ত্র’র সমীকরণ
স্বচ্ছ একসেলেটর দিয়ে সে দ্রুত উপরে উঠে যাচ্ছে। একসেলেটরের স্বচ্ছ কাচের মধ্যে দিয়ে বাইরের দিকে তাকালে বিশাল বড় সমুদ্র চোখে পড়ে, সে সমুদ্রে ক্ষণে ক্ষণে বড় বড় ঢেউ ওঠে, বড় বড় পাখিরা উড়ে দূরে মিলিয়ে যায়। কিংবা কখনও বা জাহাজ চোখে পড়ে। কান পেতে গভীরভাবে খেয়াল করলে সমুদ্রের গর্জনও শোনা যায়। যদিও যে জানে এসব মায়া, কৃত্রিম আবহ। তারপরও সে সব সময় গভীর আগ্রহ নিয়ে সেই কৃত্রিম সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। যখন রঙ বেরঙের পাখিগুলো তার পাশ দিয়ে উড়ে যায় তখনও সে গভীর মমতায় ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। যদি সম্ভব হতো তাহলে সে অবশ্যই তা হাত দিয়ে স্পর্শ করতো।
অবশ্যই করতো।
তার নাম লী।
ইতোমধ্যে সে নির্ধারিত গন্তব্য পাঁচশত বারো তলায় চলে এসেছে। দরজা খুললেই বাইরের বিশাল করিডোর চোখে পড়ে। এখানকার করিডোরের পাঁচটি লেন। আর পাঁচটি রাস্তাই পাঁচদিকে চলে গিয়েছে। লী ডান দিকের তিন নম্বর করিডোরের দিকে পা বাড়ায়। সেদিক থেকে একটি মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে।
লী অবজারভেশন ডেকে দাঁড়িয়ে থাকে। ডেকের স্বচ্ছ মোটা কাচের মধ্যদিয়ে বাইরের ঝড়ো আবহাওয়া চোখে পড়ে। প্রতিমুহূর্তে আকাশের গোলাপী রং গাঢ় থেকে গাঢ় হচ্ছে। আর একই সাথে আগুনের বৃষ্টি হচ্ছে। আগুনের বৃষ্টি দেখতে লীর খুব ভাল লাগে তাই সে মুগ্ধ বিস্ময়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
কতক্ষণ হয়েছে লী হিসেব করতে পারলো না। সম্বিৎ ফিরে পেল তার ঘারের উপর কোমল হাতের স্পর্শে। তাকিয়ে দেখে ত্র।
“কি দেখছো?” লীর পাশে বসে ত্র জিজ্ঞেস করে। সে ভালো করেই জানে লী কি দেখছে। তারপরও লী আঙ্গুল দিয়ে বাইরের দিকে দেখিয়ে বলে, “দেখেছো কি সুন্দর দৃশ্য।” তারপর সামান্য সময়ে থেকে আবার বলে, “আজ এত দেরী করে এলে যে”, অনুযোগের সুরে লী জানতে চায়।
লী ত্রয়ের পাশে বসলে ত্র বলে, “রিতুনের শেষ ধাপের সমাধান করে, তবেই না আসলাম।” হাসি হাসি ভাব করে ত্র উত্তর দেয়।
লী বিশ্বাস করতে চায় না, বলে, “সত্যি!”
“হ্যাঁ, সত্যি।” ত্র আবার হেসে উত্তর দেয়।
“তাহলে আমরা এখন সত্যি সত্যি সময়কে আটকে দিতে পারব?” লীর চোখে মুখে বিস্ময়।
“হ্যাঁ, পারব।” আবারও ত্র হেসে উত্তর দেয়।
“আমরা আমাদের অতীতকে নিজেদের মতো করে সাজাতে পারব?” লী কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না।
“হ্যাঁ পারবো।”
এরপর বেশখানিটা সময় লী চুপ করে থাকে। ত্র তখন বাইরের দিকে তাকিয়ে আকাশ দেখতে থাকে। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এই মেয়েটি রিতুনের সমীকরণ সমাধান করে ফেলেছে। লী জানে ত্র খুবই মেধাবী। আর এজন্য ত্র’র সামনে মাঝে মাঝে নিজেকে অসহায় বোধ করে। সে প্রায়ই ভাবে এবং অনেকাংশে বিশ্বাস করে ত্র’র সাথে দেখা না হলেই ভালো হতো। সে সামান্য এক লাইব্রেরিয়ান আর ত্র কিনা একজন নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী যে কিনা রিতুনের সমীকরণের শেষধাপ সমাধান করেছে। ওর মেধা সম্পর্কে এমনিতেই তার উপর কোন সন্দেহ নেই। সে মেয়ে রিতুনের সমীকরণ সমাধান করবে নাতো কে করবে?”
