Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

সালিশিনামা (ধারাবাহিক গল্প-৬)

: | : ০৩/০১/২০১৪

চেয়ারম্যান সাহেবের বাঁ পাশে বসা মোকাররম হোসেন এতোক্ষণ একটি কথাও বলেননি। তিনি বিনিত ভাবে বললেন, ‘মেয়েটা না হয় ঘরে চলে যাক চেয়ারম্যান সাহেব। যেহেতু জব্বার মিয়া নিজেই উপস্থিত আছে, তখন তার আর কি দরকার ?’
চেয়ারম্যান সাহেব তাৎক্ষণিক মাথা নেরে সম্মতি দিলে কল্পনা সভা থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। সেদিকে সবাই একবার তাকালো। তারপর চেয়াম্যান সাহেব খুক খুক করে একটু কেশে নিয়ে গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘ঘটনা যা ঘটেছে তা তো আমরা সবাই জানলাম এবং শুনলাম। এ নিয়ে নতুন করে কথা বলার আর প্রয়োজন দেখি না। ও রকম বয়সে ছেলে মেয়েদের এমনটা করা অস্বাভাবিক নয়। তবু এর একটা বিহিত করা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব। এসব নিয়ে মামলা মোকদ্দমা করা ভাল কাজ নয়। এতে যতটা না অর্থের ক্ষতি হবে তার চেয়ে বেশি হবে সম্মানের। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করা সবচেয়ে উত্তম। তাই যেহেতু এখানে আমি একা নই, এলাকার মান্যগণ্য ব্যক্তিরাও আছেন। আমরা সবাই একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আশা করি আপনারাও তা মেনে আমাদের সম্মান রাখবেন। তবে সেটা যদি আমরা আমাদের একজন মুরব্বির মুখ থেকে শুনি তাহলে কি ভাল দেখায় না ? আমি আমাদের সকলের মুরব্বি হাজী কালাচান শেখকে অনুরোধ করছি রায় ঘোষনার জন্য।
চেয়ারম্যান সাহেব ব্যাক্তিগত ভাবে ঠান্ডা মেজাজের লোক। তাই তার কথাগুলো বেশ ঋজু শোনায়। শুনে উপস্থিত লোকদের হঠাৎ উৎকণ্ঠা বেড়ে যায়। না জানি কি শুনবে তারা। তবে তার মেজাজ সম্পর্কে যারা জানে তাদের মনে কিছু আশার সঞ্চার হয়। ভাবে হয়তো সঠিক বিচারই পাবে তারা। কিন্তু হাজী সাহেব যখন বলেন, ‘যেহেতু মেয়েটার স্বামী সংসার আছে তাই আমরা ভেবেছি কিভাবে তার সেই সংসার ঠিক রাখা যায়। কারণ, কোন কিছু ভাঙ্গা সহজ গড়া কঠিন।’ চেয়ারম্যানের কথায় যাদের মনে তখন আশার সঞ্চার হয়েছিল তারা হঠাৎ নিরাশার দোলায় দুলতে থাকে। কিন্তু মুখে উচ্চারন করে বলতে পারে না, ‘হাজী সা’ব এটা কেমন কথা !’ পর্যায়ক্রমে হাজী সাহেব বলতে থাকেন, ‘আমরা অনেক দিক বিবেচনা করে ছেলে পক্ষের উপর জরিমানা নির্ধারন করেছি। সেই টাকা আমরা নিজ দায়িত্বে মেয়ের হাতে দিবো যাতে সে তার স্বামীর সংসার করতে পারে। কারণ, প্রথম বিয়ের সংসার ভেঙ্গে গেলে দ্বিতীয় বিয়ের সংসারে সুখ হয় না। তাই তার সুখের কথা বিবেচনা করে ত্রিশ হাজার টাকা জরিমানা নির্ধারন করেছি আমরা।’
