Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

মুক্তি যুদ্ধের গল্প (দশম পর্ব )

: | : ১২/০২/২০১৪

আমরা পাথরঘাটা চলে এসেছি বেশ কিছুদিন আগেই । আমরা পাথর ঘাটার যুদ্ধে আমাদের একজন সহ যোদ্ধাকে হাড়িয়েছি ।পাথর ঘাটায় যখন গভীর রাতে ডিউটি করি, তখন হঠাৎ করেই যেন শুনতে পাই, পানি পানি বলে কারও চিৎকার। তোমাদের তো আগেই বলেছি, আমাদের একজন স হ যোদ্ধা পাথরঘাটা আক্রমন করা কালে আহত হয়ে ধরা পরেছিল । পাক-সেনারা যুদ্ধের সকল নিয়ম ভঙ্গ করে নির্মম ভাবে তাকে হত্যা করে । সে মৃত্যুর সময় পানি পানি বলে চিৎকার করেছিল । তাই তো সেই পাথর ঘাটার মাটিতে দাঁড়িয়ে যখনই গভীর রাতে ডিউটি করতে থাকি তখনই হয়তো কল্পনায় সেই দৃশ্য চিন্তা করতে থাকি, আর তখনই শুনতে পাই, সেই করুন চিৎকার । জান শুভ; আমাদের সাথে থেকে যারা মারা গেছে, আমরা চোখের সামনে তাদের দেখেছি বলে তাদের মৃত্যু আমাদের কাঁদায় । কিন্তু সারা বাংলাদেশ জুড়ে কত লোক যে মারা গেছে তা তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না । তোমরা সিনেমায় বা নাটকে বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে কোন আলোচনার সময় প্রামান্য চিত্রে, মানুষের যে সকল মৃতদেহ শকুন ও শিয়াল কুকুরকে খেতে দেখ, তখন  তোমাদের অনেকেরই মনে উদয় হয়, এ গুলো হয়তো কোন ভাবে তৈরী করা হয়েছে । আসলে কিন্তু তা নয় । তখন রাস্তা ঘাটে বেড় হলেই মানুষের মৃত দেহ দেখতে পাওয়া যেত । কোথাও যুদ্ধ বাঁধলেই পাক-সেনারা যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা চলে গেলে নিরীহ মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করতো ।আমাদের টাংগাইলের ছাত্ররা পাক-সেনাদের প্রথম প্রতিরোধ সৃষ্টি করে ঢাকা আক্রান্ত হোয়ার ক”দিন পরই ।ঐ সময় করটিয়া একটি পুলিশ ক্যাম্প ছিল । ঢাকা আক্রান্ত হওয়ার পরই করটিয়া সা’দৎ কলেজের ছাত্ররা করটিয়া পুলিশ ক্যাম্পে গিয়ে সকল পুলিশের অস্র তাদের নিকট হস্তান্তর করতে বললে, ক্যাম্পের পুলিশেরা তাদের সকল অস্র গুলি ছাত্রদেরকে দিয়ে দেয় ।পুলিশদের  মধ্যে যারা সাহসী ও উৎসাহী ছিল তারা মুক্তি যোদ্ধাদের সাথে যোগ দেয় ।সম্ভবত সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার । ভোরে পাক-সেনাদের একটি কনভয় আসছিল ঢাকা থেকে টাংগাইলের দিকে। সেই কনভয়কে আছিম তলা ব্রীজে এ্যাম্বোশ করে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমন করে ।রাত থেকেই ছাত্রদের প্রস্তুতি চলছিল । সা’দৎ কলেজের ছাত্ররা আগে থেকেই রাইফেল চালানো জানত । কারন অধিকাংশ ছাত্ররাই ছিল কলেজ বি এন সি সি শাখার সদস্য । পরিকল্পনা ছিল প্রথম ব্রীজ উড়িয়ে দেওয়া হবে এবং এ্যাম্বোশে ফেলে পাক সেনাদের হত্যা করা হবে ।রাস্তার দুই পার্শে ছাত্র ও পুলিশেরা এ্যাম্বোশ করে পজিশন নেয় । ব্রীজের নিচে একটি ডিনামাইট সেট করা হয় । পরিকল্পনা হয় প্রথম আক্রমন হবে ডিনামাইট দিয়ে । সেই মোতাবেক ডিনামাইটের সংযোগ তার নিয়ে এক জন বসে যায় ব্রীজের নিচে খালের পার ঘেসে । তার দ্বায়িত্ব রইল কনভয়ের প্রথম গাড়ী যখন ব্রীজে উঠে যাবে তখনি ডিনামাইট বিস্ফোড়ন ঘটাবে । তার সাথে রাইফেল নিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা থাকে কভারেজে । নির্দেশ থাকে ডিনামাইট বিস্ফোড়নের সাথে সাথে তারা খালের মধ্যে নেমে খালের পার ঘেসে দূরে চলে যাবে । আর বাকীরা পজেশন নেয় ব্রীজ থেকে আরো অন্তত ৩০০ থেকে ৫০০ গজ দক্ষিণে । ডিনামাইট বিস্ফোড়নের পর কনভয় থেমে যাবে, তখন কনভয়ের পিছন দিক থেকে রাইফেল ধারীরা তাদের আক্রমন করবে । ডিনামাইট আক্রমনে ব্রীজ উড়ে যাওয়ায় পাক সেনারা সামনের দিকে এগুতে পারবে না ।আর পিছন দিক থেকে আক্রান্ত হওয়ায় তারা পিছাতেও পারবে না ।কাজেই আক্রমন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রনে থাকবে ।