Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

উটন দাদুর কাহিনী-১৫ (শিশু ও কিশোরদের বনজঙ্গলের রোমাঞ্চকর উপন্যাস)

: | : ১৩/০১/২০১৪

 

131010144323-jimmy-nelson-dassanech-tribe-ethiopia-horizontal-gallery

 

নেচু শুরুতে  প্রাণপণে দু হাতে আঁকড়ে ধরে ছিল গাছের ডাল। ওর এক পা ধরে বুনোরা টানছিল–ও আর গাছে অন্য পাটা ঠেকিয়ে রাখতে পারল না,সে পা ঝুলে পড়ল নিচের দিকে। এবার বুনোরা ওর দু পা ধরে হেঁচকা টান মারল। নেচু নিজেকে ধরে রাখতে পারল না—হাত থেকে তার জাপটে ধরে রাখা গাছের ডাল ছুটে গেল–ওর সমস্ত শরীর ঝুলে পড়ল নিচের দিকে—দুটো পা তখনও ধরা ছিল বুনোদের হাতে। আদিমরা আনন্দে নেচে উঠলো–শিকার ধরা পড়েছে–ওদের মুখে মুখে আনন্দ সূচক কথা ও গুঞ্জন ফুটে উঠলো। দু চারজন ওদের মধ্যে খুশিতে ঘুরে ঘুরে নেচে উঠলো। ওরা খুব খুশি,আজ আমিষ খাদ্য জুটেছে,সে সঙ্গে শত্রু ধরা পরেছে !

নেচু  চীৎকার করে উঠল—পর মুহূর্তে ভয়ে ও ব্যথায় ও বিহ্বল হয়ে গেল। নেচুর চীৎকারে বন্যরা মুখে হুহু হাহা শব্দ করে আনন্দে মেতে উঠল। নেচু  নিজেকে ছাড়াবার জন্যে হাত পা ছুঁড়ছিল,তাই দেখে ওদের মধ্যে দুজন ওকে লাথি আর চড় মারল,একজন তো অস্ত্র দিতে ওর কাঁধে  আঘাত করল। নেচু এবার ঝিম মেরে পড়ে থাকলো। বুনোরা ওর হাত-পা বনের লতা দিয়ে বেঁধে  মোটা গাছের ডালে তার শরীরকে ফাঁসিয়ে দিল আর দুজনে সে  ডালের দু দিক কাঁধে নিয়ে এগিয়ে চলল আরও শিকারের সন্ধানে। নেচু মাঝে মাঝে যন্ত্রণায়  উঁ,আহ করে উঠতেই জংলীদের কেউ কেউ ওদের ছুরি চাকুর হাতিয়ার দিয়ে ওকে খোঁচা মারছিল।

এক জাগায়  এসে বুনোরা সবাই থেমে গেল–কিছু সময় জটলা করে নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি  করল,তারপর ওরা ওদের চলার পথের দিশা বদলে নিলো। এবার ওরা নিজেদের গ্রামের পথ ধরল। ওরা সবাই এখন ফিরে চলেছে—শিকারের আশায় আর এগিয়ে যেতে চাইল না ওরা।

দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে  গেল। নেচু আর রাবুনকে ওরা চ্যাং দোলা করে নিয়ে যাচ্ছে। রাবুনের অবস্থা বড় সঙ্গিন–তার মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ বের হচ্ছিল। ওকে খুব মেরেছে বন্যরা–পালিয়ে যাওয়ার শাস্তি হিসাবে ও উপরি মার খেয়েছে। আজ হয়তো রাবুন আর নেচুর মাংসেই  জংলীদের নৈশ ভোজন হবে।

নেচু আর রাবুনের মনের মাঝে কোন ভাবনাই আসছিল না। ওদের মনটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল–কোন স্থির ভাবনা করার মত ওদের শক্তি ছিল না। বীভৎস এক মৃত্যুর চেহারা ঘুরে ফিরে ওদের চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।

বুনোরা রাবুন ও নেচুকে নিয়ে পাথরের উপাসনা গৃহে প্রবেশ করল। সেখানে বিগ্রহ পাথরের কাছে এনে ধপাস করে নেচুকে পাথরের মেঝেতে ফেলে দিল। রাবুনকে নিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে জোরে জোরে কিছু বলাবলি করে ওকেও মেঝেতে ছুঁড়ে দিল। রাবুনের মুখ থেকে গেক,করে একটা শব্দ বেরল–সামান্য নড়ে উঠলো ওর শরীরটা। তারপর চুপ মেরে গেল।

