ধারাবাহিক উপন্যাস “নিয়োগ পত্র” – ঊনবিংশ পর্ব
উনবিংশ পর্ব
(বিশ)
– ডক্টর শুনুন।
– কিছু বলবেন।
– আপনি একটু আমার পাশে বসবেন। আমি বেশী বিরক্ত করবো না। আমার অনেকগুলো কথা কাউকে বলা হয়নি। শুধু আপনাকে বলতে চাই। দয়া করে শুনবেন?
– দেখুন তিমির বাবু, শুনতে আমার আপত্তি নেয়। কিন্তু—
– তবে বসুন প্লিজ। তিমির ঘাড়টা উঁচু করে ঠেস দিয়ে বসার চেষ্টা করে।
– না। আপনি ভুলে যাবেন না আপনি খুব অসুস্থ। ঠিক সময়ে হাসাপাতালে না এলে বাঁচানো কঠিন হয়ে যেতো। আপনার এখন কথা বলা সম্পূর্ন নিষেধ। পূর্ন বিশ্রাম দরকার।
– তবে আপনি যে বললেন।
– আমি না করছি না।
– আর একটু সুস্থ হয়ে উঠুন। তারপর আপনার সব কথা শুনব। এখনও বিপদ কাটেনি।
– ডক্টর এত কষ্ট নিয়ে কখনও মানুষ বাঁচতে পারে। আমি মনে হয় বেশীদিন বাঁচবো না। তার আগে আমার কথাগুলো আপনাকে বলে যেতে চায়।
– বাজে কথা বলবেন না। কে বললো বাঁচবেন না। তাহলে আমরা আছি কি জন্য।
– স্রেফ চাকরী বাঁচানোর জন্য।
– প্লিজ কথা বলবেন না। চুপ করুন। আমার অন্য পেসেন্ট আছে। আমি চল্লাম। নার্স থাকল। প্রয়োজন হলে ডাকতে বলবেন। আর আমি কথা দিচ্ছি আমি আপনার কথা শুনব। তবে আর কটা দিন যাক।
ডাঃ মিজানুর রহমান। বয়স খুব বেশী নয়। বেটে খাটো মানুষ। ফর্সা সুন্দর মুখ। বেশ নাম ডাক হয়েছে। এই হাসপাতালে ডাঃ মিজানকে সবাই সম্মান করে। তিন নম্বর কেবিনের দিকে যাওয়ার সময় নার্সকে বলে গেলেন ঐ পেসেন্টের দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। একটু মানসিক সমস্যা আছে। প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকবেন। তিমির আবার হাত উঁচিয়ে ডাক্তারকে ডাকতে চাইল। নার্স এসে থামিয়ে দিল। বলল উনার অন্য পেসেন্ট আছে। আমি আছি। আমাকে বলুন।
– আচ্ছা আমার অসুখটা খুব কঠীন, না সিস্টার। আমি বোধ হয় বাঁচব না।
– আপনাকে কে বলল।
– আমার মনে হচ্ছে।
– অসুখ হলে ওরকম সবারই মনে হয়।
– না সিস্টার। অসুখ বলে বলছি না। অনেক টাকার দরকার। মা বাবা সবাই কাঁদছে দিন রাত। ভাইটা টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। আমি কারও জন্য কিছু করতে পারলাম না। বড় দুঃখ রয়ে গেলো।
নার্সের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। ইউনিফর্ম-এর হাতায় চোখ মুছে নিল। অবাক হয় তিমির। কি ব্যাপার আপনি কাঁদছেন কেন। আপনারা কাঁদলে রোগীদের ভরসা কোথায়। অস্বীকার করল নার্স। কই না তো। চোখের কোনায় কি যেন একটা পরেছে। তাই চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছিল। আপনার কিচ্ছু হবে না। এত ভাবলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন কি করে। আপনি শুয়ে থাকুন বলে দ্রুত অন্য সীটের দিকে এগিয়ে যায় নার্সটি।
ডাঃ মিজান আবার আসে। সময় পেলেই এসে একবার দেখে যায়। মাথায় হাত রেখে সান্তনা দিয়ে বলে,
– কি তিমির বাবু এখন কেমন বোধ করছেন।
– একটু ভালো। আমার একটা অনুরোধ রাখবেন।
– বলেন। তবে খুব সংক্ষেপে। আমার হাতে সময় বেশী নেয়।
তিমির ডাক্তারের হাতটা চেপে ধরে বললেন- আপনি জানেন না স্যাঁর, আমাদের পরিবারের শেষ সম্বল বলতে একটা দুধেল গরু আর একটা বাছুর। শুনছি আমার চিকিৎসার জন্য ওগুলোও বিক্রি করে দিচ্ছে। বাড়ীর পাশে বড় শিশু গাছটা বিক্রি করে দিয়েছে পাঁচ হাজার টাকায়। গরু গুলো বিক্রি করে দিলে আমাদের আর কিছুই থাকবে না। কেবল আপনিই পারেন এই শেষ সম্বলটুকু রক্ষা করতে। প্লিজ স্যাঁর। আপনার দু’টি পায়ে পরি। আপনি শুধু বলবেন গরু বিক্রি করতে হবে না। আমি ভালো হয়ে যাবো। আমার আর চিকিৎসার দরকার হবে না।
