Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

উটন দাদুর কাহিনী-পর্ব-১৭ (শিশু ও কিশোরদের বনজঙ্গলের রোমাঞ্চকর উপন্যাস)

: | : ৩০/০১/২০১৪

images (60)

মানুষ জন্তুরা অনেকেই ওদের নেশায় পীড়িত ছিল। ওদের মধ্যে বেশ কিছু লোক মন্দিরের চত্বরে শুয়ে আছে। কেউ কেউ নেশায় বেহুঁশ হয়ে বিড়বিড় করে কিছু বকে চলে ছিল। দু চারজন আধ বেহুঁশ বুনো নেচুর কাছে এসে দাঁড়ালো। এবার কি তা হলে নেচুর পালা ! ওরা নেচুর পিঠে লাথি মারতে লাগলো,তবু ব্যথা সহ্য করে ও চুপ করে মরার মত পড়ে থাকলো। ওরা নেচুর দু পা দু হাত ধরে চ্যাং দোলা করে ওদের দেবতার থানের একেবারে পাশটাতে নিয়ে ফেলে দিল। নেচু,উঃ,আঃ,শব্দ করে ব্যথায় কাতরে উঠলো। বন্যরা নিজেরা,গোঁ গাঁ,আওয়াজ করে নিজেদের মাঝে কি যেন বলাবলি করল। দুর্বোধ্য সে ভাষা নেচুর বোঝার বাইরে ছিল। ওদিক থেকে দুজন তাদের আধ ভোঁতা,আধ ধার পাথরের বেঢপ অস্ত্র নিয়ে নেচুর কাছে এগিয়ে এলো। ওরা নিশ্চয় নেচুর হাতদুটো,তারপর পা দুটো কেটে ফেলবে ! রাবুনকেও এভাবেই ওরা কেটে ছিল। কাটার পরের অবস্থার কথা নেচু আর চিন্তা করতে পারল না। রাবুনের হাত-পা কেটে বাকি শরীর ওরা অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেছিল। ওঃ কি ভয়ঙ্কর,কি ভয়ঙ্কর !

বুনোরা প্রায় নিভে যাওয়া কাঠের ওপর নতুন কাঠ চড়াল–একটু পরেই সে কাঠ আবার জ্বলে উঠবে–দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনে তারা নেচুকে ফেলে দেবে,তারপর তার আধা পোড়া দেহ ওরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে !

নেচু যখন মৃত্যুর শিয়রে তখনই হঠাৎ তার উটন দাদুর একটা কথা মনে পড়ে গেল। উটন দাদু ওদের কোন এক সময় বলে ছিল,উবুড় হয়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণামের ভঙ্গীতে থাকলে নাকি বন্যরা তাকে কিছু করে না। নেচুর চোখ পড়ল ওদের দেবতার দিকে, একটা লম্বাটে বড় পাথর–সিঁদুর কিম্বা রক্ত মাখা সেটা–মাঝে মাঝে চকচক করে উঠছিল ! নেচু মনে মনে আবার সেই দেবতাকে প্রণাম জানালো। বুনোরা তাদের হাতিয়ার নিয়ে নেচুর মাথার ওপর যেই ধরতে গেল সঙ্গে সঙ্গে নেচু নিজের শরীরটাকে পাল্টে উপুড় হয়ে গেল আর হাত দুটোকে প্রণামের ভঙ্গীতে সামনের দিকে সটান টেনে নিয়ে জড় করে থাকল।

আর আশ্চর্য,সঙ্গে সঙ্গে নেচুকে এমনি ভঙ্গীতে দেখে বন্যরা যেন আচমকা আঁতকে উঠলো। অস্ত্র ধরে নেচুর হাত-পা কাটার জন্যে যারা উদ্যত ছিল তারা তাদের হাত থেকে হাতিয়ার ফেলে দিল। জাগ্রত সব লোকেরা এক জাগায় জটলা বেঁধে দাঁড়ালো–ওদের চোখে মুখে ভয়ের আতঙ্ক দেখা গেল.ওরা নিজেদের মধ্যে কিছু বলার চেষ্টা করছে,অনেকে ঝুঁকে ঝুঁকে নেচুকে ভাল করে দেখে যেতে লাগলো। সবাই তাদের দেবতার দিকে তাকিয়ে কিছু বিড়বিড় করে বলে চলেছে ! এমনি ভাবে প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে ওরা দেবতার সামনে মন্ত্র পাঠ করছিল হবে। এবার জেগে থাকা সবাই এক এক করে দ্রুত মন্দির চত্বর থেকে বেরিয়ে গেল।

মাঝ রাত পার হয়ে গেছে তখন। নেচু নড়েচড়ে উঠলো–সমস্ত শরীরে তার যন্ত্রণা–তবু সে তাকাল–চার পাশে তাকিয়ে দেখল ,কিছু লোক অঘোরে ঘুমিয়ে আছে–গভীর ঘুমে হবে ওরা—একটাও জাগ্রত লোক সেখানে ছিল না,সবাই চলে গেছে তার প্রণামের ভঙ্গি দেখে।

অনেক কষ্টে নেচু উঠে দাঁড়ালো–দেহের সমস্ত ব্যথা তাকে সহ্য করতেই হবে–নতুবা ওর মৃত্যু যে অনিবার্য ! ওর দুটো পায়ে যেন যন্ত্রণা সবচে বেশী। কষ্ট করে পাশে পড়ে থাকা গাছের একটা ডাল তুলে নিলো সে—লাঠির অবলম্বন তার খুব দরকার হবে–তাতে লাঠির ভর দিয়েই চলার চেষ্টা করতে হবে।

