিট পাঁচেক।
-তাড়াতাড়ি কর।সাড়ে ছয়টা কিন্তু বেজে গেছে।
এই বলে রুম হতে বের হল।এই সময়ে সানাই বাঁশি বন্ধ,এটা কোন কথা হল?লোকগুলোর কি কোন কমন সেন্স নেই?একটু পরে বিয়ে শুরু হবে অথচ বাজনা বাজছে না।এটা কোন কথা হল?এদের ভাড়া করাই ভুল হয়েছে।
-দাদারা বাজনা বাজান।এভাবে হাত গুটিয়ে পরেও রাখতে পারবেন।
-এইতো বাবু,একটু জিরাচ্ছি।শুরু করব।
বিয়ের লগ্ন শুরু হয়ে গেছে।চারদিকে হইচই পড়ে গেল।কনেকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।বরপক্ষকে এখনো জানানো হয় নি।বরপক্ষ বারবার বিয়ে শুরু করার তাগিদ দিচ্ছে।শুরু করছি-এই বলে অনিমেষ সরে এল।মানসম্মান বুঝি এবার সব গেল।আনন্দি কিছু না বলে কাঁদতে শুরু করল।অনিমেষ চার পাশে লোক পাঠালো।
-দিদি এখন কান্নার সময় নয়।চারপাশে লোক পাঠাচ্ছি।যেকোনভাবে ওকে খোঁজে বের করবই।
বরপক্ষের কানে খবরটা চলে গেল।বর শুনেতো হতবাক।তার মনটায় কেমন জানি খারাপ হয়ে গেল।একজন বলল-বেশ বাঁচা বাচলি দোস্ত,এই রকম মেয়ের সাথে বিয়ে হলেতো লাইফ শেষ হয়ে যেত।
পাশ হতে তৎক্ষণাৎ আরেকজন বলল-শুধু শুধু মেয়ের দোষ দিয়ে কি হবে?এ পরিবারের দোষ।
বুড়ো মতন এক লোক বলল-কি মেয়েরে বাবা,এই বয়সেই এত কিছু?
বরপক্ষ একরকম ঝগড়া শুরু করল।কিছু লোক অকথ্য ভাষায় ফ্যামিলি সম্পর্কে গালাগালি করল।আনন্দি বরের বাবাকে কড়জোড়ে বলল-দয়া করে আপনারা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন।মেয়ে আমার আশেপাশেই আছে।
-এক কাজ করেন,যে ছেলের কাছে গেছে তার সাথে বিয়ে দিয়ে দিন না?শুধু শুধু অন্য ছেলের জীবন নষ্ট করে লাভ কি?
এই বলে বরের বাবা চলতে লাগল।সাথে সাথে অন্যরাও।আনন্দি বরের বাবার পা পর্যন্ত ধরল,তাতেও কাজ হল না।
সপ্তাহখানেক পর।আনন্দির অবস্থা এখনো নরম্যাল হয়ে উঠেনি।খাওয়া দাওয়া ঠিকমত করছে না।সুশীল মনে মনে বেশ খুশী।কিন্তু তাকে অভিনয় করতে হচ্ছে দুঃখ পাওয়ার।জীবনে অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছে ছিল।ছোটবেলায় অভিনয় করার প্র্যাকটিসও করত।সেটা যে এতদিনে কাজে লেগে যাবে,তা কখনো ভাবতে পারেনি।একেবারে যে রিয়েল লাইফ সো।চন্দ্রা এখনো ঘুম থেকে উঠেনি।মেয়েটার উপর বেশ ধকল গেছে।তার মা ওকে বেশ করে বকেছে।এরকম মেয়ে না থাকায় ভাল,বিষ খেয়ে মরে যাওয়া উচিৎ ইত্যাদি ইত্যাদি।চন্দ্রা অবশ্য মুখ ফুটে কিছু বলে নি।শুধু কান পেতে শুনে গেছে।তখন তার বলার সময় না।শুনার সময়।মেয়েকে পালিয়ে যাওয়ার বুদ্ধি অবশ্য সুশীলের।একটা সিএনজি ভাড়া করে রেখেছিল।হোটেলে রুম বুক করা ছিল।সিএনজিতে করে সরাসরি হোটেলে চলে যায়।ব্যস বিয়েটা ভেঙ্গে গেল।চন্দ্রা অবশ্য বলেছে শহরে এক বান্ধবীর বাসায় ছিল।এটাও বাপের পরামর্শে বলা।মা মামা মিলে যেভাবে জেরা শুরু করেছিল,তাতে প্রায় ধরা খেতে গেছিল।ধরা খেতে খেতেই খায়নি।
-বুড়ী,বুড়ী,উঠ।আমি গেলাম।সকাল দশটা বেজে গেছে।
চন্দ্রা তাকালো।মেয়ের মাথায় হাত ভুলালো সুশীল।কিছুদূরে একটি সরকারি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করে।ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।যাত্রা শুরু করল।
বছর দুয়েক পর।দেখতে দেখতে চন্দ্রার বয়স আঠারোর উপর।প্রকৃতি তার সকল রূপ সৌন্দর্য যেন মেয়েটিকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ভরিয়ে দিয়েছে।সবসময় হাসি হাসি মুখ,আনন্দের ঝলক লেগেই আছে মুখে।জীবনেও এসেছে বড় ধরণের পরিবর্তন।সে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র।থাকে সুফিয়া কামাল হলে।ক্লাস হয় মোকারম ভবনে।ক্লাস হতে বের হয়ে ডাইনেই চায়ের দোকান।ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে এখানে এসে বন্ধুরা আড্ডা মারে।শিলা বলে-একদম বোরড হয়ে গেছি।এরকম হাবার মত ক্লাস নিয়ে কোন লাভ আছে?
অলক বলে-বাদ দেতো।
এই বলে,রাসেলকে পাঁচটা চা দিতে বলে।বয়স বেশি হবে না,বার-তেরো।বেশ কয়েক বছর ধরে এখানে চা বিক্রি করছে।
মিলা হেসে হেসে বলে উঠে-দোস্ত আজ কি হয়েছে শোন?একটা সিগারেট ধরিয়েছি।দেখি হাবা টাইপের ছেলে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।যেন আমি মহাআশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটিয়েছি।আমি ছেলেটির কাছে গেলাম।বললাম-সিগারেট খাবি?
শিলা মৃদু হেসে বলে-আমিতো ভাবলাম অন্যকিছু,তোকে বুঝি প্রপোজ করে বসেছে।
-আরে শুন না,এরপর ছেলেটা বলল-আমিতো সিগারেট খাই না।আমি বললাম-এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন আমার দিকে?ছেলেটা বলল-আমার না আপনাকে খুব ভাল লাগে।আমি বললাম-দেখেই বুঝে গেছি,মজনু টাইপের ছেলে।মেয়ে দেখলেই ভালবাসতে ইচ্ছে করে।তো কানে ধরে উঠবস করেন।আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকার শাস্তি।ছেলেটা দেখি সত্যি সত্যিই কানে ধরে উঠবস করা শুরু করে দিয়েছে।
একথা বলার সাথে সাথেই সবাই একেবারে ফিক ফিক করে হেসে দিল।এমন বলদ টাইপের ছেলে যে থাকতে পারে বিশ্বাসই হচ্ছে না।আবার মিলা শুরু করল-শুন,একটা ছেলে সেদিন ফোন দিয়েছে।বলে-মিলা তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।তোমাকে ছাড়া সবকিছু কেমন শূন্য শূন্য লাগে।আমি বললাম-তাহলে মরে যান।দেশের যে অবস্থা,আপনে মরলে তাতে দেশের লাভই হবে।ঠিকানা বলেন।দড়ি কিনে পাঠিয়ে দেয়।ছেলেটা আমতা আমতা করে ফোন কেটে দেয়।
আবার কিছুক্ষণ সবাই হাসে।ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।তাই চটপট করে ক্লাসে ঢুকে পরে।ক্লাস মুনিটর এসে জানায়,আজ আর ক্লাস হবে না।সবাই খুব হইচই করে উঠে।চন্দ্রা আর কয়েকজন মিলে টিএসসির ভিতরে গিয়ে বসে।দুই একজন গান শুরু করে-ভাল আছি,ভাল থেকো।আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ……
একটার পর একটা গান চলতে থাকে।এরপর শুরু হয় জীবনের গল্প।কার কি দুঃখ ব্যথা আনন্দ আছে?প্রথমে শিলা শুরু করে-তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি।অংক স্যার ক্লাস নিচ্ছেন।কুত্তার মত সবসময় বগবগ করতেন।আমরা নাম দিয়েছিলেন লেডি ডগ।চেহারের মধ্যে মেয়ে মেয়ে ভাব ছিল।আমি স্যারকে ইনিয়ে বিনিয়ে চিঠি লিখেছিলাম।স্যারও দেখি কয়েকদিন পর বেশ আবেগসহ চিঠি লিখেছে।ক্লাসের সবাইকে দেখিয়েছি।স্যার অংক করে আর আমরা সবাই হাসি।তাকালেই সবাই চুপসে যায়।আবার অংক করে আবার হাসে।অবশেষে স্যার রেগে ক্লাস হতে বের হয়ে গেলেন।
একে একে সবাই যার যার গল্প বলে।চন্দ্রার পালা আসে।চন্দ্রা দূর অতীতে তাকিয়ে কোন গল্প খুজে পায় না।জীবনটা কেমন জানি অদ্ভূতভাবে চলেছে,কোন মজার কিছু খুজেই পাচ্ছে না।মিলা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে-কি রে কি হল?
-না রে আমার এমন কোন ঘটনা নেই।
এরপর অলক কার্ড বের করে।টুয়েনটি নাইন খেলবে।অলক আর মিলা,চন্দ্রা আর মোহিত।খেলা শুরু।চন্দ্রা কয়েকদিন হল শিখেছে।এখনো দক্ষ খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারেনি।অবনীলায় সে টাম কার্ড পাশিয়ে যায়।এক সিরিয়াল একই চারটা কার্ড থাকে তবুও সতেরো ডাকতে সাহস পায় না।যা ডাকার মোহিতকে একাই ডাকতে হচ্ছে।আর বারবার খেলা মরে যাচ্ছে।চন্দ্রা এটা খেলবি না,ওটা খেলবি না,এরপর এটা খেলতে হয়।বুঝাতে বুঝাতে দুইটা কালো সেট হয়ে গেল।লাল সেট খাওয়ার পথে।এরপর যখন টাম করতে পারত,তবুও যখন করল না,তখন মোহিতের মাথাটা কিছুটা গরম হয়ে গেল।
-না চন্দ্রা,এভাবে শুধু খেলার মত খেলে গেলেতো হয় না।একটু বুঝে খেলার চেষ্টা কর।
চন্দ্রার কান্না আসতে লাগল।বেশ কষ্টে তা থামাল।মিলা মোবাইলটা বের করে সময় দেখে।সময় দেখতো হতবাক।চারটা বেজে গেছে।কোথা দিয়ে সময় চলে গেছে কিছু বুঝতেই পারেনি।কারও তো খাওয়ায় হয় নি।
রাত্রি আটটা।রুমে বসে আছে।এক রুমে চার বেড।চার বেডে চারজন থাকে।শিলা,মিলা,নীলিমা আর ও।এরমধ্যে নীলিমার ফ্যামিলি সবচেয়ে ধনী,মিলা মিডিল ক্লাস।শিলার টাকা পয়সার সমস্যাটা একটু বেশি।একটা টিউশনি করে,তাতে বেশ চলে যায়।নীলিমার ল্যাপটপ আছে,মিলা কয়েকদিন হল ডেস্কটপ কিনেছে।চন্দ্রা তার বাবাকে বলেছে।কিছুদিন পর কিনে দিতে চেয়েছে।আর শিলা ভাবছে আরেকটা টিউশনি করাবে,সেই টাকা দিয়ে কিনবে।কবে নাগাদ কিনতে পারবে,কে জানে?সবাই মিলে মিলার ডেস্কটপে সিনেমা দেখছে।থ্রি-ইডিয়টস।দেখা শুরু হতেই মিলার ফোনটা বেজে উঠল।বারান্দায় গিয়ে কথা বলা শুরু করল।আর কিছুক্ষণ পর বাকি দুইজনও।চন্দ্রার আর একা একা মুভি দেখতে ভাল লাগছে না।এমনেতেই হিন্দি সে বুঝে না।তার উপর আবার সাবটাইটেল নাই।মুভিটা পস করে রাখে।কেমন কেমন যেন একা একা লাগে।তার এমন কেউ থাকলে খারাপ হত না।এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠে।আননোন নাম্বার।
-আপনি কি চন্দ্রা বলছেন?
-হু,আপনি কে বলছেন?
-আমি আপনার বিভাগের ই।মাস্টার্সে পড়ি।
-আপনি আপনি করে বলবেন না প্লীজ?
-ওকে ঠিক আছে।তোমার বাসাতো টাংগাইলে।
-জ্বি দাদা।
-চন্দ্রা তুমি আমাকে দাদা বলবে না।
-কি বলে ডাকব আপনাকে?
