Today 12 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

সবার উপরে মানুষ সত্য

: | : ২২/১২/২০১৩

১কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক
কে বলে তা বহুদূর
মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক
মানুষে সুর অসুর

মনে মনে এই লাইন গুলি আবৃত্তি করছে শফিক।দীর্ঘ আট বছর পরে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশ এর পথে রওয়ানা করছে মা বাবাকে দেখার জন্য। প্লেন বাংলাদেশ এর মাটি ল্যান্ড করার পথে। সে খুব উত্তেজিত। আবেগ এ তার চোখে পানি চলে আসছে বারবার। কতদিন পরে এ দেশ টা কে দেখছে মা বাবাকে দেখবে সব আপনজনকে দেখবে।

তারা চার বন্ধু একসঙ্গে এবার এর কোরবানির ঈদ করতে এসেছে বাংলাদেশ এ। হাসান, সাহাজান,অলিদ ও একইসঙ্গে এসেছে।

প্লেন ঢাকা র ভূমি স্পর্শ করলো। সবাই যে যার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে যার যার বাড়িতে রওয়ানা হলো। শফিকের এর বাড়ি ফেনী তে। যতই বাড়ি র কাছাকাছি আসছে ততই সে উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছেনা আনন্দে।

ঐতো ঐতো দেখা যাচ্ছে মাকে বাবাকে

আহারে আমার মা কতদিন পরে তোমাকে দেখছি আবেগে এ তার কন্ঠ কেপে যাচ্ছে।

ট্যাক্সি এসে থামল তার বাড়ির সামনে। মা আনন্দে কাদতে শুরু করলো, ছোট ছোট ভাই বোন্ এর চোখ অশ্রুস্বজল

ভাইয়া কতদিন পরে তোমাকে দেখলাম তুমি শুকিয়ে গেছ ভাইয়া। সবাই এসব কথা আলাপ আলোচনায় আসতে আসতে ঘরের ভিতর ঢুকলো।

অনেকদিন পরে শফিক নদীতে গিয়ে সাতার কাটল প্রানভরে। দুপুরে খেতে এসে দেখে বিশাল আয়োজন। যত ধরনের রান্না করা যায় মুরগির মাংশ, কই মাছ , পালং শাক দিয়ে চিংড়ি, শুটকি মাছ , ডালের চচ্চরি ,পুটি মাছ, গরুর ভুনা ,ডিমের কারি।

আম্মা কতদিন ধরে এগুলি রান্না করছ ? তোমারে আমার সাথে নিয়ে যেতে হবে। মাঝে মাঝে রান্না করার কষ্টের জন্য না খেয়ে শুয়ে থাকি।

এটা করিসনা বাবা কিছু একটা অবশ্যি খাইয়া ঘুমাবি। মা বলে মমতায়।

মাঝে মাঝে একেবারে সময় থাকেনা মা বারো ঘন্টা কাজ করে এত টায়ার্ড থাকি ইচ্ছে করেনা।

২ বিকাল এ একটু হাটতে বের হলো তার ছোটবেলার দুইবন্ধুকে নিয়ে আশা গ্রাম টা একবার দেখবে ঘুরে ঘুরে।

বাশ ঝাড় এর কাছাকাছি আসতে প্রায় হোচট খেয়ে পড়তে গেল কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে।

কি এটা দেখতে গিয়ে ও আল্লাহ এত মানুষ এভাবে পড়ে আছে কেন?

তার বন্ধু সাহাজান বলে সরে আয় সরে আয় এ বেটার যক্ষা তারপর কুষ্ঠ নাকি আছে।

লোকটি আস্তে আস্তে গান গচ্ছে শোনা যাচ্ছে

মরিলে কান্দিসনা আমার দায় যাদুধন
মরিলে কান্দিসনা আমার দায়।

মানে কি তোরা একটা অসহায় অসুস্থ লোকরে এভাবে ঘরের বাহিরে ফালায় রাখছিস ? রাগে আর কষ্টে সে উচ্চারণ করলো।

আমরা কি করব বল তার বাড়ি থেকে এখানে আইনা ফালায় রাখছে।

তোরা কিছু না করিস হাসপাতাল এ ফোন করলে তো ওরা আইসা নিয়া যায়।

কার এত মাথা ব্যথা বল? সবাই নিজের পেটে র ভাত জোগাড় করতে দমবন্ধ। তুই আছিস ভালো শহর এ টাকা পয়সা পাছ , তোর্ এখন এসব মায়া হইব। আমাদের কে মায়া করে বল প্রতিদিন এর ভাত জোগাড় হয় অনেক কষ্টে।

