মানুষ !
মহাকাশযানের গতিবেগ যথাসম্ভব কমিয়ে তিনি কতগুলো বোতাম টিপে সামনের বিশাল স্ক্রীনের ছবিটিকে যতটাসম্ভব পরিস্কার করে দেখতে থাকলেন।
‘তাহলে এই তোমার নীল গ্রহ।’ দ্বিতীয়জন আশাহত হয়ে পাশের আসনে বসে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে স্ক্রীনের দিকে তাকালেন।
‘হ্যাঁ।’ প্রথমজন জবাব দিলেন। ‘মহাবিশ্বের একমাত্র নীলগ্রহ।’
‘আমিতো কোন বিশেষত্ব দেখছি না।’ তৃতীয়জনও তাল মেলালেন।
‘তুমি গ্রহটির আবর্তনবেগটি লক্ষ্য কর।’ প্রথমজন উৎসাহ দেন।
তারা দুজনই অলসভাবে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। হয়তো বিরক্তবোধ করতে শুরু করেছেন। তিনজনই একটি বিশেষ পরীক্ষা করে নিজ গ্রহে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে এই এলাকাটি পড়লে প্রথমজন সবাইকে সৌরজগতে ঢোকার অনুরোধ করেন। এর আগে তিনি ভুলক্রমে একবার এসেছিলেন তখন প্রায় বহুদূর থেকে এটিকে দেখেছিলেন। এবার কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়ে অন্য দুজনকে অনুরোধ করে নিয়ে আসেন।
‘ধীরগতির।’ তৃতীয়জন বলেন।
তবুও প্রথমজন হতাশ হলেন না, ‘উপগ্রহটির আবর্তণ দেখ। গ্রহটির প্রায় সমান।
‘গ্রহটির একটি বায়ুমণ্ডল আছে।’
‘বেশীরভাগ গ্রহেরই নিজস্ব বায়ুমণ্ডল আছে।’
‘তবুও এখানে কেমন জানি নিজস্ব মায়াবীতা আছে।’
অন্য দু’জন কোন মায়াবীতা খুঁজে পান না। গ্রহ থেকে কোটি মাইল দূরে মহাকাশযান চলে আসলে দ্বিতীজন বলেন, ‘তোমার কৌতুহল নিশ্চয়ই মিটেছে, এবার ফিরে চল। নইলে দেরী হয়ে যাবে।’
‘অন্তত একবার ভিতর থেকে ঘুড়ে এলে হতো না।’ প্রথমজন মিনতি করেন।
‘সে অনেক সময়ের ব্যাপার।’ দ্বিতীয়জন এড়িয়ে যেতে চাইলেন।
‘তবুও।’
তারা দু’জন আশা ছেড়ে দেন। ‘ঠিক আছে কিন্তু খুব অল্প সময়ের জন্য।’
‘ঠিক আছে।’ প্রথমজনের চোখ খুশীতে চকচক করে উঠল।
মহাকাশযানের গতিবেগ যথাসম্ভব কমিয়ে উপগ্রহের চাদিকে কয়েকটা চক্কর দিয়ে গ্রহটির দিকে ছুটিয়ে দেয়া হয়। গ্রহটিতে ঢোকামাত্রই সবাই একবার করে বিস্মিত হলেন। গ্রহটিতে হালকা একটা প্রলেপ আছে বলে মনে হলো। কোন গ্রহেই এ ধরনের আস্তরণ তারা দেখেনটি। মহাকাশযানের গতিবেগ তখন ধুবই কম। সবাই স্ক্রীনে ফুটে ওঠা তথ্য সমূহ গভীরভাবে দেখতে থাকেন।
‘এটা নাইট্রোজেন ভিত্তিক গ্রহ।’ প্রথমজন অবাক হয়ে যান।
‘এই প্রথম কোন গ্রহে এতটা নাইট্রোজেন দেখতে পেলাম।’ দ্বিতীয়জন সুর মেলালেন।
মহাকাশযান অনেকটা নীচে নেমে এসছে। ভিতরের পরিবেশ তাদের বিস্ফোরিত করেছে। ‘আশ্চর্য! এখানে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে!’ দ্বিতীয়জন এতক্ষন বসে ছিলেন, এবার উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালেন। ‘আশ্চর্য!’ প্রথমজনও ভাবতে পারেননি তিনি এতটা বিমুঢ় হবে, ‘পুরো গ্রহটি সবুজ প্রাণীতে পরিপূর্ণ!’
