ধারাবাহিক বিজ্ঞান-কল্পকাহিনি: পঞ্চম স্বীকার্য (চতুর্থ পর্ব)
সকালে আলিমের ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখে পাশে মৌমিও ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখে পৌনে আটটা। সে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। আজ ঢাকা থেকে পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর ঝটিকা সফরে আসার কথা।
আলিম সরাসরি গোসলে চলে গেল। যাবার আগে মৌমিকে ডেকে তুলল।
বাথরুম করা, দাঁতব্রাশ, সেভ আর গোসল শেষে সে যখন বের হয়ে এল তখন সাড়ে আটটা। মৌমি আলিমের জন্য রাতের তরকারি গরম করল, সঙ্গে ডিমভাজি। সকালের খাবার খেতে আলিম সময় নিল মাত্র দশ মিনিট। অফিসের জন্য রেডি হতে পাঁচ মিনিট সাথে চা খেতে তিন মিনিট।
ন’টা বাজতে দশ মিনিট আগেই আলিম বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই মৌমি আলিম রাতের মেইলের কথা মনে করিয়ে দিল।
আলিম ঘড়ি দেখল। এমটিতেই দেরি হয়ে গেছে। মেইল দেখতে গেলে কমপক্ষে দশ মিনিট লাগবে। দেরী যখন হয়েছেই মেইলটা চেক করার সিদান্তই নিল।
কম্পিউটার অন করে মেইল বক্সে আসতেই দেখল প্রহীর মেইল এসেছে।
জনাব আলিম
আপনার মেইল পেলাম। আমার মনে হচ্ছে আপনি আমার অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। আর সে কারণেই আপনি সতের সেপ্টেম্ববরের কিছু আগাম ঘটনা জানতে চেয়েছেন।
আমার জানামতে এখনও কেউ অতীতে যায়নি কিংবা কেউ অতীতে তথ্য পাচার করেনি। ধরুন আমি আপনাকে কিছু নির্দিষ্ট তথ্য পাচার করে দিলাম। আপনি সে অনুযায়ী কিছু পদক্ষেপ নিতে পারলেন। তখন আপনার সময়ে এমন কিছু পরিবর্তন হওয়া শুরু করবে যা কিনা হবার কথা ছিল না।
আরও একটু ব্যাখ্যা করি। ধরুন আমি আপনাকে আপনার সময়ের অগ্রীম দুই বছরের শেয়ারমার্কেটের দৈনিক বিস্তরিত তথ্য দিয়ে দিলাম। আপনি সে অনুযায়ী শেয়ার ব্যবসা করলেন। দেখা যাবে দুইবছরের মাথায় আপনি দেশের সবচেয়ে বেশী অর্থবিত্তের মালিক হলেন।
আপনার মনে হতে পারে এটা সমস্যা কীসের। ভেবে দেখুন শেয়ার ব্যবসা করে আপনি যে বিত্তবান হবেন সেটা কিন্তু হবার কথা নয়। আর আমি আছি আপনার থেকেও ছয়শ বছর পরে। অতীতে সামান্য কিছু পরিবর্তেনের ফলে দীর্ঘ ভবিষ্যতে বিশাল কোন পরিবর্তন আসতে পারে যা পুরো সময় ও জীবজগতের ভারসাম্য পুরোপুরি নষ্ট করে দিতে পারে।
আলিম এই পর্যন্ত পড়ে দুটো প্রিন্ট করল। একটা মৌমির হাতে দিল আর একটা নিজের পকেটে নিয়ে অফিসে রওনা দিল।
অফিসে এসেই জানতে পারল বন ও পরিবেশ মন্ত্রী তার সিডিউল পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকা চলে গেছেন। তারপর খবর এল পাশের এলাকার লোকালয়ের লোকজন পিটিয়ে একটা বাঘ মেরে ফেলেছে। আলিমকে পুলিশ নিয়ে দ্রুত সেখানে যেতে হল। ঢাকায় রিপোর্ট পাঠাতে হলো।
