বাজী ( ২য় পর্ব )
৩ .
কালাম , জীবু আর হাসেম ।
প্রায় সমবয়সী তিন যুবকের সম্পর্ককে এখন আর বুঝি শুধু বন্ধুত্ব হিসাবে সংজ্ঞায়িত বা বিশেষায়িত করা যাবে না । আসলে গত কয়েকবছর ধরে তাদের জীবন এমনভাবে এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে যে তাদেরকে এখন একজন হিসেবে আলাদা করাই মুস্কিল । বলা যায় অনেকটা অসম্ভবও । কালাম আর হাসেমের মধ্যে আগে থেকেই পরিচয় আর বন্ধুত্ব থাকলেও ওদের সঙ্গে জীবু যোগ দিয়েছে সবচেয়ে পরে । মাত্র কয়েকবছর আগে । ওদের সেই পরিচয়টা অবশ্যই কোন সুস্হ সময়ে বা মাধ্যমে হয়নি ।
সত্যি বলতে কি ,এদের সাথে জীবুর জড়িয়ে পড়ার কোনরকম কথাই ছিল ন । কারণ বাকী দুইজনের মতন পরিবার পরিজনহীন অবস্হায় বড় হয়নি জীবু । ছোট থেকেই রাস্তায় রাস্তায় তাকে চালাতে হয়নি কোনমতে বেঁচে থাকার যুদ্ধ । বলতে গেলে নিজের হাতে নিজের ধ্বংস টেন এনে নিজেকে আজ এই পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে সে । যেখান থেকে এখন আর ওদের চাইতে নিজেকে আলাদা কিছু ভাবার সমস্ত অধিকার সে হারিয়েছে ।
নইলে তিনভাই আর দুইবোনের সংসারে কোনকিছুর অভাব তো ছিল না । ওর বাবা নরেন দাসের বড় মনিহারী দোকান ছিল কুমিল্লা শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে । এছাড়া ছিল সুদের ব্যবসা । জমি জিরাতও করেছিলেন প্রচুর । এইতো পাশের দুই গ্রামের পরেই তাদের সবকিছু এখনো আছে । আছে পুরো পরিবার । নেই শুধু তাদের সাথে তেমন কোন সম্পর্ক । যার জন্য আর কেউ কোনভাবেই দায়ী নয় । একমাত্র জীবু নিজে ছাড়া ।
জীবু পড়াশোনাও করেছে ক্লাশ টেন পর্যন্ত । ম্যাট্রিক পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি তার । আসলে তার বছর দেড়েক আগে থেকেই যে অধঃপতনে যাওয়া শুরু হয়েছিল জীবু । ক্লাশ এইটে থাকাবস্হাতেই হটাৎ করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায় পড়ে যান ওদের বাবা নড়েন দাস । শহরের বড়ো দোকান একা সামলাতে পারছিল না বড় ভাই শিবেন দাস । সেও সবেই বছরখানেক হলো বাবার সাথে ব্যবসায় আসা যাওয়া শুরু করেছে । আর ওদের সবচেয়ে পবন ছোট ভাইটি তখনও কোলের । ফলে স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে ভাইকে ব্যবসায় সাহায্য করার জন্য শহরের দোকানে বসা শুরু করে জীবেন ।
আর জীবুর অন্ধকারের পথে যাত্রা শুরু আসলে ঐ সময় থেকেই । দোকানে নিয়মিত কাঁচা টাকা হাতাতে হাতাতে কেমন করে দ্রুত হয়েছিল তার সেই অধোঃপতন – ভাবলে এখন আর নিজেই থই খুঁজে পায় না যেন । আর হাতে টাকা থাকলে যা হয় । কেমন করে কোথাদিয়ে যে এতো সংগীসাথী জুটে গেল ভগবানই জানে ! অথচ যাদের বেশিরভাগকেই সে আগে থেকে চিনতো না । সেই নবাগত বন্ধুদের হাত ধরেই একসময় সিগারেট থেকে আস্তে আস্তে গাঁজা , মদ , ফেন্সিডিল হেন কোন নেশা নেই সে যে জড়ায়নি । তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছিল বোধ করি জুয়ার নেশা । এই জুয়া তাকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে টাকা জোগাতে একসময় বেপরোয়াভাবে সরাতে শুরু করে দোকানের ক্যাশবক্সের টাকা । আর সেটা ধরা পড়তেও খুব বেশি সময় লাগেনি ।