লী ত্রয়ের হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, “তোমার জন্যও একটি খবর আছে। আমি প্রাচীন পৃথিবীর বইগুলোর লেখা পাঠোদ্ধার করেছি।”
ত্র চমকে ওঠে, বলে, “কি ছিল তাতে?”
লী উঠে দাঁড়ায়, সঙ্গে ত্র’ও। হেঁটে পাশের ক্যাফেতে চলে আসে। একটা উত্তেজক পানীয় নিয়ে জানালার পাশে বসে পড়ে।
“তুমি ভাবতেও পারবে না তাতে কি লেখা ছিল!” লী তাকে আগ্রহ নিয়ে বলতে থাকে, “সেখানে ছিল একটি জাতির উপকথা।”
ত্র প্রথমবারের মতো চুমুক দিয়ে বলল, “কি ছিল?”
“পৃথিবীতে নাকি তখন পানির বৃষ্টি হতো!”
“কি বললে?” ত্র কিছুটা অবাক হয়ে যায়।
“পানির বৃষ্টি হতো।” লী আবার বলে।
“সেটা কি করে সম্ভব।” ত্র’র চোখে মুখে তখন পরিপূর্ণ অবিশ্বাস।
লী বলে চলে, “আমরা যেটাকে পৃথিবী বলে জানি সেটি আসলে পৃথিবী নয়। বহু বছর পূর্বে পৃথিবীর মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় জন্য একটি মহাকাশযান নিয়ে মহাশূন্যে বেরিয়ে পড়ে। কালক্রমে সেটাই পৃথিবী নামে থাকে। বইতে লেখা রয়েছে সেই পৃথিবীতে নাকি সবুজ গাছপালা ছিল। আকাশ থেকে পানির বৃষ্টি হতো, মোটেও আগুনের নয়। মানুষ ঘরের জানালায় পাশে বসে সেই বৃষ্টি দেখত। ইচ্ছে হলে হাত দিয়ে স্পর্শও করত।” লী থেমে যায়।
“আর?”
“আর ইচ্ছে হলেই বৃষ্টিতে ভিজতো। সত্যিকারের পানিতে।”
উত্তেজনায় যেন এবার ত্র’য়ের শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। সে ভাবতেই পারেনি তাদের পূর্বে কোন গ্রহ ছিল, সেখানে মানুষ থাকতো তাহলে মহাবিশ্বে মানুষ আর যাযাবর প্রাণী হিসেবে রইল না। এখন জানা গেল মানুষের ঘর ছিল, স্থায়ী ঠিকানা ছিল। এ সব ভাবতে থাকে।
আর লী’র চোখে তখন পৃথিবী।
“আচ্ছা আমরা রিতুনের সমীকরণের শেষধাপ দিয়ে অতীতে যেতে পারি না?” ত্র’কে জিজ্ঞেস করল।
ত্র ভাবতে কিছুক্ষণ সময় নিল; তারপর বলল, “হয়তো, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন বিপুল শক্তি, অভাবনীয় শক্তি।”
লী যেন কিছুটা আশাহত হলো। কিছুক্ষণ পর হঠাৎই বলে উঠল, “তাহলে আমরা সময়কে স্থির রেখে বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারি না?”
ত্র বুঝতে পারে না লী কি বোঝাতে চাইছে, তাই সে জানতে চায়, “সেটি কেমন।”
“ধর আমরা রিতুনের সমীকরণ ধরে একই সময়ে অবস্থান করে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতে পারি না? তাহলে তো কম শক্তি লাগার কথা।”
এবার ত্র বুঝতে পারে লী কি বলতে চায়? সে বলে, “তা সম্ভব তবে সেখানেও কম শক্তি লাগবে না!” সংশয় প্রকাশ করে।
“সাইরাস ফর্টিটু গ্রহাণু থেকে একটি মহাকাশযান গত সপ্তাহেই আমাদের কাছে এসেছে। সেখানে প্রচুর অ্যান্টিমেটার রয়েছে। আর আমি যেভাবেই হোক একটা কুরু ইঞ্জিন সংগ্রহ করে ফেলবো। তারপর…” কিছুক্ষণ থেমে ত্র’র দিকে তাকিয়ে চোখ উজ্জ্বল করে জানতে চাইল, “কি তুমি পারবে না?”
