বন্ধু
আমি বিরক্ত হয়ে এক প্রকার ধমকের সুরেই বললাম, ‘তুই কি যাবি আমার সামনে থেকে ?’
আমার ধমক শুনে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো জহির। আমি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম বাড়ির দিকে। সঙ্গে জহিরও ছিল। যেতে যেতে সে একই কথা বার বার বলছিল। বলছিল, ‘ ‘আমার চাকুরির কি হলো ? কিছু করলি ? খুবই বিপদে আছি।’ এ কথা সে বছর খানেক ধরেই বলে আসছে আমাকে। ওর হয়তো ধারনা চাকুরি আমার বাড়ির কোন গাছের ফল। আম, জাম, লিচু বা কলার মতো। চাইলেই একটা ফল ওকে আমি দিতে পারি। কিন্তু দিচ্ছি না। আসলে আমি দিতেও চাই না। কারণ, একটা চাকুরির জন্য নিজে একজন অফিসার হয়ে অন্য কোন অফিসারের কাছে মাথা নত করে কথা বলতে আমার খুব দ্বিধা হয়। আমার সংকোচ হয়। নিজেকে ছোট মনে হয়। আমি কারো জন্য নিজেকে ছোট করতে চাই না। যদিও আমার মুখের একটা কথায় ছোট খাটো একটা চাকুরি পাওয়া কোন ব্যাপারই নয়।
প্রায় তিন বছর ধরে আমি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে উচ্চ পদে চাকুরি করি। বেতন যা পাই তা নেহাৎ মন্দ নয়। ঢাকা শহরে দিব্যি চলেও বেশি হয়। উচ্চ পদের চাকুরির অনেক সুবিধাও আছে। সারা দিনের চা নাস্তা যখন যেমন খুশি অফিসেই খাওয়া যায়। কোম্পানির গাড়িতে করে চলাফেরা করা যায়। বেশ আরামেই আছি। প্রতি মাসে অন্তত একবার আমি বাড়িতে আসার চেষ্টা করি। সাপ্তাহিক ছুটির পাশে দু’দিন যোগ করে চাইলেই বাড়িতে আসা যায় দিব্যি। তারপরেও মাঝে মধ্যে সরকারী ছুটি তো আছেই। কিন্তু ইদানিং ছুটি ছাটায় বাড়িতে এলে খুব অসস্তিতে পড়ি আমি। প্রতিবেশি অনেকেই এসে বিরক্ত করে। কেউ বলে, ‘বাবা আমার ছেলেটার একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দাও।’ কেউ বলে, ‘ভাই আমাকে একটা চাকুরি নিয়ে দেন।’ যেমন জহিরও বলে।
গতকাল আবার ছুটিতে এসেছিলাম। এসেই আমার এক প্রতিবেশি সরকারী চাকুরিজীবি বন্ধুর সাথে দেখা। প্রায় এক বছর পরে তার সাথে আমার দেখা হলো। অনেকক্ষণ ধরেই তার সঙ্গে নানা রকম খোশ গল্প করছিলাম। সেও ছুটি পেয়ে বাড়িতে এসেছে। গল্প বলতে তার আর আমার চাকুরি জীবনের সফলতা-ব্যর্থতার গল্প আর কি। তার মধ্যে দু’একটা পারিবারিক গল্পও ছিল। গল্পের তো আর শেষ নেই ! নানা রকম গল্প শেষে সেই বন্ধুটি চলে যাওয়া মাত্রই জহির আমার পিছু নিয়েছিল। আর ঐ একটি কথাটিই বার বার বলছিল-‘আমার চাকুরির কি হলো ? কিছু করলি ? খুবই বিপদে আছি।’