-অর্ণব।
-না তা কি করে হয়?ঠাকুর পাপ দিবে না?
-দিলে দিবে,তবে সবকিছু একরকম ভাবলে হবে না?বন্ধু ভাবলেই হয়ে গেল।
-না তা কি করে হয়?দাদা বলেই ডাকি না?
-না।
-আচ্ছা বরং আমি নাম ধরেই ডাকব।
-এইতো গুড।
-কেন?
-নাম ধরে ডাকবে তাই।আচ্ছা আজ রাখি।আবার কথা হবে।ভাল থেক।
-তুমিও।
এই বলে ছেলেটা ফোন কেটে দিল।চন্দ্রার ঠিক কেমন কেমন জানি লাগতে লাগল,বুঝতে পারল না।বিভাগে মাস্টার্সে অর্ণব নামে কেউ আছে কিনা,খোঁজ নিতে হবে।কেমন জানি বুকটা ধুরু ধুরু করছে।ফেসবুকে ঢুকে।ছয় মাসের মত হল আইডি খুলেছে।প্রোফাইল পিকচার দিয়েছে টুকটুকে লাল শাড়ি পড়া একটি ছবি।লাল টিপ,চুলগুলো বেণী করা।মুচকি মুচকি হাসছে।প্রায় সবসময়ই সুযোগ পেলেয় ফেসবুকে বসে।বন্ধুর সংখ্যা ১২০।পরিচিত না হলে রিকোয়েস্ট একসেপ্টই করে না।ঢুকলেই দু-চারটা রিকোয়েস্ট থাকেই থাকে।বেশিরভাগই অচেনা।ছেলেদের বুঝি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই যে মেয়ের আইডি দেখলেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়।অনলাইন চ্যাটে আছে বারজন।
-ওই চাঁদ
ওর মামাতো বোন মাম্পি।কৃষি ভার্সিটিতে ভ্যাটেনারিতে পরে।
-দিদি কেমন আছ?
-ভাল।
-তুই?
-এইতো চলছে।পেইনের উপর আছি।পরীক্ষা সামনে।
-ও।
সাথে দুঃখ সূচক চিহ্ন পাঠিয়ে দেয়।
-যাইরে পড়তে হবে।বাই।
-বাই।
ছেলেগুলো নিয়ে যত ঝামেলা।মেয়ে চ্যাটে দেখলেই হাই বুঝি দিতেই হবে।তিন চারজন নক করেছে।মোবাইলে এত জনের সাথে চ্যাট করা বেশ ঝামেলার।রেসপন্স না করলে আবার কেমন দেখা যায়?নীলিমা কথা শেষ করে রুমে প্রবেশ করে।
-কি চাঁদ,কার সাথে ডেটিং মারা হচ্ছে?
-কার সাথে মারব ভাই,আমাদের তো আর কেউ নেই।
-এমন করে মিথ্যা কথা বলে না চাঁদ,ঠিক দেখেছি,হেসে হেসে কার সাথে যেন কথা বললি?
-ও,আমাদের বিভাগের এক বড় ভাই ফোন দিয়েছিল।
-তাহলে তো আজ ঠিক ধরেছি,চুপি চুপি এমন ঘোলা পানি কত দিন ধরে খাওয়া হচ্ছে?
-না রে,আজকেই প্রথম।
-তো চালিয়ে যাও।
-তোর কি খবর?
-এইতো একটার সাথে কেবল চালালাম।আর তিন চারটার সাথে ডিল করতে হবে।
-সবার সাথে চালিয়ে যেতে খারাপ লাগে না?
-খারাপ কিসের,খুব ভাল লাগে।ছেলেরা মেয়েদের কাছে এসে যে কতটা বলদ হয়ে যায়,কথা না বলে বুঝবি না।এদের বলদামি দেখতে খুব ভাল লাগে।
এরপর নীলিমা একটা বেনসন সিগারেট ধরায়।আগে খাওয়ার অভ্যাস ছিল না।ভার্সিটি উঠার পর অভ্যাসটা হয়েছে।ছেলেরা যদি খেতে পারে,মেয়েরাও খেতে পারবে,সেই জিত ধরেই খাওয়া।মিলা এসে দুই টান দেয়।এরপর দুইজনে মিলে বেশ টানাটানি করে চন্দ্রাকে সিগারেট খাওয়ার জন্য।চন্দ্রা কিছুতেই সিগারেট খাবে না।
মিলা বলে-একটা টান দিলে কি হয় চাঁদ?
চন্দ্রা দেরি না করে তৎক্ষণাৎ বলে-একটান একটান করেই তো অভ্যাসটা হয়ে যায়।
অবশেষে মিলা হাল ছেড়ে বলে-আচ্ছা খুকি,তোমার খেতে হবে না।তুমি বসে বসে ফিটার খাও।
এমন সময় নীলিমা হেসে উঠে।মিলা কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলে-একটু পরে চন্দ্রা যে একটা বাঁশ খাবে,তাই ভেবে মজা পাচ্ছি।
চন্দ্রা মেয়েটার দিকে তাকাল।মেয়েটার মাথায় কি ফন্দি এসেছে,কে জানে?এরতো আবার ফন্দি মাথায় একটার পর একটা আসতেই থাকে।
নীলিমা বলল-মিলা একটু এদিকে আয়?
মিলা এদিকে আসতেই পেছন ঘুরে চন্দ্রার মুখের উপর প্রাকৃতিক গ্যাস ছেড়ে দিল।তিনদিন ধরে টয়লেট করে না।গ্যাসটা একেবারে নাক মুখের উপর দিয়ে গেল।বিশ্রী গন্ধে বমি আসার মত অবস্থা।ওরা দুজন হাসতে হাসতে একেবারে রুমের বাইরে চলে গেল।হাসি যেন কিছুতে থামছেই না।
-মি…মি
কথা না বলতেই আবার হাসা শুরু করল।
-ফাটিয়ে দিয়েছিস নীলু।অনেকদিন ধরে এমন বিশুদ্ধ আনন্দ পাই না।থ্যাংক ইউ দোস্ত।
চন্দ্রা নাক মুখ উড়না দিয়ে ঢেকে বসে আছে।নীলুটা এমন ফাযিল যে,মুখে বলার মত না।উড়না রেখে বেসিনে মুখটা ভাল করে ধৌত করতে গেল।কয়েকবার ভাল করে ধুইল।তবুও কেমন জানি নাক মুখ হতে গন্ধ যাচ্ছে না।মনে হচ্ছে তীব্র গন্ধটা এখনো রয়ে গেছে।
রাত্রি বারটা পেরিয়ে।শিলা লিখতে বসেছে।তার আবার লেখালেখি রোগ আছে।গভীরভার রাত পর্যন্ত জেগে লিখে।কি যে মজা পায়,কে জানে?নীলিমা আর মিলা বারান্দায় দাড়িয়ে কথা বলা শুরু করেছে।একটা দেড়টার আগে কথা বলা থামবে না।চন্দ্রা শুধু একা বসে আছে বিছানায়।বড় বড় একা একা লাগছে তার।বেশ ইচ্ছে করছে কারও সাথে কথা বলতে।ফোনটা হাতে নিল।ভাবল,অর্ণবকে কল দিবে।কল লিস্ট থেকে নামও বের করল।কিন্তু কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে।ঠিকমত চিনে না,জানে না,এমন একটা ছেলেকে কল দিবে,তা কি হয়?ছেলেটায় বা কি ভাববে,ভাল মেয়ে নয় নিশ্চয়,নইলে নিজের গরজে কল করে।অবশেষে ছেলেটার উপরই রাগ উঠছে।মাথা মোটা একটা।বারটা বেজে গেছে একবার কল দিতে কি হয়?রাত্রিতেই সবাই সবার সাথে কথা বলে।কে জানে,হয়তো আরেকজনের সাথে কথা বলছে।আজকাল ছেলেদের যে অবস্থা,এক একটা মজনু হয়ে গেছে।মেয়েদের প্রেমে পড়া বুঝি অভ্যাস হয়ে দাড়িয়েছে।
কয়েকদিন কেটে গেল।মনের ভিতর ছটফট বেড়ে গেছে।ভাবছে,এই বুঝি অর্ণব কল করবে।কিছুতেই মন বসছে না।বিকেলবেলা।হালকা বাতাস বইছে।চেয়ে আছে আকাশের দিকে।আকাশে সাদা সাদা মেঘ একবার এদিক যাচ্ছে আরেকবার ওদিক যাচ্ছে।এমন সময় ফোনটা বেজে উঠে।হৃদয়টা যেন লাফ দিয়ে উঠে।ভয়ে ভয়ে মোবাইলের দিকে তাকায়।সত্যিইতো অর্ণব কল করেছে।
-হ্যালো।
-কি কর?
-এইতো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি।
-কারও প্রেমে পড়লে নাকি?
-আরে না।
-প্রেমে পড়লে নাকি আকাশ,ফুল,ফল,নদী ইত্যাদির প্রতি ভাল লাগা জন্মায়?
-বেশতো অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হচ্ছে।
-অভিজ্ঞতা নেই,তবে গল্প উপন্যাস পড়ে তাইতো দেখি।
-বেশ গল্প উপন্যাস পড়া হয় বুঝি।
-ধুৎ,হাতে গুণা ছয় সাতটা হয়তো পড়েছি।তুমিতো বেশ গল্প উপন্যাস পড়,ঠিক বলেছি কিনা?
-তা বলেছ,কিভাবে জানলে বলতো?
-এইটুকু না,আর অনেক কিছু জানি।
-যেমন।
-তুমি প্রচন্ড পড়ুয়া,ইন্ডিয়া তোমার ফেভারিট ক্রিকেট টিম,অবশ্য বাংলাদেশের পরে।
-প্রচন্ড পড়ুয়া,এটা বোধহয় ঠিক না।
-ইন্টারে প্রচুর পড়াশুনা করেছ।কিন্তু এখন কিছুটা আরামে আছ।এই কথাতো,সেটাইতো বুঝিয়েছি।
-তা ঠিক আছে।এতসব তুমি কিভাবে জান?
-তা তো বলা যাবে না।
এইভাবে চলল দুই তিন সপ্তাহ।চন্দ্রা ছেলেটাকে ঠিক বুঝতে পারছে না।কথা যে খুব বেশি হয়,তা না।তিন চারদিন পর পর দশ বার মিনিট।প্রতিদিন অবশ্য ম্যাসেজ পাঠায় দুই তিনটা।সেও রিপ্লাই করে।এই পর্যন্তই।মনের ভিতর ধুক ধুক ছাড়ে না।এ কোন ব্যথার ভিতর পড়ল,ভেবে পায় না।সন্ধ্যা ঘনিয়ে চারদিকে আধার নামা শুরু হয়েছে।নীলিমা অভিনয় করা শুরু করেছে।
দেখ,জলিল স্যার কিভাবে হাটে?এই বলে নীলিমা হাটতে শুরু করে।কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলে-This is the best of the best department of the university.প্রায় ষাট হাজার ছাত্র ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলে।তোমরা মাত্র অনলি ফোরটি ফাইভ এখানে পড়ার সুযোগ পেয়েছ।
এরপর তামান্না ম্যাডাম কেমন করে, দেখানো শুরু করে।উড়নাটা মাথায় দিয়ে বলে-উ আ,আজ বড় ক্লান্ত লাগছে।দেখি তোমাদের কি পড়ানো যায়?এই চন্দ্রা বইটা দেয়তো।আর ভাল লাগে না।
তারপর রিয়া ম্যাডামের হাবভাব দেখায়।মিলার চোখ হতে চশমাটা খুলে পড়ে।চশমাটা কিছুটা ঝুকিয়ে নাকের উপর নেয়।এরপর বলা শুরু করে-আজ কাল চোখে কি যে সমস্যা হয়েছে,কিছু ঠিকমত দেখতে পাই না।চশমাটার পাওয়ার বাড়াতে হবে।যাই হোক,এই বিভাগে ভর্তি যখন হয়েছ তখন মুখস্থ তোমায় করতেই হবে।নইলে রেজাল্ট ভাল করা টাফ হয়ে যাবে।
এতক্ষণ হাসতে হাসতে ওদের প্রায় পেটব্যথা হয়ে গেছে।মেয়েটা অসম্ভব সুন্দর অভিনয় করতে পারে।অভিনয়ে গেলে যে বেশ নামডাক করবে এই ওদের ধারণা।চন্দ্রার ফোনটা বেজে উঠে।শিলা মুচকি হেসে বলে-কিরে,তোরও কি হয়ে গেল নাকি?
চন্দ্রা কিছু না বলে বারান্দায় গিয়ে কল রিসিভ করল।
-হু কেমন আছ?
-ভাল,ইউ?
-এইতো চলছে।
-তোমার কি বিএফ আছে?
-হঠাৎ করে এই প্রশ্ন?
-না,এমনেই করলাম।
-না,তোমার?
-ওই তোমার মতই।তোমার কেমন ছেলে পছন্দ বলতো?
-খুব সাদাসিধে,এখন পর্যন্ত রিলেশন করেনি।আমাকে খুব ভালবাসতে হবে।
-তো দেখতে কেমন হবে?
