Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

দুই টুকরো কাশ্মিরী শাল – ১২

: | : ২৪/০১/২০১৪

(পূর্ব প্রকাশিতের  পর )
পরদিন বড় বোনের কথামতন বাড়ীতে নিয়মিত দুধ সরবরাহের ব্যবস্হা করেছিলেন আহাদ মাষ্টার । আর তার সেই বিস্ময়কর আর অভাবিত ব্যবস্হা দেখে বাড়ীতে অবস্হান করা দুই মহিলা প্রথমটায় রীতিমতন বাক্যহারা হয়ে গিয়েছিল বললেও হয়ত খুব বেশি ভুল বলা হবে না !

সেই বিকেলটাতেও নিজেদের বাড়ীর উঠানে বসেছিল সালেহা আর জানু । ঠিক বসে ছিল বললে ভুল হবে । আসলে জানু আপা সালেহাকে সামনে বসিয়ে পেছন ভাই বৌয়ের চুল বাঁধার কাজে ব্যস্ত ছিলেন । পরপর কদিন ভুল করায় এখন আর সালেহার উপর ভরসা রাখতে পারছেন না তিনি । তাই এখন থেকে যতটা সম্ভব এই দায়িত্বটাও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি ।

চুল পরিচর্যার সাথে সাথে তাদের কথাও চলছিল । অবশ্য কথা না বলে বিভিন্ন উপদেশ নির্দেশ প্রদানই চলছিল । আর তা অতি অবশ্যই জানু আপার দিক থেকে । কোন প্রশ্ন করা হলে সালেহা শুধু জবাব দিয়ে যাচ্ছিল ।

– হুন বউ , তর যহন যা খাইতে মন চাইবো লগে লগে আমারে কবি । মনের মইদ্যে চাইপা রাখবি না । যেমনে পারি আমি তর ইচ্ছা পূরণ করমু । নাইলে কিন্তু তর পোলাপানের লোল পড়া থামাইতে পারবি না কয়া রাখতাছি । জানস তো পোয়াতী থাকতে মাইয়াগো কুনু কিছু খাইতে মন চাওয়ার পরেও যুদি ঐ জিনিস না খাইতে পায় , তাইলে এমুন অয় । আর লুল জরইন্না পোলাপানরে অনেক মাইনষে কয় ছুচা । খবরদার বউ , তর কারণে যুদি আমাগো বাচ্চারে কেউ ছুচা ডাকে আর হেইডা আমার কানে আহে – তাইলে তরে যে আমি কি করমু .. !

ভয়টা বজায় রাখতেই যেন শাস্তির ধরণটা আর উল্লেখ করে না জাহানারা ।

যদিও জানু আপার কথায় বিন্দুমাত্র ভয় পায় না সালেহা । কারন এসব উপদেশ আর হুমকি প্রায় প্রতিদিন একবার করে শুনতে হয় তাকে । তাই আজকাল বরং মজা পায় সে । আর তাছাড়া দুইজনের সম্পর্কটাও দিনে দিনে অনেকই গভীর বন্ধুত্বে এসে দাঁড়িয়েছে ।

– কি করবা তাইলে তুমার ভাতিজা ভাতিজি যুদি স্বভাব ছোঁচা অয় !

– তাইলে তরে মাইর ধইরও দিতে পারি কওন যায় না ! আর তর ছুঁচা বাচ্চার জইন্য যে আমারও বদনাম অইবো – তা কি বুঝস তুই !

– তুমার বদনাম ? এর মইদ্যে আবার তুমার বদনাম অইবো ক্যান ?

– অইবো রে অইবো ! মাইনষে কি আর জানে না তর এই পোয়াতিকালে কে আছিল তর লগে । হগ্গলে মিল্যা তহন কইবো , ঐ বদমাইশ ননাসডায় ভাই বৌয়েরে ঠিক মতন খাওয়ায় নাই । যা মন চাইছে পোয়াতীকালে তার জোগাড় এই হারামী বেডি করে নাই বইল্যাই মাসুম বাচ্চাটার অহন লুল পড়তাছে !

– আরি তুমি কি কইতাছো আপা ?

জাহানারার অদ্ভুত যুক্তি শুনে খিলখিল করে হেসে ওঠে সালেহা ।

– খবরদার বউ খবরদার । যহন তহন ইমুন বেলাজের মথন হাইসা উঠবি না কইলাম ! তর সব কিছু কিন্তু তর সন্তানে প্যাডে থাইকা বুঝতাছে । আর এই সময় তুই যা করবি তর বাচ্চা কিন্তু ঐ গুলা হিগাই দুন্যায় আইবো ! আর এই সব আমার বানাইন্যা কুনু কতা না । ময় মুরুব্বীগো কইয়া যাওয়া কতা !

