উটন দাদুর কাহিনী-পর্ব-১৬ (শিশু ও কিশোরদের বনজঙ্গলের রোমাঞ্চকর উপন্যাস)
এদিকে উটন দাদুর দল বহু দূরে এসে পড়েছে। নিজেদের বাঁচাতে ওরা ঊর্ধ্ব শ্বাসে সামনের দিকে এগিয়ে চলছিল। পথে ওরা রাবুন ও নেচুকে হারিয়েছে। কিছুই করার ছিল না। ওদের বুনোদের কবল থেকে বেঁচে ফিরে আসা অসম্ভব। তবু ভাগ্য ভাল থাকলে,ওপরওয়ালার ইচ্ছে থাকলে হয়তো বাঁচলে বাঁচতেও পারে !ওদের পেছনে তাড়া করে চলেছিল বুনোরা। বুনোরা ভীষণ হিংস্র। বন্য জানোয়ারদের চে কোন অংশে কম নয়।
সামান্য দূর দিয়েই সেই উড়ালী নদী বয়ে চলেছে। নদীর জলের কলকল,ছলছল শব্দ কানে আসছিল। ওরা এখন নদীর পার ধরে হাঁটছে। ওরা বুঝেছিল যে বন্যরা ওদের আর অনুসরণ করছে না। ওরা হয় তো রাবুন ও নেচুকে অথবা ওদের দুজনকেই খুঁজে পেয়েছে। সেই শিকার নিয়েই নিজেদের গ্রামে ফিরে গেছে হবে। এ ছাড়া ঘণ্টা খানেক আগের সেই হই হল্লার আওয়াজ আর তত কানে আসছে না–তার বদলে বহু দূর থেকে ভেসে আসছিল কোলাহল,গুঞ্জন,সে সঙ্গে খটাখট কোন বেতাল শব্দ ধ্বনি।
অনেক সময় পরে নীরবতা ভঙ্গ করে বনুই বলে উঠলো,আমাদের নেচুর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে–তাই না উটন দাদু ?
–হ্যাঁ,ওকে ছেড়ে যাওয়া আমাদের উচিত হবে না–অন্তত একটা দিন অপেক্ষা করে দেখতে হবে ও আসে কি না।
নবু বলে উঠে,ও যদি না আসে,আমরা কি তবে আবার বুনোদের গ্রামে যাব ?
উটন দাদু কিছুক্ষণ ভেবে জবাব দিল,মনে হয় জীবন সংশয় করে আর ওই মানুষ নামক জানোয়ার গুলির মাঝে না যাওয়াই ভাল–তা না হলে কে জানে যে আমাদের মধ্যে থেকে আবার কাকে কাকে হারাতে হবে !
শমী শঙ্কিত হয়ে বলে উঠলো,নেচুকে সত্যি কি ওরা মেরে ফেলবে ?
উটন আবার বলল–ওদের কাজ তো তাই–মানুষ পেলে মেরে খায়–যে মানুষ মানুষের মাংস খায় সে তো আসলে অমানুষ,জন্তু হয় ! নেচুর জন্যে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে ! এসেছিলাম এই বন্যদের মানুষ ভেবে শিক্ষা দিতে—মনুষ্যোচিত শিক্ষা দিতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। ওদের কিছু শেখাতে গেলে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিতে হবে। নেচু বা রাবুনের মত প্রাণ দিতে হবে। বস্তুত ছেলেদের মনেও জীবনের ভয় ঢুকে গেছে। নেচুর জন্যে ওদের সবারই কষ্ট হচ্ছিল।
উটনরা নদীর পারে এসে গেল। চাঁদের আবছা আলোয় নদীর জল ঝিলমিল করছিল। ওরা এবার আশপাশ থেকে গাছের ডাল কেটে বিশ্রামের জন্যে বসার জাগা তৈরি করে নিলো। প্রায় মাঝ রাত হতে চলল,কিছু সময় না ঘুমালেও বিশ্রাম সবার প্রয়োজন।
সাবধানের মার নেই,একথা ভেবে উটন কুন্তাকে বলে উঠলো,কুন্তা, একবার চার পাশটা ঘুরে দেখ তো–আশপাশে কোন বুনোরা বা অন্য বিপদের আশংকা নেই তো ?
কুন্তা নদীর দিকে নেমে গেল–আশপাশে কোন শত্রু সে দেখতে পেল না–এবার ও পারের ওপরে উঠে এলো–এদিক ওদিক দেখে নিলো–না বিপদ ঘটাবার মত কোন কিছু তার চোখে পড়ল না। কুন্তা এবার ফিরে এলো বিশ্রামের জন্যে। কিছু সময় ওকে বিশ্রাম নিতেই হবে। চোখ দুটি তার ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে আসছিল। শরীর তার বড় ক্লান্ত,তার হাত,পা আর যেন চলতে চাইছিল না। সামান্য সময়ের মধ্যেই সবার চোখ ঘুমে জড়িয়ে এলো–আর এক সময় সবাই ঘুমের কলে ঢলে গেল।
উটনের ঘুম আচমকা ভেঙ্গে গেল–ওর পাশ দিয়ে মনে হল–সরসর করে কোন সরীসৃপ জাতীয় কিছু চলে যাচ্ছে ! নিশ্চল হয়ে,শ্বাস বন্ধ করে উটন চুপ করে পড়ে থাকলো। ও জানে সাপ হলে নড়াচড়া না করাই উচিত। তা না হলে,সাপ যখন তখন দংশন করতে পারে। আর বিষধর সাপ হলে তো মৃত্যু অবধারিত। সে সরীসৃপ উটনের গা ঘেঁষে দূরে সরে গেল। আর কিছু সময় যেতে না যেতেই বনুই ঘুমের মধ্যে চীৎকার করে উঠলো। সবাই ধড়ফড় করে উঠে পড়ল। বুনাই তার এক পা নাড়তে পারছিল না–মনে হচ্ছিল ওর একটা পা অবশ হয়ে গেছে !