পারছিল না নেচু—হঠাৎ ওর চোখে দেবতুল্য পাথরটার দিকে নজর পড়ল। নেচু মাথা নিচু করে তার ভক্তি নিবেদন করল। তারপর সে এক পা এক পা করে লেংড়াতে লেংড়াতে পৌঁছল দেব বিগ্রহের পেছন দিকে–যেখানে সেই গুপ্ত পাথরটা রয়েছে যেটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মন্দির থেকে গোপন পথে বেরিয়ে যাওয়া যায়। অনেক চেষ্টার পর সে পাথর সামান্য সরল–এখন আরও কিছুটা সরাতে না পারলে নেচু তার শরীর গলিয়ে যেতে পারবে না–তবু সে তার একটা হাত পাথরের ফাঁকা দিয়ে বের করে দিল। এবার সেই ফাঁকায় সে তার কাঁধ সামান্য ঢুকিয়ে দু দিকেই ধীরে ধীর ঠেলার চেষ্টা করল। পাথর আস্তে আস্তে সরতে লাগলো আর নেচু এক সময় নিজের দেহ ঘষটে ঘষটে বেরিয়ে এলো মন্দিরের বাইরে। না,সে পাথরের ফাঁকা জাগাটা আর বন্ধ করল না—সে জাগা তেমনি ভাবে খোলাই পড়ে রইল।

চারিদিকে ছেয়ে আছে ঘন কালো,নিকষ অন্ধকার। নদী স্রোতের শব্দ আসছিল–নেচু আন্দাজ মত নদীর পারের দিকে এগিয়ে গেল। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে সে খুঁজার চেষ্টা করল সেই আগের পথ—যেখান দিয়ে জঙ্গল পথে ওরা পালাবার জন্যে যাত্রা শুরু করেছিল আর তাদের পেছনে তাড়া করেছিল বুনোর দল।

চোখের সামনের অন্ধকার কিছুটা থিতিয়ে এসেছিল–আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছিল সে। সামনেই তার মনে হল সেই পথ—পা টিপে টিপে অসহ্য ব্যথা নিয়ে সে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। সামান্য রাস্তা এগিয়ে গিয়ে চাঁদের আবছা আলোয় চোখে পড়ল সেই জাগা যেখানে মানুষের অসংখ্য কঙ্কাল, হাড়-গোড় পড়ে আছে। বুনোদেরই এ কাজ,মানুষের মাংস খেয়ে তার অবশেষ হাড়গোড় এখানে এনে ফেলেছে। হঠাৎ নেচু দেখতে পেল,সদ্য ফেলে রাখা এক তাজা কঙ্কাল–শেয়ালেরা তা নিয়ে কামড়া কামড়ি করছে। ওর মনে পড়ল,রাবুনের কথা—নিশ্চয় এটা ওর দেহের কঙ্কালই হবে।

না দাঁড়ালে চলবে না–বুনোদের কথা কিছুই বলা যায় না। কখন আবার ওরা দেখে ফেলবে যে নিচু পালিয়েছে। তাকে ধরতে ওরা ছুটে আসবে সেই লাঠি-সোঁটা,হাতিয়ার নিয়ে। লাঠিতে ভর দিয়ে ও আবার এগিয়ে চলল ঘন জঙ্গলের পথ ধরে।

হ্যাঁ,এর আগে এই পথেই উটন দাদু ও তার দলবল,সে সঙ্গে নেচুও এসে ছিল। আলো-অন্ধকার পথে এক লাঠির সাহারায় ধীর গতিতে সে এগিয়ে চলেছে। বনের সরু রাস্তায় ছোট বড় ডালপালা সরিয়ে,কখনো ভেঙে,তাকে শ্লথ গতিতেই এগোতে হচ্ছে। অনেক দূর এসেও ও উটন দাদুদের খুঁজে পেল না–ওরা সবাই নিশ্চয় আরও অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আর পারছিল না নেচু। ওকে বিশ্রাম নিতে বসতেই হল। এক জাগায় মাটিতে লেপটে বসে পড়ল সে।

বনে জন্তুদের ভয় সব সময় লেগে থাকে। ওদের দিকটা লক্ষ্য রেখে সাবধানে চলতে হয়,ওদের সংসর্গ বাঁচিয়ে না চলতে যে সমূহ বিপদ।  রাস্তায় অনেকবার সাপ,শিয়াল,বনগরু দেখেছে নেচু–ওদের ভয় পায় না সে—উল্টো শিয়াল মানুষকে দেখে ভয়ে পালায়। আর সাপ আসলে কিন্তু নিরীহ প্রাণী। ওকে আঘাত না করলে ও কখনো কারও ক্ষতি করে না। তবে অজগরের কথা আলাদা। বড় আজগর সাপ নাকি মানুষ গিলে খেতে পারে। যাই হোক,পথ চলতে হিংস্র কোন জানোয়ার নেচুর সামনে এখনও এসে পড়েনি। তা হলে নেচুর বাঁচা অসম্ভব হয়ে পড়ত–শেষ পর্যন্ত মরতেই হত.আর সেই যদি মরতেই হবে,তবে আর রামে মারুক আর রাবণে মারুক তাতে কি ফারাক ?

ক্রমশ

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top