জাহানারার কথায় এবার খানিকটা ভয় পেয়েই হাসি থামিয়ে ফেলে সালেহা । কোনভাবেই নিজের ছেললেমেয়েকে বেহায়া হতে দিতে রাজী না সে !

জাহানারা বুঝি আরো কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিলো । কিন্ত বাড়ীতে প্রবেশের রাস্তা দিয়ে একটা জোর হুপ হুপ শব্দ শুনে থেমে যায় সে । শব্দটা সালেহার কানেও গেছে । দুজনই তখন কৌতুহলী হয়ে বাড়ীর প্রবেশ পথে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে । যেহেতু শব্দ ক্রমশঃ বেড়ে এই দিকেই আসছে ।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না । কয়েক মুহুর্ত পড়েই তাদের চোখে একটা বাছুরসহ গাভী দৌড়ে ঢুকে পড়েছে তাদের উঠানে ।

– ইয়া আল্লাহ মাবুদ , কাগো গরু আবার এমনে কইরা ছুইটা আইলো । অই তুই সর । সর । গুতা খাবি নে আবার !

প্রথমেই সালেহার নিরাপত্তার কথাটাই মাথায় এল জাহানারার । প্রায় লাফ মেরে উঠেই সে সালেহাকে আড়াল দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সামনে এসে । নিশ্চিতভাবেই গাভীটা এদিকে তেঁড়ে এলে নিজের উপর দিয়ে আঘাত নেবে জাহানারা । তবু সালেহার বিন্দুমাত্র ক্ষতি সে হতে দেবে না !

তবে ভাগ্য ভাল ঘটনা সেদিকে গড়ালো না । কোন দুর্ঘটনা ঘটার আগেই দুই যুবক দৌড়াতে দৌড়াতে ঢুকলো বাড়ীর ভেতর । এবং দ্রুত নিয়ন্ত্রণ নিলো প্রানীদুটোর উপর তাদের দঁড়ি দুটো ধরে ফেলে ।

এবার যুবকদের উপর ফুঁসে উঠে প্রায় তেড়েই গেলেন জাহানারা ।

– কিমুন রাখাল গো তুমরা যে গরু ধইরা রাখতে পারো না , অ্যাঁ ? তুমরা আওনের আগেই যুদি আমাগোরে গুতাইয়া শেষ কইরা দিতো ?

– না গো আম্মারা । ডরানের কিছু নাই । এইডি পালা গরু । পুরা ঠান্ডা । দেহেন না বাড়ীর মইধ্যে ঢুইকাই কেমুন খাড়ায়্যা গেছে গা চুপ মাইরা !

সত্যিই কিন্তু গরুগুলো যুবকেরা এসে ধরার আগেই উঠানের ঠিক মাঝামাঝি আসার পর থেমে গেছিল নিজেরাই । কিন্তু আকস্মিক ভয়ের কারনেই সম্ভবত জিনিসটা তাদের চোখে পড়েনি ! যদিও এই মুহুর্তে মেজাজ গরম হয়ে থাকা জাহানারা এ বিষয়য়টা মানতে মোটেও রাজী ছিলেন না ।

– হ । নিজের গোয়ালের গরু কহনো খারাপ অয় না ! তা বাবা , তুমাগো গরু যুদি এত ভালাই অইবো তয় ইমুন কইরা অন্যের বাড়ীর মইধ্যে ঢুইকা পড়ে ক্যান ।

– হে ! হে ! … পরের বাড়ী অইবো ক্যান আম্মা নিজের বাড়ী চিইন্যাই দুইটায় ইহানে ঢুকছে !

এবার সত্যি সত্যিই ক্ষেপে ওঠে জাহানারা দুই রাখালের বোকামী দেখে ।

– এই বাড়ীর গরু মানি ? আমাগো আবার গরু আইলো কইথনে ? বাইর অও ! বাইর অও অহনি এই আপদ নিয়া !

জাহনারার তেড়ে আসা দেখে থমকে যায় যুবক দুজন । চেহারায় ভয়েরও ছায়া পড়তে দেখা যায় দুজনেরই ।

– আম্মা । আপনে আমাগো উপরে চেইতেন না গো । ভুল অইলে ক্ষেমা চাইতে আছি । কিন্তুক তার আগে কন এইডা মাষ্টার সাবের বাড়ী না ?

– তুমরা কুন মাষষ্টারের কতা কইতাছো ?

– জ্বে , আমাগো হাই স্কুলের মাষ্টার সাব । আহাদ মাষ্টর সাব !