তখন মুক্তিযোদ্ধারা ভেবেছিল এই আক্রমনে পাক-সেনারা সব মারা যাবে। আসলে এত বৎসর পর বুঝতে পারছি যে, তখনকার প্রশিক্ষণহীন , বিনা প্রাকটিসে যুদ্ধের সময় কত ভাগ গুলি পাক-সেনাদের আঘাৎ করতে পেরেছে তা চিন্তার বিষয় । কাজেই আমাদের মুক্তি যোদ্ধারা এ্যাম্বোশ করে মনে করেছিল সকল পাক-সেনারা মারা যাবে, আর এখনই এই কনভয়ে যত অস্র আছে সব তাদের হস্তগত হয়ে যাবে । তারা তো আর তখন জfনতো না যে, ভীষন ভাবে প্রশিক্ষিত না হলে ১০০ শত মিটার দূর থেকেই কোন টার্গেটে গুলি লাগানো কঠিন কাজ । আর মুক্তি যোদ্ধারা পজেশন নিয়েছিল কয়েক শত মিটার দূরে । কাজেই কল্পনায় যুদ্ধের যে পরিনতি নিয়ে তারা পুলকিত ছিল, যুদ্ধের পর কিন্তু তারা সে ফল পেল না ।কারন প্রথমেই ডিনামাইট বিস্ফোড়ন ঘটানো হল । সেই বিস্ফোড়নে একটি গাড়ি উড়ে গেল ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘ সময় গুলা গুলিতে কেহ নিহত হল কিনা, সেটা অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে রয়ে গেল ।কারণ এখন বুঝতে পারি, ডিনামাইট বিস্ফোড়ন হওয়ার সাথে সাথেই পাক -সেনারা দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার মাঝে লেইং পজিশন নিয়েছিল। তাতে তাদের সুবিধা হলো এই যে, মাঠ থেকে রাস্তার উচ্চতা ছিল ১০ ফুটেরও বেশী উচু । ফলে মাঠ থেকে টার্গেট লক্ষ্য করে গুলি করলে সকল গুলি রাস্তার কিনারে লেগে শূন্যে উড়ে গিয়েছে, আবার একটু নিচু করে গুলি করলে সে সকল গুলি রাস্তার কিনারে লেগে মাটিতে ঢুকে গেছে। ফলে প্রশিক্ষণহীন মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে কোন পাক সেনাই মারা যাচ্ছিল না ।সকাল থেকেই গুলি বিনিময় চলতে থাকল । এক নাগারে গুলি চললো দুপুর একটা নাগাদ । মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি শেষ হয়ে আসলো । ফলে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করলো ।পাক-সেনারা বিকাল পর্যন্ত মাঝে মাঝে গুলি ছুড়লো । কিন্তু যখন তারা দেখল দীর্ঘক্ষণ গুলি ছুরার পরও কোন প্রতি উত্তর আসছে না তখন তরা আস্তে আস্তে সাহস সঞ্চয় করে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ল । দক্ষিণ দিকে কোন প্রতিরোধ না থাকায় ঢাকা থেকে সাহায্যের জন্য আরো সৈন্য চলে এল । তারা এসে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঢুকে তল্লাশী চালিয়ে যে সকল লোক বাড়ির মায়া ত্যাগ করতে না পেরে বাড়িতে ছিল তাদের মাথা থেকে পৃথিবীর মায়া ছাড়িয়ে স্বর্গে পাঠিয়ে দিল ।রাস্তার উপর থেকে রকেট ল্যাঞ্চার ছুড়ে এলাকার সকল বাড়ি ঘর ঝ্বালিয়ে দিল । টাঙ্গাইলের প্রথম যুদ্ধ ছিল এই আছিমতলা ব্রীজের যুদ্ধ ।সেই যুদ্ধে মুক্তি যোদ্ধারা কয়েক ঘন্টা টিকে থেকে তাদের শক্তির একটা পরীক্ষা দিয়ে দেখল । অবশ্য এই যুদ্ধে কোন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেল না। তবে তারা বুঝতে পারল প্রশিক্ষিত পাক-সেনাদের প্রকাশ্য সন্মুখ যুদ্ধে হাড়ানো এত সহজ কাজ নয়  । তাই তারা গেড়িলা যুদ্ধ শুরু করল । রাতের আঁধারে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা টাঙ্গাইল রোডের অবশ্য শুধু ঢাকা টাঙ্গাইল রোডের নয় সারা বাংলা দেশের সকল রাস্তার ব্রীজ,কালবার্ট উড়িয়ে দিতে লাগল। এতে করে পাক-সেনাদের যোগাযোগে বেশ সমস্যার সৃষ্টি হতে থাকল । বিভিন্ন ব্রীজ ভাংগাতে দেশের আর্থিক ক্ষতি হল ঠিকই, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের এই লাভ হলো যে, পাক-সেনারা এই সকল ব্রীজ পাহারা দিতে রাজাকার নিয়োগ দিল । এতে আমাদের দুটো লাভ  হলো,১) যে সকল রাজাকাররা ব্রীজ পাহারায় নিযোজিত হলো, আমরা সহজ আক্রমনেই তাদের পরাজিত করে রাজাকারদের অস্র কেড়ে নিতে পারছিলাম। ২) যে সকল ছেলেরা মুক্তি যুদ্ধে যেতে উৎসাহী ছিল, কিন্তু অস্র নাথাকার কারণে মুক্তি যুদ্ধে যোগ দিতে পারছিল না,তারা রাজাকারে যোগ দিয়ে অস্র নিয়ে পালিয়ে এসে আবার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিল।