যখন ঢাকায় চাকুরিতে থাকি তখনো মাঝে মাঝে এর তার মোবাইল থেকে জহির আমাকে ফোন করে ঐ এক কথাই বলতো। অবশ্য চাকুরিতে যোগ দেওয়ার প্রথম দিকেও জহির আমাকে ফোন করতো। সে সময় জহির গ্রামে কিসের যেন ব্যবসা করে আয় রোজগার করতো। তখন সে প্রায়ই ফোনে আমার খোঁজ খবর নিতো। অথবা আমার বাড়ির খোঁজ খবর আমাকে জানাতো। বাবা মারা যাবার খবরটা জহিরই প্রথম আমাকে দিয়েছিল। অথচ আমাকে বাড়ি থেকে জানানো হয়েছিল বাবা গুরুতর অসুস্থ। সত্য কথা বলতে জহির কখনোই দ্বিধা করতো না। কিন্তু বছর খানেক হলো ফোন করে ভাল-মন্দ খোঁজ খবরের পাশাপাশি জহির আমাকে চাকুরির কথা বলে আসছিল। কোম্পানির নানান কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। আমার চাকুরি খোঁজার সময় কোথায় ? তবু সে ফোন করে করে আমাকে অতিষ্ট করে তুলেছিল। জহিরের নিজের কোন মোবাইল ফোন নেই। তাই যে ক’দিন ঢাকায় থাকতাম অপরিচিত কোন নাম্বার থেকে ফোন এলেই আমার মনে হতো এই বুঝি জহির ফোন করেছে। ইদানিং তাই ওকে সামনে দেখলেই আমার ভিতরে এক ধরনের বিরুক্তি তৈরি হয়। যার ফলে আজ একটা ধমক দিয়েই বসলাম।
ধমক খাওয়ার পর হাবভাব দেখে মনে হলো জহির আমার বিরুক্তিটা বুঝতে পেরেছে। এখন চলে যাবে। আর সে এখন গেলেই আমি বাঁচি। কিন্তু, না। সে গেলো না। ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়েই রইলো।
আমাদের বাড়ি থেকে অল্প ক’টা বাড়ির পরেই জহিরদের বাড়ি। এতো কাছে যে ঘর থেকে বেরোলেই ওদের উঠোন দেখা যায়। ছেলেবেলায় জহিরদের উঠোনই ছিল আমার খেলার আখড়া। তাছাড়া ওদের উঠোনে একটা কাঁচামিঠা আমের গাছ ছিল। আমের সিজনে আমি সুস্বাদু সেই আমের জন্যই ওদের উঠোনে পড়ে থাকতাম সারাদিন। গাছের প্রায় অর্ধেক আম আমি আর জহির মিলে চুরি করেই সাবার করতাম। সেই গাছটা যদিও এখন আর নেই। দারুন অভাবের দিনে ওরা গাছটা বেচে দিয়েছিল। আমি সঙ্গে থাকলে প্রয়োজনে নিজের জিনিস নিজে চুরি করতেও জহির দ্বিধা করতো না। তখন নিজের চেয়েও জহিরকে খুব সাহসী মনে হতো আমার। আশে পাশের কোন বাড়িতে কোন কিছু খোয়া গেলেই দোষ পড়তো আমার আর জহিরের। আমার মা ভাবতেন জহির সঙ্গে থাকে বলেই আমি এতো রকম দুষ্টমি করে বেরাতে পারি। সে জন্য মা সব সময় খেয়াল রাখতেন আমি যেন জহিরের সাথে মিশতে না পারি। তাই কোন মতলব মাথায় এলে আমি সরাসরি জহিরকে ডাকতে যেতাম না মা জানবে বলে। আমাদের উঠোনে এসে জহিরের বেরোনোর অপেক্ষায় আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম। জহির উঠোনেই বেরোলেই চোখে চোখে কথা হতো। তারপর সুযোগ বুঝে বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়তাম। জহির আর আমি এক সাথেই স্কুলে গিয়েছি। এক সাথেই খেলা-ধূলা করেছি। আমার ছেলেবেলার সব কর্ম এবং অপকর্মের সঙ্গী ছিল একমাত্র জহির।