ত্র’র চোখমুখও ততক্ষণে আনন্দে ভেসে উঠেসে। হেসে নিজেই নিজের খোঁপা বাঁধা চুল খুলে দিয়ে বলল, “অবশ্যই।”
লী আর ত্র’র চোখে তখন হারানোকে ফিরে পাওয়ার এক অন্যরকম অনুভূতি, নিজ ঘরে ফেরা আনন্দ। চোখে মুখে তখন এক অপার্থিব আনন্দ খেলা করে। কোন মানুষই সে রকম চোখ আগে দেখতে পায়নি।
পাবেই বা কেমন করে? মানুষতো গত তিন হাজার বছর এরকম কোন স্বপ্নই দেখেনি।
পরিশিষ্ট :
“এই হলো পৃথিবীতে মানুষের ফিরে আসার গল্প।” আমি বললাম। আর আমি যোগ করলাম, “লী আর ত্র হচ্ছে আমার বাবা-মা। তারাই হচ্ছে পৃথিবীতে পা রাখা প্রথম মানুষ।” সমুদ্রের তীরে ক্যাম্পফায়ার করে একদল মানুষের সাথে বসে গল্প করছি। সমুদ্রের ঢেউ ভাঙ্গা গর্জন আর শোঁ শোঁ বাতাসের মাঝে ক্যাস্পফায়ারের মজাই আলাদা।
সামনে বসে থাকা হালকা-পাতলা ছেলেটি বলল, “তোমার মা-বাবার সাথে আর কেউই আসেনি?”
“তারা যখন প্রথমবার আসেন তখন দুজনই ছিলেন। কিন্তু এরপর তারা সব মানুষকে বুঝিয়ে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হন।”
“মানুষ এত সহজে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারলো?” পিছন থেকে কেউ একজন বললো, হালকা আলোতে আমি তার কালো অবয়ব ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না।
“না, সেটা সহজ ছিল না, অনেকখানি সময় লেগেছিল মানুষকে বোঝাতে আর তাছাড়া ততদিনে মহাবিশ্বের আরও অনেক বুদ্ধিমান সভ্যতা পৃথিবীর কথা জেনে গিয়ে ছিল। তাই কাজটি সহজ ছিল না। তারপর………..”
“তারপর ……..?”
“অনেক কথা।” আমি থেমে উত্তর দিলাম।
“হ্যাঁ বলো। আমরা তোমার সব কথা শুনবো।” সবার চোখে তখন কৌতূহল উদ্দীপক চাহনি। গভীর অন্ধকারে আগুনের পাশে বসে থাকা এই সব মানুষেরা আমার কাছ থেকে ফিরে আসার গল্প শুনতে চায়। প্রায় রাতেই আমি সবার সাথে এ গল্প করি।
“তোমার বাবা-মা পৃথিবীতে এসে কি দেখল?” কেউ একজন বললো।
“পৃথিবীতে ততদিনে আবার সবুজে ভরে গেছে। পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তাও শেষ হয়ে গেছে। সব জায়গায় শুধু ফুল আর ফুল।” আমি বললাম, “মানুষকে তখন সবকিছু আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হলো।”
“তোমার বাবা-মা এমন কোনকিছু কি পেয়েছিল যা দেখে তার নিশ্চিত হয়েছিলেন, পুরোনো বইয়ের কথা সত্যি।”
“হ্যাঁ।”
“সেটি কি?”
“মানুষের কঙ্কাল।”
“হ্যাঁ কঙ্কাল।”
“কিভাবে পাওয়া গেল?”
“মহামান্য জ্যাক জে শ্রুফ রেখে গিয়েছিলেন। লিখে গিয়েছিলেন তেজস্ক্রিয়তার হাত থেমে বাঁচার জন্য তারা মহাশূন্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন। যদি কখনও পৃথিবীতে মানুষ ফিরে আসে তবে তারা যেন তাদের ক্ষমা করে।”
সবাই তখন আরও কাছাকাছি এসে পড়ে। আমি বলি, “বিশ্বে আবার মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠল। কোথাও এখন গোলাবারুদের গন্ধে বাতাস দূষিত হয় না। নীল আকাশের মাঝে থাকে সাদা মেঘের ভেলা। ভোরের ¯িœগ্ধ আলো সবাইকে মাতোয়ারা করে দেয়। দমকা বাতাস বইলে গাছের পাতা নড়ে উঠে। ঝিরিঝিরি বাতাসে মানুষের শরীর জুড়িয়ে আসে। রাতের আকাশ ভর্তি থাকে নক্ষত্র আর একফালি চাঁদ।”
সামনের বাচ্চা ছেলেটি আমার কোলে এসে বসে জিজ্ঞেস করল, “তোমার মা-বাবা কি তাহলে প্রথম মানুষ যারা পৃথিবীতে পা দিয়েছিলেন।”
“হ্যাঁ বাবু।” আমি তার নরম গাল টিপে উত্তর দিলাম।
“তাহলে আগে যে মানুষ পৃথিবীতে থাকত তারা কোথা থেকে এসেছিল?”
সেটা আরেক কাহিনী; আজ থাক অন্য দিন বলবো।”