যখন সে অফিসে আসল তখন জানতে পারল একদল কাঠপাচারকারীদের আটক করা হয়েছে। সে দ্রুত সেখানে চলে গেল। আটক লোকদের বনবিভাগের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হলো। তারপর সে অফিসের পথে ফিরল। পকেটে হাত দিয়ে অবাক হয়ে দেখল মোবাইল তার পকেটে নেই। তখন খেয়াল হল অফিসে ঢুকেই সে ড্রয়ারে রেখেছিল। তারপর হঠাৎ করেই বের হয়ে যাওয়াতে নিতে মনে ছিল না।
দুপুরের খাবার সময়টা খুব ভাল গেল। মন্ত্রী আসবেন জেনে আয়োজনও ছিল ভাল।
খাবার শেষে নিজের রুমে নিয়ে মোবাইল হাতে নিল, দেখে সাতচল্লিশটা মিসকল। কোন অঘটন হল নাতো? আলিম ভয় পেয়ে মৌমিকে ফোন দেয়।
‘কী ব্যাপার? কই ছিলে আমি সেই দুপুর থেকে তোমাকে চেষ্টা করছি।’ মৌমি অনুযোগের স্বরে বলে।
‘এই তো ছিলাম। একটা বাঘ মেরে ফেলা হয়েছে। কাঠ পাচারকারী ধরা হয়েছে। এইসব ঝামেলায় ছিলাম।’ আলিম জবাব দেয়।
‘কেন আজ মন্ত্রী আসে নাই?’
‘না’ আলিম উত্তর দেয়।
‘তুমি প্রহীর মেইলটা ভালোভাবে পড়েছিলা?” মৌমি প্রশ্ন করে।
প্রশ্ন শুনেই আলিমের মনে পড়ে তার পকেটে প্রহীর মেইল।
‘না’ কী হয়েছেি
‘পড়ে দেখ তাড়াতাড়ি।’ মৌমি লাইন কেটে দেয়।
আলিম পকেট থেকে মেইলটা বের করে পড়তে শুরু করে।
আর সে কারণেই ঘটবে এরকম কোন তথ্য আপনাকে দিতে চাচ্ছি না। তবে আপনার সন্দেহ দূর করার জন্য আপনাকে এমনকিছু তথ্য দিচ্ছি যার কোন প্রভাব আপনি সময়ের উপড় দিতে পারবেন না।
একঃ একটু আগে আপনাকে শেয়ার মার্কেটের উদাহরন দিয়েছি। সতের সেপ্টম্বর ২০১২ তে শেয়ার মার্কেট নিম্নমুখী ছিল। এই দিন তখনকার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক সতের পয়েন্ট কম ছিল। এই মূর্হুতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বলে কিছু নেই তবে পুরো এশিয়া নিয়ে একটি শেয়ার মার্কেট আছে। বিস্তারিত আমি আপনাকে দিতে চাচ্ছি না।
দুইঃ সতের সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে বাংলাদেশের সাথে আয়ারল্যান্ডের খেলা ছিল। খেলাটিতে বাংলাদেশ পরাজিত হয়।
তিনঃ তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আদালত একটি রায় দেয়। সঙ্গত কারণেই আমি বিস্তারিত লিখছি না। আশা করি দিনশেষে আপনি আমার মেইলগুলোকে বিশ্বাস করতে পারবেন।
চারঃ দক্ষিণাঞ্চল ভ্রমন শেষে ঢাকা যাবার পথে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা এই দিন প্রান হারিয়েছিলেন। আমি নাম বলতে চাচ্ছি না।
আপনার বিশ্বাসের অপেক্ষায় রইলাম।
প্রহী।
আলিম পুরো মেইলটা একবার না, দশবার পড়ল খুব ভালো করে পড়ল। প্রহী বেশকিছু তথ্য দিয়েছে। আলিমের কাছে মনে হতে থাকে খুব ভাল বিশ্বাস যোগ্য তথ্য।
সে ঘড়ির দিকে থাকায়। প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। মৌমিকে ফোন দেয়।
‘মেইল পড়েছ?’ মৌমি জানতে চায়।
‘হ্যাঁ।’ আলিমও উৎসাহের সাথে জবাব দেয়।
‘আজ শেয়ার মার্কেট নেগেটিভ ছিল। ঠিক সতের পয়েন্ট।’
‘বল কি!’
