অপেক্ষায় আছি……
পতাকার মানে কি তা আমি কি করে বুঝবো, আমার সন্তানেরা কি করে বুঝবে! একেবারে যখন থেকে প্রথম স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম, প্রতিদিন প্রাতঃকালীন সমাবেশে দাড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইতাম, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি”। ভালবাসির শেষ অংশে এসে যখন সুরটা বেশ দ্বীর্ঘ হতো তখন মনে হতো এটাই মনে হয় ভালবাসা। কেমন যেন একটা মায়াকাড়া টান। গান-বাজনা করার বা বোঝার কোন সুযোগ কখনো পাইনি বা পেলে করতাম কিনা জানিনা। কিন্তু একটু-আধটু শুনি মাত্র। যেটা ভাললাগে সেটা অনেকবার শুনি, যে অংশটা ভাল লাগে বহুবার শুনি। এ্যাসেম্বলীতে দাড়িয়ে প্রতিদিনই, মানে স্কুল কামাই না দিলে, পতাকাটা দেখতাম, এমনিই, বিশেষ কোন মনোযোগ দিয়ে যে দেখতাম তা না। কিন্তু বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসগুলিতে সাধারনত নতুন পতাকা উড়ান হতো, অন্য সময় বেশ রঙচটা পতাকা, ছিড়া পতাকাও দেখেছি যতদুর স্মরনে আছে। যেন পতাকাটা শুধু বিশেষ দিনের।
বড় হতে থাকলাম, এক ক্লাস দু ক্লাস করে উপরে উঠতে থাকলাম। আর ফাকিবাজিও বেশ শিখতে থাকলাম। সবাই যখন জাতীয় সংগীত গাইছে তখন আমরা কেউ কেউ খালি মুখ নাড়ছি। কখন এটা শেষ হবে সেই অপেক্ষা। মাঝে মাঝে মুখ নাড়ানোর কৌশল সঠিক ভাবে প্রয়োগ করতে না পেরে ধরাও খেয়েছি বেশ অনেকবার। কখনও কখনও আবার হঠাৎ করে পিছনে বেতের সপাং সপাং বাড়ি। আবার উচ্চ গলায় গান শুরু। এভাবেই স্কুল শেষ করলাম, কলেজে তো আর বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া জাতীয় সংগীতের গুরুত্ব নেই। তবে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় আমার আশেপাশের বড়দের যে একটা শ্রদ্বাবোধ দেখতাম সেটা আমার খুবই গর্বের বিষয় বলে মনে হতো। বিষয়টা স্মৃতিতে বেশ ফিকে। তবে ঐ সময় পর্যন্ত পতাকা নিয়ে আমি যা শিখেছি যতটুকু শিখেছি, তা যে আমার পরিবার আর পারিপার্শিকতা থেকেই শিখেছি, তাতে কোন সন্দেহ নাই।
তবে দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি আমার স্কুল-কলেজ জীবনের কোন শিক্ষককে বা আমার পরিবারের কাউকে এই পতাকাকে কিভাবে সম্মান করতে হবে তা কখনও বলতে শুনিনি। স্কুল-কলেজে হয়তো বলেন না কারন সিলেবাসে নেই তাই, আর বাসায় বলেনি কারন এটা কে আদৌ কোন জ্ঞ্যান দেবার বিষয় বলে কেউ হয়তো মনে করেন নি। কিন্তু আমি আমার সন্তানদের বলছি পতাকার মানে কি, অবশ্যই আমি যতটুকু বুঝি, তাদের দুজনেরই নিজের একটা করে পতাকা আছে।
