দুই টুকরো কাশ্মিরী শাল – ১৩
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
অবশেষে একদিন ভোর রাতের দিকে প্রসব বেদনা উঠলো সালেহা ।
সেদিনও আর দশটা রাতের মতন স্বাভাবিকভাবেই স্বামীর পাশে একসাথে বিছানায় ঘুমাতে গিয়েছিলেন । অবশ্য পরোপুরি স্বাভাবিকভাবেও ঠিক বলা যাবে না । আসলে ঘুমাতে যাবার কিছুক্ষণ আগে থেকে তলপেটটায় চিনচিন করে ব্যাথা অনুভব করছিলেন সালেহা । যদিও এটাকে খুব বেশি পাত্তা দেননি সেদিন তিনি । কারণ গত কদিন ধরে মাঝেমধ্যেই এমন ব্যথা হচ্ছিল তার । আবার নিজে থেকে সে ব্যথা আচমকা উধাও ও হয়ে যাচ্ছিল একসময় । জাহানারা আপা বলেছেন , সময় একেবারে ঘণিয়ে এসেছে বলে এমন হচ্ছে । এখন এরকম করতেই করতেই নাকি চুড়ান্ত ব্যথা উঠে যাবে ।
সেই চূড়ান্ত সময় সময়ের লক্ষণগলো সম্পর্কেও গত কদিন যাবৎ পই পই করে বলে যাচ্ছিলেন তাকে জানু আপা । রীতিমতন পাখি পড়া পড়িয়ে রেখেছেন তাকে সবকিছু । সুতরাং অনেকটা নিশ্চিত হয়েই বিছানায় গিয়েছিল সালেহা সে রাতে । কিন্তু শেষ অবধি আর নিশ্চন্ত থাকা হয়নি । কারন সে রাতে তলপেটের ব্যথা আর কমলোই না । বরং বেড়ে চলল উত্তোরত্তর সময়ের সথে পাল্লা দিয়ে । প্রচন্ড ব্যাথায় একসময় জ্ঞান হারাবার উপক্রম হলো তার । তারপরও ভোর হবার আশায় দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাবার চেষ্টা করছিল সালেহা সব যন্ত্রণা । কিন্তু একসময় বুঝি আধো জ্ঞানের মধ্যেই টের পেল তার নিমাঙ্গে ধেয়ে আসা পানির স্রোত । যা তার হাঁটু বেয়ে কুলকুল করে নেমে আসছে পরনের পেটিকোট শাড়ী সব ভিজিয়ে ।
সুতরাং শেষ পর্যন্ত ঘুম থেকে ডেকে তুলতেই হল স্বামীকে । বুদ্ধিমান জ্ঞানী মানুষটা সালেহার দিকে তাকিয়ে কি বুঝলো কে জানে ! তৎক্ষনাত পাশের ঘর থেকে ডেকে তুললো জানু আপাকে । অভিজ্ঞ জানু আপাও প্রস্তুত হয়েই ছিল এই বিশেষ ক্ষণটার জন্য । দ্রুত দুই ভাইবোনে ধরাধরি করে সালেহাকে নিয়ে গেল নিজের ঘরে ।
– একটু সইজ্য কইরা যা বইন । দাঁত চাইপা থাক । আমি গরম পানি কইরা নিয়া আসি !
– তুমি অর লগে থাকো আপা । আমি গরম পানি কইরা আইনা দেই ।
অস্হির ভঙ্গিতে জাহানারে কথাটা বলেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে উদ্যত হয় আহাদ মাষ্টার । কিন্তু তাকে বাঁধা দিয়ে থামান জাহানারা ।
-তুই থাম । এইসব কাম পুরুষমাইনষের না ! আমিই সব করতে আছি ! ঘাবড়ানের কিছু নাই । অহনও আতে সময় আছে । তুই অহন এই ফাঁকে দৌড়ায়া যায়া করিমন খালারে ডাইক্যা আন গা ! যা দেরী করিস না !
