Today 12 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

ধারাবাহিক উপন্যাস “নিয়োগ পত্র” – সপ্তদশ অধ্যায়

: | : ১৭/১২/২০১৩

সপ্তদশ পর্ব
(আঠার)
কথাটা আদৌ মিথ্যা নয়।
প্রভাবশালী মহলে মাস্তানের কদর বেশী। জেল খানার খুনী কয়েদীদের মতো। জাত খুনীদের ক্ষমতা জেলখানায়ও আছে। চোর, চ্যাচড় পুঁচকে কয়েদীদের ওরা বেদড়ক পিটায়। রাতারাতি ওস্তাদ বনে যায়। মাস্তানদের এটায় সৌভাগ্য। সবক্ষেত্রে তাদের বিচরন। শুধু পাবলিক সেন্টিমেন্টে যা সামান্য একটু ভয়। পাবলিকরাও ইদানীং চুপসে গেছে। খুব বেশী বাড়াবাড়ি না হলে তারাও মুখ খুলে না। জীবনের প্রতি ভীষণ মায়া। কেউ মরতে চায়না।
একটা বিশেষ মহল ব্যাপারটাকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যেতে তৎপর। যে মারা গেছে তাকে সাজানো হচ্ছে একজন সাধারন পাবলিক হিসাবে। ওরা তিনজন সেখানে উপস্থিত ছিল বটে। তবে মাস্তান নয়। প্রকৃত মাস্তানরা সবার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছে। ব্যাপারটা অনেকটা সন্দেহমূলক। পাবলিক সেন্টিমেন্টটা ওই তিন নিরীহ যুবকের উপর গিয়ে পরেছে। ঠিক ওই সময় পুলিশ এসে না পরলে নিশ্চয় ওরাও প্রাণে রক্ষা পেত না। যারা প্রাণে বেঁচে পালিয়েছে তারা বড় ভাইয়ের নির্দেশে আপাতত গা ডাকা দিয়েছে। ঘটনাটা কোন দিকে মোড় নেয় এখনও সঠিক করে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
যে লোকটির টাকা ছিনতাই করতে গিয়ে এ ঘটনা তাকেও বেশ কয়েকবার টেলিফোনে হুমকি দেওয়া হয়েছে। তিনিও মৃত্যভয়ে জর্জরিত। বউ বাচ্ছা নিয়ে সংসারে বেশীদিন বেঁচে থাকার খুব স্বাদ। ভাবছে টাকা যখন খোয়া যায়নি তখন আর নিজের প্রানটাকে ওদের হাতে তুলে দিয়ে লাভ কি। তাছাড়া যা হবার তাতো হয়েই গেছে।

আসামী দু’জনকে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর আদালতে হাজির করা হয়েছে। বিজ্ঞ বিচারক জামিনের আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। আরো তিনদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে সংগে যারা ছিল তাদের নাম ঠিকানা। পুলিশের কৌশলের তারিফ করতে হয়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পুরো কেস স্টাডিটা বের করে নিয়ে আসছে। পুলিশেরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আইন বলে কথা। কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ আর বের হয় না। কেঁচোতেই থেকে যেতে হয়।
এই পুলিশ অফিসারটার সাহস আছে। নতুন জয়েন করেছে। পায়ের তলায় যে ক’টা বেত মেরেছে তাতে মাথার রগে টান পরেছে। এখনও ঝিম ঝিম করছে। তারপরও স্বাদ মেটেনি। বলছে, বল শালা আর কে কে ছিল। মনে হচ্ছে সোজা আংগুলে ঘি উঠবে না। আঙ্গুল বাঁকা করতে হবে। তবে তোর বাপও গড় গড় করে বলে দেবে। হট ওয়াটার থেরাপি দিতে হবে। অফিসার টগবগে গরম পানি আনার হুকুম দিলেন। একজন সেন্ট্রি পানি নিয়ে এলেন। পানি থেকে গল্লা বেঁধে ধোঁয়া উঠচে। এই পানি নাক দিয়ে ঢুকানো হবে। আর না বলে উপায় নেয়। ভাবতেও কেমন গা শিউড়ে উঠছে।