নেচুর দু,চার জাগা থেকে রক্ত ঝরছিল। ওকেও ছুরি জাতীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে ছিল বুনোরা। সে সব ক্ষতগুলিতে প্রচণ্ড ব্যথা। ও ব্যথা সহ্য করে ঝিম মেরে পড়ে ছিল। বুনোদের মধ্যে থেকে একজন হঠাৎ নেচুকে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে দিলো। নেচু ব্যথায় কাতরে উঠলো। বুনোরা নেচুর অবস্থা দেখে উৎকট হেসে উঠলো–সে হাসি বড় ভয়াবহ–হিংস্র।

চারদিকে মশালের আলো জ্বলছিল। তবু আলো থেকে অন্ধকারের ভাগটাই বেশী মনে হচ্ছিল। দূরের জিনিস ভাল ভাবে দেখা যাচ্ছিল না।

এবার বুনোরা সবাই মিলে তাদের দেবতার কাছে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ল। কিছু কি তারা প্রার্থনা করছিল ! কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। কিছু সময় চারদিক বড় শান্ত হয়ে গেল। মিনিট কয় পরেই আবার হৈহল্লা শুরু হল–নেচু ধীরে ধীরে চোখ মেলে দেখল,ওরা নাচতে শুরু করে দিয়েছে। অদ্ভুত তালে বেতালে ওরা লাফাচ্ছিল। লাফ দিয়ে শরীরকে ওরা  একবার নিচুতে একবার উঁচুতে করছিল। এটাই হবে ওদের নাচের ধরন ! তারপর ঠক-ঠক, ঠক-ঠক,করে বেজে উঠলো বাঁশের লাঠির বাড়ি। বড় বড় ফাটা বাঁশ নিয়ে পাথরের মেঝেতে পিটাতে লেগেছে ওরা। ফাটা বাঁশ গুলোই ওদের বাদ্যযন্ত্র হবে। মাঝে মাঝে একজন আর একজনের  বাঁশে বাড়ি মারছিল,সে সঙ্গে নানান অঙ্গভঙ্গি করে হেসে উঠছিল। ওদের হাসিও বড় ভয়াবহ ও বিকৃত লাগছিলো। হৈহল্লা আর বাঁশের বাড়ির শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছিল না।

নেচুর এবার চোখে পড়ল,এক জাগায় টাল করে রাখা বড় বড় শুকনো গাছের ডাল। বুনোদের কয়েকজন সেখানে গিয়ে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করছে। ওদের দু হাতে দুটো পাথরের টুকরো, একটা আর একটাতে জোরে জোরে ঠোকাঠুকি করে যাচ্ছে। আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছিল সেগুলি থেকে। একটু পরেই সফলতার সঙ্গে আগুন জ্বলে উঠলো। কাঠের বড় বড় লাকড়ি থেকে প্রথমে বেশ ধোঁয়া বের হতে লাগলো–তারপর ধীরে ধীরে সেগুলি জ্বলে উঠলো।

এবার শুরু হল আদিমবাসীদের নর্তন উৎসব–তালহীন উন্মাদের নৃত্য আরম্ভ হল। গ্রাম থেকে বউ,ছেলে,মেয়ে,বৃদ্ধরা একে একে উৎসবে যোগ দিতে লাগলো। ওরা সবাই মিলে অতাল বেতাল নেচে যেতে থাকলো ! বাঁশের বাড়ির ঠুস ঠাস,চটাং চটাং এমনি আজিব রকমফের আওয়াজের সাথে সাথে ওদের লাফালাফির নাচের প্রদর্শন চলতে থাকলো।

নেচু ভাবছিল,বনমানুষগুলি কি তাকে কেটে কাঁচা মাংসই খাবে ? না কি ওই সামনের জ্বলন্ত আগুনের ভেতরে ফেলে দেবে আর পুড়িয়ে খাবে তার মাংস ? উঁ–আর ভাবতে পারছিল না নেচু। চারদিকে ধপাধপ পায়ের শব্দের তালে বেতালে ভূতের নাচ চলেছে–ল্যাংটা ভূতের নাচ ! উলঙ্গ ছেলে-মেয়ে,বুড়ো-বুড়ি, সবাই উলঙ্গ—তাদের শরীরে এক চিলতে পোশাক নেই ! সবার শরীর আলোআঁধারে একবার জেগে উঠছে,আবার মিশে যাচ্ছে মিশমিশে অন্ধকারে। নেচুর মনে হল,সে নির্ঘাত কোন প্রেতপুরীতে এসে গেছে। এখনি ভূতেরা বুঝি তার মুণ্ড ছিঁড়ে খাবে !

