জীবন নদীর স্রোত
মানুষের জীবন বুঝি এক বহতা নদীর মতনই । যেভাবে যেকোন অবস্হায় আপন লক্ষ্যপানে ছুটে চলাই যার একমাত্র ধর্ম ।
” সবুজ বাংলা ” সরকারী প্রাথমিক উচ্চ বিদ্যালয় !
চারতলা ভবন বিশিষ্ট বিদ্যালয়টিকে কদিন আগেই মাত্র বন্যার্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে ! আর সেই ঘোষণার পর বলতে গেলে প্রথমদিনই বিদ্যালয়ের প্রতিটা কক্ষ তো বটেই এমনকি টানা বারান্দাসহ সিঁড়ির ধাপগুলো অবধি দখল হয়ে গেছে বানভাসী মানুষের ভীড়ে ! যে যেখানে পেরেছে পরিবার পরিজন নিয়ে খুঁজে নিয়েছে মাথার উপর একটুখানি ছাউনি । বউ – ছেলেপুলেসহ অন্যান্য স্বজনদের সঙ্গে এমনকি অনেকে তাদের বেঁচে থাকার সম্বল গৃহপালিত জীবজন্তুগুলোকে অবধি নিয়ে চলে এসেছে আশ্রয়কেন্দ্রে । যদিও ঐসব হাঁস , মুরগী আর পশুদের ঠাঁই হয়েছে বিদ্যালয়ের বড়ো মাঠে । ফলে ঐসবের মালিকপক্ষের কাউকে না কাউকেও প্রতিদিন পাহারাদার হিসেবে রাত্রি যাপণ করতে হচ্ছে খোলা আকাশের নীচে !
তারপরও দেখা গেল , খুউব অল্প সময়ের মধ্যেই আদমসন্তানগুলো কি সুন্দর গুছিয়ে নিয়েছে এই পরিবর্তিত প্রতিকুল পরিবেশ আর পরিস্হতির সাথে ! আর জীবনও চলতে শুরু করেছে তার স্বীয় গতিতে । আসলে নিত্য সংগ্রামরত এই দরিদ্র লড়াকু মানুষগুলোর জীবনচাকা পুরোপুরি থামানোর মতন সাধ্য যে প্রকৃতিরও নেই !
কেমন চলছে এখানকার মানুষগুলোর বর্তমান জীবন ? আসুন দেখার জন্য আমরা ঘুরে আসি তিনতলার ৩০৪ নম্বর কামরাটা । এই কামরাটাই হোক একদল সাহসী মানুষের যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি ।
********************
কালামের বৌয়ের সন্তান হবে । মাত্র বছর দেড়েক হলো কালাম বিয়ে করেছে অষ্টাদশী জমিলাকে । বলিষ্ঠ যুবক কালাম রিক্সা চালায় । টানাটানির সংসারে আর যাই হোক দুজনার মধ্যে ভালবাসার কোন অভাব নেই ! ওরা জীবন দিয়ে ভালবাসে একজন আরেকজনকে ।
সেই কালাম আর জমিলার পৃথিবী আলো করে আসছে সন্তান । তাদের ভালবাসার প্রথম ফসল । মনে আছে , যে রাতে জমিলা ভীষণ লাজুক মুখে তার কানেকানে জানিয়েছিল সুখবরটি কয়েক মুহুর্তের জন্য আনন্দের অতিশয্যে সমস্ত শরীর বুঝি অবশ হয়ে গিয়েছিল কালামের । হবে না কেন ? সেই ছেলেবেলায় বাপ মা হারানো এতিম কালামের জমিলা ছাড়া এতোদিন তো আপন বলতে আর কেউ ছিল না ! সেই কালামই কিনা বাপ হতে চলেছে !