পুলিশের বড়কর্তা এইমাত্র গাড়ি থেকে নামলেন। সেলের সামনে গিয়ে অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলেন-
– কিছু বলেছে।
– না স্যার। হট ওয়াটার থেরাপি দিচ্ছি। এবার বলবে। তাতেও যদি কাজ না হয় তাহলে হট এগ থেরাপি। আপনি কি বলেন স্যার।
বড় কর্তা ইশারায় কাছে ডাকলেন। ফিস ফিস করে বললেন-ওদের বেশীদিন আটকে রাখা যাবে না। বেশী টরচার করারও দরকার নাই। আগামী মিছিলে জামিনও হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া—।
– বুঝেছি স্যার। আর বলতে হবে না।
গরম পানির আর প্রয়োজন হয়নি। আদুরে গলায় জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। বাচ্চা ছেলেকে শাসন করতে গেলে শাসন আর চোখ রাঙ্গানীর একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। ঠিক সেই রকম। বাচ্চারাও বুঝে। অবলীলায় এক ধরনের হাসির জন্ম দেয়। এও ঠিক তেমনি।

তিমিরের কোন হদিস নেই। কোথায় লাপাত্তা হয়ে গেছে। একদিন মাঝ রাতে চুপি চুপি এসে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র গুলো নিয়ে বেরিয়ে পরেছে। অনন্তদা হা করে তাকিয়েছিল। কিছু বুঝে উঠার আগেই বলল-আমি যাচ্ছি। জরুরী প্রয়োজন আছে। তুমি তালা লাগিয়ে পারলে ক’দিনের জন্য কোথাও ঘুরে আসো। আর কেউ আসলে বলবে ক’দিন হলো কোথায় বেড়াতে গেছে। এই নাও বলে একটা পাঁচশ টাকার নোট অনন্তদার হাতে দিয়ে বেরিয়ে পরল।
পরদিন রাতেই পুলিশ এসে তল্লাশী চালিয়েছে। অনন্তদা বিশ্বস করতে পারছিল না। হাউ মাউ করে বাচ্ছা ছেলের মত কেঁদে উঠল। পুলিশের পায়ে ধরে বলল-তিমির সে রকম মানুষ নয়। বিশ্বাস করেন, ও এ কাজ করতে পারে না। ওর মত মানুষ হয় না। চাকরী খুঁজতে খুঁজতে তিল তিল করে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। টিউশনি করে নিজের ও পরিবারের ভরন পোষন চালায়।
পুলিশের জাত। কার কথা কে শোনে। বলে-তুমিওতো এই কাজের কমিশন খাও। থানায় চলো। তোমাকেও মজা দেখাচ্ছি। অনন্তদা পুলিশের হাতে পায়ে ধরে কেঁদে কেটে সে যাত্রায় কোন ভাবে রক্ষা পেয়েছে। পরদিন ভোর না হতেই দরজায় তালা ঝুলিয়েছে।
শেলী কয়েকবার খবর নিতে এসেও ব্যার্থ হয়ে ফিরে গেছে। কেউ জানে না কোথায় গেছে। এটুকু সবাই আন্দাজ করে বলেছে-ইদানীং নাকি বাজে ছেলেদের সাথে বেশী মিশত। খুব বেশী নেশাও করত। শেলীর কষ্ট হয়। কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
শেলী স্বাধীনচেতা। স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যবোধে বিশ্বাসী। এই মুহুর্তে প্রতিজ্ঞা করে বসেছে যে, আসলে তিমির এতটা নীচে নেমেছে কিনা তাকে জানতে হবে। প্রয়োজনে ওপথ থেকে যেভাবে হোক তিমিরকে ফিরিয়ে আনবে। নতুবা যে ভালোবাসা এতদিন তিল তিল করে বিশ্বাসের পাহাড় গড়েছে তা মুহুর্তেই ভেঙ্গে যাবে। তিমিরের বাড়ীর ঠিকানা শেলীর জানা আছে। তবে পথ চেনা নেই। খুঁজে বের করতে হবে। একেতো মেয়ে মানুষ। পুরোপুরি ভরসা পাচ্ছে না।
