ছোটমামা
আট ভাই-বোনের মধ্যে মজনু মামা সবার ছোট। ছোট বলেই হোক, আর অত্যধিক
স্নেহ-ভালবাসার কারণেই হোক, তার মধ্যে সবাই কেন জানি নানান
প্রতিভা-সম্ভাবনার বিচছুরণ দেখতে পেলেন। সুতরাং অন্য ছেলে-মেয়েদের চেয়ে
ছোট মামা বড় কিছু হবেন-এমন আশা পোষণ করতেন পরিবারের সবাই। সব আশা সবাইকে
দিয়ে যদি সমান তালে পূরণ হতো তবে মামার কোনো দোষ ছিল না।
মামা বহু কষ্ট-সাধনা করে এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছেন তিনবার। ফেল
করেছেনও তিনবার। প্রতিবারই তিনি ভালভাবে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিতে
গিয়েছেন। যাওয়ার আগে যথারীতি ময়মুরুব্বীদের সেলাম-তোয়াজ করে পায়ের ধুলি
মাথায় মেখেছেন। পরীক্ষার খাতায় লিখেছেনও মেলা। অর্থাৎ পরীক্ষায় পাশ করার
জন্যে যা যা করার দরকার মামা তার সবই করেছেন। অন্ততঃ এদিক থেকে তিনি
পরিস্কার।
এবার মজনু মিঞার পরীক্ষা কেমন হলো, পাশ করবে তো? মামা
আত্নীয়-অনাত্নীয়দের এমন বহু অযাচিত ও বিব্রতকর প্রশ্নের জবাব দিতেন খুবই
স্বাভাবিকভাবে। এ ধরনের প্রশ্নের উত্তরদানে অভিজ্ঞ মামা বিচলিত হতেন না
কখনো। তবে চতুর্থবার পরীক্ষা দিয়ে তিনি আত্নবিশ্বাসের সাথে বলতেন, এবার
দেখা যাবে, পরীক্ষক বাছাধনেরা কীভাবে আমাকে ফেল করায়। প্রশ্ন সব কমোন।
ডান-বাও তাকাবার ফুরসত ছিল না। খাতা না হারালে আর শিক্ষা বোর্ডের
কম্পিউটার ভাইরাস আক্রান্ত না হলে জিপিএ ফাইভ এর নিচে আশা করি না।
যথাসময়ে পরীাক্ষার ফল বেরোলো।
ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবকেরা রুল নম্বর নিয়ে যখন উর্দ্ধশ্বাসে
ছোটাছুটি করছে, মামা তখনও ছিলেন শান্তশিষ্ট, নির্বিকার। বহু তত্ব-তালাশ
করে তালিকায় মামার রুল নম্বরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল না। এ অবস্থায়
সবাই যখন চিন্তায় অস্থির, মামা তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিজ্ঞের মত মাথা
নেড়ে বললেন, বুঝেছি ওই একই অবস্থা হয়েছে এবারও। খাতা-পত্তর দেখে উপযুক্ত
নাম্বার দিয়ে পাশ করানোর দায়িত্ব পালনকারী পরীক্ষকেরা কতটা একনিষ্ঠ ছিলেন
তা আমার বোঝা হয়ে গেছে। পরীক্ষকদের মনোবৃত্তি, সততা আর প্রদত্ত নম্বরের
কোনো অডিট হয় না বলে এরা থাকেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সুতরাং স্বেচছাচার হতে
কতক্ষণ। আমি যে কোন্ স্বেচছাচারীর নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছি তা কেবল
আল্লাই ভাল জানেন। তাঁর ওপরই ছেড়ে দিলাম এ মহারহস্যের কঠিন হিসেবটি। আমার
ওপর এ অবিচার প্রত্যক্ষ করে পরম করুণাময় আফসুস করে হয়তো বলছেন” হে মজনু,
কেউ জানুক আর না জানুক, আমি তো জানি তুমি ষোলো আনা কর্তব্য পালন করিয়াছ,
কিন্তু কেহই তোমার উপযুক্ত মূল্যায়ন করে নাই। হতাশ হইও না। কোন না কোন
ভাবে আমি তোমাকে এর তুল্য মূল্য দান করিব।” অতএব মামা বেশ আছেন।
