গরু এক,মালিক দুই !
(ঘটনাটি ২১/০১/২০১৪ তারিখের ‘দৈনিক ভাস্কর’ পত্রিকাতে ছেপেছে। মনে হলো এমনি একটি সত্যি ঘটনা নিয়ে ছোটদের জন্যে গল্প লিখলে মন্দ হবে না। আমার প্রয়াসও তাই এগিয়ে গেল।)
৬ই জানুয়ারি জবলপুরের কতুয়ালি থানায় এক নালিশ এলো। এক গরু নিয়ে দুই মালিক থানায় এসে হাজির হল।
গরুর এক দাবীদার,আক্রম। সে বলল,হুজুর এইডা আমার গরু।
অন্য দাবীদার,বিক্রম। সে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,না হুজুর,এ গরু আমার।
আক্রম বলে,আমার গরু।
বিক্রম বলে,না,আমার।
দুই দাবেদার মালিকের মুখের চেহারা ছবি দেখে কে যে মিথ্যাবাদী তা বোঝার কোন উপায় ছিল না।
পুলিশ আক্রমকে জিজ্ঞেস করল,কি প্রমাণ যে এটা তোমার গরু ?
আক্রম বল,হুজুর,নিজের গরু চিনতে পারুম না ! গরুর দুই কানের আধা সাদা রঙ্গের।
বিক্রম চটপট বলে উঠলো,হুজুর,গরুর পেটের তলডাও সাদা।
আক্রম বলল,সে তো আমি কইতে গেছিলাম,তার আগেই–
পুলিশ বিক্রমকে বলল,হ্যাঁ,তা কথা ঠিক,তোমারে তো আমি কইতে বলি নাই তবে আগ বাড়াইয়া তুমি কও কেন ?
পুলিশ এবার আক্রমকে প্রশ্ন করে,কবের থে এ গরু তোমার ঘরে ?
আক্রম বলে,সে হুজুর,এই গরু জন্মর থে আমাগ ঘরে।
–না,হুজুর,মিথ্যা কয়,তিন বছর আগের কিনা,বিক্রম তাড়াতাড়ি জবাব দিয়ে ওঠে।
পুলিস এবার বিরক্তির সুরে বলে,আবার কথা ! তোমারে না চুপ থাকতে কইছি আমি ? এই বার কও তুমি কি আক্রমের কাছ থেইকা গরু কিন ছিলা ?
বিক্রম বলে,না হুজুর,হাটের তে কিন ছিলাম।
মাঝখান থেকে আক্রম বলে ওঠে,আমি গরু বিক্রিই করি নাই !
পুলিশ এবার আক্রমকে ধমক দেয়—তোমারে আমি জিজ্ঞাসা করসি কিছু ? এবার পুলিশ সাহেব আবার বিক্রমের দিকে তাকায়,বলে,আচ্ছা,গরুর কি কোনও নাম আছে ?
বিক্রম বলল,নাম ? ও কিছু সময় মনে করার চেষ্টা করে বলল, হ্যাঁ,হুজুর গরুর নাম–কালী।
চুপ না থেকে আক্রম আবার বলে ফেলল,না সার,গরুর নাম লক্ষ্মী।
পুলিশ বাবু এবার রাগ করে বলে উঠল,আঃ,আচ্ছা জালা,জিজ্ঞেস করব একজনকে আর জবাব দেবে দুইজনে—তাও আবার একলগে ! তোমরা এক এক করে গরুর নাম ধরে ডাক দেও দেখি !
সঙ্গে সঙ্গে দুই মালিকই গরুকে ডাক পাড়তে শুরু করল,একবার আক্রম,লক্ষ্মী,বলে ডাক দেয়।একবার বিক্রম,কালী,বলে ডেকে ওঠে।
গরুর দড়ি ছিল সিপাইয়ের হাতে ধরা। বেতাল সুরে দুই মালিকের দুই নাম ধরে ডাকার ভঙ্গিতে গরু বোধহয় ঘাবড়ে গিয়ে ছিল–ও সিপাইয়ের হাতে ধরা দড়ি টান মেরে পালাবার চেষ্টা করল।
পুলিশ সাহেব রেগে বলে উঠল,হচ্ছে কি তোমাগ ? এক সঙ্গে দুই নামে ডাকলে গরু বুঝতে পারব ?
