Today 12 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

দুই টুকরো কাশ্মিরী শাল – ২

: | : ২১/১২/২০১৩

( পূর্ব প্রকাশিতের পর )

২ .

ঝ….ন….ন……না…..আ…..আ……ৎ !!

মধ্য ডিসেম্বরের কনকনে শীতের মঝরাতে যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন চারপাশের সমস্ত চরাচর জুড়ে বিরাজ করছে গভীর নিস্তব্দ্ধতা , ঠিক তখনই কাঁচের কোন কিছু শক্ত মেঝেতে ভেঙ্গে পড়ে গুড়িয়ে যাবার বিকট শব্দে দারুন ভয় পেয়ে ঘুম থেকে একলাফে বিছানায় উঠে বসলো অনামিকা ।

ঘুমের মধ্যে আচমকা ভয় পেয়ে যাওয়ায় খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খাবার মতন অবস্হা হয়েছে তার । বুকের খাঁচার ভেতর তার চমকে ওঠা হৃদপিন্ডটা যেন লাফিয়ে চলেছে ছোট্ট পিংপং বলের মতন দূরন্ত গতিতে । ঘুমের ঘোর লেগে থাকা  অনামিকা  প্রথমে ভেবেছিল  আশেপাশে কোথাও শক্তিশালী কোন বোমার বিষ্ফোরন হয়েছে বুঝি !

যদিও ক্ষণিকের সেই বিহ্বলতা কাটিয়ে ফের ধাতস্ত হতেও সময় লাগলো না  তার । অন্ধকারে বিছানায় বসেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে  পেতে সময় নিলো একটু । তারপর কান পেতে খোঁজার  চেষ্টা করলো শব্দটার উৎস । সাথে সাথেই কানের পর্দায় এসে বাড়ি খেলো নারীকন্ঠের ফিসফিসানি । মনে হলো নীচু সাবধানী কন্ঠে কেউ কাউকে বুঝি ভৎর্সনা করে চলেছে ! নারী কন্ঠটি চিনতে মোটেও বেগ পেতে হলো না অনামিকা ওরফে অনুর । তার কাজের মেয়েটার কথাই ভেসে আসছে কোনের ঘরটা থেকে । অর্থাৎ  যা কিছু অপকর্ম ঘটার ঘটেছে তার নিজের ফ্ল্যাটেই  ।

সাথে সাথে যেন প্রচন্ড রাগে মাথায় আগুন ধরে গেল অনুর । অগ্নিঝরা দৃষ্টি নিয়ে ঝট করে ফিরে চাইলো বিছানার অন্যপাশটায় । যেখানটায় তার স্বামী আতিক শোয় । জায়গাটা যদিও  এই মুহুর্তে শূন্য পড়ে আছে । ভাগ্য ভালোই বলতে হবে বেচারা আতিকের ।! সে কদিনের জন্য ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে গেছে । নইলে এ মুহুর্তে নির্ঘাৎ সে ভস্ম হয়ে যেত স্ত্রীর দৃষ্টির জ্বলন্ত আগুনে !

আতিকের উপর এমনিতেই প্রচন্ড রেগে আছে অনু । ওর বড় ইচ্ছা ছিল স্বামীর সাথে এবার ইউরোপ ঘুরে আসার । ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ারটা জম্পেশ উপভোগ করে আসার । ওই সব জায়গায় না গেলে আসলে বোঝাই যায় উৎসব কতটা রঙ্গিন আর জীবন কতোটা উপভোগ্য হতে পারে !  এই পচা দেশের গরীব মানুষগুলো তো জানেই না জীবন আসলে কি !

তারা আর উৎসব করবে কি !!

যত্তোসব হাঁভাতে মানুষে ভরা বিরক্তিকর এই দেশ !

কিন্তু চাইলেই কি আর সব হয় !

