পৃথিবী
মহাকাশযানের নিজ কেবিনের স্বচ্ছ মোটা কাচের মধ্যদিয়ে নোভা বাইরে তাকিয়ে আছেন। মহাকাশযানের সুতীব্র আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, ফলে বহুদূর পর্যন্ত অ্যাস্টরয়েড চোখে পড়ছে। হাতের কাছে থাকা নিয়ন সুইচটি তিনি আলতোভাবে স্পর্শ করে বন্ধ করে দিলেন। আর তখনই চারদিক এক অপার্থিব অন্ধকারে ভরে উঠল। এখন যতদূর চোখ যায় ততদূর নীকষ কালো অন্ধকার। নোভার চোখ ধীরে ধীরে অন্ধকার সহ্য করতে শুরু করে। খানিকক্ষন পর তিনি বহুদূরের নক্ষত্রের আলো দেখতে পেলেন। খুবই ক্ষুদ্র আলোকবিন্দু। আলোকবিন্দু গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় অনন্ত মহাশূণ্যে মহাকাশযানটি কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তখনও মহাকাশযানটি শব্দের গতি থেকে তিনলক্ষগুণ বেশি গতিতে মহাশূণ্যে ছুটে চলছে।
এভাবে মহাশূণ্যের দিকে প্রথম প্রথম কেউ তাকিয়ে থাকতে পারে না। মানুষ কখনই শূন্যতা সহ্য করতে পারে না কখনও স্পর্শও করতে পারে তখন তার নেশা ধরে যায়। প্রাগৈতিহাসিক কালে পৃথিবীর মানুষও গভীর আগ্রহ নিয়ে অনন্ত মহাশূণ্যের দিকে তাকিয়ে থাকত।
নোভা নিজকে সামলে পিছন ফিরে তার ঘরে চলে এলেন। হালকা নীলাভ আলোতে তিনি তার ছোট্ট মেয়েটিকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখলেন। তার নিষ্পাপ মেয়েটিকে আরও নিষ্পাপ ও অসহায় মনে হচ্ছে। মানুষকে ঘুমিয়ে থাকলে সবসময়ই কোন এক বিচিত্র কারণে অসহায় মনে হয়। তিনি মেয়ের পাশে বসে আলতোভাবে তার খয়েরী চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে অত্যন্ত প্রাচীন ভঙ্গিতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। কিছুক্ষণ পর ডাক দিলেন, ‘মামনি, মামনি… ইরা.. মামনি ওঠ।’
ইরা আধবোঝা করে চোখ খুলল।
তিনি আবার বলনেন, ‘মামনি ওঠ এখনই পৃথিবী এসে পড়বে।’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘চল, দেখবে।’
ইরার কোন ভাবান্তর হয় না। সে মনে হয় আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনি আবার ডাক দিলেন, ‘মামনি ওঠ .. চল।’
‘না আমার ঘুম পেয়েছে। আমি দেখব না।’ ইরা ঘুম জাড়ানো চোখে বলে।
‘ছিঃ একথা বলে না। তিনি ইরাকে তার কোলে বসিয়ে কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বললেন,” পৃথিবী এলে সবাইকে পৃথিবী দেখতে হয়।
এবার ইরা নড়েচড়ে উঠল। সে তার ক্ষুদ্র জীবনে কখনই পৃথিবী দেখেনি। তাই একে নিয়ে নিষ্ফল আবেগের মানেও সে বুঝতে পারে না।
নোভা তার মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে হাত দিয়ে যথাসম্ভব শক্ত করে ধরে জানালাল পাশে এসে দাঁড়ালেন। বহুদূরে একটি গোলাকপিণ্ডকে দেখা যাচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে এটি ততই বড় ও কালচে নীলাভ রঙ এ বদলে যাচ্ছে। মহাকাশযানটি একসময় সেই নির্জীব, প্রাণহীন, ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রহটির ভিতরে সুতীব্র বেগে ঢুকে পড়ল। যতদূর চোখ যায় নোভা ঠিক ততদূরই ধ্বংসস্তুপ দেখতে পেলেন। তারপর একসময় মহাকাশযানটি বিস্তৃর্ন মরুভূমি, ধূ-ধূ প্রান্তর আর ভয়াবহ ধ্বংসস্তুপকে পাশে ফেলে রেখে তীব্রবেগে গ্রহটি থেকে বের হয়ে এল।
এরপর আবার গ্রহটি ছোট হতে হতে বিন্দুর মত ধারণ করে একসময় অনন্ত মহাশূণ্যে ছারিয়ে গেল। নোভার মনে পড়ে এই গ্রহ থেকেই তার পূর্বপুরুষ এসেছিলেন যখন মানুষের জন্ম হতো কষ্ট আর আনন্দের এ সুতীব্র অনুভূতি থেকে। তাও কয়েক হাজার বছর আগের কথা।
ইরা অবাক বিস্ময়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মহাকাশযানের আবছা অন্ধকারে হালকা বাতাসে তার মার খয়েরী চুল দুলতে থাকে। মায়ের এরুপ আগে কখনও সে দেখেনি। পৃথিবী নিয়ে বড়দের অদ্ভুত আবেগের মানে সে কখনও বুঝেনি, বুঝতে চায়ও না।
ইরা দূরে তাকিয়ে তারার আবছা আলো দেখতে থাকে। এই ছোট ছোট আলো দেখতে তার খুবই ভালো লাগে।
সে কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারে না।