-ধবধবে ফর্সা ছেলে আমার পছন্দ না।শ্যামলা হলে ভাল হয়।
অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।চন্দ্রা কিছুটা উৎকন্ঠা নিয়ে বলল-কি হল?
-কিছুই তো মিল না।
-কার সাথে?
-আমার সাথে।
-তাই বুঝি?তোমার কপাল বোধহয় পুড়ল।
-পুড়ল কি বলছ,একেবারে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে।
-তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাও,নইলে তো ক্ষত শুকাবে না।
-তাই যেতে হয় বুঝি।তোমার জন্য ভাল খবর আছে।
-কি ভাল খবর?
-পেয়ে গেছি।
-কি?
-ছেলে।আমার বন্ধু।ছোটবেলা হতে একসাথে পড়ালেখা করেছি।কুয়েটে সিভিলে পড়ে।আমার দেখা সবচেয়ে ভাল ছেলেদের একজন।
-নাম কি?
-সমুদ্র সরকার।
-ছেলে খুব ভাল গল্প উপন্যাস লিখে।যদিও সব অপ্রকাশিত।তোমার তো আবার গল্প উপন্যাস খুব প্রিয়।একেবারে তরতাজা পড়ে ফেলতে পারবে।
তিন চারদিন পর।সমুদ্র টিউশনি করে হলে ফিরছে।ফোনটা বেজে উঠে।
-এতদিন পরে তাহলে মনে পড়ল।
-কি খবর ভাই?
-ভালই আছি।তোর কি খবর?
-এইতো চলছে।ওই প্রেম করবি।
বন্ধুর এই আকস্মিক অফারে বেশ বিস্মিত হল।এখন পর্যন্ত কেউ এইভাবে অফার করেনি।সমুদ্র মৃদু হেসে বলল-পছন্দ হলে করব।
-মেয়েটা খুব ভাল।আমার বিভাগেই পড়ে।প্রথম বর্ষ।
-দেখতে কেমন?
-আমার খারাপ লাগে না।মেয়েটা ভার্জিন আছে,এমন মেয়ে তুই পাবি কই?
-তা ঠিক।এ যুগে এমন মেয়ে পাওয়া টাফ।
-আর শুন,আমার নাম আকাশ নয়,অর্ণব।আর মোবাইলে টাকা লোড কর।কনফারেন্সে আলাপ করিয়ে দিব।
-ঠিক আছে।
-তোর সময় হবে কখন?
-আমিতো ফ্রি আছি।
-আটটার দিকে ফোন দিব।
সমুদ্র মোবাইলে একশ টাকার কার্ড ভরল।কেমন কেমন যেন লাগছে।প্রেম করার প্রথম স্বপ্ন দেখেছিল মেট্রিক পরীক্ষার পড়ে।এক মেয়েকে দেখে প্রচন্ড ভাল লেগেছিল।একই সাথে পড়ত।মাঝে মাঝে দেখা হত।দেখা হলে হালকা পাতলা কথা।খুব কাছে যেত ইচ্ছে হয় মেয়েটার।সবসময় থাকতে ইচ্ছে করত আশে পাশে।
রাত্রি সাড়ে সাতটা।কিভাবে কথা শুরু করবে, চন্দ্রা ভেবে পাচ্ছে না।ছেলেটা কেমন হবে,বলদ টাইপের হবে নাতো?চোখের সামনে একটি সংসারের ছবি ভেসে উঠছে।একটা ঘর,পাশেই একটি ছেলে বসে আছে।একজনের হাত আরেকজনের হাতে।পাশের রুম হতে একটি বালক এসে বলল-মা আমি খেলতে গেলাম।
ছেলেটা বলল-তোমায় এত ভাল লাগে কেন,বলতে পার।
-সবসময় এমন চাপাবাজি করবা না,ভাল লাগে না।
-চাপা মারব কেন,ভাল লাগলে আমি কি করব?
মুচকি হেসে বলে-বাজারে যাওতো।রান্নায় দেরি হয়ে যাবে।
-দাড়াও,তোমাকে কিছুক্ষণ দেখে নেই।ও,আমার বউটা এত সুন্দর কেন?
এমন সময় নীলিমা ধাক্কা দিয়ে বলে-কি রে,কি হল তোর?এভাবে একা একা হাসছিস কেন?
চন্দ্রা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-ও কিছু না,এমনেই।
নীলিমা কিছুটা কঠিন হয়ে বলল-এমনেই মানে,এমনেই হাসে পাগলে,তুই আস্ত একটা ভাল মানুষ।
-একটা হাসির কথা মনে পড়ছিল।
-কি কথা?
-একদিন আমি আর বাবা ভাত খাচ্ছি।বাবা বলল-মা একটু জোরে জোরে কান্না করত।কান্না শুরু করতেই মা এসে হাজির।বলল-কি হয়েছে মা?আমি বললাম-কিছু না।মা বলল-তাহলে কাদছিস কেন?এরপর আমি আর বাবা একসাথে হাসা শুরু করলাম।আমাদের হাসি দেখে মাও হেসে দিল।
নীলিমার বিন্দুমাত্র হাসি পেল না।এটা কোন হাসির ঘটনা হতে পারে?চন্দ্রার দিকে তাকাল।ওর চোখে মুখে বেশ অস্থিরতা।চন্দ্রা বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়।বুকটা ধক ধক করছে।আটটা বাজতে মিনিট দুয়েক বাকি।যেকোন সময় রিংটোনটা বেজে উঠবে।মাথাটা কেমন ঘুর ঘুর করছে।মোবাইলের দিকে বারবার তাকাচ্ছে।পা কিছুটা কাপা শুরু হয়েছে।
সমুদ্র এক গ্লাস জল খেল।তার বারবার পানি পিপাসা পাচ্ছে।টেবিলের উপর রবি ঠাকুরের শেষের কবিতা বইটা পড়ে রয়েছে।কয়েক দিন আগে এক বন্ধুর কাছ হতে নিয়ে এসেছিল।পড়বে পড়বে করেই পড়া হয়ে উঠছে না।বইটা নিয়ে পড়া শুরু করল।দশ পনেরো মিনিট চলে গেল,কয়েকটা লাইন এখন পর্যন্ত পড়তে পারল না।বার বার পড়ার চেষ্টা করছে,বার বার মন যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে।অবশেষে বইটা রেখে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে।কল না আসা পর্যন্ত ঘুম পাড়ায় মনে হল ভাল হবে।একবার ভাবল,আকাশকে কল দিবে।কিন্তু মনে কি এক দ্বিধা তাকে আটকে দিল,নিজেও বুঝতে পারল না।এক রুমমেট লো ভলিয়মে সিনেমা দেখছে।এই লো ভলিয়মও তার কাছে বেশ বিরক্ত লাগল।মনে হল,এখনি যেয়ে চট করে একটা থাপ্পড় মেরে সাউন্ড অফ করতে।আরেকজন বেসুরো গলায় গলা ছেড়ে গান গাওয়া শুরু করেছে।অন্যদিন তো এসব কখনও বিরক্ত লাগে নি।আজ কেন এমন হচ্ছে?শেষ পর্যন্ত রাগ গড়িয়ে পড়ল আকাশের উপর।বলদটা এত দেরি করছে কেন?কল দেয়ার কথা আটটায়।সাড়ে আটটা বাজে।টাইম সেন্স যে কবে হবে,কে জানে?দেরি হলে একটা কল দিয়ে জানিয়ে দিলেই হয়,এভাবে বসিয়ে রাখার কোন মানে হয়?মেয়েটা নিয়ে ভাবতে থাকে।কেমন জানি মনে হচ্ছে,দেখতে খুব একটা বোধ হয় ভাল হবে না।বন্ধু একবারও তো বলল না,মেয়েটা দেখতে ভাল।মেয়েটা ভার্জিন,একথা বলার মানে কি?একটা ফ্রেশ মেয়ে পাচ্ছি,সে যেমনই হোক,এটায় বড় ব্যাপার হিসেবে কি তুলে ধরছে না?মেয়ের ফেসবুক আইডি নিতে হবে।মেয়েটার ছবি দেখে পছন্দ হলে তবেই এগোবে।শুধু শুধু মেয়ে পছন্দ না হলে রিলেশনে জড়িয়ে লাভ নেই।রাহাত রুমে প্রবেশ করে।টিউশনিতে গিয়েছিল।
-কি এরকম ভাবে অবেলায় শুয়ে আছিস?
-না এমনেই।
বলে উঠে বসে সমুদ্র।সুমন তার বেড থেকে বলে-দেখ,কী আকাম কুকাম করেছে,করে একেবারে নেতিয়ে গেছে।
রাহাত হেসে বলে-ওর কি কিছু আছে যে আকাম কুকাম করবে?ছেলেমানুষ হলে কথা ছিল।
সমুদ্র রাহাতকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে-কয়েক বছর ধরে তো শুধু প্রেমই করে যাচ্ছ,প্রডাকশন তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।কী আমার ছেলে মানুষ?আর আরেকজনের প্রেমিকা তো এখন বোন হয়ে গেছে।কিছু থাকলে কি আর মেয়েটা বোন বানায়?
রাহাত বলে-তবুও তো প্রেম করছি।কিছু নেই বলেই তো প্রেম করার কোন ইচ্ছায় হয় না।হাতের কাছ দিয়ে মেয়ে চলে যায়,কোন ভাবগতির উদয় হয় না তোমার।আমার তো মাঝে মাঝে পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছে হয়।
এই বলে সমুদ্রকে জড়িয়ে ধরে।সাথে সাথেই দীনেশ আর সুমন এসে জাপটে ধরে।সুমন হাসি হাসি কন্ঠে বলে-দীনেশ খুল,তাড়াতাড়ি খুল।
সমুদ্র জোড়ে জোড়ে হাত পা নাড়া শুরু করে।
-দীনেশ,আর এগোবে না বলছি।এক পা এগোলেই খবর আছে।
দীনেশ হেসে হেসে এগোতে থাকে।যেন পৃথিবীর সবচেয়ে মজার কর্মকান্ডটা করছে।দীনেশ লুঙ্গির প্যাচ ধীরে ধীরে টান দিচ্ছে।
-দীনেশ,এটা কিন্তু ভাল হচ্ছে না।একবার ছাড়া পেলে কিন্তু তোর খবর আছে।
সুমন বলে- তাড়াতাড়ি কর,আর ধরে রাখতে পারছি না।
-শৈল্পিক উপায়ে করত দে,যেন তেন মানুষের লুঙ্গিতো খুলছি না।লেখক মানুষের লুঙ্গি।
এমন সময় দীনেশ লুঙ্গিটা একেবারে খুলে দিয়ে দৌড় দিয়ে রুমের বাইরে চলে গেল।বাকি দুইজন ওর পিছু পিছু ছুটতে লাগল।সমুদ্র লুঙ্গিটা ঠিক করে একটা হকিস্টিক নিয়ে ধাওয়া করল।এতক্ষণে বোধহয় ওরা নিচে নেমে গেছে।চারতলা হতে নামতে ইচ্ছে হল না।নিচে নামলেও বোধহয় লাভ হবে না।এতক্ষণে এমন জায়গায় চলে গেছে যে খুজে পাওয়া যাবে না।রুমে ঢুকে।ঠিক তখনি রিংটোনটা বেজে উঠে।বুকটা ধক করে উঠে।মোবাইলের দিকে ভীত নয়নে তাকায়।
-হু অর্ণব।
-এখন আমাকে কল দে।আমি তোকে ওর সাথে আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।
সমুদ্র কল কেটে দিল।এরপর কল দিল।
-সমুদ্র,ও চন্দ্রা;চন্দ্রা আমার বন্ধু সমুদ্র।
-নমস্কার ভাইয়া।
-নমস্কার।
অর্ণব বলল-তোমরা কথা বল।
-আপনি কেমন আছেন?
-এই তো ভাল।আমাকে আপনি আপনি করবেন না,আমি আপনার অনেক জুনিয়র।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-আপনি কেমন আছেন?
-বেশ ভাল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।চন্দ্রা নীরবতা কাটিয়ে বলল-কিছু জানার থাকলে বলুন।
-আ আ চাকরি করার ইচ্ছে আছে?
-বাবার পয়সা খরচ করে পড়াশুনা করছি,চাকরি করব না,তা কি হয়?
-আপনার আ তোমার কিছু বলার থাকলে বল।
-পড়াশুনা শেষ করে বিদেশে যাবেন?
-না,দেশেই কিছু করে খাওয়ার ইচ্ছে আছে।তোমার?
-বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করব।দেখা যাক।
-ভাল।অর্ণব তোর কি অবস্থা?
-এইতো ভাল।তোর কি খবর?
-ভাই চাপের উপর আছি।থিসিসের কাজে এত ঝামেলা,আর ভাল লাগে না।
-থিসিসের কাজে চাপ তো থাকবেই।
-তার উপর সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ক্লাস।একদম অবস্থা খারাপ।
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ দুই বন্ধুর মধ্যে কথা চলতে থাকে।চন্দ্রা অবশেষে বিরক্ত হয়ে বলল-ভাই আমি রাখি।আপনাদের বন্ধুর মধ্যে আমিতো তৃতীয় পক্ষ।
-আরে না, কথা বল।
-না ভাইয়া।
-আরে কথা বল।সমুদ্র ওর সাথে কথা বল।
-তোমার ফেসবুক আইডি আছে?