এই তো , শত ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও অনু যেতে পারলো কই ? সংসারের দোহাই দিয়ে দিব্যি স্বামী প্রবর তার চলে গেল ।  যাবার  সময় দিয়ে গেল নিজের অসুস্হ মাকে দেখাশোনা করার বাড়তি মহান দায়িত্ব ! রীতিমতন বেঁধে দিয়ে গেল তার হাত পা ! দেশ – বিদেশ দূরে থাক , এখন ঘরের বাইরে বেরুতে গেলেও হাজারবার চিন্তা করতে হচ্ছে তাকে ! এই তো বার্ষিক পরীক্ষার পর মাত্র কদিনের জন্য স্কুল ছুটি পেল তার ছেলেটা । পারছে বাচ্চাটাকে নিয়ে কদিনের জন্য ধারেকাছে কোথাও বেড়িয়ে আসতে ? শেষে ছেলেটাকে কদিনের জন্য নানার বাড়ী পাঠাতে হলো একা একা ! নিজে যেতে পারলো না বাপের বাড়ী হাতের কাছে হওয়ার পরেও  !

ডিসগাষ্টিং !

হাত বাড়িয়ে ঘুমানোর সময় বিছানার উপর খুলে রাখা উলেন শালটা গায়ে ভালো মতন জড়িয়ে বিছানা থেকে নামলো অনু । রাগে থমথমে মুখ নিয়ে বেডরুমের  দরজা খুলে পা  রাখলো  কড়িডোরে । এগিয়ে গেল কড়িডোরের একেবারে শেষ প্রান্তের ছোট্ট ঘরটার দিকে ।

ওই ঘরে  প্রবেশ করে অনু  যা দেখতে পেলো তাতে আরেকদফা মাথা খারাপ হওয়ার দশা তার ।

পুরো ঘর ভেসে যাচ্ছে পানিতে ! সারা ঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঁচের টুকরায় । নাজু নামের মেয়েটা নীচু গলায় কি সব বলতে বলতে পরিষ্কার করে চলেছে সারা ঘরের পানি আর কাঁচের টুকরা । তার বিছানাপত্র সব ভিজে এক সা । আপাতত সেগুলো কোনমতে গুটিয়ে সরিয়ে রাখা হয়েছে একপাশে । আর সালেহা বেগমকে দেখা গেলো  ঘরের আরেক কোনে অথর্বের  মতন দাঁড়িয়ে থাকতে । তার এই জবুথবু হয়ে চোরের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা দেখেই অনুর আর বুঝতে বাকি থাকে না কি ঘটেছে এখানে !

অনামিকার এ ঘরে  প্রবেশ প্রথম টের পায় নাজুই । আর সাথে সাথেই মুখ খোলে সে ।

– দেখছেন ম্যাডাম , কামডা কি করছে আম্মায় । আমারে ঘুমের থন ডাইক্যা কইলো পানি দিতে । তিয়াস পাইছে । আমি কইলাম দিতাছি ! কয়্যা মাততর আমি উটতে আছি বিছনা ছাইড়্যা ! ওম্মা উনি গেল চেইতা ! আমারে এক দমকি দিয়া কয় আমি বলে কুইড়া ! দেরী করছি পানি দিতে ! কইয়্যা নিজেই ত্যাজ দেহায়্যা পানি ডাইল্যা খাইতে গিয়া দেহেন কি সব্বোনাশ করছে !

অনুর কাছে কাঁদোকাঁদো ভঙ্গিতে নালিশ করে চলে নাজু । জড়ভরতের মতন দাঁড়িয়ে থাকা সালেহার কানে নাজুর প্রত্যেকটা  কথা ষ্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় ।ভীষণ অবাক হয় মেয়েটার এমন ডাঁহা মিথ্যা বয়ান শুনে !  মনে তীব্র ইচ্ছা জাগে প্রতিবাদ করার ! কিন্তু মুখ খোলার মতন শক্তি বা সাহস কোনটাই জোগাতে না পেরে স্রেফ বোবার মতন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মিথ্যুক কাজের মেয়েটার দিকে !