পতাকাতে বৈদ্যুতিক প্রবাহ আছে সেটা প্রথম টের পেলাম জীবনের প্রায় আঠার বছর পার হয়ে যাবার পর যখন এটা কিভাবে উঠাতে হয় কিভাবে নামাতে হয়, কিভাবে এটাকে সম্মান করতে হয় এগুলি শেখা শুরু করলাম। পতাকা যেন আমার হাত থেকে মাটিতে পড়ে না যায়, এমনকি কোন অবস্থায় যেন পদদলিত না হয়, সেটা শিখলাম, সাথে সাথে এটাও শিখলাম, মাটিতে ছোয়া না ছোয়াটা আসলে কোন বিষয় নয় আসল বিষয় যেটা আমার প্রশিক্ষক আমাকে শিখাতে চাইছেন তা হলো, তুমি এবং তোমরা বেচে থাকতে যেন এর অপমান না হয়। তখন ভেবে ছিলাম আমি অনেক শিখেছি।
অনেক বছর পর আমার এক সিনিয়রের কাছ থেকে পতাকার ব্যাপারে দারুন একটা বিষয় শিখলাম। আমরা বেশ কজন একটা প্রশিক্ষনের জন্য একসাথে দেশের বাইরে ছিলাম। ঐ দেশের কর্মকর্তাদের সাথে আমাদের একটা প্রীতি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হলো। খেলা শুরু হবার আগ মুহুর্তে যখন দু দেশের পতাকা তোলা হবে তখন ঐ দেশের পতাকা তো আছে, কিন্তু আমাদের পতাকা নেই। তখন আমার সেই সিনিয়র একটা পতাকা নিয়ে আসলেন যেটা তিনি নাকি সবসময় তার সাথেই রাখতেন। আমি অভিভুত হয়ে গেলাম! পতাকার মানে কি তা বুঝার পথে মনে হয় আমি একটানে অনেকদুর এগিয়ে গেলাম। এর পর থেকে আমি আর কখনও পতাকা ছাড়া কোন দূর যাত্রা করিনি। কখনও ছোট, কখনও বড়, সবসময় আমার লাগেজের মধ্যে একটা পতাকা থাকে। ব্যাপারটা হয়তো খুব গুরুত্বপুর্ন নয় কিন্তু আমি বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। বিষয়টা একেবারেই ব্যাক্তিগত।
মাত্র কিছুদিন আগেই যখন আমার এক সময়ের সহকর্মী-কোর্সমেটের লাল-সবুজে মোড়ানো কফিন ঘাড়ে নিয়েছি, যক্ষের ধনের মত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে গিয়েছি আর সবশেষে পতাকাটা থেকে ওকে বের করে আমরা কজন শেষ বারের মত কবরে শুইয়ে দিয়েছি তখন মনে হয় এই পতাকার মানে আমি আরও খানিকটা বুঝেছি।
আমার ছেলেরা প্রতিদিন বড় হচ্ছে, তাদের কে আমি বলি পতাকাটা এমন একটা জিনিষ যা শুধু বুকের ভিতরে রাখলেই হবে না কাছেও রাখতে হবে, অন্যেরা না রাখলে কি, তাদের হয়তো অন্য কোন পন্থা আছে ভালবাসার, তোমার থেকে আলাদা, তোমার থেকে অধিকতর, তুমি তার কাছ থেকেও শিখ। ভালবাসা জিনিসটাই মনে হয় এরকম, সব সময় কাছে রাখতে ইচ্ছা করে, যখন তখন দেখতে ইচ্ছা করে। এত অপুর্নতা ভরা আমাদের জীবন, আমাদের সময় এত সমস্যা সংকুল যেখানে আমাদের মৃত্যুর খবর ইদানীং আর নামে প্রচার হয় না, প্রচার হয় সংখ্যায়, এত সুবিধা বঞ্চিত, যেখানে ১৬কোটি মানুষের হয়তো নব্বই ভাগই কোনদিন কোন প্লেনে চড়েনি, সেখানে এতটুকু সুবিধা পুরোপুরি ভোগ করতে বাধা ত নেই।
তবে আমি জানি এটাই শেখার শেষ নয়। অপেক্ষায় আছি……
উৎসর্গঃ মেজর মোহাম্মদ আলী (অবঃ) এবং প্রয়াত লেঃ কমান্ডার মোহাম্মদ মাসুদ আলম,(সি),(পিএসসি),বিএন