মজনু মামা এখন নির্জলা, নিষ্ফলা, নিরঙ্কুশ বেকার। বেকার বলে তার কাজের
কোনো অভাব নেই। মামার ‘বেশ‘ থাকাটা শেষ পর্যন্ত বেশিদিন টেকেনি। কারো
কোনো প্রয়োজন হলেই ডাক পড়ে বেকার মজনু মামার। সারাদিনই কারো না কারো
ফুট-ফর্মাস খাটতে হয়। পরীক্ষায় ফেল করার পর মামার ওপর কাজের চাপ ও তাপ
অনেক বেড়ে গেছে। কারো আদেশ অনুরোধ উপেক্ষা করার সাহস করেন না মামা। তিনি
সবার, সব কাজের। তার সবখানে খাপ খেয়ে চলতে হয়। তার খাপ বাঁকা-ত্যাড়া হলে
চলে না; একদম সোঝা-সাপটা, নরম তুলতুলে হতে হয়।
চঞ্চল মজনু মামা বারবার পরীক্ষায় ফেল করে, চারপাশের ছোট বড় সবার
আদেশ-নিষেধ আর কটুকাটুব্যে কেমন জানি ভোঁতা হয়ে গেছেন। হালের বলদ কাদায়
পড়ে গেলে গিরস্থের লাঠির অব্যাহত ঘা গুঁতো খেয়েও যেমন নীরব থাকে, মজনু
মামার অবস্থাও হয়েছে তেমন। কারো কোনো কথার তিনি প্রতিবাদ করতে পারেন না;
রাগ-গোস্যা, মান-অভিমান,ক্ষোভ যন্ত্রণা ভেতরেই রাখেন; বাইরে প্রকাশ করেন
না। কাউকে বুঝতেও দেন না।
মজনু মামার বড় তিন ভাই চার বোন। ভাইয়ের পক্ষে ভাবী আর ভাস্তে-ভাস্তি
এবং বোনের পে দুলাভাই আর-ভাগ্নে ভাগ্নী। অতএব তার অসংখ্য মনিব। সবখানে
সবসময়ই ডাক পড়ে তার। আইয়রে-নাইয়রে, অসুখে-বিসুখে ইত্যাদি নানান কাজে
বেকার মামাটির মুখ দর্শন করা চাই। এদের ফুটফর্মাস আর ঝাল-ত্যাজ উপক্ষা
করার কোন কার্যকারণও মামার হাতে নেই। সুতরাং অর্ডার পাওয়ার সাথে সাথে অটো
মেশিনের মত রান করতে হয় মামাকে। মেশিন চালাতে তেল লাগে; মামাকে চালাতে
পানিও লাগে না। লাগামহীন ফুটফর্মাশ আর ধমক-ঠমকের ভারে মামার অবস্থা
ত্রাহিমধুসূদন।
নানা নানুর আশার গুড়ে বালি। যাকে নিয়ে এত আশা ভরসা, এত কল্পনা আর
গাল-গল্প, সে যে এভাবে ডোবাবে, এ কথা তাঁরা কোনোদিন কল্পনায়ও আনেন নি।
মামা ব্যর্থতা ও লাঞ্ছনার মূর্ত প্রতীকরুপে পরিবারের নিতান্ত অনাবশ্যক
ভার হয়ে কোনোমতে টিকে আছেন। ঘরে-বাইরে, চলনে-বলনে, খাওয়া-পরায়,
আচার-অনুষ্ঠানে, হাসি-তামাশায় মামা নিজেকে বেমানান ও অপ্রাসঙ্গিক বোধ
করতে লাগলেন। তার আবেগ-আব্দার, মান-অভিমানগুলো আগের মত সুবিচার পায় না।
মামা মনে প্রাণে প্রতিনিয়ত অনুভব করতে লাগলেন, পরীক্ষায় বারবার ফেল করে
বোধ হয় নিজের চেয়ে অন্যের তি করেছেন বেশি। অতএব বড় কোনো পরিবর্তন ছাড়া এর
থেকে নিষ্কৃতি নেই।
মামা বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলেন।
যা চাওয়ামাত্র পাওয়া যায়, তা না পাওয়ার কার্যকারণ খোঁজার প্রয়োজন পড়ে না।
এখন অলস মনিবেরা ডাক দিয়েই একান্ত অনুগত মাগনা কামলাটাকে সামনে পায় না।
সবার আঁতে এবং হাতে টান পড়ে গেল।
তারা বেকার ছেলেটির ব্যাপারে প্রথম তিন, ছয় ও শেষ অবধি দশদিন ছিলেন
উদাসীন। কারণ পরীক্ষায় যে তিনবার ফেল করে বেকারত্বের সাথে দাসত্বকে মেনে
নিয়েছে, তার জন্য অবশ্য এ সময় নেহাত কম না। বেচারি যাবে কোথায়; ফিরে না
এসে তার উপায় কি?