– হ । এইডা তো উনারই বাড়ী ! তুমাগো এই কতাডা তো ঠিকই আছে !

জাহানারা বিস্মিত হলেও যুবক দুজনের চেহারায় তখন ফিরে এসেছে আত্ববিশ্বাসের ছায়া ।

– তাইলে আম্মা আমাগো সবই ঠিক আছে । এই বাছুরসহ গাভীনডা মাষ্টরসাবেই কিন্যা পাডাইছে ! আমার বাপজানের কাছ থিক্যাই মাষ্টর সাব এই দুইডা কিনলো । আমরা খালি এইগুলানরে জায়গামতন পৌঁছায়া আর বাদবাকী বন্দোবস্ত কইরা দিয়া যাইতে আইছি আম্মা ।

সালেহা আর জাহানারাই এখন উল্টো বোকার মতন পরষ্পরের তাকিয়ে থাকে ।

– অ ! তা তোমাগো মাষ্টরর সাবে কই ? সে আইতাছে না ক্যান ?

– জ্বে মাষ্টরসাবে আমাগো বাড়ীতই আছে । বাপজানের লগে টেহা পয়সার কাম সাইরা আইতে এট্টু সময় লাগবো !

——————————– *** —————————————

 

আহাদ মাষ্টারের সেদিন ফিরতে একটু রাতই হয়েছিল । রাতে খাবার সময় তাকে পাকড়াও করেছিল জাহানারা ।

– এইডা তুই কি করছস রে আহাদালী ?

– কি করলাম গো আবার জানু আপা ?

– এই যে বৌয়ের লিগা দুধের জোগাড় করতে কইলাম আর তুই এক্কেরে গরু লয়া বাড়ীত আইলি ।

– ও এই কথা । তা আপা তুমি খালি সালেহার কথা ভাবছ কিন্তুক নিজের দিকে তাকায়্যা দেখছো একবারো ? তোমারো তো বয়স অইতাছে । তোমারও তো অখন একটু ভালমন্দ কিছু দরকার আছে ?

– তা বইলা তুই ..!

জাহানারার মুখে যেন কথা জোগায় না । সে ভাইয়ের দিকে চেয়ে থাকে চোখ বড় বড় করে । যদিও তার চোখমুখে উপচে পড়া খুশী হারিকেনের অন্ধকার আলোতেও চোখ এড়ায় না সালেহার । সত্যি সত্যিই সেও খুব খুশী হয় মানুষটার বিবেচনাবোধ দেখে ।

– আর খালি তোমার লাইগাই তো না ! ঘরে নিজের গরু দুধ দিলে হেইডা আমরা সকলে মিলাই তো খাইতে পারুম !

বলতে বলতে খাবার শেষ করে উঠে যায় আহাদ মাষ্টার । বাড়ীর একমাত্র পুরুষটির খাওয়া শেষ হয়ে গেলে এরপর দুই মহিলা বসে খেতে একসাথে ।

– ওই আমারে বুজাইল আর আমি বুজলাম !

খেতে খেতে সালেহাকে বলে জাহানারা ।

– কি আপা ?

– এই যে কইল আমার লিগাও গরু কিনছে !

– ক্যান আপা , এই কথা কন ক্যান ? উনি তো সত্যই বলছেন !

– আরে মরণ , আমি কি কইছি আমার আহাদালী মিছা কইছে ! আমি তো একটা কারণ অবিশ্যিই ! তয় আসল কারণ না হেইডাও ঠিক । আসল কারণ অইলি গিয়া তুই ! হ বউ তুই !

জাহানারার কথায় প্রতিত্তোর না দিয়ে চুপ করে থাকে সালেহা ।

– আমার ভাইডায় মজছে রে বউ , তর পিরিতে পুরাই মজছে ! কি দিয়া মজাইলি লো ইমুন জগৎছাড়া মানুষটারে ।

অনেকটা সুর করা ঢঙে কথাগুলো বলতে বলতে সালেহার থুতনি নেড়ে দেয় জাহানারা ।

না । তার কথায় কোনরকম হিংসা বা তেমনকিছুর লেশমাত্র খুঁজে পায় না সালেহা । বরং জানু আপার কথায় যেন উপচে পড়ে একতাল স্নেহ আর ওদের প্রতি তার অকৃত্রিম শুভকামনা ।

যদিও এই মুহুর্তে জানু আপার পরিহাস তরল ননদসুলভ ফোঁড়ন কাটায় লজ্জায় একেবারে নুয়ে পড়ে সালেহা । ( চলবে )

 

 

 

 

 

 

 

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top