‘এরকম একটা গ্রহের অস্তিত্ব রয়েছে আমরা জানতে পারলাম না কেন?’
‘অবাক কাণ্ড এমনতো হবার কথা নয়।’ তৃতীয়জন ভুল সংশোধন করা চেষ্টা করে বলেন, ‘মহাবিশ্বের এই কোনায় সাধারণত কোন মহাকাশযান আসে না। আর মানচিত্রে এলাকাটি অস্পষ্ট।’
‘তাই হয়তো হবে।’ দ্বিতীয়জন মত দিলেন।
‘তবুও এত বড় একটা ঘটনা আড়ালে থেকে যাবে এমনতো হবার কথা নয়।’ প্রথমজন বলেন।
মহাকাশযান তখন একঝাঁক সবুজ প্রাণীর উপর দিয়ে চলে যায়। ঠিক তখন বিশাল এলাকা ধরে ছোট ছোট কিছু যান সবুজ প্রাণীর ভেতর দিয়ে বের হয়ে আসে। তারা কেউই ভাবতে পারেননি এতদ্রুত এত মহাকাশ যান বের হয়ে আসতে পারে। নিরাপত্তার জন্য মহাকাশযাটিকে তারা আরও উপরে উঠিয়ে নেন।
‘সবুজ প্রাণীতো খুবই উন্নত।’ প্রথমজন বলেন।
তারা কেউই আর কথা বলেন না। সববিছু ভালভাবে দেখতে থাকেন। ছোটছোট যানগুলোর কিছু দূরে মিলিয়ে গেল আবার কিছু কিছু সবুজ প্রাণীর ভিতরেই চলে গেল।
এরই মধ্যে মহাকাশযানের স্ক্রীনে কিছু তথ্য ফুটে ওঠে। যেগুলোকে তারা মহাকাশযান ভেবেঠিছলেন সেগুলো আসলে প্রাণী!
‘প্রাণী ? আশ্চর্য!’ তৃতীয়জন বলেন। ‘প্রাণী কী করে উড়তে পারে?’ প্রথমজন বলেন।
‘আমাদের মনে হয় আরও ভালভাবে গ্রহটিকে পরীক্ষা করা উচিত।’ দ্বিতীয়জন বলেন।
অন্য দুজন অবাক হলেন, কিছুটা দ্বিধাকণ্ঠে প্রথমজন বলেন ‘তারমানে তুমি গ্রহটিতে নামতে চাচ্ছ।’
‘অবশ্যই। এতকাছে এসে একটা তুমি গ্রহটিতে নামতে বেীরভাগ ব্যাপারই অগোছালো আর রহস্যময় সেই গ্রহে একটু নামব না। স্পর্শ করব না তা কী করে হয়?’
‘সেটা করা কি উচিত হবে?’
‘এতদূর থেকে এসে না, নেমে ফিরে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?’
‘আমি জানি না।’
মহাকাশযান টিকে গ্রহটির আলোকিত অংশে বেশ কয়েকবার চক্কর দিয়ে খোলামেলা জায়গা দেখে অবতরণ করানো হলো। সবাই অতিসাবধানে নভোচারীর পোষাক পড়ে বের হয়ে এল। প্রথমজন ভূমিতে হাত দিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে পরীক্ষা করতে থাকেন। দ্বিতীয়জন তা দেখতে থাকেন আর তৃতীয়জন দূর দিগন্তে তাকিয়ে থাকেন।
হাত দিয়ে ধরামাত্র হাতে থাকা সূক্ষ্মযন্ত্র গ্রহটির গঠন প্রণালী কিছুটা তুলে ধরে।
‘এটি সিলিকন ভিত্তিক গ্রহ।’ প্রথমজন বলে ওঠেন।
‘এতে অবাক হবার কি আছে? অনেক গ্রহই সিলিকন ভিত্তিক।’ তৃতীয়জন দূর-দিগন্তে থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে বললেন।
‘শুধু সিলিকনের জন্য অবাক হচ্ছি না, এখানে আরও কয়েকটি মৌল আছে, কার্বন, কোবাল্ট, অ্যালুমিনিয়াম আর..।’
‘আর?’