এবং সেটা একসময়ে বাবার কানেও যায় । ছেলেকে শুধরাতে অসুস্হ অবস্হাতেও নরেন দাস কতিপয় কঠোর ব্যবস্হা গ্রহণ করেন । প্রথমেই বন্ধ করা হয় জীবুর দোকানে বসা । ফের বলা হয় পড়াশোনায় মনোযোগী হতে । দোকানে বসতে না পারায় বন্ধ হয়ে যায় তার হাতে টাকাপয়সা আসা । ধীরে ধীরে টাকা পয়সার অভাবে কমেও আসতে থাকে তার কু অভ্যাসগুলো । আর সবচেয়ে বড় কথা কমে আসে তার আশেপাশে ভীড় করা বন্ধুনামধারী পতঙ্গগুলো । হয়তোবা এভাবে আর কিছুদিন গেলে সত্যিই সদ্য ছেড়ে আসা অসুস্হ জীবন থেকে পাকাপাকিভাবে সুস্হ ধারায় ফিরে আসতে পারতো জীবু ।
কিন্তু বিধিবাম । নিজের উপর হারিয়ে ফেলা নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ফিরে পাবার আগেই একদিন ধরাধাম ছাড়লেন নরেন দাস । যা আসলে জীবুর গোটা জীবনটাকে ফের নিয়ে ফেলে আগের সেই নোংরা পাঁকের মাঝখানে । যেখান থেকে অল্পদিনই হয়েছিল উঠে আসার চেষ্টা করছিল সে । কিংবা বলা যায় তকে তুলে আনার চেষ্টা করছিল একটি অতি নিরাপদ হাত । হোক না অসুস্হ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা মানুষ , তবু তো মাথার উপর বাবা ছিল নির্ভরতার ছায়া হয়ে ! ছিলেন তার জীবনের ভালমন্দের শাসনদন্ড হয়ে ।
সেই বাবাই আর রইলো না । চলে গেল । যাবার বেলা ছেলেদের জন্য রেখে গেলো নিজের অর্জিত সম্পদের অংশ । যা সমানভাগে ভাগ করার পর একভাগ পেল জীবুও । ঐ বয়সে সম্পত্তি হাতে পেলে যা হয় জীবুর বেলায়ও তার কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি । প্রথমেই যা হলো সেটা ছিল পড়াশোনাকে চিরবিদায় জানানো ! মন দিল নতুন ব্যবসায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার । ভাইয়ের সাথে বনে না বলে নিজের অংশটুকু বড়দার কাছে বিক্রি করে জোগাড় করলো নিজের বআলাদা ব্যবসার পুঁজি । দাদাকে সে দেখিয়ে দিতে চায় , সেও ব্যবসায় বুদ্ধিতে বাপ ভাইয়ের চেয়ে কম যায় না । কিন্তু ভাগ্য বরাবরের মত এখানেও তাকে সহায়তা করলো না । ফলে বেশ কয়েকটা ব্যবসায় মুলধনের সঙ্গে চলে গেল অনেকখানি জমিজমাও ।
এরমধ্যে আবার ততোদিনে জুটে গেছে পুরনো সেই বন্ধুবান্ধবেরা । একদিকে একের পর এক ব্যবসায় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়া আর অন্যদিকে বন্ধুদের ক্রমাগত অনুপ্ররণা ! ফলে এবার আর খুব বেশি সময় লাগলো না জীবুর ভেসে যেতে । কারণ এখন আর তাকে রুখবার মতন কেউ ছিল না । হ্যা । বড়দা আর মা ছিল বটে । বড়দা শাসনও করতো বাবা বেঁচে থাকতে । এমনকি বাবা মারা যাবার পরেও কিছুদিন । কিন্তু তারপর আর করেনি । বিশেষ করে নগদ টাকার জন্য যখন থেকে জীবু ওর কাছ থেকে ধার করতে শুরু করেছিল । প্রথমদিকে মুখের কথায় ভাইকে টাকা ধার দিয়েছে শীবেন । কিন্তু অল্পকদিনপর থেকেই আর সই সাবুদ আর মাকে সাক্ষী রাখা ধার দিতে রাজী হয়নি শীবু । আসলে ততদিনে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে শীবু । শিখে গেছে নিজের ভালমন্দ বুঝে নিতে ।
আর মা ? মা কি বাঁধা দেয়নি ?