 

এমনটাযে হবে – তা ভালোমতনই জানে নাজু ! এ কমাসে  সালেহা বেগমের মুখচোড়া আর ভালমানুষী চরিত্র ভালমতনই  জানা হয়ে গেছে বুদ্ধিমতী তার । শুধু তাই নয় , সে জেনে গেছে আরো একটি মারাত্বক সত্য ! আর তা হলো , সালেহা বেগম সাহেবের মা হতে পারেন ,  কিন্তু পুত্রবধূর কাছে তার বিন্দুমাত্র গ্রহণযোগ্যতা নেই !  বরং ম্যাডামের ব্যাবহারই বলে দেয় শ্বাশুড়ীকে একটা বাড়তি উপদ্রব ছাড়া আর কিছুই ভাবে না ! সুতরাং আজকাল আর সালেহা বেগমকে থোড়াই পরোয়া করে নাজু । সে শুধু খেয়াল রাখে ম্যাডামের উপস্হিতিতে নিজের ভাবটা আড়াল করে রাখার ।

এই মুহুর্তেও তাই নির্দ্বিধায় সমস্ত দোষ বুড়ো অসহায় মানুষটার উপর চাপিয়ে যায় ধুরন্ধর নাজু । ম্যাডামও প্রত্যাশা মাফিক তার কথা শুনছে দেখে সাহস আরেকটু যেন বাড়ে তার !

– আল্লারে আল্লা , বুইড়্যা মাইনষে যে ইমুন গউরা কিসিমের অয় তা আমার বাপের  জন্মেও দেহি নাই । আমার বিছনাপাটি সব বিজায়া নান্দিবিনাশ কইরা ছাড়ছে  এক্কেবারে   । অহন আমি গুমাই কনে ?

বলতে বলতে নালিশের দৃষ্টিতে তাকায় নাজু তার ম্যাডামের দিকে ।

– তোমাকে ওনিয়ে ভাবতে হবে না । আমি আর এক সেট লেপ তোষক বের করে দিচ্ছি । ওগুলো বিছিয়ে শুয়ে পড়ো কাজ শেষ করে  ।

– কিন্তুক এই ঘরের মাডি তো পানিত ভিজ্যা এক্কেরে বরপ অয়্যা গেছে গা । ঘুমামু কেমনে এইহানে ?

– হুম । ঠিক আছে । আজকের রাতটা তুমি ড্রইং রুমেই বিছানা পেতে নাও ।

– তা নাইলে অইলো । কিন্তুক ডেইলি ডেইলি ইমুন রাইত দুইফরে দিগদারী করলে হেনে কাম করমু কেমনে , কন ম্যাডাম ?

– না চাইলে করবে না কাজ ! তোমার পাওনা বুঝে নিয়ে কাল সকালেই চলে যেতে পারো ইচ্ছা করলে ।

খাইছে ! একি বলে ম্যাডাম ! কোথায়  বেতন টেতন বাড়াবে তার এই অভিযোগ শুনে , তা না ! এখন দেখি এতো লোভনীয় মাসোহারার চাকুরীটাই চলে যাবার দশা ।

– আমি কি চাকরী ছাড়ার কথা কইছি নাকি ম্যাডাম ।

তাড়াতাড়ি নিজের ভুল সামাল দেবার চেষ্টা চালায় নাজু ।

– হয়েছে । এখন আর কোন কথা শুনতে চাই না । তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ষ্টোর রুম থেকে তোমার লেপ – তোষক নিয়ে যাও । আমি বের করে রাখছি ।

স্বভাবসুলভ গম্ভীর ঠান্ডা কন্ঠে কথাগুলো বলেই বেরিয়ে যায় অনু । এই ঘরে অবস্হানের পুরোটা সময় শ্বাশুড়ীর দিকে একবারের বেশি দুইবার তাকায়নি । কথাও বলেনি প্রয়োজন মনে করেনি বলে ! প্রয়োজন ছাড়া বাড়তি কথা বলা ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন অনুর একেবারেই অপছন্দ !

( চলবে )

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top