-ফেসবুকেই তো সারাক্ষণ থাকি।
-ইমেইল টা দেওয়া যাবে?
চন্দ্রা ইমেইল এ্যাড্রেসটা দিল।সমুদ্র বলল-থ্যাংক ইউ।
-আর কিছু জানার আছে।
-না,আরতো জানার মত কিছু খুজে পাচ্ছি না।আজকের মত রাখি।ভাল থেকো।
-আচ্ছা,ভাল থাকবেন।
এই বলে সমুদ্র ফোন কেটে দিল।আকাশের বেশ রাগ উঠছে।বলদ একটা,কথার মধ্যেই কাপাকাপি শুরু করে দিয়েছে।প্রেস্টিজ একেবারে শেষ করে দিল।আরে বাবা,কথা বলবি ওর সাথে,তা রেখে যত কথা আমার সাথে শুরু করেছে।এত কমনসেন্সের অভাব হলে কেমন হয়?
সমুদ্র রুমে এসে সব সবিস্তারে বর্ণনা করল।দেখা গেল,ওর থেকে রুমম্যাটদের চন্দ্রা সম্পর্কে আগ্রহ বেশি।সুমন কিউবির মডেম অন করেই ফেসবুকে ঢুকে।
-কি যেন বললি?
-চন্দ্রা।
-আরে পেয়ে গেছিতো মনে হচ্ছে।ঢাবি।অণুজীব,প্রথম বর্ষ।
-হু।
-মেয়েতো সুন্দর,সেইরকম।
রাহাত বলে-এ মেয়েতো কিছুতেই হাত ছাড়া করা যাবে না।
দীনেশ হেসে বলে-বন্ধু তোমার তো রাজ কপাল,এমন মেয়ের সাথে,ও ভাবতেই পারছি না।
সমুদ্রের মনে আঁকা কল্পিত মেয়েটার সাথে চন্দ্রা মিলল না।তবু মুখ ফুটে কিছু বলল না।ওদের বাদরামি ভালই লাগছে।সুমন হাত তালি দিয়ে বলে উঠল-এই ফ্রেন্ডরিকোয়েস্ট এ্যাকসেপ্ট করেছে।অনলাইনেও আছে।
রাহাত বলল-একটা হাই দেতো।
সুমন হাই দিল।সাথে সাথেই হাই ব্যাক এল।
-কি কর?
-এইতো বসে বসে মুভি দেখি।আপনি কি করেন?
-তেমন কিছু না।তোমার কথা ভাবছি।
-ও তাই।আমায় নিয়ে এত ভাববেন না,শেষে পাগল হয়ে যাবেন।
-আমিতো পাগল-ই হতে চাই।
একথা লিখে ওরা একযোগে হাসা শুরু করে।একেকজনের তাও আবার কি হাসি,যেন সমগ্র পৃথিবী জয় করেছে।সমুদ্রের মাথাটা শুধু ভনভন করছে।এরা যে কি ভেজালে ফালায়,কে জানে?
-তাহলে আর দেরি না করে পাগলাগারদে চলে যান।
-তুমি বললে পাগলাগারদ কেন,পৃথিবীর সব জায়গায় যেতে রাজি আছি।
-আচ্ছা এখন বাই।পরে কথা হবে।
-ওকে বাই।
সুমন হেসে বলল-ভাই মেয়েটার সাথে আমি প্রেম করি,তুইতো প্রেম করবিই না।
-বন্ধু দিয়েছে।এখন আমি তোর কথা কিভাবে বলি?
-তুই মেয়েকে সোজাসাপ্টা বলে দে,তোর একদম পছন্দ হয় নাই।কিন্তু এক বন্ধু প্রচন্ড পছন্দ করেছে।
-আচ্ছা দেখি।
এই বলে ওর বেডে এসে বসে সমুদ্র।ওর পিসিটা অন করে।ফেসবুকে ঢুকে মেয়েটার একটা শাড়ি পড়া ছবি কপি করে।এরপর ভাল করে দেখে।বেশ তো।চেহারার মধ্যে আর্ট আছে।ভারি সুন্দর মুখ।মুখে ঝকঝকে সুন্দর হাসি।ওর সব ইনফরমেশন দেখছে।কি পোস্ট দিচ্ছে, কে কে পোস্টে কমান্ড দিচ্ছে,খুটিনাটি যা জানা যায়,সব জানার চেষ্টা করছে।মেয়েটার মোটে মাত্র দুইটা ছবি খুজে পেল।আরেকটা ছবিতে দুইহাত ছড়িয়ে দিয়েছে যেন মুক্ত বিহঙ্গের মত ডানা মেলে উড়াল দিবে।বেশ লাগল মেয়েটাকে।শাড়ি পড়া ছবিটাকে ডেস্কটপে পিকচার হিসেবে সেট করে।
নীলিমা গলা ছেড়ে গান গাইছে।মাঝে মাঝেই রুমের ভিতর গলা ছেড়ে গান গায়।মনে মনে রুমের অন্যরা বিরক্ত হয়।কিন্তু কিছু বলে না।গানের লাইনেরও ঠিক নেই।এক গান গাচ্ছে তো এই গানের,আরেক গান অন্যগানের।জগাখিচুড়ী যাকে বলে।শিলা চন্দ্রার পাশে এসে বসে-কি চাঁদ দি,তোমার তাহলে হয়ে যাচ্ছে?
চন্দ্রা হেসে বলে-কি?
-ছেলে না মেয়ে?
নীলিমা গান ছেড়ে বলল-তলে তলে এতদূর,শেষ পর্যন্ত এই ছিল তোর মনে?
মিলা হাসি চেপে রেখে বলে-তাইতো দিন দিন পেট বেড়ে যাচ্ছে।
নীলিমা কাছে এসে চন্দ্রার পেটের দিকে ভাল করে তাকাল।–মিলা সত্যিইতো?
মিলা বিজ্ঞের মত বলে-সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
-এই সত্যি করে বলতো তোর কয় মাস?
-তোরা ফাযলামি ছাড়বি?
-দেখ বিষয়টা জটিল।সববিষয় এমনভাবে উড়িয়ে দিলে হয় না।
মিলা মৃদু কন্ঠে বলে-কি পাওয়ার রে বাবা,একদিনেই মেয়েটার এমন বেগতিক করে দিল।বলতে হবে ছেলেটার আছে,বেশ জোর আছে।
নীলিমা বলে-আকাম যখন করেই ফেলেছ,তখন আর কি করার?দেখি বাবাজীর ছবি?
চন্দ্রা ফেসবুকে ঢুকল।সমুদ্রের প্রোফাইলে ঢুকে।নীলিমা প্রোফাইল পিকচারের দিকে বড় বড় করে তাকিয়েই চিৎকার দিয়ে বলল-দেখছিস কি হট?
মিলা,শিলা মাথা নাড়ে।
-এই ছেলেতো পুরাই বউ ভক্ত হবে।বউ ছাড়া কিছু বুঝবেই না।বউয়ের কথায় কান ধরে উঠবে আর বসবে।চাঁদ তুই যে কত বড় ভাগ্যবতী,বুঝতে পারিস?
-অনেক হয়েছে,যার যার বেডে যেয়ে এবার ঘুমা।আমাকে নিয়ে তোদের এত ভাবতে হবে না।
কয়েকদিন পর।সমুদ্র সময় পেলেই ফেসবুকে ঢুকে।ঢুকেই অনলাইনে কে কে আছে, চেক করে,চন্দ্রা না থাকলে কেমন কেমন জানি লাগে,নিজেও বুঝতে পারে না।মেয়েটার প্রোফাইল পিকচারটা দেখে।এরপর কিছুক্ষন ওয়েট করে।চ্যাটে না এলে লগ আউট করে দেয়।রাত্রি এগারোটা।ফেসবুকে ঢুকে।চন্দ্রা অনলাইনে আছে।
-হ্যালো চন্দ্রমুখী দেবী।
-আপনি আমার ওই সুন্দর ছোট নামটা ধরে ডাকেন।
-আচ্ছা,চন্দ্রা কেমন আছ?
-ভাল।আপনি?
-এইতো চলছে।তোমার বড় ভাই কেমন আছে?
-সর্দি লাগছে।আপনারা খুব ভাল বন্ধু?
-খুব ভাল বললেও ভুল হবে,এর থেকেও বেশি।তোমার সম্পর্কে বেশ ধারণা দিয়েছে।
-কি বলেছে?
-তোমার বাড়ি টাংগাইল সদরে।তোমরা এক ভাই এক বোন।
-আর?
-তুমি নাকি মেয়েই না?
-মানে কি?
-পরী।অসম্ভব ভাল মেয়েদের একজন।তোমার দিকে তাকালে নাকি চোখ ফেরানো যায় না?
-অর্ণব বলেছে?
-আর কত কি বলেছে?
-আর কি?
-লম্বায় পাঁচ ফুট দুই,ওজন ৪৭ কেজি।
-এসব বলেছে?
-হু।
সমুদ্র আরও কিছু লিখতে যাবে,চন্দ্রা ফেসবুক হতে বেরিয়ে গেল।পাঁচ সাত মিনিট পর রিংটোনটা বেজে উঠে।
-হু আকাশ?
-সমুদ্র,আমি তোমাকে ওসব কথা বলেছি,তুমি সুন্দর,তাকালে চোখ ফেরানো যায় না?
-ভাই আমিতো ওকে সরাসরি দেখিনি,তাই তুমি বলেছ,এভাবে বলেছি।
-ওসব বলো না।তাতে খারাপ ভাববে।ছবি দেখে তোমার যা ভাল লাগে,তাই বল।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-উচ্চতা ওজন এসব কি?
-ছবি দেখে ধারণা করছিলাম।তাই বলেছি।
-আচ্ছা রাখি।ভালভাবে চালিয়ে যাও।
-ওকে।
সমুদ্রের মনটা কিছুটা খারাপ হল।বন্ধু কোন কাজের জন্য এভাবে কোনদিন বলেনি।সুমন অভিনয় করে বলছে-ও চন্দ্রা,আমি তোমাকে ভালবাসি।খুব বেশি ভালবাসি।বল,কোনদিন আমায় ছেড়ে যাবে না।আমার বুকে হাতটা রেখে দেখ।আজকাল হৃদপিন্ডের কম্পন কত বেড়ে গেছে,যেন সাগরের উত্তাল ঢেউ।চন্দ্রা,চন্দ্রা,তুমি কই,এভাবে চলে যেও না।তুমি চলে গেলে আমি বাঁচব না।
এই বলে সুমন কাঁদতে শুরু করে।রাহাত আর দীনেশ বেশ জোরে জোরে হাত তালি দেয়।রাহাত একটা খালি মদের বোতল তুলে দেয়।সুমন ঢুলতে ঢুলতে বলে-তুই,তুই চন্দ্রা?ছি ছি ছি,এটা তুই কেমনে করলি?তোর মুখের দিকে তাকাতেও আজ আমার বড় ঘৃণা হয়।তুই চলে যা,আমার সামনে হতে চলে যা।
এই বলতে বলতে বিছানার উপর ঢলে পড়ে।
মোহিত ঘুম পাড়ার চেষ্টা করছে।আধা ঘন্টা যাবৎ শুয়েও আছে।তবুও ঘুমের কোন চিহ্ন খুজে পাচ্ছে না।মোবাইলটা বের করে।বিকেল চারটা বাজে।চন্দ্রাকে কল দিল।
-মোহিত বল।
-দোস্ত কেমন আছিস?
-ভাল।তুই?
-আছি কোনরকম।এই সামনে সপ্তাহে কি পরীক্ষা?
-ইকোলজি।
-সিলেবাস?
-প্রথম দুই চ্যাপ্টার।
-পড়া শুরু করেছিস?
-আরে না,এত আগে পড়া শুরু করার ইচ্ছে নেই।এই রাখি,পড়ে কথা হবে।
-আচ্ছা।
এই বলে মোহিত কল কেটে দিল।সিলেবাস,পরীক্ষা সবই জানতো,তবুও কল দিয়েছে।কেন জানি,মেয়েটার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে হয়।প্যান্টটা পড়ে।সাথে লাল রংয়ের টি শার্ট।অলককে ডাক দিল।ছেলেটা ঘুমালে ডাক দিয়ে উঠানো খুব কঠিন।এত গভীর ঘুম।ওরা এক বেডে দুইজনে থাকে।বাকি তিন বেডে মাস্টার্সের তিন দাদা থাকে।অলককে ডেকে লাভ হল না।তাই সে একাই টিএসসির দিকে রওনা হল।ক্যাম্পাসের আশে পাশে ঘুরতে বেশ লাগে।বেশির ভাগ সময় একা একায় ঘুরে।মাঝে মাঝে মনে হয়,সাথে একটা মেয়ে থাকলে বেশ হত।দুই জনে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দেওয়া যেত।
চন্দ্রা ব্রাশ করছে।এসময়ে নরমালি ব্রাশ করে না।সকালে একবার করে,রাতে একবার করে।বিকাল বেলার ঘুম শেষে,দাঁতগুলো হতে কেমন জানি গন্ধ বের হচ্ছে,মনে হচ্ছিল।তাই।দাঁত ব্রাশ করে স্যান্ডেলিনা সাবান দিয়ে কয়েকবার মুখ ধৌত করে।গামছা দিয়ে হাত মুখ মুছে বেডের উপর বসে।নীলিমা বলে-চাঁদ পানির বোতলটা দেতো।
চন্দ্রা পানির বোতলটা এগিয়ে দেয়।
-তোর মজনুর কি খবর?