আমরা মাঝে মাঝে পাথর ঘাটা ক্যাম্প থেকে ঢাকা টাংগাইল রোডের পাহাড়ায় থাকা রাজাকারদের আক্রমন করে

অস্র সংগ্রহ করতে থাকলাম । আমরা তখন কখনোই ভাবতাম না যে, অতি অল্প দিনেই পাক সেনারা  আমাদের নিকট হেড়ে গিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাবে । আমাদের তখনকার যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল পাক সেনাদের চলার পথে তাদের আক্রমন করে ব্যতিব্যাস্ত করে তোলা ।তারা যেন বুঝতে পারে যে, তারা বাঙ্গালীদের নির্মম ভাবে ঝাকে ঝাকে হত্যা করেও মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করতে পারছে না ।আমরা  এই যুদ্ধ চলা কালীন সময়েও রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনতাম । বিশেষ করে  এম আর আক্তার মুকুলের “চরম পত্র “শুনতাম । যেখানে থাকতো – মুক্তি বাহিনীর ক্যাচকা মাইরে দেশের কোন কোন জায়গায় পাক সেনারা সাবার হয়ে গেল  এই খবর প্রতি রাতেই শুনতাম ।কারণ সেই খবর যে সত্য ছিল না বা অনেকটাই বানোয়াট ছিল তখন কিন্তু তা মনেই হয়নি । সেই সব খবর শুনেই তখনকার সময় মুক্তিযোদ্ধারা খুবই  উজ্জিবিত হতো । শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই বা বলবো কেন , সারা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষের এমন কোন বাঙ্গালী ছিল না যিনি সন্ধ্যায়  এলাকার যে বাড়িতে রেডিও আছে সেখানে গিয়ে সেই সংবাদ বুলেটিন না শুনে ঘুমাতো । সারা দিনে পাকসেনা ও রাজাকারদের বিভিন্ন হত্যা জজ্ঞের খবর মুনে যে টুকু মন খারাপ হতো, সন্ধ্যার  এই সংবাদ বুলেটিন শুনে আবার মন ততটাই আনন্দে ভরে  উঠতো । আমরা আবার পর দিন কোথায় কিভাবে যুদ্ধ করবো তার পরিকল্পনা করতে মনে জোর পেতাম । বাংলাদেশের বর্ষাকালর আকাশে সব সময়ই মেঘ থাকে । আর স্বাধীনতা যুদ্ধের বছর অতিরিক্ত বারুদ বিস্ফোরণের কারনেই হয়তো বৃষ্টি আরও বেশী হয়ে থাকবে । কোন দিকে যদি বজ্রপাতের শব্দও শোনা যেত  তখনই যে এলাকা থেকে শব্দ শোনা যেত তার পাশের এলাকার লোক জনেরাই কাজ কর্ম ছেড়ে দিযে হায় মাতম শুরু করতো এই ভেবে যে ঐ এলাকায় হয়তো পাক সেনারা আজ মুক্তিযোদ্ধাদের  উপর কামান বা মর্টারের গোলা বর্ষণ করছে ।না জানি কত নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে । কত বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে । সে সময় প্রত্যেক মানুষেরই একের পর অন্যের  একটা মমত্ববোধ ছিল । দেশের জন্য সবাই জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল । যার ফলে আমরা মাত্র নয় মাসের  যুদ্ধেই আমাদের দেশকে স্বাধীন করতে পেরেছি ।

 

 

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top