দুই টুকরো কাশ্মিরী শাল – ১০/১১
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
সালেহার বিয়াই সাহেব তার কথা রেখেছিলেন শেষ পর্যন্ত বলাই বাহুল্য । মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে নিয়ে নিজেরাও এসে ঘুরে দেখে গিয়েছেন আহাদ মাষ্টারের বসত ভিটা । নিজেরা দিনে দিনে ফিরে গেলেও নব দম্পতিকে রেখে গিয়েছিলেন । পুরো চারদিন ছিলো আতিক আর অনু সেবার । আর সেটাই ছিলো শ্বশুড়বাড়ীতে অনুর সবচেয়ে বেশিদিন একটানা থাকা ।
এরই মধ্যে ওদের ফিরে যাবার আগেরদিন দুপুরবেলা গ্রামের পরিচিত আর কাছের মানুষদের দাওয়াত করে এনে নতুন বৌ দেখিয়েছে আতিক নিজেই । সকালবেলা ঘুরতে বেড়িয়ে দুপুরবেলা বাড়ী ফিরেই মায়ের কাছে গিয়েছল আতিক ।
– মা , অরা তো জোর কইরা দাওত রাইখা দিল !
– কারা ? কিয়ের দাওত ?
সালেহা বেগম তখন কয়জন মহিলাকে নিয়ে নতুন বউয়ের জন্য হরেক রকমের পিঠা তৈরীর তদারকিতে ব্যাস্ত । তাই তিনি প্রথমেই বিষয়টা ধরতে পারেননি ।
– এই মন্টু , আউয়াল , কামাল ভাই , সগীর চাচা , মেম্বর সাব – এগো কথা কইতাছি আর কি !
নিজের ছোটবেলার বন্ধুসহ অন্য্যদের কথা মাকে জানায় আতিক ।
– অগো সবাইরে তুমি পাইলা কুনে ? দেহা অইলো ক্যামনে ?
– বাহ … ঘুরতে ঘুরতেই পাইয়া গেলাম !
মনে মনে ব্যাপারটা ঠিকই ধরতে পেরে হাসলেন । তিনি খুব ভাল করেই জানেন ছেলের সাথে বিশেষ করে তার বন্ধুদের সবার সাথে এই সময় অন্তত একসাথে দেখা হওয়ার কোনই কারণ নেই । যেহেতু তাদের অনেকেই যার যার রুটি রুজির তাগিদে সকালবেলাই গ্রাম থেকে শহরে চলে যায় । ওদের কেউ শহরে ছোটখাটো চাকুরী করে । কেউবা আবার ব্যসায় । আর শহর থেকে কাজ সেরে ওদের কেউই সন্ধার আগে ফেরে । আর আজকে সাপ্তাহিক জুম্মাবার বা অন্য্য কোন ছুটির দিনও না ।
ছোট এই গ্রামের মানুষেরা প্রত্যেকেই প্রত্যেককে চেনে । এবং ভালমত প্রায় সব খবরই রাখে । তেমনিভাবেই সালেহা জানেন ওদের ব্যাপারে । আর তাই তিনি বুঝতে পারলেন আতিক আসলে প্রত্যকের বাড়ী বাড়ী গিয়ে সকাল থেকে দাওয়াত দিয়ে এসেছে ।
এই বিষয়টা নিয়ে সালেহাও আসলে কদিন ধরে ভাবছিলেন । গ্রামের অন্তত বিশিষ্ট কয়েকজন ব্যাক্তি আর কিছু আত্বীয় প্রতিবেশিকে ছেলের বিয়ে উপলক্ষে দাওয়াত না করলে মোটেই ভাল দেখায় না । গ্র্রামের মানুষের মানসিকতা খুব ভাল করেই জানেন তিনি । সম্মান রক্ষার ব্যাপার তো আছেই । কিন্তু তার চাইতে বড় সমস্যা হয়ে দেখা গ্রামের মানুষের অতি কৌতুহলী মনোভাব । যখন সবাই জানবে আহাদ মাষ্টারের ছেলে শহরে বিয়ে করেছে অথচ নিজের আত্বীয়পরিজনদের বৌ দেখাতে ডাকেনি , তারমানে বিয়েটার মধ্যে নিশ্চিতভাবেই কোন ঘাপলা আছে । আর গ্রামবাসীদের এই ধরনের চিন্তা ভাবনা একসময় কত ভয়াবহ আর বিচ্ছিরি গল্পগাঁথায় রুপ নেয় – তা কেউ বলতে পারে না ।
যেহেতু সালেহাকে গ্রামের এই মানুষগুলোর সঙ্গেই কাটাতে হবে গোটা জীবন তাই সেই নিয়মের সাথে চলার কোন বিকল্প নেই আসলে । আর এক্ষেত্রে সহজ আর বলা যায় একমাত্র পথ হল এই মেহমানদারী । কিন্ত তা স্বত্বেও ছেলে – ছেলের বউ আসবে কিনা , আসলেও কবে আআর কদিনের জন্য – এসব নিয়ে নানা দ্বিধা দ্বন্দের কারণে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলতে সাহসে কুলাচ্ছিল না তার । কিন্তু গতকাল বিয়াই তার দেয়া কথামতন এসে যাওয়ায় কাল রাত থেকেই বিষয়টা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন সালেহা । এবং আজ দুপুরবেলাতেই ছেলের সাথে সব কথা পাকা করে নিজে বেরুতে চেয়েছিলেন দাওয়াতে ।
কিন্তু এখন যখন দেখলেন ছেলে নিজেই সব উদ্যোগ নিয়ে ফেলেছে তখন মুখে কিছু না বললেও মনে মনে খুশী না হয়ে পারলেন না । যাক , ছেলে তার এখনও পুরোপুরি শহুরে সাহেব বনে যায়নি !