তিমিরের লুকোচুরি আর ভালো লাগছে না।
সারাক্ষন একটা ভয় তাড়া করে ফিরছে। দূরে পুলিশ দেখলে আপনা আপনি নিজেকে আড়াল করে রাখতে হয়। শরীর ভেঙ্গে পরেছে। চোয়াল দু’টো কংকালসার বৃদ্ধের মত হা পিত্যেস করছে। দু’চারজন কৌতুহলী মানুষ ওর দিকে তাকিয়ে কথা বললে মনে হয় ওকেই তাড়া করতে আসছে। তিমির সেদিন পাবলিকের রুদ্র রোষ দেখেছিল। কি ভয়ংকর সে দৃশ্য। ধরতে পারলে মা বাবা ডেকে চৌদ্দ সালাম দিলেও রক্ষা হতো না। তিমির পর পর ছয় রাউন্ড শুন্যে গুলি ছুড়ে পালিয়ে বেঁচেছিল। সেই থেকে অদ্যাবধি পালিয়ে বেড়াচ্ছে। হয়তো আজীবন পালিয়ে বেড়াতে হবে।
দাড়ি গোঁফ রেখে দিয়েছে। নিজেকে আড়াল করার জন্য। এখন পরিচিত কেউ হঠাৎ দেখলে চিনতে পারবে না। সেদিন সিরাজ মিয়ার সাথে হঠাৎ পথে দেখা। সিরাজ মিয়া চিনতে পারে নি। চিনেছে তিমির। পেছন থেকে ডাকতেই সিরাজ মিয়া হা করে তাকিয়েছিল। তিমির জিজ্ঞাসা করল-
– কেমন আছো সিরাজ মিয়া।
– ভালো। কিন্তু আপনে?
– আমি তিমির। তোমার বউ কেমন আছে।
– ও ভাইজান। তয় আপনের এই অবস্থা ক্যান। মনে হইতাছে অনেকদিন না খাইয়া আছেন। চোখ দুইডা কেমন আলগা হইয়া ভাসতাছে।
– ও কিছু না। অসুখ হয়েছিল। তুমি বাড়ী যাও নাই।
– না ভাইজান। কাজ কামের লাইগা অহন আগের লাহান যাইতে পারি না। সংসারের খরচ বিরচ ও বাড়ছে। আমাগো একখান পোলাও হইছে।
– ভালো। এদিকে কোথায় যাবে।
– ঐ হাবিব কন্ট্রাকটারের লগে একটু দেহা করুম। কিছু টেহা পামু। আইজ আসতে বলছিল।
– আচ্ছা তোমার কাছে পঞ্চাশটা টাকা হবে।
সিরাজ মিয়া ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। পলক পরছে না। তিমিরের মুখে সংকোচের চিহ্ন মাত্র নেই। বলতে গেলে এভাবেই এখন চলতে হয়। পরিচিতজনদের কাছ থেকে যে সময় যা পায় ধার চেয়ে নেয়। প্রতিজ্ঞা করে সামনের সপ্তাহে দিয়ে দেবে। আর দেওয়া হয় না। সিরাজ মিয়া কিছু বলার আগে তিমির আবার বলল-আমি একটা জরুরী কাজে যাচ্ছি। বাসায় যাওয়ার সময় নেই। তোমার ঠিকানাটা বল। আমি তোমার বাসায় গিয়ে দিয়ে আসব। সিরাজ মিয়া বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস করতে পারছে না। ভাবছে উল্টোটা। তিমির ভাইজান আমার কাছে ধার চাইলো। মাথা ঠিক আছে তো। না আমি চিনতে ভূল করছি। সিরাজ মিয়া কোমড়ে গুঁজে রাখা বিড়ির বাক্স থেকে একটা নতুন পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে দিয়ে বলে-ভাইজান একটু চা খান। তিমির সামনে পা বাড়িয়ে বলে-আজ সময় নাই, পরে খাবো। সিরাজ মিয়া তাকিয়ে দেখল তিমির কেমন ব্যাস্ত ভঙ্গিতে জনারন্যে মিলিয়ে গেল। এই ঘটনাটার পর ইদানীং এক জায়গায় বেশীক্ষন থাকতেও কেমন যেন ভয় ভয় করে।
