স্বপ্নচারী(unknown future)
এখন আমি যে পথটি ধরে হেটে চলছি। না, হেটে চলছি না। আমি যেভাবে পা ফেলছি, তাকে হেটে চলা অথবা দৌড়, কোনোটিই বলা যায় না। হাটা ও দৌড়ের মাঝখানে যদি কিছু থেকে থাকে, আমি ঠিক সেই গতিতে পা ফেলছি। যে পথ ধরে আমি হেটে চলছি, তা আমার অচেনা অজানা একটি পায়ে হাটা পথ। অচেনা অজানা হলেও মাঝে মাঝে আমার কেন যেন আবছা আবছা মনে মনে হচ্ছে, এই পথ ধরে আমি হাটছি বহুকাল। বহুকাল? বহুকাল বলতে কতকাল, জানি না। হতে পারে শত সহস্র বছর। কখনো কখনো মনে হচ্ছে, এই পথটি চলে গেছে গহীন অরণ্যের মাঝখান দিয়ে। অরণ্যের নিগূঢ় কালো বৃক্ষগুলো ঠিক নিগ্রোদের মতো তমসাচ্ছন্ন। চারিদিকে শুধুই অন্ধকার, ঘোর অন্ধকার!
আবার কখনো মনে হচ্ছে, আমি হেটে চলছি ঠিক দুটি আকাশের মাঝখান দিয়ে। একটি আকাশ আমার পায়ের নিচে, অন্যটি শির হতে এতটা দূরে যে, হাত দিয়েই ছোঁয়া যাবে তার মেঘমালা। পায়ের নিচের আকাশটা কোথাও হিম শীতল, আবার কোথাও আগুন গরম। গরম অংশে পা পড়া মাত্রই মনে হচ্ছে, এই বুঝি জ্বলে পোড়ে ক্ষার হয়ে গেল আমার সমস্ত দেহ! আমার মাথার উপরের আকাশ জোড়ে কেবল আগ্রাসী মেঘের খেলা। মেঘের রক্ত চক্ষুর তীর্যক চাহনী অর্থাৎ বিরামহীন বিজলী চমকানো দেখে ভয়ে আমার বুক ফেঁটে যেতে চাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি আকাশের মায়া ত্যাগিয়া বৃষ্টি হয়ে নিচে নেমে এসে, ভাসিয়ে নিয়ে গেল আমায়! তবুও আমি ছুটে চলছি প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে। যত হাটছি ততই দেখতে পারছি, পথটি কোথাও সরু, আবার কোথাও বেশ প্রশস্ত। প্রশস্ত পথ ধরে চলতে চলতে হঠাৎ যখন পথের সরু অংশটুকু চলে আসছে, তখনি বুকটা ধড়ফড় করে ওঠছে। মনে হচ্ছে সামনে হয়ত পথ ফুরিয়ে গেছে এবং আমি চলে এসেছি পৃথিবীর শেষ সীমানায়! অর্থাৎ আমার সময় শেষ, চলে এসেছে নিধানকাল!
এখন আমি আর তেমন দ্রুত গতিতে চলছি না। চলতে চলতে আমি এখন প্রায় শ্রান্ত পরিশ্রান্ত। আমার দু-চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, পিপাসায় আমার গলদেশ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে! হঠাৎ মনে হল পেছন থেকে আতংকের লেলিহান ধেয়ে আসছে আমার দিকে। আমি আবারো দ্রুত পা ফেলতে শুরু করেছি। ক্রমশ বাড়ছে আমার চলার গতি। ইচ্ছে করেই আমাকে বাড়াতে হচ্ছে। কারণ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, কেউ বা কিছু একটা আমার পিছু করছে হয়ত আমার প্রাণ নাশের নেশায়। আমি সর্বশক্তি দিয়ে দৌড়াতে শুরু করছি। আমাকে দৌড়াতে দেখে আমার পিছু নেওয়া জিনিসটাও দৌড়াতে শুরু করছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ তার পায়ের শব্দ ক্রমশ আমার কানে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠছে। আমি দৌড়াতে দৌড়াতেই ঘাড় ঋজু করে পেছন তাকালাম, না কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু পায়ের শব্দটি ঠিকই শোনাচ্ছে। আমি দৌড়াতে দৌড়াতেই ভীষণ চেষ্টা করছি চিৎকার করে বলতে, বাঁচাও, কেউ আমাকে বাঁচাও। কিন্তু পারছি না, মুখ থেকে কোনো শব্দ বা কথা বের হচ্ছে না!