মামা ফিরে এলেন না। এই অথর্ব বেকার মামার প্রতি যার যতটুকু করুণা ও
দরদ ছিল তা দিয়ে এবং নানা নানুর পীড়াপীড়িতে মামা খালারা মোবাইল ফোনে সব
আত্নীয়, বন্ধূ-বান্ধব ও সম্ভাব্য জাগায় খোঁজাখুঁজি করলেন। না, কোথাও
মামার সন্ধান পাওয়া গেল না।
সবাই যার যার সংসার-ধর্র্ম নিয়ে ব্যস্ত। সবাই প্রায় ভুলে গেছে
মামাকে। নানা-নানু-ই কেবল এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেননি। সব
পিতা-মাতারই সবার ছোটর প্রতি বড় স্নেহ-ভালবাসা আর ভরসা থাকে বেশি। মামার
চিন্তায় নানু অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
মামা বহু জায়গায় ঘোরাফেরা করে এবং অনেক তত্ব-তালাশ ও গবেষণা করে
একটি বিষয় পরিস্কারভাবে অনুভব করতে পারলেন যে, বিদ্যা-বুদ্ধি ছাড়া
মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার কোনো বিকল্প পথ নেই। কষ্ট না থাকলে
চেতনা জাগতে চায় না। মামা মনে মনে একটা চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। তিনি নিজ
উদ্যোগে ও আয়োজনে লেখাপড়া শুরু করে দিলেন। অতঃপর মামা সফল হলেন।
এদিকে মজনু মামা জীবিত না মৃত এ আশঙ্কা বুকে বেধে নানুর বিলাপে ও
নানার প্রলাপে সবাই অস্থির। অগত্যা পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দেয়া হলো, ”মজনু,
তুমি যেখানেই থাকো না কেনো তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসো। তোমার চিন্তায় তোমার
মা বাবা শয্যাসায়ী।”
তিনদিন পর একটি চিঠি এলো বাড়িতে। মজনু মামার চিঠি। লিখেছেন-”শ্রদ্ধেয় মা
ও বাবা, আমি একটা চাকুরি করছি এবং ভাল আছি। চিন্তা করো না। আগামী
শুক্রবার বিকেলে বাড়ি আসব ইনশাআল্লাহ্। ইতি, মজনু।”
মুহূর্তের মধ্যে সংবাদটি সবখানে পৌঁছে গেল। “মামা চাকুরি করছেন এবং
ভলো আছেন!“ সংবাদটি পেয়ে আনন্দে টগবগ করতে লাগলাম। আমরা থাকি ঢাকায়।
শুক্রবারদিন দুপুরের আগেই আমরা সোজা চলে গেলাম নানার বাড়ি।
আত্নীয়-স্বজনেরা এসে গেছেন। বাড়ি ভর্তি মানুষ। আনন্দ আর ধরে না।
আমরা সমবয়সী সাত আটজন চট করে একটা বুদ্ধি আবিস্কার করে ফেল্লাম।
বাড়ির প্রবেশ পথে কলাগাছ দিয়ে একটা তোরণ নির্মাণ করে লাল ফিতা বেঁধে
দিলাম। আমার হাতে কাঁচি, কবিরের হাতে পিরিচ, নাজমার হাতে মালা ও ছোটো
খালামনির হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে মামার আগমন অপেক্ষায় ছটফট করতে লাগলাম।
আমাদের আশপাশে ছেলে-মেয়ে, বুড়া-বুড়িরা কৌতূহল নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে
আছেন। সবার মধ্যে উৎসব উৎসব ভাব।
ভট ভট, গুরগুর শব্দ ছড়িয়ে দ্রুত বেগে একটা বেবীটেক্সি গেটের সামনে
এসে থামল। মাঝারী সাইজের একটা ভারী ব্যাগ নিয়ে মজনু মামা নামলেন। বাড়ির
প্রবেশ পথে গেট আর উৎসব-আয়োজনের সমারোহ দেখে ভড়কে গেলেন মামা। গেটের
সামনে এসে লাল ফিতায় আটকে গেলেন তিনি। থতমত খেয়ে গলা বাড়িয়ে আস্তে করে
বললেন, ‘ঘটনা কিরে? তোরা আছিস কেমন? কথা বলছিস না যে!‘ আমরা পূর্ব
পরিকল্পনামত গেটপাশের আগে মুখে কুলুপ এঁটে নির্দয়ভাবে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে
রইলাম।
সবাই মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছি। মামা অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। হঠাৎ
মামার চোখ পড়ল গেটের লেখার ওপর। ”মজনু মামার আগমন, শুভেচছা-স্বাগতম।
গেটপাশ- বেকার হলে ফ্রি, চাকরিজীবী হলে মাত্র পাঁচ শ’ টাকা।” গেটের এ
লেখা পড়েই মামা শরীরটাকে একটা ঝাকুনি দিয়ে চটপট মানিব্যাগ থেকে পাঁচ শ’
টাকার একটা কড়কড়ে নোট বের করে আমার হাতে দিলেন। প্রচন্ড করতালিতে ফুলের
মালা-তোড়া আর হাসি দিয়ে মামাকে বরণ করে নিলাম। মজনু মামার আগমনে
নানা-নানুর প্রলাপ-বিলাপে ভারাক্রান্ত বাড়িটি মুহূর্তের মধ্যে আনন্দালোকে
চঞ্চল হয়ে উঠলো।