হ্যাঁ । দিয়েছিল বৈকি । কিন্তু ততোদিনে জীবুকে যে পেয়ে বসেছে আত্বধ্বংসের নেশায় । যে নেশায় একবার কাউকে পেয়ে বসলে চূড়ান্ত পতনের আগে তাকে থামানো প্রায় অসম্ভব । হয়তো অতি ভাগ্যবান কোটিতে দুই চারজন তা কোনভাবে ঠেকাতে পারে ।
কিন্তু আমাদের জীবু ততটা সৌভাগ্যবান ছিল না কখনোই !!!
——————————- ********* ——————————–
৪ .
হাঁড়িয়ার দক্ষ হাতে সাজানো গাঁজার কল্কিতে কষে টান লাগায় জীবু । বেশ কয়েকদিন ধরে আঁকুপাকুঁ করতে থাকা বুকের ছাতি যেন প্রিয় ধোঁয়ায় একবারেই ভরে পুষিয়ে নিতে চায় গত কদিনের ক্ষতিটুকু । না থেমে দ্রুত ফুঁকফুক করে টানা দম দিয়ে যায় বেশ কিছুক্ষণ । তারপর যখন মনে হয় শরীরটা এতোক্ষণে নিজের আয়ত্বে এসেছে – তখন সে কল্কি হাতবদল করতে বাড়িয়ে দেয় অন্যদের দিকে ।
কিন্তু সহসাই কেউ জীবুর বাড়ানো কল্কিটার দিকে হাত বাড়ায় না । কারণ ওরা জানে অভ্যস্ত নেশায় হঠাৎ বাঁধা পড়ার যন্ত্রনা । তাই ওরা সময় ও সুযোগ দিল জীবুকে আরো খানিকটা । আর তাছাড়া ওরা খুব ভালো করেই জানে ওদের যে ককারো চেয়ে জীবুর মাদকের প্রতি নির্ভরশীলতা কতোটা বেশি ! আর এজন্য তাকে কত কিছু হারাতে হয়েছে । যদিও কালুদের সাথে জীবুর পরিচয় আগে থেকে থাকলেও বন্ধুত্বে রুপ নিয়েছে বলা যায় জীবুর সর্বস্ব হারানোর পর ।
কালুরা বলতে গেলে জীবুর তুলনায় পথে ঘাটে বড় হওয়া মানুষ । ছোটবেলা থেকেই জীবন বাঁচানোর তাগিদে হেন কোন কাজ নেই – যা তারা করেনি । এবং এই করতে করতেই একসময় ওরা জড়িয়ে পড়ে এখানকার সীমান্তবর্তী এলাকার বহু মানুষের মতন পন্য চোরাকারবারীতে । যদিও চোরাকারবারী হিসেবে বড় মাপের কিছু ছিল না ওরা কখনোই । কাজ করতো স্রেফ ক্যারিয়ার হিসাবে । আর সুযোগ পেলে জীবুদের মতন কয়েকজনের কাছে বিক্রি করতো খুুচরা মাদক । আর এভাবেই একসময় জীবুর সাথে ওদের বন্ধুত্ব হয়ে যায় ।
জীবুর তখন বলতে গেলে দিশাহারা অবস্হা । সর্বশেষ ভিটাবাড়ীর নিজের ভাগটাও বড়ভাইয়ের কাছে বেঁচে দিয়ে ওকে নেমে আসতে পথে । সম্বল বলতে শেষ শেষ সম্বল বাড়ী বেঁচে পাওয়া অল্প কিছু টাকা । কারণ এর আগেই বেশিরভাগটা তার নিয়ে নেওয়া হয়েছে ভেঙ্গে ভেঙ্গে । সবশুনে কালুরাই ওকে পরামর্শ দিয়েছিল এই লাইনে নেমে পড়তে । ওদেরও যেমন পুঁজি দরকার নিজেদের মতন করে ব্যবসা করার । অন্যদিকে জীবুরও তখন কিছু স্হায়ী আয়ের ভীষণ দরকার হয়ে দাঁড়িয়েছিল । কারণ সবকিছু হারিয়ে সে এটুকু অন্তত বুঝে গিয়েছিল এই জীবনে আর কখনো নেশার