বন্যরা নাচতে নাচতে মাঝে মাঝেই চীৎকার দিয়ে উঠতে লাগল–সে চীৎকার গমগম শব্দে আকাশ পাতাল যেন কাঁপিয়ে দিতে চাইল। ওদের অনেকেই এবার রাবুনের স্থির দেহটার কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল। একজন এসে আগুনের ভেতর থেকে এক বড় জ্বলন্ত গাছের ডাল এনে রাবুনের গায়ে চেপে ধরল। ও নড়েচড়ে উঠলো–ওর শরীরে নড়ে ওঠার মত শক্তিও নেই। বুনোটা বারবার জ্বলা লাকড়ি ঠেসে ধরছিল রাবুনের গায়ে। আর নড়ছে না রাবুন। ও তবে কি মরে গেল ! নেচুর চোখের সামনে রাবুনের দেহটাকে ওরা এবার টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে–মনে হল ওকে দেবতার বিগ্রহের কাছে নিয়ে চলেছে।

আদিম হিংস্ররা তাদের হাতিয়ার তুলে নিলো–আর একের পর এক সবাই রাবুনের দেহে আঘাত করতে লাগলো। রাবুন মৃত অথবা সে এখন জ্ঞান হারিয়েছে। জংলীরা এবার রাবুনের হাত পা পাথর দিয়ে থেঁতলে,হাতিয়ার দিয়ে কেটে আলগা করে দিলো। তার হাত,পা বাদ দিয়ে বাকি শরীরটা এবার ওরা জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ছুঁড়ে দিল।

–কি ভয়ঙ্কর ! কি ভয়ঙ্কর !! নেচু আর দেখতে পারছিল না–ওর চোখ ভয়ে আপনি বন্ধ হয়ে এলো–ও যেন ক্রমে ক্রমে অজ্ঞান হয়ে যেতে লাগলো। তারপর রাবুনের শরীরের বিশ্রী,পোড়া দগ্ধ চারিদিক ছড়িয়ে গেল–এ যেন এক নরক কুণ্ডে এসে পড়েছে নেচু !

বুনোরা রাবুনের দেহের পোড়া মাংস খাচ্ছে–হাত পায়ের হাড্ডি থেকে মুখ লাগিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে,খুবলে খুবলে খেয়ে চলেছে–সেই হাড্ডি নিয়ে চলছে কাড়াকাড়ি–একজন আর একজনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে আর গোগ্রাসে রাক্ষসের মত গিলে গিলে খাচ্ছে !

অনেক সময় ভয়ে চোখ বুজে আছে নেচু। মাঝে সামান্য চোখ খুলে দেখল,বাচ্চা ছেলে,মেয়েরা রাবুনের মাংসহীন হাত-পায়ের হাড্ডিগুলি চুষে খাচ্ছে। ওঃ–কি সব ভয়ঙ্কর দৃশ্য ! ও আবার চোখ বন্ধ করে নিলো। ও জানে না,কে ওদের দেবতা–এত পাষাণ হৃদয় কি কোন দেবতার হতে পারে ?

নেচুর চোখ থেকে কখন যেন জলের ধারা গড়িয়ে বুক বেয়ে নেমে এসেছে। হঠাৎ নেচুর কি মনে হল ও মনে মনে বলে উঠলো,হে আদিমদের দেবতা,তুমি তো জানো আমাদের এখানে আসার মূলে সৎ ইচ্ছাই ছিল–তুমি যেই হও–এই নিষ্ঠুরতা তুমি নিশ্চয় চাও না–তোমার কাছে তো আমরা সবাই সন্তান, তবে, তবে কেন তোমার মানুষ সন্তান,মানুষকেই খাচ্ছে ? হে দেবতা ! তুমি যদি সত্যি হয়ে থাক,তবে আমাকে বাঁচাও,আমাকে বাঁচাও—কথা কটি আওড়ে নেচু শান্ত হয়ে গেল। বোধহয় আরও গভীর ভাবে দেবতাকে ও স্মরণ করে চলেছে।

ক্রমশ…

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top