-আরে বলিস না,এর জ্বালায় মরছি।
– কেন?
-আরে পিছনে সবসময় লেগেয় আছে।যখনি ফেসবুকে ঢুকি,তখনি দেখি অনলাইনে।ম্যাসেজ পাঠাতে এক সেকেন্ড দেরি করবে না।এত বিরক্ত লাগে।
চন্দ্রার মুখটা হাসি হাসি,বিরক্ত লাগে এটা শুধু যে কথার কথা,মুখের দিকে তাকালেই বুঝা যায়।
-তাহলে ছেলেতো পুরো কুপোতকাত করে ফেলেছ।
-কুপোতকাত মানে আবার কি?
-মানে ছেলেতো তোমাতে মন্ত্রমুগ্ধ।এখন তুই যা বলবি তাই হবে।ধর,তুই যদি বলিস,কাক পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পাখি।সে বলবে,ঠিক,একদম ঠিক,কাকের মত সুন্দর পাখি পৃথিবীতে থাকতে পারে না।
চন্দ্রা হেসে উঠে।
-এতেই হেসে দিলি।মূল কথাতো এখনো বাকি।ধর তুই ছেলেটার সামনে ধূম করে প্রাকৃতিক গ্যাস ছেড়ে দিলি।ছেলেটা কি বলবে জানিস?
-কি?
-ও এমন মধুর শব্দ কোনদিন শুনিনি।এমন সুগন্ধ যেন পৃথিবীর সমস্ত সুগন্ধ হার মানবে।
এই বলে নীলিমা হাসতে হাসতে নিজের বেডে বসে পরে।চন্দ্রার মুখ হতেও হাসি থামছে না।চন্দ্রা ফেসবুকে ঢুকে।মোহিত তার প্রোফাইলে পক লিখে দিয়েছে।এভাবে সবাইকে দেখিয়ে পক লেখার মানে কি?গাধা একটা।চন্দ্রা কমান্টে লিখল-এভাবে পক দেওয়ার মানে কি?
মোহিত তখন অনলাইনেই ছিল।–পক যখন করব,তখন সরাসরিই করি।সবাই জানা ভাল না?
-গোপনীয়তা বলে কিছু কথা আছে।
-আচ্ছা আর করব না।
-আচ্ছা তোর যা ইচ্ছা তুই কর।
চন্দ্রা কাল দুইটি ছবি আপলোড করেছিল।বেশ কমান্ট ও লাইক পড়েছে।সমুদ্র দুটি ছবিতেই কমান্ট করেছি।
-সে হাসি বিধাতা যাকে দিয়েছেন,তাহার আর বলিবার দরকার হয় না।রবি ঠাকুর বুঝি এমন কোন হাসি দেখেই লেখাটা লিখেছিলেন।
-রবি ঠাকুর ঐ লেখাটা লেখার আগে এমন হাসি দেখলে নিশ্চয় লিখতেন,এমন কুৎসিত হাসি তাকালে আর দ্বিতীয় বার দেখতে ইচ্ছে হয় না।
আরেকটা কমান্ট-মনে হচ্ছে ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছ,যেখানে নীল পরি,লাল পরিরা ভেসে ভেসে বেড়ায়।
-আমারও তাই মনে হয়।পরিদের সাথে উড়ার শখ আমার ছোটবেলা হতে,দেখা যাক কি হয়?
সপ্তাহখানেক পর।সমুদ্র ছাত্রী পড়াচ্ছে।ইন্টারে পড়ে।ইংরেজী পড়ায়।সিভিলে পড়ে ইংরেজী পড়ায়,অনেকটা হাস্যকর বটে।কিভাবে পড়ায়,সে আর তার ছাত্রীই জানে,এর বাইরে কিছু বলিতে পারি না।শিক্ষক ছাত্রীর সম্পর্ক একেবারে ফ্রি,দুইজনেই দুইজনার কথা বলে।
-স্যার একটা গুড নিউজ আছে।
-কি?
-আমি এখন পুরোপুরি সিংগেল।বেশ ভাল হয়েছে।কত যে পেইন থেকে বাঁচলাম,বলে বুঝাতে পারব না।এখন একেবারে মুক্ত।
বলছে হেসে হেসে কিন্তু সে হাসির মাঝে কোন প্রাণ নেই।
-বেশতো,এমন পেইন যে ছেলে দেয়,তার কাছ হতে আরও আগেয় ভাগা উচিৎ ছিল।
-ছেলেটার খালাতো বোনের সাথে বিয়ে।ফ্যামিলি থেকে ঠিক করেছে।আর ছেলেটাও দেখেন,বাবা মায়ের কথামত ওই মেয়েকেই বিয়ে করতে চলেছে।ভাল থেকে কি লাভ বলেন?
-ভাল থাকাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরী।তোমার আশে পাশে যাই হোক।
-স্যার কয়েকজন ভালমানুষের নাম বলতে পারবেন?
-দাড়াও,ভেবে দেখি।
-দাড়াতে পারব না স্যার,বসেই থাকি।
কিছুক্ষণ পর সমুদ্র বলল-পেয়ে গেছি।
-কি?
-ভাল মানুষ।ঢাবির চন্দ্রা।আমার জানা সবচেয়ে ভাল মেয়ে।
-আপনি তাকে চিনেন?
-সরাসরি চিনি না।বন্ধু কনফারেন্সে আলাপ করিয়ে দিয়েছে।
-একজনকে না জেনেই ভাল মেয়ের উপাধি দিয়ে দিলেন।
-বন্ধু বলেছে।খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।ছোটবেলা হতে একসাথে পড়াশুনা করেছি।
-ব্যক্তিগতভাবে না জেনে এভাবে ঢালাওভাবে পৃথিবীর সেরা ভাল মেয়ে বানিয়ে দেয়া ঠিক না।
-ঠিক।আমি তোমার লজিকের কাছে হার মানছি।
-ওকে বলেছি,আমার ছাত্রী আমাকে ক্যারেক্টারলেস বলেছে।এটা শুনে সে কি খুশি,বলে একদম ঠিক বলেছে।
ফারিয়ার মুখে কিছুটা বিষাদের ছাপ।–স্যার সবসময় দোষ নিজের উপর নেন কেন?আমি বলেছি,ভার্সিটির ছেলেরা ক্যারেক্টারলেস,মেয়ে দেখলেই প্রেম করতে চায়।আপনার কথা বলি নি।
-আমিতো ভার্সিটিতেই পড়ি।
-বুঝেছি আপনার সাথে কথা বলে লাভ নেই।আপুর আইডিটা বলেন।আপুর কাছে আমাকে ফাসিয়ে যাবেন,তা হয় না।
সমুদ্র আইডিটা দিল।মেয়েটা তবুও শান্ত হোক।
-এই ন্যারেশনের রুলসগুলো পড়।
-স্যার,আগেতো খুব কমই ফেসবুকে পেতাম।ঘটনা কি বলেন তো?
-আগে বড় হও,বাচ্চামেয়েদের এসব বলতে হয় না।
-স্যার আমি বাচ্ছা না।কলেজে পড়ি।
-এখনো তো আঠারো হয় নি,বাচ্ছা তো না কি?
-স্যার কি ইচ্ছে করে জানেন,আপনার মাথার চুল সবগুলো একটা একটা করে ছিড়ি।
সমুদ্র মাথা এগিয়ে দিয়ে বলে-ইচ্ছে হলে ছিড়তে পার।আমার আপত্তি নেই।
ফারিয়া চুল ধরে টানতে থাকে।অবশেষে বিরক্ত হয়ে চুল টানা বন্ধ করল।
-বেশ লাগছিল।আর কিছুক্ষণ টেনে দে না?
-ধুৎ,মনে হচ্ছে মাথাটা একেবারে থেতলে দিতে।
-এমন কাজ করে না ফারিয়া,একটা মেয়ের জীবন যে এর সাথে রিলেটেড।
-আপনাকে বিয়া করবে এমন গাধী পৃথিবীতে আছে?
-কত গাধী আছে?
-এমনভাবে বললেন যেন আপনার পিছনে লাইন লেগে আছে।
-তা তো লেগে আছেই।
ফারিয়া হেসে বললেন-হাসালেন স্যার।
-যা সত্য তাই বললাম।
-গাধীদের নাম্বার দেন,এতবড় বোকামি করছে,তাদের সতর্ক করে দেয়।
-তা তো দেওয়া যাবে না?
-বুঝছি?
-কি?
-সবই যে আপনার চাপা।
-ভাল বুঝেছ,এত ভাল কিভাবে বুঝ?
সমুদ্র টিউশনি হতে বের হয়ে সরাসরি হলে চলে আসে।মিনিট বিশেক লাগে।পিসিটা অন করে ফেসবুকে ঢুকে।চন্দ্রা অনলাইনে নেই।ওর কমান্টে কমান্ট করেছিল।তার উপরও মেয়েটা কমান্ট করেছে।চন্দ্রার কমান্ট-সারাপৃথিবীর কাছে তুমি হয়তো কিছু নও,কিন্তু কারও কাছে হয়তো তুমি সারাপৃথিবীর চেয়ে দামি।
-তোমার বুঝি oxytocin হরমোন এ্যাক্টিভ অবস্থায় আছে,সেই জন্য এমন আবেগী কমান্ট দেখতে পাচ্ছি।
-সাইকোলজিতে যে আপনার ভাল নলেজ আছে,তা সবাইকে এভাবে বলে বেড়াতে হবে না।
নতুন কি লেখা যায়,ভাবতে থাকে।মাথায় এসেও গেল কিছু একটা।–একেবারে ভুল ধারণা,সাইকোলজিতে আমার নলেজ একেবারে সীমিত।ভালবাসা যে হরমোনের কারসাজি,তা জানিয়ে দিলাম।
মোহিত নামে একটা ছেলেকে বেশ ঝামেলার মনে হচ্ছে।চন্দ্রা এ পর্যন্ত যা যা পোস্ট করেছে,সবকিছুতেই ছেলেটার লাইক কমান্ট আছেই।একই পোস্টে আবার একাধিক কমান্টও আছে।এই ছেলেটার সাথে কিছু একটা আছে বোধহয়,নইলে সবগুলো পোস্টের পেছনে এইরকম ঘুর ঘুর করে লেগে আছে কেন?বেশ লম্বা কথোপকথনও দেখা যাচ্ছে।
-ওই আজকে ক্লাসে আসিস নাই কেন?(মোহিত)
-ইচ্ছা হল না তাই।
-আজ বেশ মজা হয়েছে,লাড্ডু স্যার বলে,তার মেয়ের নাকি বয়ফ্রেন্ড হয়েছে?আরও কত কথা?
-শুনেছি,নীলিমা বলেছে।তোর জলপরীর খবর বল মুদ।
-ঐ এইরকম পাবলিক প্লেসে এরকম করলে আমিও কিন্তু হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দিব।
-কি করবি তুই মুদ?
-ঐ তোর কিন্তু খবর আছে?
-কয়টার খবর মুদ?
-তোর বাবা যে নামে ডাকে সে নামটা সবাইকে বলে দিব।
-এটা না বলার কি আছে,আমিই বলে দিচ্ছি,বুড়ী।
-ক্লাসে একদিন কয়েকজন মিলে একটা নাম বের করেছিলাম।সেই নামটা কি ফ্লাশ করে দিব?
-দিস না রে ভাই?
-এখন কেমন লাগে?
-আচ্ছা তোকে ভাল নামেই ডাকব।তোর খবর বল,তোর জলপরী কেমন আছে?
-আছে সুখেই আছে।সামনে টিএসসিতে আসবে।
-আমার সাথে কিন্তু পরিচয় করিয়ে দিবি।
-ওকে ম্যাম।ওই শ্যালার পুতের কথা বল,তোর পিছনে যে সারাদিন ভরে ঘুরঘুর করে ঘুরে।
-আছে ও একই অবস্থা।ও জিনিস কোনদিন চেঞ্জ হবে না।একটার পর একটা কথা বলতেই থাকে।মাথাটা একেবারে গেছে।
চন্দ্রাকে অনলাইনে দেখা যাচ্ছে।সমুদ্র সাথে সাথে পাঠাল-ওই,ভয়াবহ খবর আছে?
-কি?
-দাদা হলে আসছিল।
-তাতে কি হয়েছে?
-তাতেইতো যত অঘটন ঘটল।
-কি অঘটন?
-তোমার শাড়ি পড়া ছবিটি দেয়ালে প্রিন্ট করে লাগিয়েছিলাম।ডেস্কটপে ব্যাকগ্রাউন্ড ছবিও সেটাই দিয়েছিলাম।দেখে সে কি জারি?