‘আমি নিজে ডিএসইর ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখেছি। তাইতো তোমাকে এতবার ফোন দিলাম।’ মৌমি গড়গড় করে বলে গেল।
‘বল কি!’ আলিম আবারও বিস্মিত।
‘তত্ত্ববধায়ক নিয়ে আদালত রায় দিয়েছে।’ মৌমি যোগ করে। মৌমি প্রথম আলোর ওয়েব সাইট থেকে আলিমকে ফোন করে শুনায়।
‘খেলার খবর কি?’ আলিম জানতে চায়।
‘আমি ক্রিকইনফোতে দেখলাম বাংলাদেশ ব্যাটিং-এ নামল। আয়ারল্যান্ড ১৬৪ রান করেছে।’
‘১৬৪।’
‘হ্যাঁ, তাহলে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ হারবে। প্রহীর কথাই ঠিক, সে নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎ থেকে যোগাযোগ করেছে।’ মৌমি মন্তব্য করে।
আলিম তাল না মিলিয়ে বলে, ‘আমি বাসায় আসছি।’
‘তাড়াতাড়ি আস।’ মৌমি তাড়া দেয়, ‘এক সাথে খেলা দেখি।’
আলিম যতক্ষনে বাসায় ফেরে ততক্ষনে খেলা অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে। বাসায় আসতেই মৌমি বলে, ‘বাংলাদেশের ৬০ বলে ৬২ রান লাগবে। হাতে আছে আট উইকেট।’
‘তাহলে তো বাংলাদেশের হারার কোন সম্ভাবনাই নেই।’ আলিম বলে।
‘কী জানি?’ মৌমি উত্তর দেয়। তার কাণ্ঠে হতাশা।
‘আমি আসার সময় প্রহীর কথা গুলো নিয়ে ভেবেছি। আপাতদৃষ্টিতে কথাগুলো অবাক করে দিলেও এই ধরনের ভবিষ্যৎ বলা কিন্তু কঠিন না। দেখ অনেক দিন ধরেই শেয়ার বাজার খারাপ। আর কেউ যদি বলে নেগেটিভ যাবে। তবে তার কথা সত্য হবার সম্ভাবনাই বেশী।’ আলিম তার জামা প্যান্ট পাল্টাতে পাল্টাতে যুক্তি দেয়।
‘হুম কিন্তু কাটায় কাটায় সতের পয়েন্ট!’
‘হতে পারে, তবে কাকতালীয়।’
‘তাহলে তত্ত্বাবধায়ক!’ মৌমি পাল্টা জিজ্ঞেস করে।
‘প্রহী কি রায়টা বলেছিল? বলেনি। আর আজ যে রায় দিবে সেটাতো আগে থেকেই ঠিক করা।’
‘হ্যাঁ সেটা ঠিক তাহলে কি সত্যিই কেউ বোকা বানাল?
‘মনে হচ্ছে দেখি খেলাটা রিফ্রেশ কর।’ আলিম বলে। মৌমি কাম্পিউটারের সামনে ছিল। সে রিফ্রেশ করল। করেই আবাক হয়ে গেল।
‘পাঁচজন নাই। ৩৮ বলে ৩৯ লাগবে।’
‘দেখ কি হয়?’ আলিম বাথরুমে চলে যায়।
যখন বের হয় তখন মৌমি বলে ১২ রান ১২ লাগবে। হাতে ৪ উইকেট।
‘তাহলে মনে হচ্ছে প্রহীর কথা ঠিক না। এই অবস্থায় কি কেউ হারে?’ আলিম বলে।
তখন ১৯ তম ওভারের প্রথম বল, দুই রান।
দরকার এগার বলে দশ রান। হাতে চার উইকেট।
দ্বিতীয় বলে মাশরাফি আউট। মৌমি মাথায় হাত দেয়। আলিম বলে দশ বল দশ রান। তিন উইকেট হাতে। হারা অসম্ভব!
