নেতাজী
১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম ।ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক কিংবদন্তী নেতা ।তিনি নেতাজী নামে সমধিক পরিচিত ।তিনি পরপর দুবার কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন । দুভাগ্যবশত মহাত্মাগান্ধী ও অন্নান্যদের সাথে আদর্শগত সংঘাতের ফলে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন । তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক নামের একটি রাজনৈতীক দল গঠন করেছিলেন ।তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের পক্ষপাতী ছিলেন ।ব্রিটীশ সরকার এই মহান ব্যাক্তিকে ১১ বার কারারুদ্ধ করে । যখন কংগ্রেসী নেতারা ভারতকে আদিরাজ্যের মর্য্যাদা দেবার জন্য দাবি জানান তখন নেতাজী পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন ।তার বিখ্যাত উক্তি -”তোমরা আমাকে রক্ত দাঁও আমি তোমাদেরকে স্বাধীনতা এনে দেব ”
তিনি ভারতে ইংরাজ সরকারকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি শক্তিশালী দুর্গের সাথে তুলনা করেন এবং বলেন দুর্গটিকে চারদিক থেকে নিরস্ত্র অথচ শত্রুভাবাপন্ন দেশের জনগণ ঘিরে রয়েছে । দুটি উপায়ে দুর্গটিকে দখল করা যায় ,এক সর্ব্বাতক অসহযোগ এবং পুরোপুরি কর বন্ধ আন্দোলন চালু করে ইংরেজ সরকারকে ভাতে মারা । দুই সশস্ত্র আক্রমণের দ্বারা তাদের আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করা । তার মতে এই দুটি পথের আর কোন বিকল্প ছিল না ।
১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সভাপতি হলেন । কিন্তু ১৯৩৮ সালের শেষের দিকে তিনি বুঝলেন যে গান্ধীজি ও তার অনুগামীরা গণসংগ্রামের দিকে এগোতে চান না । তারা ইংরেজ সরকারের সাথে একটি আপোষে রফায় আসতে চান । তাই তিনি ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয়বার সভাপতি পদের জন্য নির্বাচনে দাঁড়ালেন । গান্ধীজি ও তার অনুগামীদের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও তিনি জয়লাভ করেন । কিন্তু গান্ধিজী ও তার অনুগামীদের বিরোধীতার ফলে নেতাজী সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেন ।
১৯৩৯ এ ত্রিপুরী কংগ্রেসের সময় নেতাজী বলেছিলেন যে ছয় মাস পরেই ইউরোপে যুদ্ধ বেধে যাবে । ভারতবাসীর উচিত হবে ইংরাজ সরকারকে এক চরমপত্র দেওয়া এবং স্বাধীনতার দাবি যদি তারা মেনে না নেয় তাহলে চূড়ান্ত লড়াই আরম্ব করা ।দুঃখের বিষয় ঐ সঙ্খট মুহুর্তে নেতাজীর প্রস্তাবে কোন দল সাড়া দেয় নি । ১৯৩৯ সালের মাঝামাঝিতে ফরওয়ার্ড ব্লকের মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য লড়াই এর পক্ষে সারা দেশ সফর করে প্রচার করতে থাকেন ।কিন্তু তেমন সাড়া না পেয়ে বাধ্য হয়ে বিকল্প পথ বেছে নেন ।তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য সারাটি জীবন বিভিন্ন স্হানে ঘুরে বেড়ান ।
১৯৪৩ সালে নেতাজীর দেওয়া ভাষণের একটা অংশে ছিল নিম্নরূপ