হাজী কালাচান শেখের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা হাত তালি দিয়ে উঠলো। কিন্তু সামনের দিকের লোকেরা কেউ হাত তালি দিলো না। তবে বিচ্ছিন্ন ভাবে দু’চার জন লোক কি ভেবে হাত তালি দিয়ে উঠেই তাল হারিয়ে ফেললো। তারপর কয়েক মূহুর্ত পিনপতন নিরবতা। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে হঠাৎ নিরবতা ভেঙ্গে হাউ মাউ করে জব্বার মিয়া ডুকরে কান্না জুড়ে বসলো। সাত্তার মিয়া তার স্বভাব সুলভ ভাষায় রায়ের বিরুদ্ধে আস্ফালন শুরু করলে জাফর সন্ডল তাকে জাপটে ধরে সভার বাহিরে নিয়ে গেলো বুঝানোর জন্য। আমজনতার মধ্যে শোরগোল শুরু হলে অনেকক্ষণ ধরে ধমক খেয়ে বসে থাকা দিনমজুর ওমেদ আলী তার বয়সের অক্ষমতাকে উপেক্ষা করে বারুদের মতো জ্বলে উঠলেন। যদিও এতো গুলো লোকের মধ্যে আর একটি লোককেও জ্বলে উঠতে দেখা গেলো না। কিন্তু তিনি একাই ছড়ি হাতে উঠে এসে চেয়ারম্যানের মুখের উপর যথাসম্ভব গলা ফাটিয়ে বলতে লাগলেন, ‘এটা কেমন বিচার করলেন চেয়ারম্যান সাব ? একটা মেয়ের ইজ্জতের মূল্য ত্রিশ হাজার টাকা ?’
ত্যাক্ত-বিরক্ত মুখে চেয়ারম্যানের মুখের পানে একটা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ওমেদ আলী। যে দৃষ্টিতে শুধুই ঘৃণা আর বিদ্রোহ। তবে হাজী সাহেবের দিকে একবারও তাকান না। চেয়ারম্যান সাহেব তার কোন কথার উত্তর দিতে পারেন না।
এ সমাজে কিছু হতভাগ্য মানুষ সব সময়ই জন্মে, যাদের ভাল বা মন্দে, পছন্দে বা অপছন্দে সমাজের কিছুই এসে যায় না। তাদের মতামতের যেমন গুরুত্ব নেই তেমনি নেই সম্মানেরও। কারণ তারা বিত্ত-বৈভবহীন। যেখানে বিত্তবান শাসিত সমাজ ব্যবস্থা প্রচলিত সেখানে বৃদ্ধ ওমেদ আলী একজন দিন মজুর মাত্র। আর তারই চোখে যদি ধরা পড়ে সমাজের কোন অসঙ্গতি, আর সে অসঙ্গতি যদি বেরিয়ে আসে বিত্তবানের মধ্য থেকেই তবে তার গুরুত্ব দিবে কে ?
কথাটা হয়তো বিত্তবান প্রভাবশালীদের আত্মায় খোঁচা দিতে পারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, দিন মজুর ওমেদ আলীর এমন একটা যুক্তি সঙ্গত প্রশ্নের উত্তর কেউই দিতে পারলেন না। এমনকি ভবিষ্যতের শত্রু হবার ভয়েই হোক অথবা চক্ষু লজ্জার কারণেই হোক অথবা পক্ষপাতের কারণেই হোক তার কথাটা দু’চার জন গ্রামবাসি ধরেও বসলো না। কিন্তু বিচারকদের সামনেই রইচ কেরানী হুংকার দিয়ে বললেন, ‘এই ভিখিরির বাচ্চা বলে কি রে ?’ অমনি তার অনুগত লোকেরা তেড়ে এলো ওমেদ আলীকে মারতে। অবশেষে বিচারকরাই মধ্যস্থতা করে মার থেকে বাঁচালেন তাকে। কিন্তু তবু ওমেদ আলী ভীত নন। বরং তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন বীরের মতো।

(চলবে..)

১ম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

২য় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

৩য় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

৪র্থ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

৫ম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top