আশ্চর্য্য কতৃত্বভরা দৃঢ় কন্ঠ শুনে একটু বুঝি থমকে দাঁড়ায় আহাদ মাষ্টার । কিনতু কথার প্রেক্ষিতে আর কিছু বলার সুযোগ বা সাহস পয় না । ঘুরে দাঁড়িয়েই বেরিয়ে যায় এই গ্রামের সবচেয়ে দক্ষ দাই হিসাবে পরিচিত করিমন খালার বাসার দিকে !
_____________________________ **** ________________________________
করিমন নামের মাঝবয়স পেরুনো মহিলাটির বাড়ী একই গ্রামে হলেও তা বলতে গেলে একেবারে শেষ সীমানায় । এবং বলাই বাহুল্য সালেহাদের বাড়ী থেকে বেশ খানিকটা দূরে । ফলে আসতে যেতে বেশ খানিকটা সময় লাগে এমনিতেই । তার উপর আহাদ মাষ্টার গিয়েছিল শেষ রাতের দিকে । খালাকে ঘুম থেকে তুলে তার পায়খানা প্রস্রাব সেরে তৈরী হতে হতে চলে গিয়েছিল অনেকটা সময় । তার উপর ছিল করিমন খালার আয়েশী ভঙ্গিতে হেলেদুলে পথ চলা । উদ্বিগ্ন আহাদ মাষ্টার যতবার তাকে তাড়া দিতে গেছে প্রতিবারই মুখভরা পান নিয়ে হাসতে হাসতে উড়িয়ে দিয়েছেন মাষ্টারের কথা । কিন্তু হাঁটার গতি বাড়াননি তা বলে ।
আসলে সারাজীবন ধরে বাচ্চা বিয়াতে বিয়াতে কোন পরিস্হিতিকেই গুরুত্ব না দেওয়াটা রপ্ত করে ফেলেছেন করিমন খালা । আর তাছাড়া তিনি অভিজ্ঞতা থেকে জানেন , পোয়াতীর পরিবারের লোকজন এসময় সামান্যতেই বিচলিত হয়ে থাকে । সুতরাং ওসব কথায় কান দেওয়ার আর কোন প্রয়োজন মনে করেন না তিনি ।
সবমিলিয়ে আহাদ মাষ্টারের করিমন খালাকে নিয়ে ফিরতে ফিরতে ততোক্ষণে সকাল হয়ে গেছে । উঠানে ঢুকেই ওরা দেখতে পেল এরমধ্যেই কোনভাবে খবর পেয়ে আশেপাশের বাড়ী থেকে উৎসুক প্রতিবেশী মহিলা তাদের বাচ্চাকাচ্চাসহ চলে এসে ভীড় করেছে ঘরের দরজার মুখে । অনেকেই যে এরমধ্যেই ঘরের ভেতর চলে গেছে – তা কেউ না বললেও বেশ বুঝতে পারলো মাষ্টার সাহেব ।
ওদের দেখেই বেশ একটা গুঞ্জণ উঠে গেল ভীড়ের মধ্যে । মহিলারা যারা এমনিতে সবসময় দারুন সম্মান করে মাষ্টার মশাইকে (তাদের যত ভাব আসলে সালেহার সাথেই) , আজ ভীষণ অবাক হয়ে মাষ্টার সাহেব লক্ষ্য করেন তাকে দেখা মাত্রই ঐ মহিলাদের কেউ কেউ আঁচলে মুখ চেপে ফিচেল হাসি হাসছে !
অন্যদিকে উপস্হিত বালিকাদের মধ্যেও বেশ একটা উৎসাহ আর চাঞ্চল্যেরও ঢেউ খেলে গেল যেন । কেউ কেউ অভ্যাস মতন সালাম জানিয়ে ঘোষণা করলো তার আগমনী বার্তা ।
– মাষ্টার মশাই আইসা পড়ছে । মাষ্টার মশাই আইসা পড়ছে ।
কান্ড দেখে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকাই বুঝি খেয়ে যান আহাদ মাষ্টার । ঘরে যাবেন কি যাবেন না – স্হির করতে না পেরে দাড়িয়ে থাকেন উঠানের মাঝখানটায় । কিন্তু এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিধা দেখা যায় না করিমন খালার মধ্যে । মাষ্টারমশাইকে ফেলে রেখেই তিনি অভ্যস্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে যান ঘরের দিকে । যদিও শেষ পর্যন্ত তার যাওয়াটাও নির্বিঘ্ন হয় না । একটু এগিয়ে তাকেও একটু খানি থেমে দাঁড়াতে হয় মহিলাদের কথায় ।
-ও খালা , তুমি এত্তো তাড়াতাড়ি আইলা ?