এ পর্যন্ত অনেকের কাছ থেকে এভাবে ধার নিয়েছে। কিন্তু পরিশোধ করতে পারছে না। ইদানীং চাকরীর জন্যও খুব বেশী ছোটাছুটি করতে পারছে না। সে একটা অন্ধকার গলির মুখে এসে দাড়ায়। অন্ধকার থাকলে জীবনের অনেকগুলো এলোমেলো প্রশ্ন ভীড় করে। অতীত আর বর্তমান নিয়ে ভাবতে ভাবতে অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। সবসময় মনে হয় বর্তমানটায় কষ্টের। অতীতটায় ভালো ছিল।
যে উদ্দ্যেশে তিমির গলির মুখে এসে দাড়িয়েছে তাতে বেশীক্ষন ভাববার অবকাশ নেয়। একজন লোক এসে জিজ্ঞাসা করে-
– লাগবো।
– রেট কত। পাল্টা প্রশ্ন করে তিমির।
– একশ বিশ।
তিমিরের জানা কথা। এর আগেও বন্ধুদের সংগে এসেছে। রেট কত জিজ্ঞাসা করতে হয়নি। দলবল ছিল। একটা দাপটও ছিল। তাদের কাজ সেরে ইচ্ছামতো যা খুশী দিয়ে এসেছে। কেউ মুখ তুলে কথা বলার সাহস পায়নি। লোকটি আবার বলে উঠল-
– আপনে পুরানা মানুষ। রেট না হয় একটু কমই দিলেন। যান সোজা পাঁচ নম্বরে চইল্যা যান। এক্কেবারে খাসা মাল। এই লাইনে বেশীদিন হয় নাই। তয় একটু তাড়াতাড়ি কইরেন। এলাকায় নতুন সাব-ইন্সপেক্টর আইছে। সে নাকি মালপানি খায় না। বেটা হারামজাদা খুব জ্বালাইতাছে। তয় লাইনে আইতে বেশীদিন লাগবো না। এরকম কত দেখলাম।
অন্ধকারে লোকটির চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবে তিমির চেনে। ইচ্ছা করছে এই মুহুর্তে জোড়ে একটা চড় মারতে। তবে এ লাইনে ওটা এত সহজ না। এখানেও সেই লম্বা হাত। অনেকেই আছে প্রতি দশ হাত পর পর পাহাড়ায় থাকে। এ লাইনে থেকে ওদের সংসার চলে। মূলত সন্ধ্যার পরে ওদের কাজ। গভীর রাত পর্যন্ত থাকতে হয়। যারা সারা রাতের জন্য আসে মাঝে মধ্যে তাদেরকেও পাহাড়ায় রাখতে হয়। খদ্দেরের কোন অসুবিধা হলে তো ব্যবসা চলবে না। বিশ কদম সামনে এগুলেই একটি পানের দোকান। হারিকেন জ্বালিয়ে মাঝ বয়সী সওদাগর দেড় মণ ওজনের ভুরিটা নিয়ে বসে বসে পান চিবোচ্ছে। আলোর সামনে কালো শরীরটা চিক চিক করছে। তিমির একটা সিগারেট কিনে জ্বালায়। তারপর ধীরে ধীরে অন্ধকার গলির বাইরে পা বাড়ায়।
রাতে কোথাও যাওয়ার জো নাই। নেপালের সাথে ক’দিন ছিল। সেও খুব একটা ভালো ব্যবহার করছে না। প্রেষ্টিজে লাগছে। নেপাল ভালো বন্ধু বটে। মেজ করে থাকে। ওখানে যাওয়ার পর প্রথম ক’দিন বেশ ভালোই খাতির যত্ন করেছিল। সেও পাবে শ’দুয়েক টাকার মত। সারাদিন বাইরে ঘুরে রাতের বেলা অগত্যা মাথা গোঁজার জন্য যেতে হয়। নেপাল বিরস মনে মেনে নেয়। শুধু মুখে বলতে পারছে না ভাই তুই কাল থেকে এখানে আসিস না। আমার অসুবিধা হচ্ছে। শত হোক চক্ষু লজ্জার একটা ব্যাপারতো আছে।
তিমির সেটা বুঝে। তবুও কি করা। নির্লজ্জের মত যেতে হয়। একটা রাতের জন্য কোন রকমে মাথা গুঁজে শুয়ে থাকা। প্রথম দু’একদিন ভাত খাওয়ার কথা বললেও ইদানীং খাওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করে না। কদাচিৎ জিজ্ঞাসা করলেও তিমির সহজ ভাবে জবাব দেয়-খেয়ে এসেছি।
চলবে…….

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top