অন্ধকারে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। উটন তাড়াতাড়ি তার কাছে রাখা টর্চ বের করে নিলো। টর্চ জ্বালতেই সবাই ভয়ে চমকে উঠল,ওরা সাপ,সাপ,বলে চেঁচিয়ে উঠলো। সবার সামনে বিরাট এক অজগর সাপ–বনুইয়ের একটা পায়ের অনেকখানি গিলে ফেলেছে ! গভীর ঘুমের মাঝে সে টের পায়নি। বনুই ভয়ে কেঁদে উঠেছে–ও এক পা নিয়ে খুব ছটফট করে যাচ্ছিল। সবাই সে দৃশ্য দেখা মাত্র লাফ দিয়ে ভয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। শেষে উটন দাদু তৎপরতার সঙ্গে ছেলেদের কাছ থেকে একটা ভোজালি বের করে নিলো। আর দ্রুত বনুইয়ের ধারে গিয় সেই ভোজালি দিয়ে অজগর সাপের ওপর চার,পাঁচ বার আঘাত করলো। সাপটা দু টুকরো হয়ে গেল। তার কাটা দেহ তখনও প্যাঁচিয়ে যাচ্ছিল—লেজের দিকটা এদিক ওদিক হয়ে খুব ছটফট করছিল। অজগরের মাথাও বেশ নড়েচড়ে উঠছিল। বনুই ভয় পেয়ে লাফালাফি করে যাচ্ছিল। এ সব ব্যাপার উটন ভাল ভাবে জানে। এর আগে সে শিকার করতে গিয়ে নিজেকে বাঁচাবার জন্যে অনেক সাপ মেরেছে। অজগরের মাথা তখন বনুইয়ের পা গেলা অবস্থাতেই ছিল। উটন এবার অজগরের শরীরটাকে ভোজালি দিয়ে ধীরে ধীরে কেটে দিল। বনুইয়ের পা এবার অজগরের মুখ থেকে মুক্ত হল। তারপরও ওর পা অবশ হয়ে ছিল। বিরাট অজগর—ছ,সাত ফুট লম্বা হবে।
সবাই তখন দূর থেকে ভয় ও উত্তেজনা নিয়ে সব কিছু দেখছিল। সাপ মারা হল। বনুইয়ের পা’র অবশ ভাব ধীরে ধীরে কম হচ্ছিল। উটন,সব ঠিক হয়ে যাবে,বলে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। সত্যি তাই,এক সময় বনুই তার পা ভাল ভাবেই নাড়াচাড়া করতে পারছিল।
ভোরের আলো ফুটে উঠছে। ওরা নদীর পারে গিয়ে দাঁড়ালো। আজ সমস্ত দিনটা নেচুর জন্যে অপেক্ষা করবে। নেচু বেঁচে থাকলে সে নিশ্চয় ওদের খোঁজে নদীর ধারে আসবে। কারণ ও জানে,শেষ রাতে ওরা এদিকের পথ ধরেই গ্রামের দিকে এসেছিল। পথ ধরে না হোক–দিক ধরে ও আশপাশে কোথাও না কোথাও উটনদের সন্ধান করবে।
আজ সমস্ত দিন ওরা নেচুর অপেক্ষাতেই থাকবে ঠিক করল। উটন জানে ওরা বুনোদের গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরে এসে গেছে। বুনোরা দল বেঁধে এত দূর আসার চেষ্টা হয় তো করবে না। আর যদিও করে তা ভোরের আগে নয়। ওরা যে পথে আসে হৈহল্লা না করে আসতে পারে না। হই হল্লার আওয়াজ সামান্য টের পেলেই উটনের দল সময় মত সাবধান হয়ে যেতে পারবে। তবে দু,একজন বুনো কোন কারণে এদিকে এসেও পড়তে পারে। তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে ব্যাপারটা অন্য রকম দাঁড়াবে। ওরা গ্রামে গিয়ে উটন দাদুদের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দিতে পারে।
উটন দাদুর ধারনা যে জংলীরা এই শেষ রাতে আর কোন ভাবে ওদের আক্রমণ করতে পারবে না। সবাই ভোরে এক হয়ে জোট বেঁধে আসতে কিছুটা সময় তো লেগেই যাবে।
বুনোদের আওয়াজ মাঝ রাতের পর থেকেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রাতের উৎসবের শেষে ওরা এখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন।
ক্রমশ…