কয়েক মূহুর্ত পরই অদৃশ্য পায়ের শব্দটি অস্পষ্ট হয়ে গেল। আমি ঠাঁয় দাড়িয়ে ভালো ভাবে কান পেতে শব্দটি শোনতে চেষ্টা করলাম, না, আসলেই এখন আর শব্দটি শোনা যাচ্ছে না। যে অশুভ জিনিসটা আমার পিছু করতে ছিল, সেটি বোধ হয় চলে গেছে। থ্যাংকস গড। গরুর গলায় ছুরি চালানোর পর যেভাবে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে এক সময় নিঃশেষ হয়ে যায়, আমি এখন বসে বসে ঠিক সেই ভাবে ফোঁফাচ্ছি। দম বন্ধ হয়ে আসছে চাচ্ছে! হঠাৎ একটি বাক্য ওনুনগ কাবের কাছে চরম বেসুরে বেজে ওঠল, ভয় পাবেন না, মিস্টার এম। আমার ভেতরের চাপা ভয়টি আবারো মাথাচাড়া দিচ্ছে। ফের আমার সর্বাঙ্গ শিউরে ওঠছে! তারপরও আমি কাঁপা স্বরে শুধালাম, কে? কে ওখানে? বাতাসে অদৃশ্য শব্দ, ভয় পাবেন না, মিস্টার এম। আমার দ্বারা আপনার কোনো অনিষ্ট সাধিত হবে না।
এবার প্রথমবারের চেয়েও বেশ স্পষ্ট শোনতে পেলাম। কেমন যেন অদ্ভুত এক কন্ঠস্বর। কোনো মানুষের কন্ঠস্বর এমন হতে পারে না। আমি কথাগুলো বুঝতে পারছি, এছাড়া মানুষ পশুপাখি অর্থাৎ এ যাবত কাল পর্যন্ত শোনে আসা কন্ঠস্বরগুলোর কোনোটির সঙ্গে এই স্বরের তেমন মিল নেই। মনে হচ্ছে যেন ভিন্ন কোনো জগৎ থেকে ভেসে আসা ভিন্ন কোনো কন্ঠস্বর! একেবারেই ছাড়া ছাড়া, ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথা। কোনো ভিন্ন ভাষীর লোক বাংলায় কথা বললে যেমন শোনায়, কিছুটা সেই ধরনের। আমি এদিক ওদিক ভালো ভাবে তাকিয়ে দেখলাম, না, আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। খানিক পর আমি আবারো বললাম, কে তুমি, কোথায় থেকে কথা বলছ? আবারো অদৃশ্য শব্দ, ধরে নিন আমি আপনার অতি প্রিয়জনদের একজন। আমার প্রিয়জন! আমার কোন প্রিয়জন? মাইনাসদের একজন। কি? অর্থাৎ যাকে বা যা আপনি এখনো দেখেন নি, সেই রকম একজন। যে কিনা আপনার চেয়ে অনেক বেশি পরিপূর্ণ।
পরিপূর্ণ, যাকে আমি দেখি নি, তাদের একজন! কে কথা বলছে, কোথায় থেকে বলছে, এসবের কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না। প্রচন্ড অস্বস্তি ও বুক ভরা ভয় নিয়ে প্র্রায় অদৃশ্যমান দাড়িয়ে আমি ভাবছি, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি, নাকি এটা কোনো জ্বিন ভূতের খেলা? অমনি বাতাস থেকে অচেনা শব্দ ভেসে এল, না মিস্টার এম, এটা কোনো জ্বিন ভূতের খেলা নয়। আমি বললাম, তাহলে কে তুমি? আমি কে, তা পরে বলছি। অনুগ্রহপূর্বক আপনি আগে আপনার মৃত প্রিয়জনদের নাম মনে করুন। আমার মৃত প্রিয়জনদের নাম, কেন?
কারণ মৃতরাও মাইনাসের অংশ। এছাড়াও অন্য প্রয়োজন আছে, মিস্টার এম। কি প্রয়োজন?
পরে বলছি। আগে আপনি নাম মনে করুন। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আমার কোনো প্রয়োজন নেই। অচেনা স্বরটি আবারো বলল, প্রয়োজনটা আপনারই মিস্টার এম। এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সুবোধ ছেলের মতো আমি আমার মৃত প্রিয়জনদের নাম মনে করতে শুরু করলাম। কেন আমি এই অচেনা অজানা একটি উদ্ভট কন্ঠের কথা মতো কাজ করছি ঠিক বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, আমার প্রিয়জনদের কে কে মারা গেছে… অমনি বাতাস থেকে শব্দ ভেসে এল, মিস্টার এম, এই পর্যন্ত আপনার অতি প্রিয়জনদের তিনজন মারা গেছে।
আমি বললাম, তিনজন, কে কে?
এস, কে, এস।
এস, কে, এস, এসব কি?
এসব হচ্ছে এম আই ডি, ও টি এস-এর সাংকেতিক নামের শর্টফর্ম ও পূর্বরূপ। এম আই ডি, ও টি এস ওটা আবার কি? এম আই ডি, ও টি এস হচ্ছে মেনি ইমপোর্টেন্ড ডাটা, অর দ্য স্ক্রিয়েট। ধীরে ধীরে আপনি সব জানতে পারবেন, আগে আপনি আপনার হারানো প্রিয়জনদের নাম মনে করুন, প্লিজ। উহ! আচ্ছা, একটু আগে তো বললে আমার মৃত প্রিয়জনদের নাম মনে করতে, এখন আবার হারানো বলছ কেন? মৃত আর হারানোর মধ্যে বেশি প্রার্থক্য নেই। দুটোই ইনক্সিস্টেন্ট অর্থাৎ মাইনাস। তুমিও তো নিজেকে মাইনাস বলছ, তাহলে তুমিও কি মৃত? না। আমি ফিউচার। ফিউচার! কিসের ফিউচার? অর্থাৎ আপনি যা জানেন না, তার একটা অংশ। বলতে পারেন, আননোন ফিউচার। কে কথা বলছে, কোথায় থেকে বলছে, এসব ভাবনার চেয়েও এখন আমার মনকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরছে যে প্রশ্নটা তা হল, এসব কি বলছে? কিছুই তো আমার মাথায় ঢুকছে না।…………….
(স্বপ্ন নিয়ে আমার ধারাবাহিক উপন্যাসের দ্বিতীয় খন্ড থেকে সামান্য তুলে ধরলাম। যদি ভালো লাগে তাহলে ভবিষ্যতে আরো পোস্ট দেবো। ধন্যবাদ সবাইকে। প্রথম খন্ড স্বপ্ননীল সামনের বইমেলায় পাওয়া যাবে। আগামী সপ্তাহে বইটি প্রেসে যাবে বলে আশা করছি)