এসব বলে মানুষের দায়িত্ব তুই অস্বীকার করতে পারিসনা।

এই এখানে কোন ট্যাক্সি আছে শফিক জোরে হাক দিল তাড়াতাড়ি সে এই মুমুর্ষ কে কোলে নিয়ে ট্যাক্সি তে বসালো এবং হাসপাতাল এর দিকে রওয়ানা হলো।

হে আমার আল্লাহ কিছু একটা কর আমার এই অসহায় দেশ আর তার মানুষগুলোর জন্য।

অসহায় রুগীটি কৃতজ্ঞতায় তার দিকে তাকিয়ে রইলো।

৩ প্রায় ঘন্টা খানিক শফিক এই ক্লিনিক এর বারান্ধায় হাটাহাটি করছে এ হতভাগ্য রোগী টিকে নিয়ে। এখন না দেখছে কোনো ডিউটি ডাক্তার অথবা কোনো নার্স অর কোনো ওয়ার্ড বয়। হতভাগ্য রোগীটির এখন সিভিয়ার এপিলেপ্সি র প্রকোপ দেখা দিয়েছে। শফিক তাকে ধরে রেখে ও কিছু করতে পারছেনা। এর পাশে একজন নার্স চলে যাচ্ছে। তার কোনো ভ্রুক্ষেপ ও নাই। সফিক এইযে এইযে ডাক দিলেও সে খুব দ্রুত চলে গেল আসছি বলে। এরপর ও প্রায় আধাঘন্টা হয়ে গেল এখন কার ও কোনো খবর।

তার এর এবার ধৈয্য চুতি ঘটে গেল হাসপাতাল এ কি অবস্থা নাকি, রোগী বাচাতে এসে উল্টা মনে হচ্ছে মরে যাবে। সামনে রিসেপশন এ যে মেয়েটা বসে আছে সেখানে এসে দাড়ালো। সে সচরাচর কারো সাথে অভদ্র ভাবে কথা বলেনা। আজকে তার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেছে সব কান্ডকারখানায় এদের কাছে মানুষের জীবনের দাম এত কম?

সামনে রিসেপশন এর মেয়েটিকে অভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করলো যেটা সে কখন ই করেনা

আপনার এখানে কাজ টা কি আমাকে বলবেন ? কতক্ষণ পরে মেক আপ করা জিজ্ঞাসা করলো অত্যন্ত কড়া স্বরে।

মেয়েটি হটাৎ করে হকচকিয়ে গিয়েছে এরকম আক্রমনে।

তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল হেসে
আপনাকে কিভাবে হেল্প করতে পারি সেটা বলুন ।

দেখা যাচ্ছে মেয়েটি বেশ স্মার্ট তার কথা বা ধরনে কিছু মনে করেনি ।

মেয়েটি জিজ্ঞাসা করলো আপনি এতক্ষণ ফর্ম পূরণ না করে দাড়িয়ে ছিলেন কেন?

আপনারা তো কেউ এসে জিজ্ঞাসা করতে পারতেন। এটা তো আপনাদের দায়িত্ব তাই না? শফিক কিছুটা বিব্রত হয়ে বলল।
আলাদা ভাবে সবাইকে গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হয়না , সবাই তো এখন সমান গুরুত্বপূর্ণ। সবাই অসুস্থ। মেয়েটি বলল হেসে।
যাক মেয়েটি মনে হচ্ছে কিছু মনে করেনি।

শফিক ফর্ম ফিলাপ করতে করতে লোকটি র পরিচয় পেল। শফিক দের পাশের বাড়ি ভুইয়া বাড়ি র পাশে এই লোকটির বাড়ি। তার স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে স্ত্রী নাকি তাকে তালাক দিয়ে পাশের গ্রামের আরেকজন কে বিয়ে করে চলে গেছে। তার দুই ছেলেমেয়ে। লোকটির নাম রফিক।

ঘরে এসে ঢুকা মাত্র মা বাবার প্রশ্ন বান কোথায় ছিলি এতক্ষণ কি ব্যাপার ?কেন তুই এসব ব্যাপার নিয়ে নাক গলাতে যাস ?

ছোট আসাদ আর আরিফা বসে আছে মায়ের চুলার সামনে। মা আজকে চিতল পিঠা বানাচ্ছে খেজুর গুর দিয়ে খাবে। অনেকক্ষণ ধরে মরিয়ম চুলায় আগুন দেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু চুলা কুয়াশায় ভিজে আছে আগুন ধরছেনা।

ভিতর থেকে তাদের দিনমজুর সৎ বাবা ঘ্যান ঘ্যান গলায় বলতেছে কই তোমার পিঠা কদ্দুর বেটি কোনো কামের না খালি বিয়া করতে পারে।