‘আর, বায়ুমন্ডেলের বেশখানিকটা জুড়ে অক্সিজেন রয়েছে। নাইট্রোজেনের কথাতো আগেই দেখেছি।’
‘হ্যাঁ, এ পর্যন্ত কোন গ্রহে একত্রে কার্বন, সিলিকন, অক্সিজেন আর নাইট্রোজেনের এতটা প্রভাব দেখিনি।’
‘আমিও না।’
‘তাহলে এটা কি সেই গ্রহ।’
প্রথমজন কিছুটা দ্বিধা বিভক্ত হন বলেন, ‘নিশ্চিত করে বলা যাবে না। আমরা কিছু পরীক্ষা করে দেখতে পারি।’
‘কী পরীক্ষা?’ দ্বিতীয়জন জানতে চান।
‘আমার সাথে এসো দেখতে পারে।’
তিনজন তিনটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে সামনের সবুজ প্রাণীর দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। সবুজ প্রাণী থেকে যে কোন আক্রমন থেকে বাঁচার জন্য সবাই প্রস্তুত থাকেন। একপা দুপা করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন।
অতি সাবধানে সন্তর্পনে তারা ধীরলয়ে এগিয়ে যান।
যতই সামনে এগুতে থাকেন তারা অবাক হয়ে যান। সবুজ প্রাণী নিশ্চল নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ দু’একটি চারপেয়ে প্রাণী দৌঁড়ে পালিয়ে যেতে থাকে।
‘সবুজ প্রাণী মনে হয় চলাফেরা করতে পারে না।’ প্রথমজন অতিসাবধানে সবুজ প্রাণীর শরীরে হাত রেখে পরীক্ষা করতে থাকে।
‘এই গ্রহের বেশীরভাগ প্রাণীই তাহলে চলাফেরা করতে পারেনা।’ দ্বিতীয়জনও সায় দেন।
প্রথমজন পায়ের কাছ থেকে ধারালো অস্ত্র বের করে সবুজ প্রাণীর শরীরের ভেতরে ঢুকানোর চেষ্টা করেন। ধারালো অস্ত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি বাধা প্রাপ্ত হন। তারপর কিছুটা অংশ কেটে বের করে স্বয়ংক্রিয় নিরীক্ষা যন্ত্রে রাখেন।
‘হ্যাঁ’
‘এটা প্রটোপ্লাজম ভিক্তিক সেই গ্রহ।’ প্রথমজন বলেন।
সামান্য সময় তিনি থেমে যান। অন্যেরাও তাই।
‘তাহলে, এখানে থাকা আর নিরাপদ নয়।’ দ্বিতীয়জন পিছিয়ে আসেন।
‘শোনা যায়, সেই পুরোনো গ্রহতে নাকি হঠাৎ হঠাৎ অপার্থিব শব্দ শোনা যায়। তৃতীয়জনও দ্বিতীয়জনের সাথে সুর মেলান।
‘হ্যাঁ ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে গ্রহটি এখনও সেই অপার্থিব শব্দ করে চলে।’
‘কিন্তু তা তো বহু আগের কথা।’
‘সেজন্যই হয়তো এই গ্রহের মানচিত্র কোথাও পাওয়া যায় না।’
‘আমরা তাহলে একটা গুরুতর অপরাধ করে ফেললাম।’ প্রথমজন বলেন।
অন্য দুজন কিছু বলেন না। বহু আগেই মহাবিশ্বের বুদ্ধিমান সভ্যতার সংবিধানে এই সৌরজগৎকে নিষিদ্ধ করে এর মানচিত্র লুকিয়ে ফেলা হয়। বুদ্ধিমান প্রাণীদের কাছে তেইশজোরা ক্রোমোজোমের গ্রহটা একসময় হারিয়ে যায়। সেও প্রায় দশ হাজার বছর আগের কথা।
‘চল ফেরা যাক।’ তৃতীয়জন বলেন।
‘হ্যাঁ, চল।’ অন্যদুজন বলেন।
তারা নিজেদের যানের দিকে পথ ধরেন। এই গ্রহের নক্ষত্র ইতিমধ্যে প্রায় ডুবতে বসেছে। আকাশ তখন নীল আর লালের অপূর্ব সমন্বয় বিরাজ করে।
‘কিন্তু গ্রহটি সম্পর্কে একটু আধটু যেসব তথ্য পাওয়া যায়। সেগুলোতে জানা যায় গ্রহটি ধ্বংস প্রাপ্ত।’ দ্বিতীয়জন বলেন।
‘সেতো অনেক অনেক সময় আগের কথা।’ প্রথমজন উত্তর দেন।
‘তাহলে গ্রহটিতে আবার বসবাস উপযোগী হয়েছে?’