ডাক্তার হাতের উপর হাত রেখে আশ্বস্ত করলেন-ঠিক আছে আমি চেষ্টা করবো যাতে গরু বিক্রি করতে না হয়। এবার আপনি চুপ করে শুয়ে থাকুন। তিমিরের চোখে মুখে প্রশান্তির ছায়া পরল। আত্মতৃপ্তির রেশ টেনে মনে মনে বলল-আমি আপনার কাছে চির ঋনী হয়ে থাকবো। সত্যিই আপনি অনেক মহৎ।
বাইরে আকাশের বুকে এক ফালি চাঁদ। কাঁচের জানালা দিয়ে ষ্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একদিকে কর্তব্যরত দু’জন নার্স পরষ্পরের সাথে কথা বলছে। সম্ভবত তিমিরকে নিয়ে কিছু বলছে। পাশের রোগীরা অনেকে ঘুমিয়েছে। বিশ নম্বর বেডের একজন পেসেন্টের খুব ঘন ঘন শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল। একজন নার্স দ্রুত উঠে এসে অক্সিজেন মাক্স পরিয়ে দিল। এখন কিছুটা স্বাভাবিক।
হাসপাতালের সোঁদা গন্ধটা তিমিরের মোটেও ভালো লাগে না। হাসপাতাল, থানা, কোর্ট তিনটার যেন একই চিত্র। স্বাভাবিক জীবনটাকে দুর্বিসহ করে তোলে। আজ অন্য রকম লাগছে। হাসাপাতালের বিশ্রি গন্ধটাও বড় ভালো লাগছে। সীটের নীচে পেশাব করার ডাবরটা আছে। তীব্র কর্কট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তলপেটের নীচের অংশটা ভারী হয়ে আসছে। যুবক মানুষ। নার্সদের সামনে এ কাজটা করতে খুব লজ্জা হচ্ছে। কষ্টও সহ্য করতে পারছে না। ডাক্তার যাওয়ার পর অনেকটা সুস্থ বোধ হচ্ছে। ভালো ডাক্তাররা নাকি শুধু কথা আর সেবা দিয়ে রোগীকে অনেক বেশী সুস্থ করে তুলতে পারে। রোগীরা সেই সব ডাক্তারদের পূজা করে। তিমির মাথা তুলে পেছনে হেলান দিয়ে বসতে চেষ্টা করে। উঠতে গিয়ে অস্ফুট শব্দ হয়। একজন নার্স ছুটে এসে বলল-
– এ কি, আপনি উঠলেন যে।
– ঘুম আসছে না সিস্টার। একটু বাথরুমে যাবো।
– না না, আপনি বাইরে যেতে পারবেন না। আমরা বরং বাইরে যাচ্ছি।
তিমির আর লজ্জা করেনি। উপুড় হয়ে ডাবরটা রাখতে গিয়ে কিছুটা জলীয় পদার্থ ফ্লোরে ছিটকে পরে। বালিশে মাথা রাখতে গিয়ে আবার প্রচন্ড ব্যাথায় ককিঁয়ে উঠে। রোগীর সেবাই সতত সজাগ। তাছাড়া ডাক্তারের বিশেষ নির্দেশ। ছুটে আসে দু’জনেই।
– কি হয়েছে আপনার।
– ব্যাথাটা মনে হয় বেড়েছে।
সিস্টার তিমিরের বুকে হাত রাখে। লোমশ বুকে মৃদু চাপ দেয়। জিজ্ঞাসা করে-
– ডাক্তার ডাকবো।
– না থাক। ডাকতে হবে না। একটা অনুরোধ রাখবেন।
– বলুন।
– আমাকে একটু ঐ জানালার পাশে একটু দাড় করিয়ে দেবেন। কিছুক্ষন দাড়াবো। হয়তো ভালো লাগবে।
– আপনি ভীষন অসুস্থ। দাড়াতে পারবেন না।
– তাও জানি সিস্টার। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছেন। শুনেছি মাদ্রাজ পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। কিন্তু অত টাকা পাবো কোথায়।
– আপনি ভূল শুনেছেন। স্যার বলেছেন আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। উনি খুব ভালো ডাক্তার।
– সত্যি উনি খুব ভালো ডাক্তার। আমাকে আপনারা মিথ্যে সান্তনা দিচ্ছেন। আসলে কি জানেন, জীবনের অন্তিম মুহুর্তে কারো না কারও সকরুন সান্তনা বড় ভালো লাগে। আমাকে একটু ধরবেন। আমি জানালায় দাড়াবো।
সিস্টার ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। তিমিরের জন্য খুব মায়া হচ্ছে। তিমিরের চোখ দু’টো উদাসীন। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারে না। দুটি হাতের তালুতে ভর দিয়ে উঠে বসতে চেষ্টা করে। যেমনটি স্বেচ্ছায় দাড়াতে চেয়েছিল জীবনের কঠিন মুহুর্তগুলির মুখোমুখি। কারও একজনের সাহায্যের হাত খুব প্রয়োজন ছিল। তবে সে হাত সিস্টারের নয়। প্লিজ আমাকে একটু ধরুন। শুধু কয়েক মুহুর্ত দাড়াবো। সুন্দর জোৎস্নাটা একটু দেখব। কত সুন্দর এ পৃথিবী বলে হাত দুটো বাড়িয়ে দিল।
চলবে……