আলিমকে অবাক করে দিয়ে পরের চারটি বলে বাংলাদেশের কোন রান আসল না!
শেষ ওভারে প্রয়োজন হলো দশ রান। হাতে তিন উইকেট।
আলিম আর মৌমি দুজনেরই নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কী ঘটবে?
শেষ ওভারের প্রথম দুই বলে কোন রান এল না। তৃতীয় বলে জিয়াউর আউট হয়ে গেল। তারপর আউট হল রাজ্জাক। বাংলাদেশ পাঁচরানে হেরে গেল।
অনেকক্ষন মৌমি আর আলিম কথাই বলতে পারল না। অসম্ভব এই জিতা ম্যাচ কেউ হারে।
‘বাংলাদেশ হারবে এটা বলা কিন্তু কঠিন ব্যাপার না। প্রায় খেলাতেইতো ওরা হারে।’ আলিম যুক্তি দাঁড় করাতে চাইল।
‘সেটা ঠিক কিন্তু টানা সবগুলোই যদি মিলে যায় তাহলে আর কীভাবে অবিশ্বাস করি?’ মৌমি বলে।
‘সবগুলো কীভাবে মিলবে? শেষটাতো মিলেনি। আমি অফিস থেকে বের হবার আগে খোঁজ নিয়েছি। বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ঢাকায় পৌঁছে গেছেন। তিনি তখন প্রধানমন্ত্রীর সাথে মিটিং এ ছিলেন।’ আলিম বলে চলে, ‘দেখ প্রহী নামে যে অনুমান গুলো করেছে তার বুদ্ধি আর বিচার শক্তি কিন্তু ভাল। প্রতিটাই কিন্তু হবার কথা ছিল শুধু শেষটা বাদে। প্রহী নামের লোকটা যদি এটা না বলত তাহলে যে কোন সাধারন মানুষ কিন্তু তার কথা বিশ্বাস করত।’
‘কি জানি হয়ত তোমার কথাই ঠিক। যাও বারান্দায় গিয়ে বস, আমি কফি নিয়ে আসি।’ মৌমি এটা বলেই রান্না ঘরে চলে গেল।
আলিম ঘড়িতে দেখল সোয়া পাঁচটা বাজে। সে টিভি অন করল। সবগুলো চ্যানেল একবার করে দেখলেও পাঁচ সাত মিনিট লাগে। রিমোট টিপে টিপে সবগুলো চ্যানেল দেখল। কোথায় ভাল কোন প্রোগ্রাম নেই। আলিম বিরক্ত হল। সে একটা গল্পের বই নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। হুমায়ুন আহমেদের মিসির আলির বই। মিসির আলি চরিত্রটা আলিমের বেশ প্রিয়। মিসির আলির মত সেও সবকিছুর ব্যাখ্যা খুঁজে বেড়ায়। সব কিছুরই ব্যাখ্যা আছে, আলিমও সেটা বিশ্বাস করে। যখন সে গভীর ভাবে গল্পের ভিতর ঢুকে ছিল, তখনই সে মৌমির চিৎকার শুনতে পায়। আলিম দৌড়ে ঘরে ঢুকে দেখে বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে মৌমি টিভির দিকে তাকিয়ে আছে।
আলিমও টিভির দিকে তাকাল।
তখন টিভির স্ক্রলে ব্রেকিং নিউজ চলছে, ‘বরিশাল-মাদারিপুর সড়কে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা। পরিবারসহ শ্রমসচিব নিহত।’
চলবে…