“আমাদের দেশবাসীরা ও দেশের ভাইবোনেরা প্রতিকুল অবস্হার মধ্যে যথাসাধ্য করছেন । কিন্তু আমাদের শত্রু নির্মম ও বেপরোয়া এবং অস্ত্রশস্ত্রে বলীয়ান । এই রকম এক নিষ্টুর শত্রুর বিরুদ্ধে যতই আইন অমান্য বা বয়কট বা বিক্ষিপ্ত সশস্ত্র আক্রমণ করা যাক না কেন,কোনও ফলই হবে না ….শত্রু ইতিমধ্যেই অস্ত্রধারণ করেছে ।সুতরাং তার সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রাম করতে হবে ।কিন্তু দেশের ভেতর আমাদের দেশবাসীর পক্ষে সশস্ত্র বিপ্লব সংঘটিত করা সম্ভব নয় ।সুতরাং এ কাজ দেশের বাইরে যে সকল ভারতীয়রা আছেন ,বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার বসবাসকারী ভারতীয়দেরই করতে হবে …. সময় এসে গেছে ।প্রত্যেকটি দেশপ্রেমী ভারতবাসীকে আজ যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগোতে হবে ।যখন ভারতীয়দের রক্ত বইতে আরম্ব করবে ,সে দিনই ভারত স্বাধীন হবে । ”
১৯৪৩ সালের ৫ জুলাই সিঙ্গাপুরের সমুদ্রতীরে টাউন হলের সামনে নেতাজী আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন ।ঐ দিন প্রথম নেতাজীকে সর্বাধিয়নায়কের সামরিক পোষাকে দেখা গেল । নেতাজীর সেদিনকার বক্তৃতা ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে ।নেতাজ বললেন ,” আজ আমার জীবনের সবচেয়ে গৌরবের দিন ।ঈশ্বরের কৃপায় আজ আমি সারা জগতের সামনে ঘোষণা করছি যে ভারতের মুক্তি ফৌজ এক বাস্তব সত্য ।আমাদের মুক্তি যুদ্ধে একটি জিনিসের অভাব ছিল – এক মুক্তি ফৌজ ।সেই অভাব আজ পূর্ণ হল ।এই যুদ্ধে আমাদের মধ্যে কে বাঁচবে কে মরবে তাতে কিছু যায় আসে না ।আসল কথা হল ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে । ”
১৯৪৫ সনের ১৭ আগস্ট পূর্ব এশিয়া ছেড়ে যাবার আগে নেতাজী আজাদ হিন্দ ফৌজের উদ্দেশ্যে তার শেষ হুকুমনামা জারি করেন ।
” আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আমরা এক বিপর্যের মুখোমুখি ।আপনার হয়ত মনে করতে পারেন যে দেশ স্বাধীন করতে আপনারা বিফল হয়েছেন । কিন্তু আমি আপনাদের বলতে চাই যে এই অসাফল্য সাময়িক ।কোনও বিপর্যয বা ব্যার্থতা আপনাদের অতীতের বিরাট কীর্তি ম্লান করে দিতে পারে না ।এই অন্ধকার মুহুর্তে আমি আপনাদের নির্দেশ দিচ্ছি যে সত্যিকারের এক বিপ্লবী ফৌজের যোগ্য অনুশাসন ,আত্মসম্মান ও শক্তি আপনারা দেখান । ”
“…..আমি মনে করি এই সঙ্খট মূহুর্তে ৩৮ কোটি ভারতবাসী আমাদের দিকে চেয়ে আছেন ।সুতরাং ভারতের প্রতি চির অনুগত থাকুন এবং এক মূহুর্তের জন্যও বিশ্বাস হারাবেন না । আপনাদের আত্মবলিদান সাফল্য এনে দেবে ।জগতে এমন কোন শক্তি নাই যা ভারতকে দাস করে রাখতে পারে ।ভারত স্বাধীন হবেই এবং শীঘ্রই হবে ।জয় হিন্দ ।” ১৯৪৫ এর ১৭ আগষ্ট বিকাল পাঁচটা পনেরো মিনিটে নেতাজী সাইগন বিমান বন্দর থেকে হবিবুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে ‘অজানার পথে পাড়ি ‘ দিলেন । তিনি আর ফিরলেন না ।
নেতাজী তার জীবনের বাণীতে বলেছিলেন ,পৃথিবীতে সবই নশ্বর ও বিনাশ পায় । কিন্তু মানুষের আদর্শ ও স্বপ্ন অমর ।মানুষ তার আদর্শের জন্য মৃত্যুবরণ করতে পারে কিন্তু তার মৃত্যুর পর সেই স্বপ্ন ও আদর্শ ভবিষ্যত প্রজন্মে আবার জন্মলাভ করে ।কোন আদর্শই আত্মত্যাগ ছাড়া সফল হয়নি ।
ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি অনেক দুঃখ ও ত্যাগ বরণ করে জগতের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে । নেতাজীর আদর্শ ও প্রেরণা আমাদের মধ্যে আবার জন্মলাভ করুক এবং আমাদের দেশকে সর্বাঙ্গীণ মুক্তি ও উন্নয়ণের পথে এগিয়ে নিয়ে যাক ।