-আপনে এটা কি করছেন?এখনও কি আছে?
-আছে।
-তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলেন।আর দাদা কি বলেছে?
-এখন আর সরিয়ে কি লাভ?যা হওয়ার তাতো হয়েই গেছে।দাদা তোমার নাম্বার চেয়েছে।মনে হয় নাম্বার পেলে তোমাকেও ঝাড়বে।
-নাম্বার দিয়েছেন?
-আমি নাম্বার কই পাব?দাদা বিশ্বাস করে না।আমার মোবাইল নিয়ে সবগুলো ম্যাসেজ দেখল,কল লিস্ট দেখল।যখন পেল না,তখন বলে-বদতো হাড়ে হাড়ে হয়েছিস?কোন প্রমান রাখিস না।
চন্দ্রার উদ্বিগ্নের মাত্রা বাড়তে থাকে।মনে হচ্ছে,মাথার সব চুল ছিড়ে ফেলতে।–ভাই আপনিতো দেখি নিজেও মরবেন,আমাকেও মারবেন।প্রেম না করেই এই অবস্থা,প্রেম করলে যে কি হত?কেন যে অর্ণবকে বলেছিলাম?আপনার বন্ধুকে বলেছেন।
-ওকে বলে কি লাভ?
-যদি ওকে কল করে আমার নাম্বার চায়,যেন না দেয়।
-সেটা তুমিই বল।একটা কথা বলি।
-বলেন।
-কিছু মনে করব নাতো?
-এতো ভণিতা না করে বলে ফেলেন।
-সাহস দিচ্ছ।
-আরে বলে ফেলেন তো?
-মহামতি চন্দ্রমুখী দেবী,এতক্ষণ যা শুনলেন বাস্তবতার সাথে তার কোন মিল নেই।যদি কারও জীবনের সাথে মিলে যায়,তাহলে লেখক দায়ী নয়।
চন্দ্রার বেশ রাগ উঠছে।ছেলেটার মাথায় কি সমস্যা আছে নাকি?-ফাযলামি করবেন,করেন,তাই এসব বিষয় নিয়েও?এটা আপনি ঠিক করেন নি।
-ফাযলামিতো ফাযলামিই,এত সিরিয়াসলি নিচ্ছ কেন?
-সবকিছুর একটা লিমিট আছে।আপনি লিমিট ক্রস করেছেন।
-আচ্ছা সরি।
-আপনি কি সবসময় মিথ্যা কথা বলেন?
-কি করব বল,ছোটবেলার অভ্যাস।আর মিথ্যা কথা বলা আমার একটি প্রিয় কাজগুলোর একটা।
-আজব।এমন পাবলিক আর একটি দেখিনি,মিথ্যা কথা বলা নাকি প্রিয় কাজ?
-বুঝ তাহলে,কত বড় ভাগ্য তোমার,এমন আজব পাবলিকের সাথে তোমার পরিচয় হয়েছে।
-ভাগ্য না ছাই।আমি বললে কি মিথ্যা কথা বলা ছাড়বেন?
-তুমি বললেই মিথ্যা কথা বলা ছাড়ব কেন?
-তাও ঠিক,আমি বললে ছাড়বেন কেন?আমি তো আর আপনার কেউ হই না।
সমুদ্র ম্যাসেজ পাঠাবে,দেখে চন্দ্রা আর অনলাইনে নেই।মনে হয়,মেয়েটা বেশ কষ্ট পেয়েছে।এতটা বুঝি ফাযলামি করা ঠিক হয় নাই।
রাত্রি বারটা বাজে।মোহিত বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।আকাশে আধা চাঁদ দেখা যাচ্ছে।হালকা বাতাস।অলক এসে কাধে হাত রাখে।অলক বলে-বন্ধু মেয়েতো একটা পছন্দ হয়েছে,কি করা যায় বলতো?
-সেইজন্যইতো উড়ু উড়ু ভাব দেখতে পাচ্ছি।কি, মেয়েটা কে?
-আমাদের ক্লাসেরি।
-কে বলতো?
-দেখি ধারণা করতো।
মোহিত কয়েকটা মেয়ের নাম বলে।অলক হেসে বলে-না রে হল না?
-কে বলতো?
অলক মুচকি হেসে বলে-চন্দ্রা।
মোহিত কিছুটা চমকে উঠল।কিন্তু বুঝতে দিল না।অলক যে ফাযলামি করছে বুঝতেই পারছে না।দম ফাটা হাসি পাচ্ছে।হাসি চেপে রেখে বলল-তোর কি হয়েছে বলতো?
-কই,কিছু হয় নিতো?
-না,বেশ চেঞ্জ দেখছি।বেশ ফিটফাট হয়ে বিভাগে যাচ্ছ।কোনদিন সেন্ট ইউস করতে দেখিনি,কয়েকদিন ধরে সেন্ট মেরে যাচ্ছ।চুলগুলো স্পাইক করছ।দিনে কমকরে হলেও ছয় সাতবার ফেসিয়াল দিয়ে মুখ ধুচ্ছ।এসবের মানে কি?
-মানে কি আবার,শরীরের যত্ন নিতে হবে না?
-এই,এইসব কথা ছাড়তো।এই তুইতো আবার চন্দ্রার প্রেমে পড়িস নি?মানে মানে বলে দিচ্ছি,ওই দিকে কিন্তু ভুলেও তাকাবি না।
মোহিত কোন কথা বলল না।চোখে মুখে চিন্তার পূর্ণ ছাপ।
-কি কথা বলছিস না কেন?
মোহিত অলকের হাত ধরে বলল-ভাই,চন্দ্রার পিছু ছেড়ে দে না?
-সেতো ছাড়া যাবে না।এমন মেয়ে হাতছাড়া হলে তো আর পাব না।এছাড়া এই প্রথম কোন মেয়েকে খুব বেশি পছন্দ হয়েছে।
-ভাই,আমি ওকে ভালবেসে ফেলেছি।তুই প্লীজ সরে যা।
-আচ্ছা দেখা যাবে,চন্দ্রা যাকে সিলেক্ট করে।তুইতো এখানো এগিয়ে।ওর সাথে বেশ যোগাযোগ আছে তোর।
এভাবে তাদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চলতে থাকে।দ্বন্দ্ব আরও বাড়তে থাকে।অলক কিছুতেই চন্দ্রার পিছু ছাড়তে রাজি নয়।
ভরদুপুর বেলা।প্রচন্ড রোদ উঠেছে।এর মাঝে শিলা,মিলা আর চন্দ্রা টিএসসি যাচ্ছে।সময় বেশি লাগবে না,মিনিট পাঁচেক।একটা ছাতা থাকলে বেশ হত।শরীর মনে হয় ঝলসে যাচ্ছে,এমন অবস্থা।টিএসসির চায়ের দোকানে বসে।চন্দ্রা বলে-মামা তিনটি চা।
একঝাক ছেলে রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে।অপরাজয় বাংলার সামনে যাবে।হালকা পাতলা শ্লোগান হচ্ছে।
-শেখ হাসিনা ভয় নাই,রাজপথ ছাড়ি নাই।এক মুজিব লোকান্তরে,লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে।ছাত্রলীগের মূলনীতি,শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি।
ইত্যাদি এসব এসব।নিরীহ ছাত্রগুলো নিতান্তই সিটের জন্য রাজনীতি করে।রাজনীতি করলেই হলে সিট পাওয়া যাবে,হলে যা খুশি করা যাবে,তাই বাধ্য হয়েই করা।বাইরে থাকলে যে খরচ,তার ব্যয়ভার বহন করা কষ্টসাধ্য। বেশিরভাগ ছাত্রই লোয়ার মিডিল ক্লাস অথবা মিডিল ক্লাস।যাদের বেশিরভাগই চলতে হয় টিউশনি করে।এতক্ষণে ওরা চা পান করা শুরু করেছে।মিলা একটি ছেলে দেখিয়ে বলে-দেখ,ছেলেটা কেমন করে তাকিয়ে আছে?চোখের দিকে তাকালেই বুঝা যাচ্ছে,মেয়ে দেখলেই প্রেমে পড়ে যায়।
শিলা মৃদুস্বরে বলে-সেতো শুধু ঐ ছেলের সমস্যা নয়।পৃথিবীর সমস্ত ছেলেদের একই প্রভলেম।কেউ কেউ নিজেদের লুকিয়ে রাখে,কেউ কেউ আবার এর মত হা হয়ে তাকিয়ে থাকে।
মিলা মুচকি হেসে বলে-দোস্ত দেখ,তোর দিকেই তাকিয়ে আছে।
-আমার দিকে না জনাব,আপনার দিকেই।
-আমাদের কারও দিকে নয়,চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে আছে।দেখ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।
শিলা চন্দ্রার কাধে হাত রেখে বলে-সখি,তাকাও না একটু।মজনু তোমার কত আশা করে দাড়িয়ে আছে।
চন্দ্রা তেমন কিছু বলে না।শুধু বলে-তোদের ইচ্ছা হয়,তোরা দেখ।
চন্দ্রার মাথায় অর্ণবের কথা বারবার ঘুরেফিরে আসছে।ছেলেটার হল কী?যেই থেকে তার বন্ধুর সাথে আলাপ করিয়ে দিয়েছে,সেই থেকে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে।এইরকম করছে কেন,তার বন্ধুর সাথে এমন কিছু হয়নি যে যোগাযোগ কমিয়ে দিতে হবে।
মিলা ধাক্কা দিয়ে বলল-এই কি হল তোর?এত কি ভাবছিস?
শিলা চন্দ্রাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলে উঠে-নতুন প্রেম তো,প্রেমিকের ভাবনায় মজে আছে।
-প্রেম,কার সাথে?
বলেই হেসে দেয় চন্দ্রা।
-কেন,সেই যে তোকে ম্যাসেজ দিল।ওরে কি রোমান্টিক ম্যাসেজ রে বাবা?
-শিলা ঠিক হচ্ছে না কিন্তু।
মিলা বেশ উৎসাহ নিয়ে বলে-কি লিখেছিল রে শু?
-তোমাকে ছাড়া যে একটা দিন কাটানো কত কঠিন,তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।যাই করতে যাচ্ছি,মনে হচ্ছে আমার পাশেই বুঝি দাড়িয়ে আছ।দিন দিন এ কোন গহ্বরের দিকে যাচ্ছি,যার আদি,অন্ত,মধ্য কিছু নেই মনে হচ্ছে।এ কোন ঘোরের গভীরে ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছি,তা জানি নে।
শিলা চন্দ্রাকে গালে হালকা থাপ্পড় দিয়ে বলে-ছেলেটার নাট বল্টুতো সব আউট করে দিয়েছেস চাঁদ।
মিলা এবার হেসে বলে-আমাদের চাঁদেরও যে নাট বল্টু গেছে।সে কি লিখেছে শোন?
-বল।
-তাই বুঝি?এত তাড়াতাড়ি কাউকে না জেনেশুনে সবসময় সাথে সাথে রাখবেন না।অর্ণব বলেছিল,আপনি লেখালেখি করেন।আজ তার প্রমাণ পেলাম।বেশ ভাল লাগল।
-ও তলে তলে এতদূর চলে গেছ।লায়লি মজনুও তো ফেল মেরে যাবে।
ওরা উঠে পড়ে।ধীরে ধীরে হাটতে হাটতে হলে চলে যায়।চন্দ্রা রুমে ঢুকেই স্নান করার জন্য বের হয়।ঝর্ণা হতে অবিরল ধারায় পানি পড়তে থাকে শরীরে।চন্দ্রা নিঃশব্দে কাদতে শুরু করে।তার হূ হূ করে কাদতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু লজ্জায় হূ হূ করে কাদতে পারছে না।
বিকেলবেলা।চন্দ্রা ঘুমাতে চেষ্টা করে।কিন্তু ঘুম আসে না।ফেসবুকে ঢুকে।ঢুকতেই সমুদ্র লিখে পাঠায়-হাই।
-বলুন।
-একটি গবেষণা করছি।একজন মানুষ সপ্তাহে কয়বার কান্না করে।
-আপনার কি খেয়েদেয়ে কোন কাজ নেই?
-কোনও কাজই ছোট নয় মহামতি।এবার বলুনতো,এই সপ্তাহে কখনও কেঁদেছেন কিনা?
-আমার মনে নেই।একটা কথা বলি।
-বল।
-আপনাকে আমি দাদা বলি।
-দাদাই তো বলবে,নো প্রভলেম।
চন্দ্রা আরও ভ্যাবাচেকার মধ্যে পড়ে গেল।কেন সে দাদা শুনতে রাজি হবে?এখনতো সবাই কত সুন্দর করে নাম ধরে ডাকে,তুমি তুমি করে বলে।
-না অর্ণবকে দাদা বলতে চেয়েছিলাম,রাজি হয় নি।
-রাজি হবে না কেন?
-আপনার বন্ধু,আপনি ভাল জানেন।
-তোমার বড় ভাইয়ের জন্য একটি মেয়ে দেখ।কয়েকদিন পর তো চাকরি করা শুরু করবে।
-কোন বড় ভাই?আপনি না অর্ণব?