উফ , কি যে সুখ । সেই থেকে শুরু স্বপ্ন পূরনের সেই দিনটির জন্য দুজনার অধীর অপেক্ষা আর প্রস্তুতি । দেখতে দেখতে কেটেও গেলো সময়টা কেমন করে । অনেকটা যেন ঘোরের মধ্যেই । এমনকি দুজনে মিলে অনাগত সন্তানদের নামও ঠিক করে রেখেছে ! ছেলে হলে নাম রাখবে জমিলার সাথে মিল রেখে জামিল ! এটা কালামের পছনশদ করা নাম ! আর জমিলা ঠিক কে রেখেছে মেয়ে হলে স্বামীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে কলি ।
এইতো মাত্র কয়েকদিন আগেই নিজের হাতে বস্তির ভাড়া করা ভাঙগাচুড়া ঘরটাই যথাসম্ভব ঠিকঠাক করে নিয়েছে কালাম । হাজার হলেও তাদের প্রথম সন্তান ! একেবারে ভাঙ্গা ঘরে তো আর সে জন্মাতে পারে না ।
কিন্তু তাদের সব স্বপ্নকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে ধেয়ে এল সর্বনাশা বন্যা ! একরাত্রের মধ্যে বানের জল ভাসিয়ে নিল ঐ বস্তির সমস্ত ঘরবাড়ী । আর দিশেহারা কালামও অন্য সকলের মতন ভরা পোয়াতী বউটাকে নিয়ে আসতে বাধ্য হলো এই আশ্রয়কেন্দ্রে !
তাদের সাথে একই ঘরে এসে উঠেছে মজিবর মিঞা তার পরিবারসমেত । যারা এই মুহুর্তে ভীষণ বিপদের মধ্যে আছে তার পক্ষাঘাতগ্রস্হ বৃদ্ধ পিতা জোবেদ মিঞাকে নিয়ে । অনেকদিন ধরে অসুস্হ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা জোবেদ মিঞার অবস্হা দিনদিন ক্রমশ খারাপ হতে চলেছে এখানে আসার পর থেকে । আসলে চারপাশের ভীড় , হট্টগোল , মলমুত্রের গন্ধ , পরিচর্চার অভাব ইত্যাদি সব মিলিয়ে বৃদ্ধর জীবনীশক্তি বুঝি ক্রমশ নিঃশেষ হতে চলেছে । এই মুহুর্তে তার সমস্ত পরিবার ভীষণ উদ্বিগ্ন মুখে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে বৃদ্ধ অসুস্হ মানুষটাকে ।
এই কক্ষেই আরো আশ্রয় নিয়েছে রহমত আলি তার বউ আর পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে । যাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়টির বয়স সতের আঠার হবে । নাম মোমেনা । এই মোমেনাকে ঘিরেই আচমকা পুরো আশ্রয়কেন্দ্র সৃষ্টি হয়েছে দারুন এক নাটকের । গতকাল রাত্রে মোমেনা আর বশির নামের এইখানকারই অন্য একটি ঘরের আশ্রিত এক যুবককে অন্তরঙ্গ অবস্হায় হাতেনাতে ধরা হয়েছে স্কুলের সিড়িঘরের অন্ধকার কোন থেকে । তৎক্ষনাত প্রেমিকযুগলকে মুখোমুখি করা হয় মুরুব্বীদের সামনে । এখানকার অস্হায়ী সেই সমাজপতিরা দ্রুতই একমত হয়ে জানিয়ে দিয়েছে নিজেদের রায় । সাব্যস্ত হয়েছে পরদিন বাদ এশা দুজনের বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হবে । বর- কনে আর তাদের পরিবার খুশিমনেই মেনে নিয়েছে এই আকস্মিক বিয়ের সিদ্ধান্ত ।
এখন চলছে সেই বিয়েরই চূড়ান্ত প্রস্তুতি ।
২ .