এই সময় শফিক এসে তাদের উঠানে পা রাখল।

নাম ধরে ডাকা মাত্র একজন খুব স্বাস্থ্যহীন বিশ বাইশ বছরে র মেয়ে মাথায় কাপড় দিয়ে এসে দাড়ালো, তার সাথে ছোট দুই ছেলেমেয়ে।ভিতর থেকে এক লোক খুব অসুস্থ রুগ্ন চেহারার দেখে মনে হচ্ছে এই লোক অনেক কষ্টে তার প্রাণ টা ধরে রাখছে।

সে কিছু বিসকুট মুড়ি কলা আর কিছু বাজার যা সামনে পেয়েছে এদের জন্য এনেছে ছোট ছেলেটি খপ করে হাত থেকে বিসকুট আর কলার প্যাকেট টান দিয়ে নিয়ে দৌড় দিল। মা এসে কান ধরে নিয়ে এসে থাপ্পর দিল।

তার পরিচয় দিতে যত্ন করে বসালো চা বানালো অনেক কষ্ট করে, ভাঙ্গা একটা কাপ এ চা দিল আর তার আনা বিসকুট দিয়ে।

বাচ্ছা দুইটাকে নেওয়ার কথা বলতে অসহায়ের মত বলল ভাইজান তার তো শরীর ভালো না, ভাইজান গো আমার তেনার লাগি অনেক মায়া লাগে বাছাগুলার লাগি তেনারে ছাড়ি আসছি।

ওনার চিকিৎসা হচ্ছে আর ভয় নাই শফিক সাহস যোগানোর সুরে বলল।

ভাইজান আপনি কতদিন এখানে থাকবেন মরিয়ম জিজ্ঞাসা করলো।

এইত পাচ ছয় মাস।

ভাইজান আমার একটা কাজ করবেন এই মানুষটা সুস্থ হইলে তারে একটা ভালো মেয়ে দেখি বিয়া দিয়ে দিবেন বলে আবেগে শফিক এর হাত ধরে ফেলল।
আহ আমার দেশের এই গরিব মানুষ গুলো এত অসহায়, তারপর ও হৃদয় থেকে আবেগ এখন ও মুছে যায়নি।

তার আনা বাজার দিয়ে রান্না করলো তারপর তাকে খাইয়ে যখন ছাড়ল তখন বেলা পড়ে গেছে প্রায় বিকাল পাচটা বাজে।

শফিক বাচ্ছা দুটোকে নিয়ে যখন হাসপাতাল এ আসল তখন আবার তার এপিলেপ্সির প্রকোপ দেখা দিল ,বাছা দুটো ভয় পেয়ে কেবিন থেকে পালিয়ে বারান্ধায় এসে দাড়ালো। অসহায় বাবা তার অসহায় চোখে তার বাছাগুলোকে নয়ন ভরে দেখতে গিয়ে সফলকাম হলনা।

শফিক এর চোখে পানি এসে গেল।

আস্তে আস্তে লোকটি সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে।হাবিব প্রতিদিন তার দুই ছেলেমেয়েকে হাসপাতাল এ সকালে নিয়ে আস এবং সন্ধায় বাড়ীতে পৌছে দিয়ে আসে।এখন আস্তে আস্তে বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়ে দুটোর ভাব হয়ে গেছে।

আস্তে আস্তে সময় গড়িয়ে আসে।শফিকের যাওয়ার সময় এগিয়ে আসে।তার মা বাবা রফিককে তাদের বাড়ীতে আশ্রয় দিল।পাশের গ্রামের একটা মেয়ে দেখে তার বিয়ে পড়িয়ে দেওয়া হল।তাকে ছোট একটা ছনের ঘর তুলে দেওয়া হয়েছে।তাকে দেখলে এখন একজন সুখী গৃহস্থের মত মনে হয়।সেই প্রথমদিনের যক্ষা রোগী বলে ভাবার কোন উপায় নাই।আল্লাহ তাকে দয়া করেছেন।বছর ঘুরতে তার এক সন্তান জন্ম দিল।এসব খবর সৌদি আরবে বসে জানতে পারল রফিকের লেখা কাচা হাতের চিঠিতে।চিঠির সঙ্গে তার সন্তানের ছবি।

আহ সে তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে মনে মনে।সে যদি সেদিন তাড়াতাড়ি হাসপাতালে না নিয়ে যেত এত সুন্দর একটা প্রান এই আনন্দ টা কি সে পেত।মনে মনে আল্লাহ কে বলে আমার অনুপস্থিতিতে দেখে রেখ আমার দেশের আর ও সব অসহায় মানুষদের।সে ভাবে আমার দেশে কত সামর্থ্যবান মানুষ আছে আমার মত বা আামার চেয়ে বেশী সামর্থ্যবান মানুষ তাদের সামান্য দানে নিজের জায়গা থেকে সামান্যতম সাহায্য যদি করত তবে এই দেশের অবস্থা পরিবর্তন হয়ে যেত রাতারাতি।

সমাপ্ত।

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top