-আমার জন্যতো দেখতে হবে না,অর্ণবের জন্যই দেখ।
কথাটা তেমন কিছু না।তবু বেশ লাগল।
-আচ্ছা দেখব।অর্ণবতো এখন আর খোঁজখবর নেয় না।আগে দিনে অন্তত দুই তিনটা ম্যাসেজ দিত।
-আচ্ছা বন্ধুকে বলে দিব।
-বাসায় গেছেতো,মাসিমার আদরে বোনটার কথা একেবারে ভুলে গেছে।আমার ভাইটা একেবারে ভাল না।
-এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না,বন্ধুর সামনে বন্ধুর বদনাম।
-ওকে ঠিক আছে।আর করব না।ও অর্ণবকে একটা রিকোয়েস্ট পাঠালাম।
-খুব ভাল কাজ করেছ।ওর মত ছেলে ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা ভাগ্যের ব্যাপার।
চন্দ্রা কিছুটা রেগে লিখে পাঠাল-এর মানে কি?
-ভাল ছেলেকে তো ভাল বলতেই হবে।আমার দেখা খুব ভাল ছেলেদের ও একজন।
-ভালতো, ভাল না?আপনি আপনার বন্ধুর প্রশংসা করবেন,আপনার বন্ধু আপনার প্রশংসা করবে,খুব ভাল।
এই লিখে চন্দ্রা ফেসবুক হতে লগ আউট করে।ঘটনা কেমন কেমন প্যাচ প্যাচ লাগছে।সমুদ্রকে দাদা বলতে চাইলে সহজেই রাজি হয়ে গেল,অথচ অর্ণব দাদা শুনতে কিছুতেই রাজি নয়।এর মানে কি?অর্ণব কি তাকে পছন্দ করে?না,কিছুতেই কিছু মাথায় ঢুকছে না।বিছানায় শুয়ে পড়ে।মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে।মনে মনে যে কল দিয়েছে,প্রথমে তাকে বকা দেয়।এরপর মোবাইলটা হাতে নেয়।মোহিত কল দিয়েছে।এসময়ে গাধাটা কেন আবার কল দিয়েছে?গাধাটা দেখি বেশ জ্বালাতন শুরু করেছে।কল ধরল না।গাধাটা আবার কল দিয়েছে।
-মোহিত বল?
-কি রে,ভাল আছিস?
-হু ভাল,তোর কি খবর?
-এইতো চলছে কোনরকম।এখন তুই ঘুমাচ্ছিলি?
চন্দ্রা কিছুটা আশ্চর্য হয়ে বলল-তুই কিভাবে বুঝলি?
কথার মধ্যে ঘুম ঘুম ভাব ছিল।তাই বলে দিয়েছে।গডকে মনে মনে থ্যাংক দিল।
-এইটুকু না,আরও অনেক কিছু জানি।
-যেমন।
-তোর প্রিয় খেলা ক্রিকেট।প্রিয় টিম ইন্ডিয়া।ফুটবল খুব একটা পছন্দ করিস না,তবে ব্রাজিল সাপোর্ট করিস।আর ক্লাবের মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদ।ইন্ডিয়ান বাংলা সিনেমা বিশেষ করে দেবের সিনেমা খুব পছন্দ।
এতক্ষণ চন্দ্রা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল।ছেলেটা এসব কিভাবে বলছে?এসব তথ্যতো সে ফেসবুকেও দেয় নাই।মুচকি হেসে বলল-তুইতো দেখি অ্যাস্টলজার হয়ে গেছিস?আর কিছু বলতো,শুনি।
-প্রচুর পড়াশুনা করতি,এখনকার কথা বলছি না,ইন্টার লাইফ পর্যন্ত।সময়ের প্রতি খুব যত্নশীল,অবশ্য ভার্সিটি লাইফে এসে কেয়ার কিছুটা কমে গেছে।ডান হাতে ঘড়ি পড়তে ভালবাসিস,আর হাতে মাঝে মাঝে মেহেদী লাগাতে বেশ লাগে।প্রিয় রং গোলাপী,ফুল গোলাপ।আর অনুষ্ঠানে শাড়ি পড়তে তোর খুব ভাল লাগে।
চন্দ্রা পুরোপুরি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল।এসব কিছু কিভাবে বলা সম্ভব?সব একেবারে মিলে গেছে।–তোকেতো আমার হাত দেখাতে হবে,ভাগ্যে কি আছে শুনতে হবে?
-আরে হাত দেখাতে হবে না,পছন্দের মানুষ বলে কথা।এমনেতেই সবকিছু বলে দিতে পারব।
-যেমন।
-বর্তমানে তুই বেশ ঝামেলায় আছিস।অস্থিরতা ভাব প্রকট।
চন্দ্রা আবার মুগ্ধ হল।এসব কথাতো কোনভাবেই জানার কথা না।সে যে ভূত ভবিষ্যত বলতে পারবে,এতে কোন সন্দেহ নেই।–বাহ,তুইতো দেখি সব একেবারে গড়গড় করে বলে দিচ্ছিস।
-সামনে রিলেশন হওয়ার ঘোর সম্ভাবনা আছে।যে ছেলেটার সাথে রিলেশন হবে তার নামে ম,হ,ত এই তিনটি বর্ণ থাকবে।
চন্দ্রা প্রথমে সমুদ্র নামটা নিয়ে ভাবে।শুধু ম থাকায় বুঝতে পারল,সমুদ্রের সাথে তার প্রেম হচ্ছে না।এরপর যে নামটা মনে উদিত হল,তা হচ্ছে অর্ণব।এর সাথেতো দেখা যাচ্ছে কিছুই মিলছে না।এর সাথেতো তাহলে একেবারেই সম্ভব নয়।এর মানে এই দুইজন একেবারেই বাদ।
-কি রে কি হল?
-না,কিছু না।ভাবছিলাম এই তিন বর্ণ দিয়ে পরিচিত কেউ আছে কিনা?
-ভাল করে ভেবে দেখ।
-ভাল করেই তো ভেবে দেখলাম।কাউকে তো খুজে পেলাম না।তুই একটু ভেবে দেখতো?
মোহিত ভাবতে থাকে।তার নামেই যে এই তিনটা বর্ণ আছে,তা কেনো মেয়েটার মাথায় আসছে না।
বেশ কয়েকদিন পর।চন্দ্রাকে আকাশ কল দিয়েছে।
-হু অর্ণব,কেমন আছ?
-ভাল,এইতো তুমি?
-বেশ ভাল আছি।আমার প্রোফাইলে যে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে,সেটা দেখেছেন।
-কই নাতো?
-ভাল করে দেখ।
-কি হয়েছে বলতো?
চন্দ্রা মুচকি হেসে বলে-এখন আর আমি সিঙ্গেল নয়,ডাবল।
-গুড।
-ধারণা কর তো কে?
-মোহিত।
-কিভাবে বুঝলে?
-কিছু কিছু জিনিস আছে যা বুঝতে হয়।
মনে মনে বলল,বেছেড়া সমুদ্রের ভাগ্য পুড়ল।
-ছেলেটা অনেক ভাল।
-তুমি ভালবাস,সে ছেলে ভাল না হয়ে পারে।আজ রাখি।পরে কথা হবে।
-আচ্ছা ওকে।
আকাশ কল কেটে দেয়।সমুদ্রকে কল দেয়।
-একটা ব্যাড নিউজ আছে।
-বল।
আকাশের মুখ আটকে যায়।
-কি রে,এমন চুপ করে আছিস কেন?
-তুই চন্দ্রার পেছনে ঘুরা ছেড়ে দে।
সমুদ্র গম্ভীর হয়ে বলে-চন্দ্রা তোকে কিছু বলেছে?
-না,কিছু বলেনি।
-তাহলে?
-ওর রিলেশন হয়ে গেছে এক ছেলের সাথে।
-আরে এই ব্যাপার,ভাল খবর তো।যাক মেয়েটার একটা সুগতি হয়েছে।
খুব সহজেই কথাটা বলে ফেলল।কিন্তু তখনি বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠল।
-আচ্ছা রাখি।
-ভাল থাকিস।
সপ্তাহখানেক কেটে গেল।সমুদ্রের কিছুতেই কিছু মন বসছে না।ফাইনাল পরীক্ষা সামনে।পড়াশুনা কিছু হচ্ছে না।থিসিসের এক গাদা কাজ বাকি।ম্যাডাম ডেকে একদিন বেশ ঝাড়ি দিয়েছে।তবুও যাচ্ছে না।যেতে ইচ্ছে করে না।সবসময় মনে হয়,জীবন হতে কী যেন বোধহয় চলে গেছে।চন্দ্রাকে লিখলেও ঠিকমত উত্তর দেয় না।ম্যাসেজ পাঠায় এখন,অনলাইনে থাকলেও উত্তর দেয় পরের দিন।ফেসবুকে ঢুকে।চন্দ্রা অনলাইনে নাই।এখন আর আগের মত পাওয়া যায় না।ম্যাসেজ করে-বেশ কয়েকদিন ধরে তোমার চিন্তায় মাথা সবসময় ঘুরপাক খাচ্ছে।তবু কেন জানি মনে হয়,বিয়ে আমার তোমার সাথেই হবে।এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।এর পিছনে কোন লজিক নেই।এমন দৃঢ় বিশ্বাস কিভাবে মনের ভিতর বাসা বাধল,সে আমি জানি নে।খুজতে খুজতে সেদিন কুষ্টিটা হাতে পড়ল।আমার বিয়ে নিয়ে একটি ভবিষ্যৎ বাণী আছে।যে মেয়ের সাথে বিয়ে হবে তার নামের মধ্যে চ,ন,দ থাকবে।তোমার নামের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে।তাতে বিশ্বাস আরও সুদৃঢ় হল।গত রাত্রে একটা স্বপ্ন দেখলাম।আমি আর তুমি বসে আছি।মাঝখানে আমাদের মেয়ে তটিনী বসে।দুইজনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি মেয়ের দিকে।তবে কীসের জন্য অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি,তা বুঝার আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেল।
আকাশকে অনলাইনে দেখা যাচ্ছে।
-কি রে কি করিস?
-এইতো মুভি দেখতেছিলাম।তুই কি করিস?
-এইতো বসে আছি।একটা ভাল খবর আছে।
-চন্দ্রার সাথে আমার বিয়ে হবে।
আকাশ বিরক্ত হয়ে বলল-ফাযলামি ছাড়বি?
-বিশ্বাস না হলে কিছু করার নেই।বিয়ে যে হবে এটা ঠিক।আজ থেকে চন্দ্রাকে বউদি বলে ডাকবি।
আকাশের মনে বেশ আশার সঞ্চার হল।কিছু একটা ঘটনা হয়তো ঘটেছে।–আচ্ছা ডাকব।দাড়া এখনি কল দিচ্ছি।
সমুদ্রকে কিছু লেখার সুযোগ না দিয়েই চন্দ্রাকে কল দেয় –অর্ণব বল।
-বউদি ভাল আছেন।
চন্দ্রা প্রথমে কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।–মানে কি?
– সমুদ্র বউদি বলতে বলল।
-সমুদ্র বউদি বলতে বলল,আর তুমি বউদি বলা শুরু করলে?তোমাদের বন্ধুদের মাথা কি দুইজনের একসাথে আউট হয়েছে?তোমার বন্ধু শুনবে কি ম্যাসেজ পাঠিয়েছে?এমন বাজে ম্যাসেজ,দেখলেই ঘৃণা লাগে।বলাতো পরের ব্যাপার।
রাগে আকাশ কল কেটে দিল।সাথে সাথেই সমুদ্রকে কল দেয়।
-হু বল।
-তুই কি মানুষ,না অন্যকিছু?
-কেন,কি হয়েছে?
-কি আর হবে,যে কান্ডখানা করেছ তার ফল পেলাম।
-চন্দ্রা কিছু বলেছে?
-না কি বলবে,কানের ভিতর যেন মধু ঢেলে দিয়েছে ।
সমুদ্র অতি শান্ত কন্ঠে বলল-ও নিয়ে ভাই তুমি রাগ করো না।বন্ধু হয়ে কত ক্ষমাই তো আমায় করেছ,প্লীজ এবারও কর।জানতো,প্রচন্ড বৃষ্টি হওয়ার আগে আকাশ ঘনকালো আধারে ভরে যায়।তাই বলে কি আকাশ আর কখনই দেখা যাবে না,তা ভাবলে হয় ভাই।
আকাশ এমন কথা শুনে অবাক হয়ে বলল।কখনো তো সমুদ্রকে এমনভাবে কথা বলতে শুনেনি।মৃদু কন্ঠে বলল-ভাই অতকথা আমি বুঝি নে।আমি তোমাকে আরও একজনের সাথে কথা বলিয়ে দিচ্ছি।চন্দ্রার থেকে অনেক বেশি সুন্দর,আর অনেক বেশি ভাল।
-ভাই যাকে বউ হিসেবে মন থেকে মেনে নিয়েছি,অন্য মেয়েকে সে জায়গা দিয়ে দিব,সে আমি পারব না।সে আর হয় না।
-তুই কেন বুঝতে চাচ্ছিস না,মেয়েটার অন্য ছেলের সাথে রিলেশন হয়ে গেছে।
-হয়ে গেছে,তো কি?এখনকার যুগের রিলেশন,ভাঙ্গতে কয়দিন?চন্দ্রা আপনা আপনিই তখন নিজের ভুল বুঝতে পারবে?