‘মনে হয় তাই।’
‘তাহলে মহাজাগতিক নিয়মে এতদিন যে কথাটি প্রচলিত ছিল তা ভুল প্রমাণিত হতে যাচ্ছে?’ প্রথমজন কিছু বলেন না চুপচাপ থাকেন, ভাবেন তারপর উত্তর দেন, ‘হয়তো।’
‘তাহলে মহাজাগতিক অনেক নিয়মই সংশোধন করতে হবে।’
প্রথমজন উত্তর দেন, ‘হয়তো।’
মহাজাগতিক নিয়মাবলীতে একটি স্থানে লেখা আছে, ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রহে কখনও নতুন করে প্রাণ সঞ্চার হয় না এবং কৃত্রিমভাবে প্রাণ সৃষ্টির প্রচেষ্টা করা নিয়বর্হিভূত কাজ।
তিনজনই মহাকাশযানের প্রায় কাছে চলে এসেছেন। যখন তারা মহাকাশযানের স্বয়ংক্রিয় সিঁড়িঁতে পা দেবেন ঠিক সেইসময় তৃতীয়জন বলেন, ‘আমি একটা অদ্ভূত গবেষণা করতে চাচ্ছি।’
প্রথমজন তার দিকে ঘুরে তাকালেন আর দ্বিতীয়জন জানতে চাইলেন, ‘কী?’
‘গ্রহটিতে নামার আগে মহাকাশযান যে ছোট পরীক্ষা চালিয়েছিল তাতে দেখা গেছে এখানে এখন আর কোন তেইশ জোড়া ক্রোমোজোমের প্রাণী নেই।’
‘তুমি কী বলছ, বুঝতে পারছ?’
‘হ্যাঁ’
‘মহাজাগতিক নিয়মভঙ্গের জন্য তোমার কঠিন বিচার হতে পারে।’
‘আমি জানি।’
‘তারপরও তুমি কাজটি করবে?’
‘হ্যাঁ, আমি তেইশ জোড়া ক্রোমোজোমের সেই প্রাণীকে আবার ফিরিয়ে আনব।’
‘সেই দুই পা আর দুই হাত ওয়ালা প্রাণী?’
‘হ্যাঁ, মানুষ।’ তিনি কিছুটা জোড় দিয়ে বলেন, ‘এবং তোমরা যদি কেন্দ্রীয় সরকারকে কিছু জানাও তারপরও আমি তেইশজোড়া ক্রোমোজোম চাষ করতে পারি।’ বলেই তিনি অপর দুজনের কাছে অনুমতি চাইলেন। তারা কিছু না বলে অন্য দিকে তাকালে তিনি নিজেই বলেন, ‘আমি চাষ করব, ধরে নিচ্ছি তোমরা আমাকে সাহায্য করবে।’
‘কিন্তু এ প্রক্রিয়াটি অনেক সময় সাপেক্ষ।’ প্রথমজন মনে করিয়ে দিলেন।
‘আমি শুধু শুরটা করতে চাচ্ছি। পরবর্তিতে কোন একসময় এসে ফসল দেখব।’
কেউ কোন কথা বলল না। শুরুতে অন্যদুজনের আগ্রহ না থাকলেও কিছুক্ষণ পর তারা আগ্রহ পান।
সৃষ্টির আগ্রহ।
সৃষ্টির উত্তেজনা।
তারা তৈরী করেন তেইশ জোড়া ক্রোমোজোমের সরল প্রাণ।
দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্রোমোজম।
তৈরী হলো মানুষ।
দ্বিতীয় প্রজন্মের মানুষ!