– কবে কখন আসতে বলছ ? আর মানুষজনরে আপ্যায়নও তো করতে হইবো ?
– পরশু বাদ জোহর আইতে কইছি মা । আমার অহনও সবাইরে কওন শ্যাষ অয় নাই । আইজ মগরিবে বা এশার ওয়াক্তৈ মজিদে মুরুব্বী বাকী যারা আছে তাগো নামায পড়া শেষে দাওত দিয়া আমু ভাবছি । তহন সক্কলরে এক লগে পাওয়া যাইবো – কি কও মা ?
– হ । তা পাওয়া যাইবো ।
– আর মা তুমিও যাগো যাগো কওনের কইয়া আসো আইজই এক ফাঁকে । তুমি আপ্যায়ন নিয়া ভাইবো না মা । আমি সব ব্যবস্হা করতাছি আইজকার মদ্যেই । কেউ তোমার বাড়ীর বদনাম করতে পারবো না মা ইনশাল্লাহ ।
না ! বদনাম করার মতন কোন কিছু আসলেই কেউ সেই দাওয়াতে কেউ খুঁজে পায়নি । প্রায় সারা গ্রামের মানুষ সেদিন ভেঙ্গে পরেছিল যেন আহাদ মাষ্টারের বাড়ীতে । বাড়ীর বাইরে বিশাল সামিয়ানার নীচে বসে আপ্যায়নে তৃপ্ত দাওয়াতী মানুষগুলো মন ভরে প্রশংসা করেছিল আতিকের ।
স্বীকার করে গিয়েছিল আহাদ মাষ্টারের ছেলেটা বাপের যোগ্য হিসাবে শুধু শিক্ষা দীক্ষা আর সামাজিক প্রতিষঠার ক্ষেত্রেই নয় , বরং মনের দিক থেকেও একজন সত্যিকারের বড় মাপের মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছে ।
সবাই একযোগে বিদায় বেলায় যেমন দোয়া করে গেছে মাষ্টার সাহেবের ছেলের আরো উত্তোরোত্তর সাফল্যর । তেমনি পরিস্হিতির সাথে একমাত্র সন্তানের জন্য প্রায় একা লড়াই করে শেষ অবধি জয়ী হতে পারায় সালেহা বেগমের ভাগ্যও জুটলো কৃতি সন্তানের গর্বিত মা হতে পারার জন্য প্রশংসা ।
ঐ মুহুর্তটায় সালেহা বেগমের মনে হয়েছিল – জীবনের কাছ থেকে সত্যি সত্যি তার চাইবার আর কিছুই বাকী নেই !!
এরপর ঢাকায় ফিরে কদিন পর তো ওরা চলে গেল বিদেশে । রওয়য়ানা দেবার আগেরদিন আতিক এসেছিল একা মায়ের সাথে বিদায় নেবার জন্য । একরাত মায়ের সাথে কাটিয়ে পরদিন ভোরে ফিরে গিয়েছিল এবং ঐ রাতেই বউ নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিল বিদেশ ।
অনেকদিন বাদে সত্যি সত্যি যেন ভীষণরকম একা হয়ে গিয়েছিলেন সালেহা বেগম । আর এই দীর্ঘ একাকীত্বের সময়টায় তার একমাত্র সঙ্গী বলতে ছিলো পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর হাজারো রকমের স্মৃতি !!!
১১.
আহ , ছেলে পেটে থাকা অবস্হায় কত রকমের পাগলামিই না সালেহাকে নিয়ে করেছেন ঐ মানুষটা !