আমাদের পরিবারে স্বচ্ছলতা থাকলেও জহিরদের স্বচ্ছলতা একেবারেই ছিল না। কত দিন গেছে জহির না খেয়ে স্কুলে গিয়েছে। না খেয়েই আমার সাথে খেলা-ধূলা করেছে। কিন্তু ওর দুরন্ত কালো শরীর দেখে বোঝার উপায় ছিল না। ওর বাবা দিন মজুরী খেটে সংসার চালাতো। তবু জহির পড়াশুনা চালিয়ে গেছে। হাইস্কুল পেরিয়ে আমরা যখন কলেজে পা দেই তখন পড়াশুনার মাঝে মাঝে জহিরকে আমি ওর বাপের সাথে দিন মজুর খাটতেও দেখেছি। ওর বাবা যখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতো তখন বলতো, ‘হবে না জহির বাদ দে পড়াশুনা।’ কিন্তুজহির শোনেনি সে কথা। আজ জহির পড়াশুনা করেই যেন বিপদে পড়ে গেছে। জহির যদি কলেজ পর্যন্ত পড়াশুনা না করতো তাহলে হয়তো নিঃসংকোচে মজুর খেটেই এ জীবন পাড়ি দিতে পারতো। জহির আজ না পারছে মজুর খাটতে, না পারছে একটা চাকুরি যোগার করতে।
আমি আমার বাবার স্বচ্ছলতার জোরে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে সরকারী চাকুরি না পেলেও অন্তত খুশি হওয়ার মতো একটা ভদ্র বেতনের বেসরকারী চাকুরি পেয়েছি। আজ আমার পরিবার আগের চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছল। তারপরেও জহিরের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা একটুও কমেনি এতদিন। সব সময়ই জহির আমার খোঁজ খবর রেখেছে। বিগত তিন বছর ধরে যে আমি শহরে থাকি তবু জহিরের কাছ থেকেই বাড়ির সব খবর আমি পেয়েছি। কিন্তু গত এক বছর হলো বাড়ির খবরের পাশা পাশি জহির তার নিজের জন্য ছোট খাটো একটা চাকুরির খবর আশা করেছিল আমার কাছে। যে খবর আমি জহিরকে দিতে পারিনি। অথবা নিজের ব্যস্ততায় এড়িয়ে গেছি বারবার।
জহির আমার প্রতিবেশি। জহির আমার ছেলেবেলার বন্ধু। জহির আমার সহপাঠি। জহির আমার জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িয়ে ছিল। জহির আজও হয়তো ঠিক সে ভাবেই আছে। কিন্তু আমি আর সে ভাবে নেই। আমি আর জহিরের শরীরের আঁচ আগের মতো অনুভব করি না। কারণ, আমি এখন একটা কোম্পানির উচ্চ পদস্থ অফিসার। আমার শৈশবের বন্ধুর স্মৃতিতে কাতর হলে চলবে না। তাই আমি বাড়তি যন্ত্রণা এড়িয়ে যাবার জন্য জহিরকে আবারও বললাম, ‘বললাম না এখন বিরক্ত করিস না ?’
এইবার জহির চলে যেতে উদ্যোত হলো। এবং চলে যেতে লাগলো। কিন্তু আমি চাকুরিজীবি বন্ধুর সাথে করা খোশ গল্পের আমেজটা হারিয়ে ফেললাম। মূহুর্তেই ভাবলাম একটু আশ্বাস দিলে যদি জহির কিছু শান্তি পায় তো পাক। আবার ডাকলাম ওকে। কিন্তুজহির আর দাঁড়ালো না। পিছন ফিরে সোজা চলে গেলো।
এতোদিন আমি ভেবেছিলাম ব্যবসা বাণিজ্য করেই তো জহিরের সংসার বেশ চলছিল। এখন হঠাৎ সেসব বাদ দিয়ে চাকুরির পিছনেই বা ছুটছে কেন ? সে তো ভালই আছে ! কিন্তু তলে তলে যে ওর সংসারের চাহিদা বেড়ে গিয়ে ব্যবসা দিয়ে আর কুলিয়ে উঠছিল না, তা আমার জানা ছিল না। হয়তোবা জানার চেষ্টাও করিনি কোন দিন। অন্যের সম্পর্কে আমার অনুমান বা বিচার বুদ্ধি কি লোপ পেয়ে গেছে ? না কি নিজের স্বচ্ছলতার মাঝে ডুবে থাকলে এমনটাই হয় ?
