স্বপ্নচ্যূত
স্বপ্নচ্যূত
নুরুজ্জামান মাহ্দি
স্বপ্ন আমার মাঝে দানা বেঁধেছে নাকি আমি স্বপ্নের মাঝে ডুবে গেছি? প্রশ্নটা নিজেই নিজেকে করি। কোন সদুত্তর দিতে পারি না। কেননা আমি হঠাৎ করেই আবিষ্কার করি নিজেকে স্বপ্নের মাঝে হাবুডুবু খেতে। অসংখ্য স্বপ্নে আমি বুঁদ হয়ে থেকেছি মিনিটের পর মিনিট, ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন এমনকি মাসের পর মাস। বছরান্তেও সেইসব স্বপ্ন আমায় ছেড়ে যায় নি।
এত স্বপ্নের ভিড়ে কখন যে স্বপ্নচ্যুত হয়েছি বুঝতে পারি নি নতুন একটিকে আঁকড়ে ধরেছি বলে। অনেক পরে বুঝেছি যখন আর কোন স্বপ্নই আমার কাছে নেই। স্বপ্নচ্যুতি বারবার নাড়া দিয়ে যায় আমাকে। কখনও কষ্টের অনুভূতিগুলোকে জাগিয়ে তোলে, আবার কখনওবা রোমাঞ্চিত করে যাওয়া কোন স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যায় আমায়। প্রতিবারই চিনচিনে একটা কষ্ট ভিতরে গেঁড়ে বসে। তবে সুখানুভূতিগুলো জেগে ওঠে; যখন স্বপ্নের পথে সফল হওয়ার ছবিগুলো মনে ফোটে।
আমার শৈশব কাটে অতি দুরন্তপনায়, অজপাড়াগাঁয়ে। সমস্ত পাড়া মেতে থাকত আমার দুরন্তপনায়। এবাড়ি হতে ওবাড়ি চষে বেড়াতাম সারাক্ষণ। দল বেঁধে হৈ চৈ করে বেড়ানো ছিল নিত্যদিনের কাজ। মাঠময় ছুটে বেড়ানো আর বিভিন্ন খেলায় মেতে থাকতাম।
বউচি, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, দাঁড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট; এসব নিয়েই মেতে থাকতাম সারাবেলা। সাথে থাকত মাঠময় ছুটে বেড়ানো। যখন মাঠের মধ্যে ছুটে বেড়াতাম আমাদের সঙ্গ নিতে ছুটে আসত হাজারো রঙ-বেরঙের প্রজাপতি, ফড়িং, পাখি। ওরাও আমাদের সাথে সাথে ছুটতে থাকত। আমাদের ছোটার গতি যেত বেড়ে। মনে হত ওদের সাথে যেন আমরাও উড়ে চলেছি। এভাবেই কেটে যেত আমার সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা এমনকি রাত অবধি মেতে থাকতাম।
ঘরে ফেরার পর শান্ত সুবোধ বালক পড়তে বসে যেতাম। তার কারণ অবশ্য ছিল- মায়ের নিজের হাতে বানানো বাঁশের কঞ্চি খাওয়ার ভয়। আমাদের তিন ভাই বোনের মধ্যে আমার ভাগেই ছিল সবচেয়ে বেশি কঞ্চি। দুষ্টুমিটা একটু বেশি করতাম কিনা! আমার মা সযত্নে নিজের হাতে আমাকে কঞ্চি খাওয়াতেন। আর তার স্বাদ পরবর্তী কয়েকদিন লেগে থাকত। হ্যা, আমার এমন বেশি বেশি কঞ্চি খাওয়াই আমাকে সেই সময়টাতে সর্বোচ্চ সফলতা এনে দিয়েছিল। আমি স্কুলে কখনোই প্রথম স্থান হতে বিচ্যূত হই নি। আর খেলাধূলায়ও ছিলাম প্রথম সারিতেই।
আমার পরিবার এবং পুরো পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে দুরন্ত, চঞ্চল আর সদাহাস্য ছিলাম বলে আমাদের প্রতিবেশী নাজমা আপা আমাকে ‘খুশির বাপ’ বলে ডাকতেন।
অনেক বছর পর আবার নাজমা আপার সাথে দেখা। তিনি আমার শৈশব এবং তার সাথে দেখা হওয়ার সময়টা তুলনা করে যা বললেন তা আমার জন্য এক শিক্ষণীয় ব্যাপার। “আমার ‘খুশির বাপ’-কে দেখে মনে হচ্ছে এ সে নয়; অন্য কেউ! এত চঞ্চল একজন মানুষ কি করে এত শান্ত গম্ভীর হতে পারে! না; তুমি সে নও!”