ভাবলে এখনো লজ্জায় জিভ কাটতে ইচ্ছা করে সালেহার । বিশেষ করে জানু আপার সামনে কতোবার যে তাকে অপ্রস্তুত অবস্হায় পড়তে হয়েছে মাননুষটার জন্য !
জানু আপার কাছেও কৃতজ্ঞতার কোন শেষ নেই সালেহার । মাষ্টার সাহেবের পর জানু আপাই বুঝি তার জীবনে আসা একমাত্র মানুষ যে কিনা আমৃত্যু প্রয়োজন মাত্রই পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । এবং সেটা অবশ্যই নিঃস্বার্থভাবে । সালেহা গর্ভবতী থাকাবস্হায় আসা যাওয়ার মধ্যেও বেশির ভাগ সময়টা জানু আপা কাটিয়েছেন সালেহার সাথেই । এই সময়টায় সালেহার জন্য তিনি স্বামীর বোনের চাইতে বলতে গেলে হয়ে উঠেছিলেন যেন শ্বাশুড়ী মা ।
প্রতি বেলার জন্য সালেহার উপর জারী করা হয়েছিল নানারকম বিধি নিষেধ । কঠোরভাবে তাকে মানতে হয়েছিল সকাল – ভর দুপুর – সন্ধা সম্পর্কিত বিভিন্ন সতর্কবানী । এমনকি শনি – মঙ্গলবারকে বিশেষ দিন ধরে নিয়ে সমস্ত দিনটায় রীতিমতন মেপে মেপে সাবধানে সালেহাকে রাখতে হয়েছে প্রত্যেকটা পদক্ষেপ ।
কখনো সালেহা হয়তো ভুল করে বিকেলবেলা চুল বাঁধেনি আর তা ঠিক জানু আপার নজরে পড়ে গেছে – আর যায় কোথায় ! সাথে সাথে রীতিমতন তেড়ে আসতেন তিনি সালেহার দিকে ।
– তর মনের আইশটা কি তুই ক তো আমারে বউ ! আমাগো বংশের পয়লা পরথম একজন কেউ আইতাছে ! তুই কি চাস না সে ভালয় ভালয় এই দুইন্যায় আসুক ! কোন আক্কেলে তুই এই ভরা সন্ধার কালে আউল্যা চুলে ঘুরতাছোস , অ্যাঁ !
তখনও হয়তো সন্ধা হতে অনেক দেরী । কিন্তু সেটা বলা যাবে না জানে সালেহা । তাহলে জানু আপা আরো বেশি তেড়ে আসবে । তাই চুপ করে অপরাধীর ভঙ্গিতে মাথা নীচু করে থাকাই শ্রেয় উপায় বুঝে এসব মুহুর্তে সেটাাই করতো সালেহা ।
– আয় এই দিকে আয় দেহি আমার কাছে । হাজারবার আমি কইছি এই সময় চুল না বাইন্দা ভর দুইফর আর সন্ধায় ঘরের থিকা বাইর অইবি না ! ভূত পেত্নীয়ে আসর করবো সুযুগ পাইলেই ! তিনাগো আছড় করার লাইগা সবচাইতে ভাল জায়গা অইলো পোয়াতী মাইয়া মানুষ ! কিন্তু কে হোনে কার কতা ।
ততোক্ষনে রীতিমতন পাকড়াও করে জানু আপা লেগে গেছেন তার খোলা চুল বাঁধার কাজে । কিন্তু তা বলে মুখ চলা বন্্ধ হয়নি আপার । হাতের সাথে তাল মিলিয়ে সেটাও সমানেই হয়তো চলছে !
– আসলে এইসব কতা মাইয়া মাইনষেরে হিগাইতে অয় জন্মের পর থিক্যা ! তর মায় তো তরে যা দেখতাছি ভালা কুনু কিছু এই জিন্দেগীতে শিখায়নি ! অহন আমি শিখাইতে চাইলে কি অইবো ? বুইড়া বয়সে কি নতুন কইরা কাউরে কিছু শিখান যায় নি !
না , জানু আপার এসব কোন বকাঝকাতেই কিছু মনে করতো না সালেহা । মন খারাপ করা কিংবা রাগ হওয়া তো দূরের কথা ।
মায়ের শাসনে কি কোন সন্তান রাগ করতে পারে !
জানু আপাকেও যে ততদিনে মায়ের আসনে স্হান দিয়ে দিয়েছে সালেহা । আরো ঠিক করে বলতে গেলে জানু আপাই তার মায়া মমতা আর স্নেহ ভালবাসা দিয়ে অর্জন করে নিয়েছেন সেই জায়গাটা । এই যেমন একরাতে খাবার সময় তিনি ধরে বসলেন তার ভাইটাকে !