আমি আর জহিরকে দ্বিতীয়বার ডাকলাম না। ভাবলাম যাচ্ছে যাক। নিশ্চয়ই জহির ওবেলায় আবার আসবে। কারণ, সে এখন সম্পূর্ণ বেকার। আর আমি ছাড়া জোর গলায় দাবী করার মতো কোন বন্ধু ওর নেই। কিন্তু আমার এই ধারনাকে ভুল প্রমাণ করে সত্যি সত্যি ওবেলায় জহির আর আমার সাথে দেখা করতে এলো না। আমিও আর জহিরকে ডেকে নিয়ে কথা বলার তাগাদা অনুভব করলাম না। যদিও আমার ঘর থেকে বেরোলেই জহিরদের উঠোন দেখা যায়।
পরদিন সকালেই আমি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম এবং তার পরের দিন সকাল দশটায় কর্মস্থলে যোগদান করে নিজ দায়িত্বে নিযুক্ত হলাম।
ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় আমার কোম্পানির অফিস। আমি ভাড়া থাকি কমলাপুরের একটি পাঁচতলা বাড়ির তিন তলায়। বাসা থেকে পায়ে হেঁটেই মতিঝিলে আসা যাওয়া করা যায়। তবু আমি রিকসাতেই যাতায়াত করি। মাস খানিক পরে একদিন বৃহস্পতিবার অফিসে যাবার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে খালি রিকসার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় পরিচিত এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা। তিনি আমার অফিসের পাশেই আরেকটা অফিসে চাকুরি করেন। তিনিও কমলাপুরেই থাকেন। তবে কোন বাসাটায় যে থাকেন তা কখনো জানা হয়নি। ভদ্রলোক আমার প্রায় সমবয়সিই হবেন। তিনি বললেন, ‘চলুন আজ গল্প করতে করতে হেঁটেই যাই।’ আমি ঘড়ির দিকে দেখলাম এখনো আধা ঘন্টা সময় হাতে আছে। তার প্রস্তাবকে সম্মান দেখানোর জন্য আমি বললাম, ‘ভাল কথা ! চলুন।’ ততক্ষণে আমার অপেক্ষা দেখে একটি খালি রিকসাও এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি রিকসাওয়ালাকে না বোধক হাত ইশারা করেই হাঁটা দিলাম। রিকসাওয়ালা নিরাশ হলো।
যেতে যেতে ভদ্রলোক বলছিলেন, ‘গাড়ি-ঘোড়ার যন্ত্রণায় পায়ে হাঁটা খুবই বিপদজনক।’ আমি সম্মতি দিয়ে বললাম, ‘ঠিকই বলেছেন। কখন যে চাপা দিয়ে মারবে তার ঠিক নেই।’ এমন সময় ভদ্রলোক আঁতকে ওঠার মতো করে বললেন, ‘ কি হয়েছে ওখানে ?’
তাকিয়ে দেখি আমাদের সামনে অদূরেই রাস্তার পাশে একটি নির্মানাধীন ভবনের গেটে কিছু মানুষের জটলা। অফিস টাইম। রাস্তায় মোটামুটি ভিড় লেগে গেছে। আমরা স্বাভাবিক গতিতেই এগিয়ে গেলাম গেটের কাছে। শোনা গেলো ভবনটার দুই তলায় বাহিরের দেওয়ালে কিউরিং করতে গিয়ে একজন হেলপার পা ফসকে নিচে পড়ে গেছে। আজ দিনের শুরুতেই তার দায়িত্ব পড়েছিল কিউরিং করার। মারা গেছে না বেঁচে আছে কেউ বলতে পারছে না। কারণ, ভিতরে কোন লোক ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ইতিমধ্যেই কৌতুহলি মানুষের ভিড় ক্রমাগত বাড়তে শুরু করেছে। কৌতুহলবশত ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতেই ভিতর থেকে কিছু লোক চিৎকার করে গেটে এসে বলতে লাগলো, ‘রাস্তা ক্লিয়ার করেন এম্বুলেন্স ঢুকবে।’
রাস্তা ক্লিয়ার করা হলো। দূর থেকে এম্বুলেন্সের হুইসেলও শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক’জন লোক পড়ে যাওয়া লোকটাকে ধরাধরি করে গেটের কাছে নিয়ে এলো। অনেক লোকের মধ্য থেকে শোনা যাচ্ছে, ‘আহারে মারা গেছে।’ কেউ বলছে, ‘না না মারা যায়নি।’ আমার সঙ্গি ভদ্রলোক ভিড়ের মাঝে কোথায় যে হারিয়ে গেছেন জানি না। তবে লোকটাকে নিয়ে এসে মাটিতে রাখলে ভিড় ঠেলে অনেক কষ্টে আমি দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি পা ফসকে পড়ে যাওয়া লোকটা আর কেউ নয়, আমার বন্ধু জহির। আমি ঢাকায় চলে আসার পর সে যে কবে এখানে এসে কাজ করছিল আমি জানি না। তাছাড়া আমি ঢাকার কোন জায়গায় থাকি জহিরও তা জানতো না। কিন্তু, সে আর নেই।
আমি যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমি যে চিৎকার করে বলবো, ‘এ আমার বন্ধু জহির।’ তা আমার মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে না। আমার কেবলই মনে হতে লাগলো, জহির যদি আমি হতো, আর আমি যদি জহির হতাম, তাহলেও কি এমনটা হতো ?