আকাশ মনে মনে বলে,তাই যেন হয়।কিন্তু মুখে কিছু বলে না।সমুদ্র বলতে থাকে-জানেতো,আগে গডে খুব একটা বিশ্বাস করতাম না।মনে হত,চেষ্টা করলেই বুঝি সব পাওয়া যায়।চন্দ্রার রিলেশন হওয়ার পর বুঝতে পারলাম,শুধু চেষ্টা দিয়ে সবকিছু পাওয়া যায় না।চেষ্টা দিয়ে হয়তো অনেক কিছুই পাওয়া সম্ভব,তবে সব নয়।তাই বিশ্বাসে মিলায় বস্তু,তর্ক্কে বহুদূর কথাটার উপর খুব আস্থা।জানেতো,গডের কাছে কোন কিছু মন থেকে চাইলে,গড সে জিনিস দিয়ে দেন-সেই ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি।গডের কাছে মন থেকে চন্দ্রাকে চেয়েছি,চন্দ্রা আমার হবেই।
আকাশের মনটা কেমন করে যেন উঠে।কি জন্যই যে মেয়েটার সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছিল,নিজের উপরই বড় রাগ হচ্ছে।যে ছেলেটা মেয়েটাকে এত ভালবাসল,মেয়েটা বুঝতেই পারল না,এর চেয়ে অভাগা মেয়ে আর কে হতে পারে পৃথিবীতে?
-একটা কিছু চাইব আকাশ,জীবনে তো অনেক কিছুই দিয়েছিস,এটাও না হয় বন্ধু হিসেবে দিলি।
-কি?
-চন্দ্রার নাম্বারটা দে। মেয়েটার সাথে বেশ কথা বলতে ইচ্ছে করে।
-আচ্ছা নে।
এই বলে চন্দ্রার নাম্বারটা বলে।
বিশ পঁচিশ দিন পর।সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেছে।দশটার সময় ফাইনাল পরীক্ষা।সাড়ে দশটা বাজল,তবু রুম হতে বের হল না।বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।বারান্দা হতে রুমে এসে আয়না দিয়ে মুখ দেখে।নিজের মুখ দেখে নিজেই চমকে উঠে।মুখে দাড়ি ভর্তি।মুখটা একেবারে মলিন।হাসির ছিটেফাটা নেই মুখে।চন্দ্রার নাম্বারে কল দেয়।কল ঢুকে না।কয়েকদিন কল দিয়েছিল,বোধহয় বিরক্ত হয়ে নতুন সিম চালু করেছে।ফেসবুকে ব্লক মেরে দিয়েছে,অর্ণবকেও।মেয়েটার সাথে যোগাযোগের কোন পথই রইল না।একটা মেয়ে কিভাবে এত নিষ্ঠুর হয়,মাথায় ঢুকে না।
বছর ছয়েক পর।অর্ণব গেছে আমেরিকাতে।পি,এইচ,ডি শেষ।কাল দেশে ব্যাক করবে।সমুদ্রকে কল দিয়েছে।
-এতদিন পরে তাহলে মনে পড়ল।
-না রে দোস্ত,তোর কথা সবসময়ই মনে পড়ে।কিন্তু তোর নাম্বারটা হারিয়ে ফেলেছি।আজকে একজনের কাছে পেলাম।ফেসবুকে কত যে তোকে নক করেছি,তার হিসেব নেই।
-ফেসবুক আছে!বসি না কয়েক বছর ধরে।বলেছিলাম না চন্দ্রার সাথে আমার বিয়ে হবেই।
আকাশ অবাক হয়ে বলল-চন্দ্রার সাথে বিয়ে হয়েছে?
-তুইতো দেখি আগের মতই আছিস,কোন কিছুই সহজে বিশ্বাস করতে চাস না।জানিস একটা মেয়ে হয়েছে।দেখতে একেবারে পরীর মত।স্বভাব আচরণে ঠিক চন্দ্রার মত হয়েছে।
-নাম কি তোর মেয়ের?
-তটিনী।অবশ্য আমি রাখিনি।চন্দ্রা রেখেছে।রোজ ঝগড়া হচ্ছে তোর বউদির সাথে।
-কেন,কি হয়েছে?
-বলেছি,আমিতো চাকরি করছি।তুমি আর চাকরি করে কি করবে?দুইজনে চাকরি করে মেয়েটার বড় অযত্ন হচ্ছে।তুই বল,অন্যের হাতে মেয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যায়?
-এতো কোনভাবেই ঠিক না।
-কে বুঝাবে ওকে বল?
-চিন্তা করিস না,আমি কাল দেশে আসছি।বউদিকে এমনভাবে বুঝাব যে,চাকরি করার নাম মুখে আনবে না।
-তোর কথায় বড় ভরসা পাই ভাই।তোর কথাও না শুনলে আমিই চাকরি ছেড়ে দিব।চাকরির থেকে মেয়ে আমার কাছে অনেক বড়।
-ঠিক বলেছিস।
-তুই কিন্তু এসেই আমার বাসায় আসবি।আর কালতো আমার মেয়ের জন্মদিন।
-ও গ্রেড নিউজ।অবশ্যই কালকেই তোর বাসায় আসব।
-আর শুন।তোর জন্য চন্দ্রা একটা মেয়ে ঠিক করে রেখেছে।আমিও মেয়েটার ছবি দেখেছি।বেশ ভাল।চন্দ্রা বলে-খুবই চমৎকার মেয়ে।তাই বলে মনে করে না,তোর বউদির থেকেও।তোর বউদি হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার মেয়ে।
আকাশ হেসে বলে-সে আমি জানি ভাই।তোমার মত এমন রাজকপাল নিয়েতো সবাই জন্মায় না।
-ঠিক বলেছিস।
-এই তোর বউদির সাথে কথা বল।
এই বলে চন্দ্রাকে মোবাইল দেয়।–হ্যালো বউদি?
লাইনটা ঝি ঝি করছে।মাঝে মাঝে এত ঝামেলা করে?কিচ্ছু বুঝা যাচ্ছে না।
চন্দ্রা সমুদ্রের কাছে মোবাইলটা দেয়।–আকাশ শুনতে পাচ্ছিস?
-হু।লাইনটা বেশ ঝামেলা করছে।
-তটিনী তোর সাথে কথা বলবে।
আকাশ ওপাশ হতে বলে-হ্যালো মা।
আবার লাইনটা ঝি ঝি করে।আকাশ বেশ বিরক্ত হয়।তটিনী বাবার কাছে মোবাইলটা দেয়।–হু আকাশ শুনতে পাচ্ছিস?
-হু,লাইনটা বেশ ঝামেলা করছে রে।
-হু,কি আর করার,কালকে এসেই সরাসরি কথা বলিস।
-বিধি বাম,কি আর করার?আচ্ছা রাখি।কালকে এসে এতগুলো বছরের সব জমানো কথা শুনব।বিশেষ করে তোর বিয়ের কাহিনী।
-ওকে।
এই বলে সমুদ্র কল কেটে দেয়।তার খুব আনন্দ লাগছে।কতদিন ধরে বন্ধুকে দেখে না?
পরদিন বিকেলবেলা।দরজা নক হতেই সমুদ্র দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে।আকাশ সাহেবি পোশাকে দাড়িয়ে আছে।একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।
-নমস্কার আন্টি,ভাল আছেন?
-আছি বাবা,তুমি ভালতো?
-হু।বউদি,তটিনী ওরা কই?
-আছে বাবা।পাশের ঘরে।
সমুদ্র ডাকল-চন্দ্রা,তটিনী তোরা কই?দেখে যা কে এসেছে?
টেবিলের উপর কেক রাখা হয়েছে।আকাশ দেখে বলল-কেক এত আগেই সাজিয়ে রেখেছিস কেন?কেক তো রাত্রে কাটবে।
-তোর বউদির কান্ড।সকাল হতে কেক সাজিয়ে বসে আছে।বলে,তুই আসার সাথে সাথেই কেক কাটা হবে।অথচ কান্ড দেখ,তুই এসেছিস,তোর বউদীর দেখা নেই।মা,ডাক দাও তো?
সমুদ্রের মা পাশের রুমে যায়।সমুদ্র হেসে বলে-তটিনীকে বোধহয় সাজাচ্ছে।
-কি রে,তোর বউদি তোর সামনে দাড়িয়ে?দেখ,কেমনভাবে হাসছে।
আকাশ কাউকে দেখতে পেল না।–কি রে আমেরিকা থেকে কি চোখ নষ্ট করে ফেলেছিস?
আকাশ দুই হাত দিয়ে চোখ মুছে।বড় বড় করে তাকায়।বুঝতে পারছে না,চোখে কি তার সত্যিই সমস্যা?
-তটিনী,এই তোমার কাকা।অনেক রাত ভরে যার গল্প করলাম।
আকাশ তটিনীকেও দেখতে পেল না।চোখে বুঝি মারাত্নক ধরণের সমস্যা হল।
-কি রে,তটিনীকেও দেখতে পাচ্ছিস না।
আকাশ হতভম্ব গলায় বলল-না।
-সত্যিই সত্যিই তো চোখের বারটা বাজিয়েছিস।মা দেখতো কান্ড,জ্বলজ্যন্ত দুইজন মানুষ দেখতে পাচ্ছে না।বুঝেছি দুই একদিনের মধ্যেই চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।এই হাততালি দে,তটিনী কেক কাটছে।
সবাই হাততালি দিয়ে বলল-হ্যাপি বার্থ ডে ডেয়ার তটিনী।
সমুদ্র বিছানা হতে উঠে বলল–মা আমি বাইরে থেকে একটু আসছি।এই পাঁচ মিনিট।কোক নিয়ে আসি।আকাশ আবার কোক খুব পছন্দ করে।
সমুদ্র বাইরে যেতেই আকাশের হাত ধরে সমুদ্রের মা কান্নাকাটি শুরু করে।বলে-বাবা,আমার ছেলেটার বাবা কি হল?ভার্সিটিতে একেবারে ভাল ছেলে পাঠালাম।ছেলে এল এই হয়ে।আগের জন্মে কত যে পাপ করেছিলাম বাবা?
-আন্টি শান্ত হন।
সমুদ্রের মা কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে-যতটুকু জেনেছি,চন্দ্রা নামের একটি মেয়েকে ও খুব ভালবাসত।মেয়েটার বিয়ের দিন থেকেই সমস্যা শুরু।কয়েকদিন সেন্সলেস ছিল।সেন্স ফিরার পর শুধু বারবার বলত-মা,চন্দ্রাকে ডাক দাও।একসময় মেয়েটাকে না পেয়ে সবকিছু ভাংচুর শুরু করে।বেশ অনেকদিন শিকল দিয়ে বেধে রাখতে হয়েছে।ডাক্তার অনেক দেখিয়েছি বাবা।এখন কিছুটা ভালর পথে।এইরকম ভাল থাকলেও হত।
আকাশ অপরাধবোধে ভূগে।রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে।তার কাছে জীবনের হিসাব বড় গন্ডগোল লাগছে।
তিন চারদিন পর।আকাশ শপিংমলে ঢুকছে।পেছন হতে কে যেন ডাকছে?কন্ঠটা বেশ চেনা চেনা লাগছে।পেছনে তাকিয়ে দেখে।
-আমি চন্দ্রা।
ভাল করে দেখে।মেয়েটা বেশ মোটা হয়ে গেছে।যৌবনের সৌন্দর্য গেছে কমে।
-ভাল আছেন দাদা।
-এইতো আছি বেশ।তুমি?
-বেশ ভাল।
-মোহিত কই?
-ও মাসখানেকের জন্য লন্ডন গেছে।
-ও।
-সমুদ্র দা কেমন আছে?
আকাশ মুচকি হেসে বলে-খুব সুখে আছে।স্ত্রী চন্দ্রা।
-কি?
-বউয়ের নাম চন্দ্রা।
-ও।
-ঠিক তোমার মত দেখতে।এত মিল যে দেখলে অবাক হয়ে যাবে।একটি খুব সুন্দর মেয়েও আছে।নাম তটিনী।
-দাদাতো তাহলে খুব সুখে শান্তিতে আছে।সংসারটা দেখতে বেশ ইচ্ছে করছে।
-এমন সুখে পৃথিবীতে আর কেউ নেই। দেখবে?চল।
-বউদি আবার কি মনে করে?
-কিছু মনে করবে না।সে খুব ভাল মেয়ে।
রিকসায় উঠে।চন্দ্রার দেরি সইছে না।রিকসাওয়ালাকে বলছে-মামা,একটু জোরে চালান।
রিকসা হতে নেমেই একটি গলির ভিতর ঢুকে।একটি বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়।আকাশ নক করে।কেউ আসছে না।কেউ আসছে না কেন?চন্দ্রার সমুদ্র দার
সংসার দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।খুব খুব।