– তর আক্কলটা কি , কতো দেহি আমারে ?
– কিয়ের কতা কইতাছো তুমি আপা ?
– খালি বাইরের দুইন্যার মাইনষের কতা ভাবলেই চলবো ? ঘরের মানুষটর দিকেও তো ইকটু নজর দিতে অয় মাঝে মইধ্যে , নাকি ?
– ক্যান গো আপা ? সালেহার আবার কি অইলো ? অ্যাঁ ? কুনুরকম অসুবিধা দেহা দেয় নাই তো ? ডাক্তারের কাছে যাইতে অইব নিকি ?
ভীষণ উদ্বিগ্ন আহাদ মাষ্টার খাবার ছেড়ে উঠতে উদ্যত হয় ।
– আরে আলাই বালাই ! আমি কি কুনু খারাপ কিছুর কতা একবারও মুখ দিয়া বাইর করছি ?
– অ ! তাইলে কি অইছে খুইলা কও আপা !
কথা শুনে ফের বসে পড়ে আহাদ মাষ্টার । বলতে বলতে একবার আড়চোখে তাকাতে গিয়ে সালেহার সাথে চোখাচোখিও হয় । এবং দেখে সালেহাও তার মতই রীতিমতই বিস্মিত । আপার বক্তব্য সম্পর্কে তার নিজেরও কোন ধারনা নেই বোঝা যাচ্ছে ।
– আমি কইতাছি , বউটার দিকে চাইয়া দেখ দিনকার দিন কি হাল অইতাছে শইলের ! অবশ্যি বিয়ার সময়ও দেখছি একবারে পাটকাঠির মতনই আছিল । কিন্তু অহন তার থিকা অইবার চাইতাছে শলার কাঠি !
– অহন আমারে কি করতে অইবো হেইডা কও ?
– হুন । পোয়াতী কালে মইয়া মাইনষের ভাল মন্দ অনেক কিছু দরকার অয় । পুলাপানের পুষ্টির লাইগাও বাড়তি খাওন দাওন দরকার – সেইটা তর মতন শিক্ষিত মাষ্টার মাইনষেরেও কি আমার বুজায়া কইতে অইবো ? কাইল সর্ব পরথম বিয়ান বেলাই তুই যাবি গোয়ালবাড়ীতে । কইয়া আবি কাইল থিক্যাই যাতে একসের কইরা দুধ দেয় রোজ বিয়ানে !
– ক্যান ! দুধ রাখা অইতাছে না বাইত্তে !
বিস্ময়ের সাথে আবার একবার সালেহার দিকে তাকায় আহাদ মাষ্টার । এবার কিন্তু স্পষ্ট অপরাধীর ভঙ্গিতে চোখ মাটির দিকে নামিয়ে ফেলে সালেহা । আহাদ মাষ্টার বুঝে যান গোটা বিষয়টা । প্রায় মাসখানেক আগে বাড়ীতে নিয়মিত দুধ রাখার জন্য কাউকে গোয়ালবাড়ী পাঠাতে বললেও , সালেহা আসলে কাউকে পাঠায়নি !
– ক্যামনে রাখা অয় না কইলে ? ক্যান তুই কি কইছিলি নি গোয়ালরে ?
– উমম … না আপা । কমু কমু কইরাও ক্যামনে জানি ভুইলা গেছিলাম । আইচ্ছা আমি কাইলই ব্যবস্হা করতাছি ! কুনু চিন্তা কইরো না তুমি !
সালেহাকে বাঁচিয়ে দিয়ে অবলীলায় নিজের কাঁধে দোষ টেনে নেয় আহাদ মাষ্টার ।
আর ওদিকে অপরাধী সালেহার খুব ইচ্ছা করে মানুষটার বুকে এই মুহুর্তে একটু কান ঠেকিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে , আসলেই কি বিশাল পরিমান ভালবাসা তার জন্য ওইখানটায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে !
কিন্তু চাইলেও এই মুহুর্তে তা করতে পারছে না সালেহা । কারন সামনে বসা আছেন জানু আপা ।
তাই ঐ অবস্হায় যা তার পক্ষে করা সম্ভব তাই করেছিল সালেহা ।
ভীষণ কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধা মেশানো একটা অদৃশ্য প্রণাম বুঝি দূরে বসেই মনে মনে সঁপেছিল ঐ বিশাল হৃদয়ের অধিকারী মানুষটার দুই পায়ের পাতায় !!! (চলবে )