আমার শৈশবের দুরন্ত সময়গুলো দুরন্ত গতিতেই বয়ে যেতে লাগলো। আমি প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে হাই স্কুলে ভর্তি হলাম। কিন্তু আমার দুরন্তপনায় ভাটার টান লক্ষ করা গেলো। এরই মধ্যে আমার খেলাধূলায়ও পরিবর্তন এলো। দাঁড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, বউচি’র জায়গা দখল করতে শুরু করলো ক্রিকেট। টাকা জোগাড় করতে শুরু করলাম, ব্যাট কিনবো। ইতোমধ্যে মধ্যে নারকেল পাতার গোড়ার অংশ কেটে ব্যাট বানালাম আর কড়ি জাম্বুরা (কড়ি জাম্বুরা= জাম্বুরার ছোট অবস্থা) হলো বল। এভাবেই চলতে লাগলো আমার খেলা। তারপর এক সময় টাকা জোগাড় এবং ব্যাট ও টেনিস বল কেনা হলো। সারাক্ষণ মেতে থাকি ক্রিকেট নিয়ে। ক্রিকেটই যেনো ধ্যান-জ্ঞান। ঘুমুতে যাওয়ার সময়ও সাথে থাকে ব্যাট আর বল। স্বপ্ন দেখা শুরু হলো ক্রিকেটার হবো।
এদিকে পড়ালেখার কিছুটা ক্ষতি হতে শুরু করলো। প্রথম স্থান হতে আমার নাম ছিটকে গেলো। কষ্ট পেলেও কাউকে বলতে পারলাম না। কেননা আমাকে ধিক্কার জানাতে কেউই ভুল করলো না। কাকে বলবো যে আমি তোমাদের থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছি। হতাশা ছেঁয়ে যেতে থাকলো আমায়। কিছুই ভাল লাগছিল না আমার।
আমার ক্রিকেটের অনুশীলন কিছুদিন থেমে থেকে আবার শুরু হলো। এলাকায় একটা ক্রিকেট টীম গঠন করলাম এরই মধ্যে। দলগতভাবে ক্রিকেটের সমস্ত সরঞ্জাম কিনে নিলাম। শুরু হলো খেলার জগতে পাড়ি জমানো। আমি আমার দলের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান এবং অফ স্পিন বোলার। এলাকায় এবং অনেক দূরে পর্যন্ত বিভিন্ন টুর্নামেন্টে আমার দল চ্যাম্পিয়ন হতে শুরু করলো।
এদিকে আমার নাম ছিটকে যেতে যেতে ক্লাসে তেরো নম্বরে চলে গেলো। তখন অষ্টম শ্রেণী শেষ করে সবে নবম শ্রেণীতে। আমার বাবা বাড়ী এলেন এবং সভা আহ্বান করলেন। পরিবারের সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে আমার ক্রিকেটের বিরুদ্ধে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। অনাস্থা প্রকাশ করলেন আমার এবং আমার ক্রিকেটের বিরুদ্ধে। অতএব আমাকে ক্রিকেট ছাড়তে হবে।
চরম হতাশা গ্রাস করে নিলো আমায়। আমি নিজেকে সব কিছু হতে, সমাজ হতে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে নিই। আমি আমাদের বাড়ী হতে একটু দূরে পুরনো প্রাইমারী স্কুলের ছাদে নয়ত আধাপাকা স্কুল ঘরটির টিনের হেলানো ছাদে জঙ্গলের দিকটাতে শুয়ে থাকি যেনো কারও চোখে না পড়ি। প্রকৃতির মাঝে একাকার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা। কথা বলি পাখির সাথে, প্রজাপতির সাথে।
একদিন বিকেল বেলা। আধাপাকা স্কুল ঘরটির হেলানো ছাদে হেলান দিয়ে শুয়ে আছি। কথা বলছি পাখির সাথে। হঠাৎ পাখি উড়ে চললো। আমিও আনমনে উড়ে চললাম। মাটিতে কিছু পড়ার শব্দ হলো। তারপর শুনি কে যেনো আমায় ডাকছে দূর হতে ভেসে এলো কানে। চোখ মেলে দেখি গাঢ় অন্ধকার; কিছুই ঠাহর করতে পারি না। ডাকের উৎসের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম পা টিপে টিপে। বাড়ী পৌঁছে দেখি গভীর রাত। ৭-৮ ঘন্টা আমার কিভাবে কাটলো জানি না।
এভাবেই কাটতে থাকে আমার প্রতিটি দিন।
আমার আর আমার স্বপ্নের দূরত্ব বাড়তে থাকে। যে স্বপ্নের মাঝে আমি ভেসে বেড়াতাম সেই স্বপ্নকে আর খুঁজে পাই না। স্বপ্ন আমায় ছেড়ে চলে গেলো নাকি আমিই স্বপ্নের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি বুঝতে পারি নি এখনও। তবে এটা সত্য যে আমি আর স্বপ্ন আলাদা বাস করছিলাম । স্বপ্নের মাঝে বুঁদ হয়ে থাকা হলো না আর। নিজেকে আবিষ্কার করি বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হিসেবে। তারপর আবার নতুন করে বেঁচে ওঠা ।