ইতোমধ্যে মোমেনাকে যথাসম্ভব সাজিয়ে তোলা হয়েছে কনের সাজে । নিজেদের সাথে এখানকার সকলের খুশীমনে দেয়া উপহার স্বরুপ টাকায় কেনা হয়েছে বরকনের জন্য সস্তার শাড়ী পানজাবীসহ আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র । এই মুহুর্তে সেই লাল শাড়ীর লম্বা ঘোমটা মাথায় টেনে আলতা মেহেদি রাঙ্গানো মোমেনা বসে আছে উৎসাহী মহিলাদের ভীড়ের মাঝখানে ভীষণ লাজুক ভঙ্গিতে । পাশের অন্য আরেকটি ঘরে নতুন পান্জাবী আর মাথায় টুপি পরে তৈরী হয়ে বসে আছে বর বশিরও । এখানকার উৎসাহী যুবকদের কজন গেছে পাশের কোন মসজিদ থেকে একজন মৌলভী সাহেবকে খুঁজে আনতে । ওরা আসলেই অপেক্ষমান বাদবাকী তরুন যুবারা নিজেদের হেফাজতে থাকা বরকে নিয়ে পাশের কামরায় যাবে বিয়ে পড়ানোর জন্য ।
এদিকে ঐ দুপুরের পর থেকেই ব্যাথা অনুভব করছিল জমিলা । সন্ধার দিকে সেটা অসহ্য হয়ে ওঠায় কালামকে ডেকে আনতে হয়েছে এখানকার কয়েকজন বয়স্কা মহিলাতে । অভিঞ্জ মহিলারা জমিলাকে এক নজর পরীক্ষা করেই বুঝে নিয়েছে এটা চূড়ান্ত প্রসব ব্যাথা । দ্রুত সেই অনুযায়ী ব্যাবস্হাও নেয়া হয়েছে যথাসম্ভব । স্হান অকুলান হওয়ায় ঐ কামরারই এককোনে চারপাশ কাপড় দিয়ে ঘিরে তৈরী করা হয়েছে আঁতুড় ঘর ।
জোবেদ মিঞারও বুঝি শেষ সময় আর খুব বেশি দেরী নেই । তার বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে । জ্ঞানও প্রায় নেই বললেই চলে । শ্বাস কষ্টও শুরু হয়ে গেছে । তার ঘোলা শূন্য দৃষ্টি মেলে তাকানোই বলে দিচ্ছে তিনি কাউকে চেনার বা বোঝার মতন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য অবস্হায় আছেন এই মুহুর্তে ।পরিবারের সদস্যরা চামচে করে একটু একটু করে পান করাবার চেষ্টা করছে শেষ পানিটুকুন ।
পরিশিষ্ট :
হটাৎ করেই বাইরে শুরু হয়েছে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি । এরমধ্যেই ওই ঘরটিতে ঘটে চলেছে মানবজীবনের তিনটি আবশ্যম্ভাবী অনিবার্য ঘটনা ।
মৌলভী সাহেবের বিয়ে পড়ানো প্রায় শেষের পথে ।
– … বাবাজী বলেন কবুল ।
-…. আম্মজান বলেন কবুল ।
– কবুল কইছে ! কইন্যা কবুল কইছে !
– পোলায়ও আমাগো কবুল কইছে !
– কি হুনছেননি হাজেরান মজলিশ হগ্গলতে আফনেরা ।
– হুনছি । হুনছি । হগ্গলে হুনছি ।
– আলহামদুলিল্লাহ ! আসেন এখন আমরা নতুন মিঞা বিবির জইন্য আল্ল্াহপাকের দরবারে হাত তুইলা মুনাজাত করি ! রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া …..
সকলে একসাথে দুই হাত তুলে ধরে আল্লাহতালার দরবারে !
ওঁয়া । ওঁয়া ।
মোনাজাত চলতে থাকা অবস্হাতেই সকলের কানে এসে পৌঁছায় নবজাতকের তীক্ষ্ন কানযনার আওয়াজ । মোনাজাত ধরা অবস্হাতে নিজের অজান্তেই আমুল কেঁপে ওঠে কালাম ।
– কালামের পোলা অইছে গো ! চান্দের লাহান টুকটুইকা পোলা ।
ঘরের কোন থেকে ভেসে আসা মহিলাদের সম্মিলিত উল্লাসভরা কন্ঠ কানে যেতেই মুনজাতের মধ্যেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে কালাম ।
লা ইলাহা ইল্লাললাহু মুহাম্মাদুর রাসুল আল্লাহ ( সঃ ) ।
মৌলভী সাহেব মোনাজাত শেষ করেন । সমাপ্ত হয়ে যায় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা !
মোনাজাত শেষ করতে করতেই সকলের কানে বাড়ি খেল আরো একটি আহাজারী !
– ওরে আল্লারে আমার বাপ আর নাইরে !
সবাই বুঝলো জোবেদ মিঞা নামের মানুষটা এইমাত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে !
ইন্নালিল্লাইহি ……… রাজিউন । ( শেষ)
*************** – ____ *************************