খপ্পর থেকে বের হয়ে আআসতে পারবে না সে । আর বের হয়ে আসার কোন রকম ইচচ্ছাও ছিল না তার আসলে । বরং সব হারানোর কলঙ্ক নিয়ে লুকিয়ে থাকার জন্যই তার তখন আরো বেশি মাদকে ডুবে থাকার প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছিল । অবস্হা এমন দাঁড়িয়েছিল যে , হাতের সম্বল শেষ হওয়ার পর হয়তবা তাকে চুরি ছিনতাইতেই নামতে হতো একসময় !ফলে সে আর কোনকিছু না ভেবে নেমে পড়েছিল ওদের সাথে চোরাচালানের ব্যবসসায় ।
যাই হোক , সেও প্রায় চার পাঁচ বছর আগের কথা । সেই তখন থেকেই ওরা তিনজন আস্তে আস্তে জড়িয়ে গেছে একে অন্যের সাথে । এবং ভাল হোক মন্দ হোক এই দুইজন অন্তত জীবুর জন্য সুখের পায়রা না হয়ে একসময় সত্যিকারের বন্ধু হিসাবেই প্রমানিত হয়েছে । এবং এখন জীবুর ঘর সংসার পরিবার বলতে এরাই ।
– না জীবুদা । এইডা তুমি একলাই শেষ করো । আমি আবার বানামু হের পরে । ষ্টকে বহুৎ আছে ।
জীবুর উদ্দশ্যে বলে হাঁড়িয়া ।
ষ্টকের কোন অভাব থাকার কথা যে নয় – তা জীবুও জানে । কারণ হাঁড়িয়াকে ওদের সাথে রাখাই হয়েছে এজন্য । নইলে হাঁড়িয়ারও দিনকাল খুব ভাল যাচ্ছিল না । আগে ও চোলাই তৈরী করে গোপনে বিক্রি করতো । জীবুরাও মাঝেমধ্যে ওর কাছ থেকে ঐ চোলাই কিনে খেত । আর সেই সূত্র ধরেই হাঁড়িয়ার সাথে ওদের ঘনিষ্ঠতা । কিন্তু হাঁড়িয়ার সেই ব্যবসাও বেশ অনেকদিন ধরে বন্ধ হয়ে গেছে পুলিশ টের পেয়ে যাওয়ায় । এই সময়ই জীবুরা ওকে প্রস্তাবটা দিয়েছিল । এই বিরাট শ্মশাণ এলাকায় নিজেদের চোরাইমাল মজুদ করার জন্য এমন বহু জায়গা আছে যেগুলোর হদিশ হাঁড়িয়া ছাড়া আর কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয় । এমন হাঁঁড়িয়ার অজান্তে এইদিকে কিছু করাও সম্ভব নয় ।
প্রথমদিকে হাঁড়িয়া রাজি না হলেও শেষমেষ তাকে রাজি হতে হয়েছিল । কারণ এই শ্মশাণে কাজ করে যা আয় করে তাতে তার খাওয়াই ঠিকমতন জোটে না । এসব জুটবে কোথ্থেকে । এখন বলতে গেলে হাঁড়িয়া ওদের অবৈধ সব মালপত্রের জিম্মাদার । আর বিনিময়ে ওরা হাঁড়িয়ার অন্য সব প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখে !
এভাবেই ওরা একজন আরজনের প্রয়োজনে হয়ে উঠেছে একে অন্যের প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ ।
– আস্তে আস্তেই চালাই না হাঁড়িয়াদা । সারারাইতই তো পইড়া রইছে !
– হ । তা রইছে !
বিজ্ঞের মতন মাথা দুলিয়ে সায় দেয় হাঁড়িয়া । ( আগামী পর্বে সমাপ্য )
—————— ——– * ************* ———–