– তুমার কাম তো সারা অয়া গ্যাছে খালা আল্লাহর রহমতে । অহন আর যায়া কি অইবো তুমার ?
-কি কস ? বাচ্চা কি অয়া গ্যাছে ?
দ্বিধান্বিত করিমন খালা ।
– তয় ! ম্যালা আগেই অয়া গেছে গা !
মাষ্টার সাহেবের কাছ থেকে প্রথম বাচ্চা হওয়া বাবদ বেশ ভালো কিছু আদায় করতে পারবে বলে ভেবে রেখেছিল করিমন খালা । কিন্তু তা আর পাওয়া হলো না – দেখে খানিকটা হতাশই বুঝি হয় প্রথমে করিমন খালা । তবে তা খুব সামান্য সময়ের জন্যই । নিপুন পেশদারী দক্ষতায় পরিস্হিতি সামলে নেয়ার জন্য উদ্যোগী হতেও সময় লাগে না । তার বাড়ীতে বাচ্চা হয়ে যাবার খবর পৌঁছানোর আগেই যে সে আসতে পেরেছে – এটাও কম কথা না । এখন তা ভাঙ্গিয়েই যা আদায় করার করতে হবে !
– আল্লাহ পাকে যে ভালায় ভালায় সব আসান করছে , এইডাই আসল কতা ! দেহি সর ! সর তরা ! আমারে আগে যাইয়া সব বুঝবার দে । খালি বাচ্চা হওনই তো বিষয় না ! অওনের পরেই তো আসল কাম , নাকি ?
আপনমনেই বকবক করতে করতে ভীড় ঠেলে সোজা ঘরের ভেতর ঢুকে যান করিমন খালা ।
এদিকে আরো বেশ অনেকক্ষণ উঠানের মাঝখানে দুরুদুরু বক্ষে দাঁড়িয়ে থাকার পর অবশেষে ডাক আসে আহাদ মাষ্টারের ঘরের ভেতর থেকে । নিজেদের শোবার ঘরে ঢোকার পর আর বেশি অপেক্ষা করতে হয় না । অঅল্পক্ষণের মধ্যেই জানু আপা ওই ঘরে প্রবেশ করেন হাসতে হাসতে । ভীষণ অবক হয়ে আহাদ মাষ্টার লক্ষ্য করেন আপার বুকের মধ্যে জাপটে থাকা কাঁথায় মোড়ড়ানো একটা ছোট্ট পোঁটলার মতন কোন কিছু !
ওটা যে তারই অস্তিতের অংশ হিসাবে পৃথিবীতে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া নিজের ঔরসজাত সন্তান – তা কাউকে বলে দিতে হয় না আহাদ মাষ্টারকে । সমস্ত শরীর বেয়ে বয়ে যাওয়া অদ্ভুৎ তৃপ্তির এক তরঙ্গ বোধই যেন তথ্যটা ফিসফিস করে জানান দিয়ে যায় তাকে ।
– দেখরে ভাই , কি চান্দের লাহান পোলা অইছে তর । ল ভাই তর পোলারে তুই ল ! লয়া পোলার কানে আযান দে ! পোলার কানে বাপের আযান বড়ই বরকতের রে ভাই ! বড়ই বরকতের !
দারুন খুশী জাহানারা বলতে গেলে তার নিজের একার কৃতিত্বে সদ্যভূমিষ্ঠ ভাইপোকে এগিয়ে দেয় ভাইয়ের দিকে ।
নিজের সন্তানকে প্রথমবারের মতন বুকের ওমের সাথে মিশিয়ে নিতে দুহাত বাড়ায় আহাদ মাষ্টার ।
আশ্চর্য্য , কি এক অনাস্বাদিত আবেগে শক্ত সামর্থ্য মানুষটার সবল হাতদুটো তখনো কাঁপছে রীতিমত !!! ( চলবে )