আমার দেখা পৃথিবী
॥১॥
কত মানুষের জীবনে কত কিছু ঘটে যায়, সবগুলো যেমন লিপিবদ্ধ করা যায় না তদ্রূপ দর্শনীয় অনেক কিছু প্রকাশ করাও যায় না। এবং একজন মানুষের পক্ষে সারা পৃথিবী দেখা দূরে থাক, নিজের ঘরের চারি পাশে যা কিছু আছে তা দেখাও অনেকক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। আমার জীবনটা খুবই ব্যতিক্রমী। এ জীবনে যা কিছু ঘটেছে এবং দেখেছি সবটুকু প্রকাশ করতে না পারলেও যতটুকু সাধ্যে কুলায় বর্ণনা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে এখানে আমার জীবনের গল্প বলব না। আমি যে একজন কত ভ্রমণপ্রিয় মানুষ ছিলাম সেটা বর্ণনা করব।
ছোটবেলার অনেক দুরন্তদের মতো আমিও খুব ডানপিটে ছিলাম। মারামারি করে কারও নাক ফেটে দেওয়া অথবা নিজের মাথা ফাটা আমার নিত্যাভ্যাস কিবা বদভ্যাস ছিল। আমার দুরন্তপনায় মা রীতিমতো অতিষ্ঠ। এত অভিযোগে অভিযুক্ত হই আমি–প্রতিদিন আমার জন্যে যদি একটা করে ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করা হয় তবু ন্যায্যবিচার হয় না। একজন মা যদি সন্তানের ন্যায্যবিচার করতে পারত তা হলে বোধ হয় পৃথিবীতে জনসংখ্যা এমনহারে বাড়তে পারত না। কারণ অনেক মায়ের হাতে অনেক ছেলের অকালমৃত্যু হত। আর একজন ছেলের অকালমৃত্যু মানে অসংখ্য বংশবিস্তারের সম্ভাবনা থেকে মুক্তি।
আমাকে শাসন করতে করতে মা ক্লান্ত–আর পারছে না। বলে–রাখ, খুব তাড়াতাড়ি তোকে দুচোখের আড়াল করছি; আমার বাপের মোষ তাড়াতে যদি না দিই তবে আমার নাম সুলেখা নয়। লেখাপড়া করতে হবে না। কী হবি আর এটুকু লেখাপড়া শিখে। সত্যিই, লেখাপড়া করতে হবে না শুনে খুব আনন্দ লাগছিল তখন। তার কিছু দিনপর আমরা নানার বাড়ি এলাম। সত্যি সত্যি মা আমাকে এবার নানার বাড়ি রেখে যায় । মামা-মামিদেরকে বলে যায়, এক মিনিটের জন্যেও যেন আমাকে খেলতে দেওয়া না হয়। লেখাপড়ার চাপের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সকল কাজকর্মও যেন করায়। ছেলেবেলেদের সঙ্গ-আড্ডায় ও খেলাধুলায় সকল নষ্টের মূল বলে যায়। আমি আরও আনন্দিত। কারণ এখানে মামাত-খালাত ভাই ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আছে–অনেকটা আমার সমবয়সী। তাদের সঙ্গ যে পাব, আর কথাই নেই।
এবার মামিদের নাককাঁদন কে দেখে! কথায় কথায় কানমলা ‘হারামজাদা’ ‘জারোয়া’ এসব হয় নিত্যসঙ্গী। নাককানে খৎ দেয়–আপদ তাড়াতে পারলেই তবে তারা বাঁচে। এখানে মায়ের শাসন নেই সুতরাং আমাকে দমায় কে, মামারাও যে প্রবাসে; কিছু দিনের জন্যে এক-একজন আসে আবার চলে যায়। দিন যত যাচ্ছে আমার শিকর ততই পোক্ত হচ্ছে। এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে টো টোতে দিন যাচ্ছে। দুপুরে গ্রামসুদ্ধ লোক ঘুমিয়ে পড়লে এদের আম ওদের জাম কারও কলা কারও বেতফল ছিঁড়ে দলবেঁধে আড্ডা দিতে দিতে খাওয়া হচ্ছে। কখনো সদলবলে চলে যাচ্ছি হাটখোলা, কখনো রথখোলা, কখনোবা কান্তার কূল শম্ভুনাথের মেলা দেখতে। কখনো দলভিড়ে স্কুল পালিয়ে যাচ্ছি সিনেমা দেখতে। কখনো ফুটবল খেলার ম্যাচ নিয়ে চলে যাচ্ছি ফকিরহাট, ভুজপুর, শান্তিরহাট, শাহনগর, ধলই, দলঘাট, দাঙ্গারচর, মতিয়ারপুল, মধুনাঘাট। কখনো সমাধানের তর্কাতর্কিতে বন্ধুবান্ধবেতে লেগে যাচ্ছে আবার তুমুল লড়াই–আড়াআড়ি। কিছু দিনপর মিটমাট হলে দলবলে আবার ছুটছি দূরে কোথাও ভ্রমণে–বনভোজনে। এতটুকুতেই আমার বেশ বেড়ানো হয়ে যায় দেশের অনেকটা জায়গা।
চলন্ত…