সালিশিনামা (শেষ পর্ব)
সভাময় বিশৃংখলা শুরু হলে আমজনতা রণে ভঙ্গ দেয়। মারামরি-কাটাকাটি লাগতে পারে এই ভয়ে যে যার মতো কেটে পড়া শুরু করে। তবে এতক্ষণ যারা বিচারের রায় নিয়ে কোন মন্তব্য করার সাহস পায়নি, তারা এবার যেতে যেতে ওমেদ আলীর ঔদ্ধত্য নিয়ে কড়া মন্তব্য করতে দ্বিধা করে না। কে একজন এগিয়ে এসে জব্বার মিয়ার হাত ধরে রইচ কেরানির বারান্দায় নিয়ে যায়। সেখানে বিচারকরাও একে একে গিয়ে বসতে শুরু করেন। হয়তো এখন সেখানে একজন দিন মজুরের কন্যার ইজ্জতের মূল্য লেনদেন হবে।
এক সময় ক্ষোভ শীতল হয়ে এলে বিক্ষুব্ধ ওমেদ আলী খেয়াল করেন তার আশে পাশে এমন কি উঠোন জুড়ে একটি লোকও নেই। হ্যাচাকের আলো কমে এসেছে। রাতও গভীর হয়েছে। এক সময় গভীর রাতের ঘন অন্ধকার ভেদ করে বয়সের ভাড়ে ক্ষয়ে আসা চোখের ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে কেরানির বারান্দার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের বাড়ির দিকে হাটতে থাকেন ওমেদ আলী। রইচ কেরানির উঠানের শেষ প্রান্তেই লোকদের চলাচলের রাস্তাটার ধারে মোক্তব ঘরের পাশেই তার কুঁড়েঘর খানা। তিনি যেতে যেতে জব্বার মিয়ার স্ত্রী আর মেয়ের বিলাপ করা কান্না শোনেন। তবে ওদের কান্না তাকে যতটা না ব্যথিত করে, তার চেয়ে বেশি ব্যথিত করেছে সমাজের ভূমিকা।
ওমেদ আলী ঘরে ফিরে দেখেন তার শিয়রের কাছে জ্বালিয়ে রেখে যাওয়া হারিকেনটা কেরোসিনের দৈন্যতায় নিবু নিবু করছে। দরোজাটা কোন রকমে ভেজিয়ে দিয়ে আবছা আলোয় বহু পুরোনো ছেঁড়াফাঁড়া ময়লাচ্ছন্ন কাঁথাখানি গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু কিছুতেই তার ঘুম এলো না। বার বার তার মনে হতে লাগলো, ‘এটা কেমন বিচার ! গাঁয়ের লোক গুলোই বা কেমন !’ তবে একবারও তার মনে হয় না যে, তিনি একজন গরীব দিন মজুর। গাঁয়ের দশজনে তাকে কাজে না নিলে তার অন্ন জুটবে না। তাই সমাজের ন্যায়-অন্যায় নিয়ে তার মাথা ঘামানো উচিৎ না। এই সমাজ নিয়ে তার মতো কাঙ্গালের না ভাবলেও চলবে।
সালিশি সভায় উপস্থিত লোকেরা বাড়ি ফিরে কে কি ভাবলো জানি না, তবে ওমেদ আলীর ভাবনা যেন শেষ হয় না। ভাবতে ভাবতে এক সময় রাত যে ফুরিয়ে যায় তা সে জানেই না। হঠাৎ এক সময় মসজিদের মিনার হতে মুয়াজ্জিনের কন্ঠ ভেসে এলে তিনি সচকিত হয়ে নামাজের জন্য বিছানা ছেড়ে তড়িঘড়ি উঠে পড়েন। তারপর নামাজের অযু করবার আগে পানির বদনাটা নিয়ে পাড়ার পিছনের ভিটেটায় যান পায়খানা সারতে।
রাস্তা থেকে ভিটেতে ঢুকবার মুখেই ফইমুদ্দির কাঁচামিঠা আম গাছটা সামনে পড়ে। সেখানে পৌঁছে একটু দম নেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বমুখি হয়ে কোমরটা টান করে দাঁড়াতেই তিনি বিকট এক চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
তখনো রাত খুব ফর্সা হয়নি। সালিশি বৈঠক থেকে মধ্য রাতে ঘরে ফেরা লোকেরা গভীর নিদ্রায় কেবল মগ্ন। যারা নামাজ পড়েন তারা সবেমাত্র জেগেছেন। হয়তো নামাজের অযু করবার প্রস্তুতিও নিয়েছেন কেউ কেউ। বিকট চিৎকার শুনে তারাই প্রথম ছুটাছুটি শুরু করেন চিৎকারের উৎস আবিস্কারের জন্য। যারা নিদ্রায় মগ্ন ছিলো তারা ধড়মড় করে উঠে অজানা আশংকায় দ্বিগবিদ্বিগ ছুটতে আরম্ভ করে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তারা জেনে যায় ঘটনা বাড়ির পিছনে ভিটেটার দিকে। সেখানে গিয়ে তারা দেখেন বৃদ্ধ ওমেদ আলী জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে আছেন। একপাশে কাত হয়ে পড়ে থাকা বদনাটা থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সবাই তাকে ধরে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু এ অবস্থা তার কেন হলো তা যেন কারো মাথাতেই ঢুকছে না। ততক্ষণে রাত অনেকটা ফর্সা হয়ে গিয়েছে। চিৎকারের কারণ আবিস্কারের জন্য ভীত সন্ত্রস্ত চোখে বিভ্রান্তের মতো সবাই এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। এমন সময় মধ্য বয়সী কালু মিয়া ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘ঐ যে !’ মূহুর্তে অসংখ্য কৌতুহলী চোখ একসঙ্গে তাকায় ঊর্ধ্বমুখে নির্দেশিত কালু মিয়ার হাতের আঙ্গুলের দিকে।
সেদিকে কাচামিঠা আমগাছটার অল্প উঁচু এক মগডালে গলায় লাল ওরনা পেচানো কল্পনার নিথর দেহটা ঝুলছে।
(সমাপ্ত)