সিপাই বেচারা গরুর দড়ি অনেক কষ্টে সামলাতে সামলাতে বলে উঠলো,সার,গরু তো মালিক চেনে–ওনাগ গরুরে ধইরা আদর করতে কন !
পুলিস বলল,ঠিক আছে,তোমরা একজন একজন করে গরুর কাছে যাও–নিজের গরুরে গিয়া আদর করো দেহি !
বিক্রম তাড়াতাড়ি গরুর দিকে এগিয়ে গেল,কিন্তু না,গরুর মেজাজ এখন গরম,ও মাথা নাড়িয়ে সিং উঁচিয়ে তেড়ে আসলো বিক্রমের দিকে।
এবার আক্রম এগিয়ে যায় গরুর দিকে,এবারও গরু মাথা ঝাঁকায়,কাছ ঘেঁষতে দেয় না।
পুলিশের সামনে এক বড় সমস্যা বটে ! এমন গুবলেট কেস আগে কখনো আসে নি। শেষে কি না পুলিশকে গরুর চোর ধরতে হবে ? তাও তার সামনে দাঁড়িয়ে যে দুইজন তার মধ্যেই একজন গরুর মালিক,আর একজন হল চোর–তাও যে সে চোর নয়–গরু চোর ! পুলিশের প্রেস্টিজ পানচার যাকে বলে–তবু কিছু করার নেই। পুলিশ হল গিয়ে শান্তির রক্ষক,তাকে তো কিছু করতেই হবে।
পুলিশ অনেক চিন্তা করে বলল,ঠিক আছে,এই গরু পনের দিন, পনের দিন করে তোমাগ দু জনের ঘরেঐ থাকবো। তারপর গরুরে তোমাগর দুই বাড়ির মাঝখানে ছাইড়া দেওয়া হইব। গরু যার বাড়ি চিইন্না হাজির হইব সেই হইব গরুর আসল মালিক।
তাই ব্যবস্থা হল। প্রথমে গরু বিক্রমের বাড়িতে পনের দিন রাখার ব্যবস্থা হল। পনের দিন কেটেও গেল। এবার গরুর পনের দিন আক্রমের বাড়িতে থাকার কথা। পুলিশ,সিপাই,আর গরু ধরার লোক এই তিনজন মিলে গরু নিয়ে চলেছে আক্রমের বাড়ির দিকে। ওরা হাঁটছিল,আধ কিলো মিটার পথ চলার পরে গ্রামের প্রধান সড়ক শুরু হল। প্রধান সড়কে উঠেই গরু এদিক ওদিক কেমন যেন তাকাতে লাগলো। তারপর জোরে জোরে হেঁটে যেতে লাগলো। গলার দড়ি টানতে টানতে গরু সবার আগে আগে চলেছে। দড়ি হাতে লোকটাকে প্রায় টেনে নিয়ে যাবার অবস্থা। সবাই দেখল গরু আক্রমের বাড়ির দিকেই চলেছে। তার মানে ও রাস্তা চিনতে পেরেছে মনে হল।
এবার গরু ছুটতে শুরু করেছে। গরুর টানে লোকটার হাত থেকে রশি গেল ছুটে। আর সবাই দেখল গরু দৌড়াতে দৌড়াতে আক্রমের বাড়িতে পৌঁছে গেল। আক্রম বাড়িতেই ছিল। সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে গরু আক্রমের কাছে গিয়ে মুখ উঁচু করে দাঁড়ালো। আক্রম পরম আদরে ডেকে উঠলো,লক্ষ্মী !
লক্ষ্মী এবার–হাম্বা,করে ডেকে উঠলো। আক্রম ওর গরু লক্ষ্মীকে গলার নিচে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলো। ঘরের ভেতর থেকে আক্রমের বউ আর ছেলে মেয়েরা হাতে রুটি আর পিঠা নিয়ে এসে লক্ষ্মীর মুখের সামনে তুলে ধরল। লক্ষ্মী পরম আনন্দে সে সব খেয়ে নিলো।
কারু বুঝতে বাকি থাকলো না যে গরু,লক্ষ্মীর মালিক আক্রমই।
তারপর আর কি ? পুলিশ রেগে মেগে বিক্রমকে থানায় ডেকে পাঠাল। বিক্রম যেই না এলো পুলিশ ওর পিঠে দু ঘা রুলের বাড়ি মারল আর ধমক দিয়ে বলে উঠলো,হারামজাদা,গরু চোর কোথাকার !
সমাপ্ত